পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সভ্যতার ক্রমবিকাশে মানুষ বাঁচার জন্যে নানা কৌশল উদ্ভাবন করছে। একে অপরকে ঘায়েল করার জন্যে, শত্রæর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়ার জন্যে এবং রাষ্ট্র তথা দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার খাতিরেও প্রয়োজনীয় নানা জিনিসপত্র আবিষ্কার অব্যাহত রয়েছে। যুদ্ধের নেশাটা প্রাচীনকালের মতো বর্তমানেও সচল রয়েছে। বর্তমানের যুদ্ধ বিরাট, ব্যাপক এবং খুবই জটিল। প্রাচীনকালে যুদ্ধাস্ত্র ছিলো তীর, ধনুক, বর্শা ইত্যাদি। বর্তমানে যুদ্ধাস্ত্র পারমাণবিক বোমা, হাইড্রোজেন বোমাসহ উন্নত প্রযুক্তির নাম না জানা মরণাস্ত্র।
প্রায় ৭৫ বছর পূর্বের কথা। এশিয়ার উন্নত দেশ জাপানে যুক্তরাষ্ট্র এক চরম মানবতা বিরোধী বর্বর হত্যাকাÐ ঘটিয়ে বিশ্ববাসীকে হতবাক করে দিয়েছিলো। ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট, রোজকার মতো জাপানীরা দিনের কর্মকাÐে যোগ দেয়ার জন্যে ছুটছে আপন গতিতে। জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা পথে মানুষদের তাড়া করবে মৃত্যু দূত, একথা তারা জানতো না। জানার কথাও নয়। প্রাণ চাঞ্চল্যের শহর ‘হিরোশিমা’ ও ‘নাগাসাকি’। যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালোনা গাই বি-২৯ বোমারু বিমান থেকে হিরোশিমা শহরে আনবিক বোমা (অ্যাটম বোমা) ফেলা হয়। একই মাসের ৯ আগস্ট মার্কিন যুদ্ধ বিমান থেকে নাগাসাকিতে ফ্যাটম্যান নামে আরেকটি আনবিক বোমা ফেলা হয়। দ্বিতীয় বোমাটি ফেলার নির্দিষ্ট টার্গেট ছিলো জাপানের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় দ্বীপ কিয়ুসুর কোকুরা অস্ত্রাগার। বৈরি আবহাওয়ার কারণে বৈমানিক ভুলবশতঃ বোমাটি নাগাসাকি শহরে ফেলেন।
হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে দুইদিনের ব্যবধানে যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যে বর্বর নারকীয়তার জন্ম দেয় তার তাতে মুহূর্তে প্রায় ১,৪০,০০০ হাজার লোক নিহত হয়। লাখ লাখ মানুষ আহত হয়। সে এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। তখন দুই শহরের আকাশে-বাতাসে ধ্বনিত হয়েছিলো বাঁচার আর্তনাদ। লাখ লাখ আহতদের বাঁচানোর জন্যে বিশ্ববাসীর এগিয়ে যাওয়া এবং দুঃখ প্রকাশ করার ভাষাও হারিয়ে ফেলেছিলো। মানব সভ্যতা যেনো হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়ায় এখানে। এ বর্বর হত্যাকাÐের পেছনের ঘটনা হলো ১৯৩৯ সাল। পৃথিবীতে তখনও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়নি। তবে তৎকালীন জার্মানীর এডলফ হিটলারের গলাবাজিতে সারাবিশ্বের মানুষ আশংকা করেছিলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। পশ্চিমা বিশ্ব হিটলারের আণবিক বোমা প্রাপ্তির একচেটিয়া অধিকারী হয়ে সারাবিশ্বের কর্তৃত্ব গ্রহণ করার গোপন খবরে তটস্থ হয়ে পড়ে। ঠিক এমন সময় যুক্তরাষ্ট্রে শরণার্থী হিসেবে বসবাসকারী, হাঙ্গেরীতে জন্মগ্রহণকারী বিজ্ঞানী ড. লিও জিলার্ড সর্বপ্রথম আণবিক বোমা তৈরির জন্যে একটি প্রস্তাব দেন তৎকালীণ মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্টকে।
