Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চামড়া শিল্পকে রক্ষা করতে হবে

রিন্টু আনোয়ার | প্রকাশের সময় : ৫ আগস্ট, ২০২০, ১২:০১ এএম

চামড়া দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি শিল্প। নির্দিষ্ট কিছু কারণে রফতানিমুখী এ শিল্প পিছিয়ে পড়ছে। উদ্বেগের বিষয়, এ শিল্প থেকে গত দুই বছরে অব্যাহতভাবে বৈদেশিক মুদ্রার আয় কমছে। কাঁচামালের সহজলভ্যতার পাশাপাশি মূল্য সংযোজনের হিসেবে কোনো একটি নির্দিষ্ট খাত থেকে সবচেয়ে বেশি রফতানি আয়ের অন্যতম বড় উৎস দেশের চামড়া শিল্প। কিন্তু এ সত্য শুধু কাগজে কলমেই। বাঘএকবতা হলো, নানা ধরনের পণ্য উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন প্রতি মাসে আমদানি করছে প্রায় ৫০ লাখ বর্গফুট চামড়া। করোনা পরিস্থিতির কারণে গতবারের চামড়াই এখনো প্রক্রিয়াজাত করতে পারেনি। এতে সংগৃহীত কাঁচা চামড়ার গুণগত মান কমে যাচ্ছে। নতুন চামড়া সংরক্ষণে স্থান সংকট রয়েছে। অনেক ট্যানারি এখনো উৎপাদনে যায়নি। এসব কারণে চামড়া প্রক্রিয়াকরণ নিয়ে দুশ্চিন্তা এবারো থাকছে। এদিকে, এবার দেশে ৫০ শতাংশ কুরবানি কম হবে বলে শঙ্কা করা হলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। তবে সংখ্যায় কমেছে। ৭০ লাখ গরু কোরবানি হবে বলে ধারণা করা হলেও সংশ্লিষ্টরা বলছেন ৫০ লাখের মতো কোরবানি হয়েছে। যদিও পশু সম্পদ মন্ত্রণালয় দাবী করেছে এক কোটি পশু কোরবানি হয়েছে। এবার কুরবানি সংখ্যায় কম হলেও পশুর চামড়া নিয়ে ঠকবাজি কম হয়নি। বরং একটু বেশিই হয়েছে। দাম না পেয়ে চামড়া মাটিতে পুতে ফেলা, নদীতে ফেলে দেয়ার ঘটনা ঘটেছে। ঘটনা আগাম আঁচ করতে পেরে অনেকে কুরবানির চামড়া মাদ্রাসা, এতিমখানায় দান করেছেন। সরকারিভাবেই এবার কমিয়ে দেয়া হয়েছে গরু-ছাগলের চামড়ার দর। গত বছরের চেয়ে কমিয়ে এবার ঢাকার জন্য লবণযুক্ত কাঁচা চামড়ার দাম গরুর প্রতি বর্গফুট ৩৫ থেকে ৪০ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ২৮ থেকে ৩২ টাকা বেঁধে দেয়া হয়েছে। যা গত বছর ঢাকায় ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। আর ঢাকার বাইরে ছিল ৩৫ থেকে ৪০ টাকা। অন্যদিকে খাসির চামড়া সারাদেশে প্রতি বর্গফুট ১৩ থেকে ১৫ টাকা ও বকরির চামড়া ১০ থেকে ১২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁচা চামড়ার দাম ও সামগ্রিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন, ট্যানারি অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে আলাপ করে এ দাম নির্ধারণ করা হয়। ট্যানারি মালিকরা নির্ধারিত দামে কাঁচা চামড়া কেনার ঘোষণা দিয়েছেন। এ বছর চামড়া যাতে নষ্ট না হয় এবং নির্ধারিত দাম নিশ্চিত করতে সরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়েছে বলেও জানিয়েছিলেন মন্ত্রী। কিন্তু, বাস্তবে কী হলো? আড়তদার সরকারের নির্ধারিত দামের অর্ধেকে বা তার চেয়েও কমে চামড়া কেনার সুযোগ নিয়েছে। আড়তদার ও ট্যানারির মালিকেরা বলছেন, চলতি বছর গতবারের চেয়ে ৩০-৩৫ শতাংশ কম চামড়া আসবে। তাই চামড়ার বেশ চাহিদা রয়েছে। তারপরও চামড়ার দাম কম হওয়ার পেছনে পুরোনো যুক্তিই দেখানো হচ্ছে।

