Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

প্রাচীর

অনুবাদ : মুসাফির নজরুল

মূল : জ্যঁ পল সাঁত্রে | প্রকাশের সময় : ৩০ জুলাই, ২০২০, ১২:০২ এএম

তারা আমাদের ধাক্কা দিয়ে একটি বড় ঘরের খোলা কক্ষে ঢুকিয়ে দিল। এ সময় আমার চোখ পিটপিট করা শুরু হলো, কারণ আলো আমার চোখকে আঘাত করছিল। তারপর আমি দেখলাম একটি টেবিল ও চারজন মানুষ টেবিলের চারপাশে, পত্রিকার দিকে তাকিয়ে আছে এক সিভিলিয়ান। তারা অন্য একদল কয়েদীকে পিছনে বেঁধে রেখেছে এবং আমরা সম্পূর্ণ কক্ষ পাড়ি দিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিলাম। তারা ছিল আলাদা আলাদা। আমি জানতাম এবং অন্যরাও জানতো যে, এরা অবশ্যই বিদেশী। দু’জন আমার মতই ফর্সা রঙের সোনালী চুলওয়ালা ব্যক্তি যাদের মাথা আবৃত, তাদের দেখতে সুন্দর লাগছিলো। আমার ধারণা হলো যে, তারা ফ্রান্সের অধিবাসী। একসময় ছোট একজন আতঙ্কিতভাবে প্যান্ট টেনে তুলল।

এ ঘটনার প্রায় তিনঘন্টা অতিক্রান্ত হলো। আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম এবং আমার মাথা ঘুরতে লাগলো। কিন্ত রুমটি ছিল ভালো উষ্ণ এবং আমি এতেই যথেষ্ঠ সন্তুষ্ট ছিলাম।

চলে যাওয়া চব্বিশ ঘন্টায় আমাদের কম্পন থেমে যায়নি। রক্ষিরা কয়েদিদের টেবিলের উপর রাখলো একের পর এক। চারজন ব্যক্তি প্রত্যেকে এক একজনের নাম জানলো ও তাদের ব্যাপক জেরা করলো। অধিকাংশ সময় তারা বাইরে গেলো না এক মুহুর্তের জন্যও। স্বভাবসূলভ এটা ওটা সাধারণ প্রশ্ন করতে লাগলো।

“তোমাদের কাছে কি যুদ্ধের উপকরণাদী আছে?” অথবা “৯ তারিখ সকালে তোমরা কোথায় ছিলে এবং কি করছিলে?”
তারা উত্তর শুনছিলেন না অথবা আদৌ তাদের বোধ হচ্ছিল না। মুহুর্তের মধ্যে তারা সরাসরি তাদের দিকে তাকাচ্ছিল এবং লেখতে আরম্ভ করছিলো। তারা টমকে জিজ্ঞাসা করছিলো-

“এটা কি সত্য যে, তিনি আর্ন্তজাতিক সৈন্য?”- টম কোন উত্তরই দিচ্ছিলেন না, কারণ পত্রিকায় তারা তাদের জামা দেখেছে। তারা জুয়ানকে কি জিজ্ঞাসাই করছেন না, কিন্তু তারা অনেক সময় ধরে লেখার পর, তিনি তাদের কাছে তার নাম বলেছেন।
“আমার ভাই জোসি একজন নৈরাজ্যবাদী”- জুয়ান বলল।

“আপনারা জানেন তিনি এখানে কখনোই আসেননি। আমি কোন পার্টিতে অংশগ্রহণ করিনি। আমি কখনও কোন রাজনীতি করিনি।”
তারা কোন উত্তর দিলেন না। জুয়ান বলেই চলল-

“আমি কিছুুই করিনি। আমি কারো জন্যই কিছু করতে চাই নি।” তার ঠোঁট কাপতে লাগলো। একজন রক্ষি তাকে বাঁধলো এবং বাইরে নিয়ে গেলো। এটা ছিলো তার পরিণতি।
“তোমার নাম কি পাবলো ইবিতা?”

‘হ্যা’ লোকটি পত্রিকার দিকে তাকিয়েই আমাকে জিজ্ঞেস করলো। “র‌্যামন গ্রিস কোথায়?”
“আমি জানি না।”

“আপনি তাকে ৬ তারিখ থেকে ১৯ তারিখ পর্যন্ত লুকিয়ে রেখেছেন।” “না।”
তারা এক মিনিটের জন্য লিখলো। তারপর রক্ষি আমাকে বাইরে নিয়ে গেল। করিডোরে টম এবং জুয়ান দু’জন রক্ষির সঙ্গে অপেক্ষা করছিলেন।
আমারা হাটতে শুরু করলাম। টম একজন রক্ষিকে জিজ্ঞেস করল- “অতএব” “অতএব কি ?”- রক্ষি জিজ্ঞেস করল।
“ওটা কি জেরা বা বিচার ছিল?”
“বিচার”- রক্ষি জানালো
“তারা আমাদের সঙ্গে কি করতে যাচ্ছে?”
রক্ষি শুষ্কভাবে উত্তর দিল-
“আপনাদের কারাগারে ঢোকাবার এজাহার লেখা হচ্ছে।
বস্তুত, আমাদের সেলটি ছিল একটি হাসপাতালের কক্ষ। এটা ছিল ভীষণ ঠান্ডা, কারণ সেখানে ঝাপটা বাতাস প্রবেশ করত। আমরা সারারাত কাঁপতে থাকতাম, এমন কি দিনের বেলায়ও সেটা অধিক বাস উপযোগী ছিল না। আমরা পূর্ববর্তী পাঁচদিন খ্রিস্টানদের মঠে একটি কক্ষে কাটিয়েছিলাম। এটা ছিল প্রাচীরের ছোট গর্তের মাঝামাঝি।

এ সময় অধিক সংখ্যক কয়েদী ছিল কিন্তু সে তুলনায় কক্ষ ছিল না। তারা আমাদেরকে উপরে যে কোনখানে বেঁধে রেখেছে। আমি আমার কক্ষ (সেল) হারাতে চাইনি। আমাকে বেশি কষ্ট করতে হয়নি ঠান্ডায়। কিন্তু আমি ছিলাম একা।
কিছুক্ষণ পর এটা আমাকে উত্তেজিত করে তুলছিল। সেলের মধ্যেই জুয়ান নামে আমার একজন বন্ধু উচ্চস্বরে কথা বলছিল সে খুবই ভীতু ছিল এবং কিছু বলার মত যুবক ছিল না। কিন্তু টম একজন ভালো গল্পবাজ ছিল এবং সে জানতো স্পেনীয়রা খুব ভাল। সেলের মধ্যে একটি বেঞ্চ ও চারটি পাটি পাতা রয়েছে। যখন তারা আমাদেরকে চোধ বেঁধে পিছনে নিয়ে গেল, আমরা শব্দের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।

দীর্ঘক্ষণ পরে টম বললেন - “আমরা আটক আছি।”
“আমিও বেশ চিন্তা করলাম।” আমি বললাম- “কিন্তু কোনভাবেই ভাবতে পারছি না তারা কাঠের টব দিয়ে কোন কিছু করতে পারে।”
“তারা কিছুই করবে না তার বিরুদ্ধে।” টম বললেন- “সে একজন মিলিশিয়ার ভাই এবং এটাই যথেষ্ঠ।”

আমি জুয়ানের দিকে তাকালাম। বোধ হয় সে শুনতে পাচ্ছিল না। টম চলে গেল। “তোমরা জানো তারা সারাগোসাতে কি করে? তারা রাস্তায় শুইয়ে রাখে এবং তাদের উপর দিয়ে ট্রাক তুলে দেয়। মরক্কোর মরুভূমিচারী আমাদের এ কথা বলেছিল। তারা বলেছিল এটা ‘মুক্তি আন্দোলন।”
“এটা পেট্রোল থেকে মুক্ত নয়”- আমি বললাম।
আমি টমের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। সে বলে দিল যে, “তারপর অফিসারগণ একাকী রাস্তায় হেটে ছিল।” তারা উপরে গিয়েছিল। সব কিছু পরিদর্শন করেছিল। তারা তাদের পকেটে হাত ঢুকাচ্ছিল এবং সিগারেট টানছিল, তোমরা চিন্তা করো তারা কি অতি সুন্দর ছিল?
নরক নয়। তারা তাদেরকে এক ঘন্টার জন্য মুক্ত করেছিলাম মরোক্কানরা বলল, তাদের কাছে তেমন কোন গোলাবারুদ মজুদ ছিল না। সে প্রথম সময় নরক থেকে মুক্ত হল।

আমি বিশ্বাস করি না তারা ওটা এখানে করেছিল। তারা বলল- “যদি না তাদের আসলেই ক্ষুদ্র পরিমাণে গোলাবারুদ থাকতো।”
বাতাসকে চারটি ভাগে ভাগ করে আলো সরাসরি আসতে লাগলো এবং ছাদের নিম্নপৃষ্ঠের চারপাশে ঘুরতে লাগলো। বাম পাশে, তোমরা সরাসরি আকাশ দেখতে পাবে। গর্তের সোজাসুজি স্বভাবতই একটি জাল দ্বারা বন্ধ করা কক্ষে তারা কয়লার স্তুপ জমা করছে। এগুলো হাসপাতালের তাপের কাজে ব্যবহৃত হবে। কিন্তু যুদ্ধ শুরু হবার আগেই রোগিরা হাসপাতাল ত্যাগ করবে এবং কয়লাগুলো এখানেই অব্যবহৃত পড়ে থাকবে। কিছু সময় এগুলো বৃষ্টিতে ভিজবে কারণ তারা জালের মুখ বন্ধ করতে ভুলে যাবে।

টম ঠান্ডায় কাঁপতে লাগলো- “ভালো যিশু খ্রিস্ট” সে বলল, “এখানে এটা আবার যাবে।”
সে উঠে পড়লো এবং শরীর চর্চা শুরু করলো, প্রতিটি মুহুর্তেই তার জামা তার সাদা এবং লোমযুক্ত বুক থেকে খুলে যাচ্ছিল। সে তার পিছনে শুয়ে পড়লো, পা দু’টি প্রসারিত করলো বাতাসের মধ্যে এবং সাইকেলের মত ঘুরাতে লাগলো। আমি দেখলাম তার মেরুদন্ডের কসরত। টমের শরীর অধিক পরিমাণে মোটা ছিল। আমি অনুভব করলাম এবং লক্ষ্য করলাম কিভাবে সে রাইফেল ও বেয়োনেট বহণ করে।

আমি আসলে শীতার্ত ছিলাম না, কিন্তু আমি আমার অস্ত্র এবং সৈন্য পরিচালনা করতে পারছিলাম না। অনেক সময় আমার মাঝে আবেগ হচ্ছিল যে, আমি কিছু যেন ভুল করছি এবং আমার পেটের জন্য চারদিকে তাকিয়ে দেখছিলাম। তারপর হঠাৎ মনে হল তারা আবার আমাকে একটি কোর্ট দিয়েছিল, যদিও সেটা পড়ে আমি মোটেই স্বচ্ছন্দবোধ করছিলাম না। তারা আমাদের কাপড় নিয়ে গিয়েছিল এবং সেগুলো তাদের সৈন্যদের দিয়ে দিয়েছিল। পরিশিষ্ট ছিল আমাদের জামা এবং তাদের পরিত্যক্ত প্যান্ট যা তাদের হাসপাতালের রোগিরা গ্রীষ্মের মাঝামাঝি পরিধান করতো।

কিছুক্ষণ পর টম উঠে পড়লো এবং পুরোপুরি কাপড় পড়ে আমার পাশে বসলো।
‘উষ্ণতা?’ ‘কিন্তু আমি বাতাসের বাইরে।’
সন্ধ্যা আটটার দিকে স্পেনীয় চরমপন্থী দলের দু’জন সদস্যসহ একজন মেজর এলেন। তার হাতে একখ- কাগজ ছিল। তিনি রক্ষিকে জিজ্ঞেস করলেন- “ওই তিনজনের নাম কি?”
“স্টেইনবক, ইবিয়েটা এবং মিরবাল।”- রক্ষি বলল।

মেজর তার চশমা চোখে নিলেন এবং তীক্ষ্ম দৃষ্টি দিয়ে তালিকা দেখলেন। “স্টেইনবক...স্টেইনবক...স্টেইনবক... ওহ্ হ্যা... তুমি ... তুমি মৃত্যুদন্ডাদেশ প্রাপ্ত। তোমাকে আগামীকাল সকালে গুলি করে হত্যা করা হবে।”
তিনি বাইরে চলে গেলেন। ‘অন্য দু’জন ওভাবেই রইলো।’
“ওটা সম্ভব নয়” জুয়ান বললেন “আমাকে নয়।”
মেজর তাকেতীক্ষ্মদৃষ্টিতে দেখলেন “তোমার নাম কি?” জিজ্ঞেস করলেন।
“জুয়ান মিরবাল”- তিনি বললেন। “ভালো, তোমার নামও ওখানে আছে।” মেজর বললেন, “তুমিও মৃত্যুদন্ডাদেশপ্রাপ্ত।”
“আমি কিছুই করিনি”- জুয়ান বললেন।

মেজর তার ঘাড়ে জোড়ে ধাক্কা দিলেন এবং টম ও আমার কাছে ছুড়ে ফেলে দিলেন। “তোমরা কি ভীত বা উদ্বিগ্ন?”
“কেউ ভীত বা উদ্বিগ্ন নই।”
তিনি বিরক্ত হয়ে তাকালেন, “তারা আমাকে বললেন, ওখানে তিনজন আছে। আমি আমার সময় নষ্ট করবো না। তারপর এমনিতেই একজন ধর্মযাজক চাইবে না।”
আমরা এর উত্তর জানতাম না।
তিনি বললেন, “একজন বেলজিয়ান ডাক্তার খুব তারাতারি আসছেন। তিনি রাতের বেলায় তোমাদের দেখাশোনার দায়িত্বে থাকবেন।” তিনি একটি মিলিটারি স্যালুট ও অনুশীলন প্রশিক্ষণ দিবেন। “আমি আপনাকে কি বলেছিলাম ?”- টম বললেন।
“আমরা এটা পেয়েছি।”

“হ্যা” আমি বলেছিলাম- “এটা ছাগল শাবকের ন্যায় ক্ষুদ্র।”
আমি শালীনতা রক্ষার জন্য বজায় রেখে বলেছিলাম, কিন্তু আমি ছাগলশাবক পছন্দ করতাম না। তার মুখমন্ডল এতোই চিকন ছিল যে, সে কষ্ট অনুভব করতো, তিনদিন আগে সে একটা ছোট শিকার ধরেছিল। মন্দ নয়, কিন্তু এখন সে দেখতে একজন বৃদ্ধ পরীর মতো এবং আমি চিন্তা করি সে আর কখনোই যুবক হবে না, এমন কি যদি তারা তাকে একা রেখেও যায়। এটা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে তার পক্ষে ছোট হওয়া। সে কিছুই বলতে পারেনি। কিন্ত সে ধূসর বর্ণ ধারণ করেছে। তার মুখ এবং হাত- দু’টোই ধূসর। সে আবার বসে পড়লো এবং চারিদিকের মাটি তাকিয়ে দেখতে লাগলো।

টম ছিল খুব স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন, সে তার হাত ধরতে চাচ্ছিল কিন্তু ছাগল শাবকটি ঝড়োগতিতে থাবা দিচ্ছিল এবং একটি মুখাবয়ব তৈরি করছিল।
তাকে একা রাখা হলো। আমি ধীরকন্ঠে বললাম- “তোমরা কি দেখছো না যে, সে কেঁদে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।”
টম পুনরায় বিশ্বস্থতার সঙ্গে আনুগত্য দেখালো; সে ছাগলছানাকে দেখছিল। এতে তার সময়ের অপচয় হচ্ছিল। ফলে তার নিজের সম্পর্কে ভাবনার অবকাশ ছিল না। কিন্তু এটা আমাকে পীড়া দিচ্ছিল। আমি কখনোই মৃত্যু সম্পর্কে চিন্তা করি না।
আমার কোন কারণ নেই। কিন্তু এখন যে কারণটা এখানে উপস্থিত এবং তখন এটা ভাবা ছাড়া কিছুই করার নেই।

টম কথা বলতে শুরু করলো- “বলো, তোমরা কি কখনোই কোন অদ্ভূত পোষাক পরিহিত লোককে দেখেছিলে?” সে আমাকে জিজ্ঞেস করলো।
আমি কোন উত্তর দিলাম না, সে আমার কাছে ব্যাখ্যা করতে শুরু করলো যে, আগস্টের শুরু থেকে এ পর্যন্ত সে প্রায় ছয়জন এমন মানুষকে দেখেছে। সে এমন বাস্তব পরিস্থিতির সম্মুখিন হয়নি এবং বলেছিল আমি বাস্তবিকই এমন পরিস্থিতি চাই না। কিছুটা হলেও এ সম্পর্কে আমার ধরনা আছে। আমি মনে করি এটা আমাকেই যন্ত্রণাদগ্ধ করবে। পাশাপাশি এর সব কিছুই ছিল বাস্তব প্রশ্ন, কিন্তু আমি ছিলাম স্থির ও নির্বিকার।

একটি নিস্প্রভ রক্তিম আভা বাতাস ভেদ করে বেড়িয়ে আসছিল এবং সারা আকাশময় ধোঁয়ার দাগ জমা হচ্ছিল। আমি রীতিমত একটি তারা দেখছিলাম গর্তের সিলিং বেয়ে; রাত ছিল খাঁটি এবং আদ্র।

দরজা খুলে গেল এবং দু’জন রক্ষি ভিতরে এলো। ইউনিফর্ম পরিহিত একজন স্বর্ণাভ চুল ও বর্ণ বিশিষ্ট মানুষকে অনুসরণ করছিল। তিনি আমাদের অভিবাদন জানালেন- “আমি ডাক্তার” তিনি বললেন। এই চলতি একঘণ্টা আপনাদের সাহায্য করার জন্য আমাকে বিধিসম্মতভাবে ক্ষমতা দান করা হয়েছে।

তার কণ্ঠস্বরে আনুগত্য ও বিনয়ের সুর ছিল। আমি বললাম “আপনি এখানে কি চান?”
“আমি আপনাদের ব্যবস্থাপনায় আছি। আমি পরবর্তী সময়ের সবকিছুকেই কম কঠিন করে তুলবো।”
“আপনি এখানে কি জন্যে এসেছেন? ওখানে মনরো হাসপাতাল তাদের দ্বারা পরিপূর্ণ। ”
“আমি ওখানে ছিলাম।” তিনি বাঁকা চোখে তাকিয়ে উত্তর দিলেন। “আহ্! আপনি কি ধুমপান পছন্দ করেন?”
তিনি হৃদয়ঙ্গম করে যোগ করলেন, “আমার কাছে সিগারেট আছে, এমন কি চুরুটও।”

তিনি আমাদের ইংলিশ সিগারেটের জন্য প্রস্তাব করলেন, কিন্তু আমরা তা সাদরে প্রত্যাখ্যান করলাম। আমি তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকালাম এবং সূক্ষভাবে দেখলাম। আমি তাকে বললাম- “আপনি কি আমাদের জন্য সুসংবাদ নিয়ে আসেননি? আমি আপনাকে সাম্যবাদ বিরোধী লোকের সঙ্গে ব্যারাকের উঠানে দেখেছি। যখন আমি বন্দী হয়েছিলাম।”

আমি বলেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিছু কিছু সময় আমাকে হঠাৎ বিস্ময়াভিভূত করে তুলছিল। ডাক্তারের দীর্ঘক্ষণ উপস্থিতি আমার কাছে সুবিধার মনে হচ্ছিল না। সাধারণত আমার কাছে যদি কেউ আসে তখন আমি যেতে বলতে পারি না। কিন্তু আমাকে কথা সংক্ষেপ করতে বলা হল। রক্ষি একটি মাদুরের উপর বসে ছিল।
আমি সামান্য কাঁধ তুললাম এবং আমার চোখকে এদিক ওদিক ঘুরালাম। সামান্য পরে আমি আমার মাথা তুললাম। আমি নিজেকে শুদ্ধ করার চেষ্টা করলাম। রক্ষি মাদুরে বসে আছে লম্বা, চিকন, ছিপছিপে পেডরো এবং অন্যজন তার চুল টানছিল এবং সে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে গেল।
“আপনি কি আলো চান?” পেডরো হঠাৎ ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করলো। অন্যজন উত্তর দিল-“হ্যা।”
আমি মনে করি সে সুদর্শন ছিল, কিন্তু সে অবশ্যই খারাপ চাচ্ছিল, তার ঠান্ডা নীল চোখের দিকে তাকিয়ে দেখা যাচ্ছিল যে, এ দৃশ্য নিতান্তই তার কাল্পনিক ছিলো। পেডরো বেরিয়ে গেল এবং একটি তেলের বাতি নিয়ে ফিরে এলো এবং সেটা সে বেঞ্চের কোণে রাখলো। এটা খুব খারাপ আলো দিচ্ছিল, কিন্তু একেবারেই না থাকার চেয়ে খারাপ নয়।
তারা রাতের অন্ধকারের আগেই আমাদের ছেড়ে গেল।

দীর্ঘক্ষণ পর আমি আমি সিলিংয়ে একটি বড় বাতি তৈরি করলাম। আমি মুগ্ধ ছিলাম। তারপর আমি হঠাৎ উঠে পড়লাম। আলোর চক্রটি অদৃশ্য হয়ে গেল এবং আমি প্রচন্ড তাপের নীচে পড়ে গেলাম।

-এটা মৃত্যু চিন্তা ছিল না অথবা মুক্তি; এটা ছিল অজ্ঞাত। আমার কাঁধ পুড়ে যাচ্ছিল এবং আমার মাথা সামনের দিকে ধাবিত হচ্ছিল।
আমি বিচলিত হয়ে উঠেছিলাম এবং দু’জন বন্ধুর দিকে তাকিয়ে দেখলাম- টম তার মুখে নিজেই আঘাত করছে। আমি শুধুমাত্র তার ঘার দেখলাম। আর ছোটজন দু’পায়ের মধ্যে মাথা গুঁজে বসে ছিল।

ডাক্তার চলে গেল এবং তার কাঁধের উপর হাত বুলিয়ে আশ্বস্থ করলো। কিন্তু তার চোখগুলো ছিল শীতল ও ভেজা ভেজা।
তারপর আমি দেখলাম বেলজিয়ানের হাত দিয়ে জুয়ানের হাতের কব্জির নীচে শক্ত করে ধরেছে। জুয়ানের সেদিকে মনোযোগ নেই। বেলজিয়ান তার হাতের তিনটি আঙুল দিয়ে আরো চেপে ধরেছে। একই সময়ে হিসাবটি ছোট হয়ে এলো এবং তার পিঠ আমার দিকে ঝুকে পড়লো। কিন্তু আমি পিছন ফিরলাম এবং সে তার পকেট থেকে একটি ঘড়ি বের করছে এবং কিছুক্ষণের জন্য তাকিয়ে দেখছে। সে তার হাত ছেড়ে দিল এবং পকেট থেকে একটি নোটবুক বের করে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য লেখলো এবং লেখলো- ‘বাসটার্ড’।
আমি খুব রাগের সঙ্গে ভাবলাম, তার কাছে ফিরে এলাম এবং আমার জিনিসপত্র নিয়ে তার দৃষ্টির বাইরে চলে গেলাম।
সে ফিরে এলো না। কিন্তু আমি তাকে আমার দিকে রাখলাম। আমি আমার মাথা তুললাম এবং তার দিকে ফিরে তাকালাম। ব্যক্তিগতভাবে সে আমাকে বললো- “তোমার কাছে কি এই জায়গাটা শীতল লাগছে?”
সে স্থিরভাবে তাকালো, সে ছিল বাকরুদ্ধ।
‘আমি ঠান্ড নই’-আমি তাকে বললাম।
আমি নিজের রুমাল দিয়ে আমার কাঁধ বেঁধে নিজেকে সন্তুষ্ট করছিলাম। কারণ এখন আমার স্যূট আমার কাঁধে রাখছিলাম। শীঘ্রই আমি আমার অপ্রয়োজনীয় রাবার তুলে ফেললাম, আমার রুমাল ইতিমধ্যেই ভিজানো ছিল এবং আমি পুরোপুরি স্যুট পরিহিতি ছিলাম এবং আমার পিছনের অংশ ভিজে গিয়েছিল। আমার প্যান্ট বেঞ্চের সঙ্গে লেগে যাচ্ছিল।
হঠাৎ জুয়ান কথা বলছিলেন, “আপনি কি একজন ডাক্তার?” “হ্যা” বেলজিয়ান উত্তর দিলেন।
“এটা কি মনেপ্রাণে---খুব দীর্ঘ?”
“এ্যাঁ? কখনো---ওহ্ না” বেলজিয়ান স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন। “আদৌ না, এটা খুব তারাতারি”
তিনি একজন কাস্টমারের মত অভিনয় করলেন।
“কিন্তু আমি---তারা আমাকে বললেন---কিছু সময় তারা দ্বিতীয়বার আগুন জ্বালালেন- “কিছু সময়” বেলজিয়ান বললেন- “নির্বোধ।”
এটা ছিল যখন প্রথম গোলাগুলি শুরু হয়, তখন শরীরের কিছু যন্ত্রাংশের মত।
“তারপর তারা তাদের সমস্ত রাইফেল এবং অস্ত্র-সস্ত্র পুনরায় গাড়িভর্তি করলো কিছুক্ষণের জন্য। তিনি চিন্তা করলেন এবং তারপর নিজেকে যুক্ত করলেন ওই সময়।”
সে দুঃখ প্রকাশ করার সময় খুঁজে পেল”। এটা ছিল তার সমস্ত চিন্তা সম্পর্কে। আমি এটা সম্পর্কে কখনোই ভাবতাম না। এটা আমার চিন্তার জন্য উপযুক্ত সময়ও ছিল না।
আমি উঠে পড়লাম এবং কয়লার স্তুপের দিকে হাটতে লাগলাম।
টম লাফ দিয়ে আমাকে ধাক্কা দিয়ে দৃষ্টির অদূরে ছুড়ে দিল। আমি তার প্রতি বিরক্ত হলাম। কারণ আমার পায়ে জুতা ছিল। আমি চিন্তা মুক্ত হলাম যদিও আমার মুখটা মাটিতে রঙিন হয়ে উঠেছিল। আমি দেখলাম সে-ও স্যুট পরিহিত।
আকাশ ছিল মেঘমুক্ত। কোন প্রকার আলোই অন্ধকারকে সরিয়ে দিচ্ছিল না। আমিই একমাত্র জেগেছিলাম। আমি দৃষ্টি নিবন্ধ করে দেখছিলাম। কিন্তু এটা ঘটার মত কিছুই ছিল না। রাতের আগে আমি আমার সেলের কাছে একটা বিশাল আকাশ দেখেছিলাম এবং দিনের প্রতিটি ঘন্টাই আমার স্মৃতিতে বিভিন্ন ধরনের ভাবনার সৃষ্টি করেছিল।
সকাল। যখন আকাশ রুক্ষ্ম রূপধারণ করেছিল, আলো নীল, আমি আটলান্টিকের সমুদ্র তীরের কথা ভাবছিলাম। দুপুরে আমি সূর্য দেখেছিলাম এবং আমার মনে হচ্ছিল ম্যানজেলিনার মদ্যপের কথা। বিকালে আমি আমার ছায়াকে ভাবছিলাম, এটা ছিল সত্যিই কঠিন- সারা বিশ্বের সূর্যরশ্মিকে কল্পনা করা। কিন্তু তখন আমি যেভাবে মনে করেছি সেভাবেই আমার ঘড়িতে দেখতে পেয়েছি। এটা আমার কাছে মোটেই দূরবর্তী মনে হচ্ছিল না। আমি মনে করি ওটাই ভালো ছিল। আমি ফিরে এলাম এবং টমের পাশে বসলাম। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। টম ধীরে ধীরে কথা বলতে শুরু করলো। সে তার মনের মত করেই কথা বলছিলো। আমার মনে হচ্ছিল সে আমার সাথে কথা বলছে ঠিকই কিন্তু আমার দিকে তাকাচ্ছে না। সে আমার দিকে তাকাতেই ভয় পাচ্ছিল, ঠিক যেমন ঘটছিল আমার ক্ষেত্রেও। আমরা একে অন্যকে আয়নায় কল্পনা করছিলাম। সে বেলজিয়ানকে মনোযোগের চেষ্টা করলো।
“আপনি কি বুঝেছেন?” সে বলল- “আমি কিছু বুঝিনি।” আমিও মৃদুভাষায় কথা বলতে শুরু করলাম এবং আমিও বেলজিয়ানের দিকে মনোযোগ দিলাম। “কেন? ব্যাপারটা কি?”
কিছু সময় আমাদের চলে গেল, আমি বুঝতে পারলাম না। টমের কাছে কিছু বস্তু ছিলো। এটা আমার কাছে স্পর্শকাতর বলে মনে হলো। আমি বলেছিলাম- “তোমরা কিছু সময়ের জন্য বুঝতে চেষ্টা কর।
“এটা পরিষ্কার নয়।” তিনি অবশ্যম্ভাবীভাবে বললেন, আমি সুন্দরভাবে জানতে চাই। কিন্তু মোটের উপর আমার জানা আছে। শোন, তারা আমাদের দেশের বাইরে নিতে চায়। তারা আমাদের চার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে কিভাবে?
“আমি জানি না। তারা পাঁচ অথবা আট-তার অধিক নয়।” “ঠিক আছে, তারা আট।” কেউ কেউ আমার দিকে তাক করে আছে। কারো কারো কাছে অস্ত্র আছে এবং আমার কাছে মনে হচ্ছে-আটটা রাইফেল। আমি চিন্তা করছি, কিভাবে ওদের প্রাচীরের মধ্যে আনা যায়। আমি তাদের পিছনের দিকে থেকে ধাক্কা দিবো, ঠিক শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে। কিন্তু প্রাচীর স্থির। আমি সকলকে নিয়ে ভাবছি। একমাত্র তুমি একাই জানো কিভাবে আমি এটা ভাবতে পারি।
“ঠিক আছে, ঠিক আছে!” আমি বললাম, “আমিও এটা চিন্তা করছি।” এটা বাস্তবিকই একটি নরকের মতো।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: প্রাচীর

৩০ জুলাই, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন