Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

করোনাকালে সঙ্কটে গণমাধ্যম

ড. মোহা. হাছানাত আলী | প্রকাশের সময় : ২৩ জুলাই, ২০২০, ১২:২৫ এএম

কোভিড-১৯ দেশে-বিদেশে বিভিন্ন সেক্টরে ব্যাপক সংকট সৃষ্টি করেছে। এর মধ্যে আর্থিক ও কর্মসংস্থানের সংকট বিশ্বব্যাপী প্রকট আকার ধারণ করেছে। দেশে দেশে উৎপাদন কমেছে। কর্মসংস্থান সংকুচিত হয়েছে। বহুমানুষ চাকরি হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে স্থবিরতা বিরাজ করছে। বিদেশ থেকে কর্ম হারিয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে রেমিটেন্সযোদ্ধারা। ঠিক একইভাবে মহাসংকটে পড়েছে দেশের গণমাধ্যম। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ের উল্লেখযোগ্য কোনো সহযোগিতা ছাড়াই দেশের গণমাধ্যমকর্মীরা নিজেদের ও পরিবারের স্বাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা না করে করোনা সংক্রান্ত বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও সংবাদ সরবরাহ করে জাতিকে সচেতন করে যাচ্ছে। সরকারি পর্যায়ে প্রায় একলক্ষ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করলেও সে তালিকায় নেই গণমাধ্যম। গণমাধ্যমের সংকট দেশে এটাই প্রথম নয়। মূলত সংকটের মধ্য দিয়ে পথ চলায় অনেকটা অভ্যস্ত দেশের গণমধ্যম। তবে করোনাকালে গণমাধ্যমের সংকট একেবারেই নতুন ও নজিরবিহীন। এমন ভয়াবহ অভিজ্ঞতা গণমাধ্যমের ইতিহাসে বিরল। একটি ফেসবুক গ্রুপের জরিপের (আমাদের গণমাধ্যম-আমাদের অধিকার) তথ্যানুসারে, করোনাকালে গত ৯ জুন পর্যন্ত দেশে মোট ৫৭০ জন সাংবাদিক আক্রান্ত হয়েছেন। করোনায় মৃত্যুবরণ করেছেন ১২ জন সাংবাদিক। করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন ৯ জন গণমাধ্যমকর্মী। সুস্থ হয়েছেন ২১৮ জন। গণমাধ্যমকর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও তাদের পেশাজীবী সংগঠন ও নিয়োগকারী কতৃপক্ষের নিকট সাংবাদিক আক্রান্ত ও মৃত্যুর কোনো অফিসিয়াল তথ্য নেই। এ বিষয়ে তাদের দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগও নেই। গণমাধ্যম কর্মীদের পেশাগত ও আর্থিক নিরাপত্তা নেই। মোটাদাগে বলতে গেলে সাংবাদিকদের পক্ষে কথা বলার লোকও তেমন নেই। যা পেশা হিসেবে গণমাধ্যমকে দীর্ঘমেয়াদী সংকটের মধ্যে ফেলে দিয়েছে।

করোনার প্রভাবে পত্রিকার সার্কুলেশন কমে গেছে। অনেক পত্রিকার প্রকাশনা বন্ধ। বেসরকারি বিজ্ঞাপন নেই বললেই চলে। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বকেয়া বিজ্ঞাপন বিলের স্তূপ জমেছে। ফলে গণমাধ্যমে আর্থিক সংকট চরমে পৌঁছেছে। মূলত দেশের গণমাধ্যম সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপনের উপর নির্ভরশীল। বর্তমানে হাতে গোনা কয়েকটি পত্রিকা ও টিভি চ্যানেল নিয়মিত বেতনভাতা পরিশোধ করছে। ইতোমধ্যে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল ও সংবাদপত্রের বিভিন্ন বিভাগে কর্মী ছাঁটাই করা হয়েছে। নিয়মিত বেতন হয় না বেশিরভাগ টেলিভিশন ও সংবাদপত্রে। এদিকে দেশের কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় পত্রিকা ও মিডিয়া হাউজ তাদের বিভিন্ন বিভাগে কর্মী ছাঁটাইয়ের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সংবাদে প্রকাশ, কোনো কোনো গণমাধ্যম তাদের সিনিয়র সাংবাদিকদের বিনা বেতনে ছুটি দিয়ে অপেক্ষাকৃত জুনিয়র ও শিক্ষানবিশ কর্মী দিয়ে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিছু পত্রিকা আবার তাদের সংবাদকর্মীদের বেতন-ভাতাদী অর্ধেকে নেমে এনেছে। ফলে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সংবাদকর্মীরা মানবেতর জীবন যাপন করছে। মফস্বল থেকে প্রকাশিত গণমাধ্যম ও তার সংবাদকর্মীদের অবস্থা আরো নাজুক।

টিভি চ্যানেলের অবস্থা আরো শোচনীয়। নতুন নাটক ও প্রোগ্রাম নেই। বিজ্ঞাপন কমে গেছে। অর্থসংকটে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে টিভি চ্যানেলগুলো। গত দুই দশকে দেশে ৩০টি টিভি চ্যানেল তাদের স¤প্রচার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। আরো নতুন ১৫টি টিভি চ্যানেল স¤প্রচারের অপেক্ষায় রয়েছে। দেশে ২৬টি বেসরকারি রেডিও তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। প্রায় প্রতিটি জেলায় রয়েছে কমিউনিটি রেডিও। এসব গণমাধ্যমের আয়ের অন্যতম উৎস বিজ্ঞাপন। যা আজ সংকুচিত। বিজ্ঞাপন প্রাপ্তির তালিকা অনুসারে দেশে জাতীয় ও স্থানীয় পত্রিকার সংখ্যা ৭০৭টি। এদের মধ্যে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ৩৬৫টি, আর মফস্বল থেকে প্রকাশিত হয় ৩৪৭টি। দেশে দৈনিক পত্রিকার সংখ্যা ৫১২টি। এসব পত্রিকা সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপন পেয়ে থাকে। অথচ ঢাকা থেকে প্রকাশিত বাজারে প্রচলিত পত্রিকার সংখ্যা মাত্র ২০-২৫টি। বাকিগুলো অনিয়মিত। কিন্তু তারা বিজ্ঞাপনে ভাগ বসায়। এদের মধ্যে আবার কোনটি প্রকাশ হয় কোনটি প্রকাশ হয় না। কোনো কোনো প্রত্রিকা আবার রাজনৈতিক বিবেচনায় বিজ্ঞাপন পেয়ে থাকে মর্মে অভিযোগ রয়েছে। সংবাদ পত্রে ওয়েজ বোর্ড এখনো পুরোপুরি কার্যকর নয়। টিভি সাংবাদিকরা আবার ওয়েজ বোর্ডের অন্তর্ভুক্তই নয়। ফলে এ পেশার ন্যূনতম নিরাপত্তা নেই।

এদিকে করোনাকালে সাংবাদিক নির্যাতন, মামলা ও হামলা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র আসকের পরিসংখ্যান অনুসারে গত ছয় মাসে ১৫৬ জন সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছে। আসকের তথ্যানুযায়ী, করোনাকালে সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত যথাক্রমে ১৭, ১৮ ও ১৫ জনসহ মোট ৫০ জন সাংবাদকর্মী নির্যাতিত হলেও এপ্রিল-জুন মাসে এ সংখ্যা যথাক্রমে ৩৬, ৪০ ও ৩০ জনসহ মোট ১০৬ জন সাংবাদিক পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। করোনাকালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় দেশের বেশ কিছু সাংবাদিক এখনও কারান্তরীণ রয়েছেন।

ঘরে বাইরে এমনতর বহুবিধ সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার মাঝেও করোনাকালের সস্মুখযোদ্ধা হিসেবে গণমাধ্যম কর্মীরা তথ্য সংগ্রহ, প্রচার ও জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান অব্যাহত রেখেছেন। তবে করোনাকালে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতার ভঙ্গুর চিত্রটা প্রকটভাবে প্রকাশিত হয়েছে। ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা একটি সস্মাজনক পেশা হিসেবে টিকে থাকবে কিনা, মেধাবীরা আদৌ এ পেশায় আত্মনিয়োগ করবেন কিনা তা নির্ভর করছে দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের ভূমিকা কতটা সাংবাদিক বান্ধব হবে, পেশা সহায়ক হবে, সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের আর্থিক সঙ্গতি বৃদ্ধি পাবে কিনা, সরকার গণমাধ্যমবান্ধব হবে কিনা এবং সাংবাদিকদের মধ্যে ঐক্য-সংহতি প্রতিষ্ঠত হবে কিনা তার উপর। বলা বাহুল্য, পেশা হিসেবে সাংবাদিকতা দেশে দুর্বল হয়ে গেলে দেশের গণতন্ত্র, উন্নয়ন ও সুশাসন ব্যাহত হবে।
লেখক: প্রফেসর, আইবিএ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: করোনাকাল


আরও
আরও পড়ুন