সোনালি আঁশ নামের পাটশিল্প শেষ হয়েছে কবেই? বিদেশে এক সময় বাংলাদেশের পাটজাত পণ্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল। সরকার ও বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সমন্বয়হীনতার কারণে এ শিল্প প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এ দেশের কৃষি খাত বিশেষ করে ধান ব্যবসাও সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে। ধানের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না কৃষক, তৈরি হয়েছে বহু সংকট। চা শিল্প টিকে আছে কোনো মতে। গার্মেন্টস শিল্প যায়-যায় অবস্থার মধ্যে। প্রায় একইভাবে চামড়াজাত পণ্য বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি পণ্য হওয়া সত্তে¡ও সিন্ডিকেটের কারসাজিতে শিল্পটি বিপন্ন হতে চলেছে। তৃণমূল পর্যায়ে বিক্রেতা ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের চামড়ার ন্যায্য মূল্য না পাওয়ার পেছনে আমলাতান্ত্রিক জটিলতার সঙ্গে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যও রয়েছে। এ দুইয়ের কারসাজিতে চামড়া শিল্প আজ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এছাড়াও অনুসন্ধানে জানা গেছে, চামড়া শিল্পে সংকটের নেপথ্যে রয়েছে অনেকগুলো কারণ। কারণগুলো হচ্ছে- ১. সঠিক পরিকল্পনার অভাব। ২. সাভারে কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (সিইটিপি) নির্মাণ কাজ শেষ না করে কারখানা স্থানান্তর করা। ৩. সাভারে ট্যানারিপল্লীতে অবকাঠামোগত সুবিধা দেয়ার ক্ষেত্রে সরকারের প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়ন না করা। ৪. নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ ও সময়মত গ্যাস সংযোগ দিতে না পারা। ৫. তিন বছরেও সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে প্রত্যাশা অনুযায়ী সুবিধা নিশ্চিত করতে না পারা, ১১. কারখানা স্থানান্তরের পরও অনেক প্রতিষ্ঠান উৎপাদনে যেতে না পারায় রফতানি আদেশ বাতিল হয়ে যাওয়া, ১২. হাজারীবাগে ২০৫ টি কারখানা থাকলেও সাভারে মাত্র ১৫০টি প্লট বরাদ্দ দেয়া। ১৩. প্লট না পাওয়া ৫৪টি কারখানা বন্ধ হওয়ায় এসব কারখানার শ্রমিকদের বেকার হয়ে যাওয়া, ১৪. অবৈধ পথে চামড়া পাচার। ১৫. আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পণ্যের আধুনিকায়নে সামঞ্জস্যতা না থাকা। পাশাপাশি প্রতি বছর দেশে উৎপাদিত ২২ কোটি ঘনফুট চামড়ার প্রায় অর্ধেকই ব্যবহৃত হচ্ছে না রফতানিযোগ্য পণ্য উৎপাদনে। চামড়ার আন্তর্জাতিক ক্রেতাজোট লেদার ওয়ার্কিং গ্রæপ-এলডবিøউজি’র ছাড়পত্র না থাকাই এর মূল কারণ। ট্যানারি মালিকরা বলছেন, সাভারে নতুন শিল্প নগরীই পারতো সব সংকট সমাধান করতে, যদিও তাদের দাবি বিসিকের গাফিলতিতে সংকট বেড়েছে আরও। গত বছরের কোরবানির ঈদে চামড়া সংগ্রহের জন্য দেয়া প্রায় ৭০০ কোটি টাকা ঋণের বেশির ভাগই আদায় হয়নি। যদিও এবার কোরবানির পশুর চামড়া কিনতে রাষ্ট্রায়ত্ব চার ব্যাংক থেকে ট্যানারি মালিকদের এক হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ছিল। গত বছরের ঋণের অর্থ আদায় না হওয়ায় এ ঋণ বিতরণ নিয়েও জটিলতা তৈরি হয়।

চামড়ার টাকাকে গরিবের হক বলা হলেও দেশের বর্তমান বাস্তবতা ভিন্ন। বাস্তবতা হলো গরীব, এতিম ও মিসকিনদের পক্ষে কথা বলার লোক নেই। কুরবানির লাখ লাখ গরু-ছাগলের চামড়া নিয়ে কার্যকর পদক্ষেপ আসলে কোনো কালেই জোরালো ছিল না। গত কয়েক বছরে সেটা আরো বিশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে পড়েছে। ঋণ দেয়া, সেল গঠনসহ অনেক কিছু শোনা গেলেও সমস্যা রয়েই গেছে। বছর কয়েক আগেও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা পাড়ামহল্লায় চামড়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তো। চামড়া নিয়ে কাড়াকাড়ি করতো। গত দুই বছর ধরে তা ফিকে হয়ে গেছে। এ সময়টায় তাদের অভিজ্ঞতা বড় খারাপ।

বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে চামড়াশিল্পকে ঢাকার হাজারীবাগ থেকে সাভারের হেমায়েতপুরে নেয়ার সময় বলা হয়েছিল, ট্যানারিগুলো পরিকল্পিত শিল্পনগরে এলে বুড়িগঙ্গা দূষণ থেকে বাঁচবে। শিল্পনগরী হবে কমপ্লায়েন্স। বড় ব্র্যান্ডগুলো আর বাংলাদেশী চামড়ায় তৈরি জুতা-ব্যাগ কিনতে কোনো দ্বিধা থাকবে না। চামড়া খাতে বিনিয়োগ বাড়বে, কর্মসংস্থান হবে। কিন্তু বাস্তবে তা দেখা যাচ্ছে না। গতবার চামড়া কিনে পুঁজি হারানোর জেরে এবার মৌসুমী ব্যবসায়ীরা ছিলেন খুব সতর্ক। মাঠেই নামেনি অনেকে। এরপরও যারা নেমেছে তারা লোকসানের মুখোমুখি হয়েছে। গত বছর ঢাকার বাইরে কাক্সিক্ষত দাম না পেয়ে চামড়া সড়কে ফেলে দেওয়া ও পুঁতে দেওয়ার ঘটনা ঘটে। প্রায় ১ লাখ চামড়া সড়কে ফেলে দিতে বাধ্য হয়েছিলেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা। তখন অভিযোগ উঠেছিল, আড়তদাররা সিন্ডিকেট করে অস্বাভাবিক কম দামে চামড়ার দর নির্ধারণ করতে শুরু করে এবং একপর্যায়ে চামড়া কেনা বন্ধ করে দেন। বাধ্য হয়ে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা রাস্তায় ফেলে চামড়া নষ্ট করেছিলেন। এ বছরও চট্টগ্রামে এ দৃশ্য দেখা গেছে। চট্টগ্রাম, খুলনা, যশোরসহ বিভিন্ন নগরীর বাইরে বিভিন্ন উপজেলা থেকে আড়তদারের কাছে কোরবানির পশুর কাঁচা চামড়া বিক্রি করতে এসে আশানুরূপ সাড়া পাননি অনেকে। অভিযোগ উঠেছে, আড়তদারেরা উপজেলা থেকে আসা চামড়াগুলো কিনতে প্রথমে অনীহা দেখান এবং অস্বাভাবিক কম দামে কিনতে চান। ফলে লোকসান দিয়ে বিক্রি না করে বিক্রেতারা সেগুলো ফেলে দিয়েই চলে যান। চামড়ার দাম কম হলেও গরুর গোশতের কেজি ৬০০ টাকার নিচে নয়। একটি গরুর ভুঁড়ির দামই ১৫/১৬ শ’ টাকা। এমনকি গোবর মেশানো এক ব্যাগ মাটি বিক্রি হয় দুইশ’ থেকে সোয়া দুইশ’ টাকায়। গরুর চমড়ায় তৈরি জুতা ব্যাগ, বেল্টের দাম জিজ্ঞাস করতেও সাহস লাগে। পশুর এসব উপকরণের দাম কোনোদিন কমে না। কারণটা কি? আড়তদার এবং ট্যানারি মালিকরা বলতে চান, বহু ট্যানারির কাছে গত বছরের চামড়া জমে রয়েছে। ইউরোপে মন্দার কারণে রপ্তানি আদেশ চার ভাগের একভাগে নেমে এসেছে। ইউরোপে তিন ডলারের পণ্যের দাম নেমে গেছে দেড় ডলারে। স¤প্রতি করোনা ভাইরাসের কারণে ফিনিশড লেদারের সবচেয়ে বড় বাজার চীনেও ব্যবসা থমকে গেছে। ২০০৩ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত প্রতিবর্গফুট কাঁচা চামড়া ১৩০ টাকায় বেচাকেনা হলেও, এখন তা ৩০ টাকায় নেমে এসেছে বিশ্ববাজারের দরপতনের ছুঁতোয়। আবারো বলতে হচ্ছে, চামড়া সাধারণ কোনো শিল্প নয়, দেশের অন্যতম বৃহৎ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনকারী শিল্প। তাই দেশের অর্থনৈতিক স্বার্থে সরকারের দায়িত্ব যত দ্রæত সম্ভব এ শিল্পের সমস্যাগুলো সমাধান করা।

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: চামড়া

১৩ ডিসেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন