পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পবিত্র ঈদুল ফিতরের দুই একদিন পূর্বে এবং তার পরে বাংলাদেশ এবং এই উপমহাদেশে বেশ কয়েকটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। বাংলাদেশের ঘটনাটি বাংলাদেশের প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নিয়মিতই আসছে। কিন্তু উপমহাদেশের ঘটনাবলী আমার চোখে পড়েনি। হয় সেগুলো প্রকাশিত বা সম্প্রচারিত হয়নি। অথবা হলেও তত গুরুত্ব পায়নি। উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলী হচ্ছে (১) গত বছর ভারত কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করে সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বিলোপের মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল বানিয়েছে। গণচীন ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের তীব্র বিরোধিতা করেছে। (২) গণচীন গত ৬ অগাস্ট বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর প্রশ্ন উত্থাপন করেছে এবং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর বিরোধের নিষ্পত্তি দাবি করেছে। (৩) পাকিস্তান নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করেছে। এই মানচিত্রে ভারতের দখলে থাকা জম্মু ও কাশ্মীর, লাদাখ এবং গুজরাটের জুনাগড়কে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত দেখিয়েছে। (৪) অযোধ্যায় যেখানে বাবরি মসজিদ ছিল সেখানে গত ৫ অগাস্ট বুধবার রামমন্দির নির্মাণের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এই উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে নরেন্দ্র মোদি ৫ অগাস্টকে ভারতের স্বাধীনতা দিবস ১৫ অগাস্টের সাথে তুলনা করেছেন। (৫) কক্সবাজারের অদূরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সাবেক মেজর সিনহাকে পুলিশ গুলি করে হত্যা করেছে। এই হত্যাকান্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে থানার ওসি প্রদীপ কুমার এবং ইন্সপেক্টর লিয়াকত-সহ ৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কাশ্মীর, ভারতের রামমন্দির এবং পাকিস্তানের নতুন মানচিত্র সম্পর্কিত খবর আমি ভারতের ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া,’ ‘দি হিন্দু’, ‘আনন্দবাজার,’ পত্রিকায় পড়েছি। এই খবরগুলো আমি আমার কম্পিউটারে সেভ করেছি। মেজর সিনহার হত্যাকান্ড সম্পর্কে প্রতিদিনই পত্র পত্রিকায় নানান অ্যাঙ্গেল থেকে খবর বের হচ্ছে। এই ৫টি বিষয় নিয়ে এক দিনে একটি কলামে আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই আমরা দুই/তিনটি বিষয় নিয়ে আলোচনা করবো।
প্রথমে কাশ্মীর এবং চীন প্রসঙ্গ। তার আগে বলা দরকার যে, গত বছর ৫ অগাস্ট ভারত তার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে। এই অনুচ্ছেদ বলে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ বা রাজ্যের তুলনায় কাশ্মীরকে আলাদা মর্যাদা দেওয়া হয়েছিল। জম্মু ও কাশ্মীর সরকার প্রধানকে মুখ্যমন্ত্রী না বলে প্রধানমন্ত্রী বলা হতো। ভারতের অন্যান্য প্রদেশ থেকে কোনো নাগরিক এসে কাশ্মীরে জমি কিনতে পারতো না। ভারতের অন্য প্রদেশের কোনো নাগরিক কাশ্মীরে এসে কোনো কাশ্মীরী নারীকে বিবাহ করতে পারতো না। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে শিমলায় ভারতের পরলোকগত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের মরহুম প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোর মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ঐ চুক্তিতে বলা হয় যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক ও আলাপ আলোচনার মাধ্যমে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করতে হবে। শিমলা চুক্তির গভীর এবং সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য হলো এই যে, কাশ্মীর একটি বিরোধপূর্ণ অমীমাংসিত ইস্যু, সেটি ভারত স্বীকার করে নেয়। ভারত এও স্বীকার করে যে, আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে এই বিরোধের নিষ্পত্তি করতে হবে। এর আগে ১৯৪৯ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে গণভোটের মাধ্যমে। অর্থাৎ, কাশ্মীরী জনগণের ভোটের মাধ্যমে এটি নির্ধারিত হবে যে, কাশ্মীর ভারতের অন্তর্ভুক্ত হবে, নাকি পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হবে, নাকি স্বাধীন থাকবে।
ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু জাতিসংঘের এই প্রস্তাব মেনে নেন।
দুই
৩৭০ ধারা বিলোপ সম্পর্কে চীনের প্রতিক্রিয়া বুঝতে হলে আমাদের আরও একটু পেছনে যেতে হবে। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় জম্মু ও কাশ্মীর ছিল একটি দেশীয় রাজ্য। এর ছিল ৫টি অঞ্চল। এগুলো হলো (১) জম্মু, (২) কাশ্মীর উপত্যকা, (৩) লাদাখ, (৪) গিলগিট ওজারত এবং (৫) গিলগিট এজেন্সি। ১৯৪৭ সালের অক্টোবর মাসে কাশ্মীর নিয়ে প্রথমে উপজাতীয়রা বিদ্রোহ করে। অতঃপর ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। জাতিসংঘের হস্তক্ষেপে ১৯৪৯ সালে যুদ্ধবিরতি হয়। ভারত বড় দেশ এবং পাকিস্তানের চেয়ে শক্তিশালী। তাই যুদ্ধ বিরতির পর দেখা যায় যে, লাদাখসহ সমগ্র জম্মু ও কাশ্মীরের ৬৫ শতাংশ ভারতের দখলে গেছে এবং ৩৫ শতাংশ পাকিস্তানের দখলে গেছে। সমগ্র কাশ্মীর উপত্যকা এবং লাদাখ ভারতের দখলে যায়। আর পাকিস্তানের দখলে যায় আজাদ কাশ্মীর এবং গিলগিট ও বাল্টিস্তান। এর পর ভারত গণভোট প্রশ্নে ক্রমাগত টালবাহানা করতে থাকে। এভাবে এসে যায় ১৯৭১ সাল। বিশ্ব রাজনীতির পরিবর্তনের সাথে সাথে আমেরিকা, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশ গণভোটের সিদ্ধান্ত থেকে পিছু টান দেয়।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান পরাজিত হলে ভারত শিমলা চুক্তিতে গণভোট থেকে সরে আসে এবং দ্বিপাক্ষিক আলোচনার সিদ্ধান্ত হয়। যেহেতু শিমলা চুক্তিতে দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধানের কথা বলা হয়েছে, তাই ২০১৯ সালে ভারত তার সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করতে পারে না। অধিকন্তু জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখকে দুটি কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করে ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করতে পারে না। এটি শিমলা চুক্তির লংঘন। ভারত একতরফাভাবে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।
এই পটভূমিতে এসেছে গণচীনের বক্তব্য। গত ৫ অগাস্ট ছিল ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের একবছর পূর্তি। এই দিবসে চীনের পররাষ্ট্র দফতর থেকে জারী করা এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জম্মু ও কাশ্মীরের স্থিতাবস্থাকে একতরফাভাবে পরিবর্তন অবৈধ এবং বাতিল (Invalid).’ বিবৃতিতে বলা হয়, ‘কাশ্মীর অঞ্চলের পরিস্থিতি চীন গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। এ ব্যাপারে আমাদের অবস্থান অপরিবর্তনীয় এবং পরিষ্কার। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় ইস্যুটি পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে চলে আসছে। এটাই হলো বস্তুনিষ্ঠ ঘটনা। জাতিসংঘ সনদ, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবসমূহ এবং ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক আলোচনাসমূহ এই বস্তুনিষ্ঠ সত্যকেই প্রতিষ্ঠিত করে। স্থিতাবস্থায় কোনো একতরফা পরিবর্তন অবৈধ এবং বাতিলযোগ্য। চীনা পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট দেশগুলির মধ্যে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান করা উচিত।’
তিন
চীন শুধুমাত্র এই বিবৃতি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি। একই দিন অর্থাৎ গত ৫ অগাস্ট বুধবার জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদেও কাশ্মীর বিরোধ উত্থাপন করে। টাইমস অব ইন্ডিয়া, দি হিন্দু এবং আনন্দবাজারের খবরে জানা যায়, গত এক বছরে চীন নাকি আরও দুই বার নিরাপত্তা পরিষদে কাশ্মীর ইস্যু উত্থাপন করে। গত ৫ অগাস্ট নিরাপত্তা পরিষদের রুদ্ধদ্বার বৈঠকে এটি উত্থাপন করে চীন। কিন্তু যেহেতু অধিবেশনটি হয়েছে রুদ্ধদ্বার কক্ষে তাই তার বিস্তারিত জানা যায়নি।
কাশ্মীর পরিস্থিতি সর্বশেষ যা দাঁড়িয়েছে, সেটি হলো এই যে ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল এবং জম্মু ও লাদাখকে ভারতের কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল করায় এখন শিমলা চুক্তি (১৯৭২) অকার্যকর হয়ে পড়েছে। সেজন্যই গত ৫ আগস্ট পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ঘোষণা দিয়েছেন যে, নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনার অধীনেই কাশ্মীর বিরোধের নিষ্পত্তি হতে পারে। অর্থাৎ কাশ্মীর ইস্যুর সমগ্র পরিপ্রেক্ষিতই পাল্টে গেছে। তাই পাকিস্তানও তার দেশের নতুন মানচিত্র প্রকাশ করেছে। এই মানচিত্র ভারত অধিকৃত কাশ্মীর, লাদাখ এবং ভারতের গুজরাট রাজ্যের জুনাগড় অঞ্চলকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত দেখানো হয়েছে। নতুন মানচিত্রের অনুমোদন দেওয়ার পর ইমরান খান বলেন, ‘আজ (৫ অগাস্ট) পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে ঐতিহাসিক দিন। এই প্রথমবার ভারতের দখলীকৃত কাশ্মীরকে পাকিস্তানের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানের সমস্ত রাজনৈতিক দলের এতে সমর্থন রয়েছে।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবনার অধীনেই কেবল কাশ্মীর বিরোধের নিষ্পত্তি হতে পারে। জাতিসংঘের এই প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, কাশ্মীরের জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। সেই ইচ্ছার প্রকাশ ঘটবে গণভোটের মাধ্যমে।’ পাক প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, ‘কাশ্মীরের জনগণকে দেওয়া বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতিশ্রুতি এখনও পূরণ হয় নাই। আমরা স্পষ্ট বলতে চাই যে, এটিই একমাত্র সমাধান।’
আমি ইতোপূর্বে এই কলামে লিখেছি যে, লাদাখ সংঘর্ষের মাধ্যমে চীন প্রত্যক্ষভাবে কাশ্মীর বিরোধে জড়িয়ে পড়েছে। কাশ্মীরে চীনের জড়িত হওয়াটা সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য বহন করে। ১৯৬২ সালে আকসাই চীন দখলের মাধ্যমে এর শুরু। চীন ৬০ বিলিয়ন ডলার বা ৬ হাজার কোটি ডলার দিয়ে যে চীন-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডোর নির্মাণ করছে তার অধিকাংশ গেছে গিলগিট এবং বাল্টিস্তানের ওপর দিয়ে। এই গিলগিট এবং বাল্টিস্তান পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণাধীন কাশ্মীরের অংশ। তৃতীয়তঃ চীন কারাকোরাম মহাসড়ক নির্মাণ করা শুরু করেছে। এটি চীনের জিনজিয়াং প্রদেশের কাশগড় থেকে শুরু করে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুন খোয়ার (পূর্বনাম উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ) অ্যাবোটোবাদ জেলার সাথে যুক্ত হয়েছে। কারাকোরাম মহাসড়ক নির্মাণের বিরুদ্ধে ভারত তীব্র প্রতিবাদ করেছে। কিন্তু চীন সেই প্রতিবাদ গায়ে মাখেনি।
৩৭০ ধারা বাতিলের বিরুদ্ধে চীনে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে চীন পরোক্ষাভাবে বলে দিয়েছে যে, কাশ্মীর বিরোধে দুটি পক্ষ নয়, তিনটি পক্ষ জড়িত রয়েছে। আর এই তৃতীয় পক্ষ হলো গণচীন।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।