১৯৪০ সালের ৭ মার্চ আইনস্টাইন তাঁর এক চিঠিতে আণবিক বোমা তৈরির জন্যে প্রেসিডেন্টের কাছে অনুমতি প্রার্থণা করেন। এ প্রক্রিয়ার মধ্যে ঘটলো আরেক অঘটন ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর। জাপান সরকার যুক্তরাষ্টের পার্ল হারবার বিমান এবং নৌঘাঁটিতে সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে সবকিছু তছনছ করে দেয়। চোখের পলকে সেখানে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়। এবার যুক্তরাষ্ট্র জাপানের উপর আঘাত হানার পরিকল্পনা আঁটে। সুদে-আসলে বদলা নেয়ার জন্যে কৌশল অবলম্বন করতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র আগের দুই বৈজ্ঞানিকের আণবিক বোমা বানানোর প্রস্তাব বিবেচনায় এনে চূড়ান্তভাবে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৫ সালের ৮ মে। জার্মানীর আত্মসমর্পণের পর ইউরোপের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটলেও অপর অক্ষ্যশক্তি জাপান তখনও মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেনি। এতে তখন এটাই প্রতীয়মান হয়ের্ছিলোযে, যুক্তরাষ্ট্র যেই আণবিক বোমা তৈরি করেছে তার লক্ষ্যবস্তু জাপান।
জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকি শহরে বোমা হামলা ছিলো কোনো যুদ্ধে আণবিক বোমা হামলার প্রথম ঘটনা। ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের ইতিহাস এতোই মানবতাবিরোধী, যার ক্ষয়ক্ষতি এখনো বহমান। জাপানের ঐতিহাসিক এই দুই শহরের মানুষ শিখেছে নতুনভাবে বাঁচার। অসহায় মানুষের কান্না এবং আহাজারী বিশ্বের মানুষকে শিখিয়েছে যুদ্ধ এবং আধুনিক ধরনের অস্ত্রকে ঘৃণা করতে। হিরোশিমায় নিক্ষিপ্ত বোমার সংক্ষিপ্ত বিবরণ : বোমার নাম ‘লিটল বয়’। নিক্ষেপের সময় ৬ আগস্ট, ১৯৪৫, সময়- ৮টা ১৫ মিনিট (জাপানের সময় অনুযায়ী), বোমা বহনকারী বিমানের নাম- বি-২৯, যুদ্ধ বিমান। নিহতÑ৬৬ হাজার (তাৎক্ষণিক), বোমার শক্তি- ১৫.০২ কিলোটন টিএনটির সমান, আহতÑ৭০ হাজার (তাৎক্ষণিক), ক্ষতিগ্রস্ত চতুর্পাশ্বÑবোমা নিক্ষেপের কেন্দ্র থেকে চারদিকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ পর্যন্ত। মোট আহতÑ ১ লক্ষ ৩৬ হাজার। হিরোশিমায় হিসেব মতে, ১৯৪৫ সালের শেষ নাগাদ মৃতের সংখ্যা প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজারের মতো।
নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার ক্ষয়ক্ষতি নি¤œরূপ : বোমার নামÑফ্যাটম্যান, নিহতের সংখ্যাÑ৭৩ হাজার ৮৮৪ জন (তাৎক্ষণিক), আহতÑ৭৪ হাজার ৭৯৩ জন (তাৎক্ষণিক), বোমা বহনকারী বিমানের নামÑবি-২৯ যুদ্ধ বিমান, বোমা নিক্ষেপের সময়Ñ৯ আগস্ট, ১৯৪৫ সাল, স্থানীয় সময় রাত ৩টা ৪৭ মিনিট, ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাÑ৬.৭ মিলিয়ন বর্গমিটার, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়ি-সম্পূর্ণ ধ্বংস ১১ হাজার ৫৭৪টি, ধ্বংসপ্রাপ্ত ১ হাজার ৩২৬টি, মারাত্মক ভস্মীভূত ৫ হাজার ৫০৯টি, মোট ১৮ হাজার ৪০৯টি।
মারাত্মক এ বোমার বিষক্রিয়ায় পরবর্তীতে শহরের ২ লাখ ৭০ হাজার জনসংখ্যার প্রায় দেড় লাখেরও বেশি লোক মৃত্যুবরণ করে। পঙ্গুত্ব বরণ করেছে অসংখ্য জনসাধারণ। বধ্যভূমিতে পরিণত হওয়া দুই শহরের অধিবাসীরা বেশুমার ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে আপ্রাণ চেষ্টা এখনো চালিয়ে যাচ্ছে।
হিরোশিমা নাগাসাকিতে এই বর্বর হামলার পর জাপানীদের মনোবল ভেঙে পড়ে। জাপানের স¤্রাট হিরোহিতো আমেরিকার কাছে আত্মসমর্পন করে ১৪ আগস্ট। এতো বছর পরও জাপানীরা স্বজন হারানোর ব্যথা ভুলতে পারেনি। হিরোশিমা দিবস পালন উপলক্ষে তারা সমবেত হন দক্ষিণ-পশ্চিমের কান্ট্রি ক্লাব ড্রাইভের স্টারকার আর্টস পার্ক ও ৪৫ নম্বর স্ট্রিটে ৭ আগস্ট। প্রিয়জনের আত্মার পারলৌকিক সদগতি কামনায় আয়োজন করে প্রার্থণা সভা। বিহারে গিয়ে প্রদীপ জ্বালিয়ে নিহতদের স্মরণ করবে। গায় বেদনাতুর গান, এবং কবিতা পাঠ।
প্রতি বছর আগস্টের ৬ ও ৯ তারিখ আমাদের জানান দেয় পীড়াদায়ক ঘটনার। হিরোশিমা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে জাপানীরা নতুনভাবে শিক্ষা নেয়। তেজস্ক্রিয়তার কুফল জাপানীরা এখনও ভোগ করছে। শহর দু’টি এখনো বহন করছে যুক্তরাষ্ট্রের পাপের বোঝা। বিশ্ববাসীর সাথে আমরাও হিরোশিমা দিবস পালনকালে জাপানীদের সুখ-শান্তি এবং মৃতদের আত্মার সদগতি কামনা করছি।
এক নজরে ঘটনাপঞ্জি : ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৮ : নাৎসি জার্মানীর দুই বিজ্ঞানী অটো হার্ন এবং ফ্রিৎজ স্ট্রাসমান সফলভাবে অণু ভাঙার পর সে দেশে আণবিক অস্ত্র কর্মসূচি শুরু হয়। ২ আগস্ট, ১৯৩৯ : আলবার্ট আইনস্টাইন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন ডি রুজভেল্টকে জার্মানের সম্ভাব্য পরমাণু বোমা হামলা সম্পর্কে সর্তক করে দেন এবং আণবিক গবেষণায় জোর দেয়ার দাবি জানান। জুন, ১৯৪২ : পদার্থ বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেন হেইমারের নেতৃত্বে ম্যানহাটান প্রকল্পে গোপন আণবিক অস্ত্র কর্মসূচি শুরু করে যুক্তরাষ্ট। ২ ডিসেম্বর, ১৯৪২ : এনরিকো ফেরমির নেতৃত্বে মার্কিন বিজ্ঞানীরা বিশ্বের প্রথম পরমাণু বোমা তৈরি করে। ১৬ জুলাই, ১৯৪৫ : যুক্তরাষ্ট্র নিউ ম্যাক্সিকোর আলামোগোরডো এলাকার কাছে পরমাণু পরীক্ষা চালায়। এটি ছিলো বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক পরীক্ষা। ২৬ জুলাই, ১৯৪৫ : মিত্রশক্তি জাপানের প্রতি তাৎক্ষণিকভাবে এবং বিনাশর্তে আত্মসমর্পন করার দাবি জানায়। প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যান সোভিয়েত নেতা জোসেফ স্ট্যালিনের কাছে বলেন যে, যুক্তরাষ্টের কাছে আণবিক বোমা রয়েছে। ৬ আগস্ট, ১৯৪৫ : মার্কিন বোমারু বিমান বি-২৯ ইনোলা গেটি থেকে হিরোশিমায় আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। ৯ আগস্ট, ১৯৪৫ : নাগাসাকিতে যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয়বারের মতো আণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। ১৫ আগস্ট, ১৯৪৫ : স¤্রাট হিরোহিতো রেডিও ভাষণে জাপানী সৈন্যদের আত্মসমর্পনের ঘোষণা দেন।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।