Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ : হুমায়ুন সাহিত্যে পিএইচডি প্রদান

মোবায়েদুর রহমান | প্রকাশের সময় : ২১ জুলাই, ২০২০, ১২:০১ এএম

অনেকগুলো বিষয়ই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সেগুলোর মধ্যে কোন বিষয়টি নিয়ে লিখবো সেটিও চূড়ান্ত করে ছিলাম। কিন্তু লেখার আগে আজ রবিবার সকালে পত্রিকাগুলোর ওপর নজর বুলাতে গিয়ে একটি জায়গায় এসে চোখ আটকে গেলো। রবিবার ১৯ জুলাই ছিলো বাংলাদেশের কিংবদন্তী কথাশিল্পী হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যু বার্ষিকী। এই উপলক্ষে কোনো কোনো পত্রিকা হুমায়ূন আহমেদের ওপর একাধিক ফিচার ধর্মী লেখা ছেপেছে। এসব লেখার মধ্যে একটি লেখায় লেখক প্রশ্ন করেছেন, শরৎ সাহিত্যের ওপর যদি পশ্চিমবঙ্গে পিএইচডি ডিগ্রির ব্যবস্থা থেকে থাকে তাহলে বাংলাদেশে হুমায়ূনসাহিত্যের ওপর পিএইচডি ডিগ্রী দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবে না কেন? প্রশ্নটি খুবই জেনুইন। শরৎচন্দ্র, বঙ্কিমচন্দ্র, মাইকেল মধুসুদন দত্ত প্রমুখ বাংলা সাহিত্যের আকাশে উজ্জ্বল তারার মতো জ্বলছিলেন। বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার অবকাশ ছিলো খুব কম। এর মাঝেও যে দুই একজন মুসলমান সাহিত্যিক সাহিত্য চর্চা করেছেন তাদের মধ্যে নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খান, মীর মোশারফ হোসেন প্রমুখ উল্লেখযোগ্য। শরৎ, বঙ্কিম বা মাইকেলরা প্রতিভাদীপ্ত ছিলেন এবং সাহিত্য চর্চা নিয়েই তারা মগ্ন থাকতেন। বঙ্কিমের লেখার সংখ্যা কম, কিন্তু তার লেখা সাম্প্রদায়িকতার দোষে দুষ্ট। সেজন্য মুসলমানদের কাছে তার লেখা গ্রহণযোগ্য ছিলোনা। কিন্তু শরৎচন্দ্র অসংখ্য লেখা লিখে গেছেন, যেসব লেখায় তৎকালীন সমাজের পশ্চাৎপদ অংশের চিত্র ভালোভাবে চিত্রিত হয়েছে। সে কারণে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে শরৎ সাহিত্য গ্রহণযোগ্য ও জনপ্রিয় ছিলো। চরিত্রহীন, দেবদাস, মেজ দিদি ইত্যাদি অনেক উপন্যাস আজও বাংলাদেশের অনেকের ঘরে পাওয়া যায়।

মুসলমানদের লেখার মধ্যে নজিবর রহমান সাহিত্য রত্নের ‘ আনোয়ারা’ উপন্যাস এবং মীর মোশারফ হোসেনের ‘ বিষাদ সিন্ধ’ নামক কারবালা গাঁথাটি মুসলমানদের ঘরে ঘরে শোভা পেয়েছে। আসলে একজন লেখকের জনপ্রিয়তা নির্ভর করে তার লেখার মুন্সিয়ানা এবং জনগণের ভাষায় কথা বলার ওপর। আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বাড়ীতে বিষাদ সিন্ধু নামক মোটা বইটি ছিলো। আমার আব্বা-আম্মা এই বইটি পড়েছিলেন। তারা আমার ভাইবোনদের কাছে ঐ কাহিনী বর্ণনা করতেন। আব্বা আম্মার গল্প শুনে আমিও বিষাদ সিন্ধু নামক ঐ মোটা বইটি পড়ি। কারবালার বিয়োগান্ত ঘটনাবলী মীর মোশারফ হোসেন এমন মর্মস্পর্শীভাবে বর্ণনা করেন যে আমি পড়ে কেঁদে কেটে বুক ভাসাই। সেই থেকে আজও আমার মনে কারবালা কাহিনী মীর মোশারফ হোসেনের বর্ণনায় প্রোথিত হয়ে আছে।

দুই
ফিরে যাচ্ছি শরৎসাহিত্যে ডক্টরেট দেওয়া প্রসঙ্গে। শরৎসাহিত্যে পশ্চিমবঙ্গের বিশ্ববিদ্যালয় যদি পিএইচডি ডিগ্রী দেওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে তাহলে হুমায়ূন সাহিত্যে গবেষণা পত্রের জন্য পিএইচডি ডিগ্রী দেওয়ার ব্যবস্থা থাকবেনা কেন? সুখের বিষয়, হুমায়ূনসাহিত্যে ডক্টরেট করার ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং ইতোমধ্যেই একজন মহিলা অধ্যাপকিা হুমায়ূনসাহিত্যে পিএইচডি ডিগ্রী অর্জন করেছেন। গত ১৮ জুলাই শনিবার একটি বাংলা দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সানজিদা ইসলাম নাত্নী একজন প্রভাষিকা হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তিনি নেত্রোকোনা শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক। রিপোর্টে এও বলা হয়েছে যে, হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য নিয়ে এপর্যন্ত ডক্টরেট ডিগ্রী অর্জন করেছেন একজনই মাত্র। তিনি সানজিদা ইসলাম। এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে আর কারো নাম শোনা যায়নি। সানজিদা ইসলামের গবেষণার শিরোনাম ছিলো ‘ হুমায়ূন আহমেদের কথা সাহিত্যে স্বদেশিক চেতনা’ হুমায়ূন আহমেদের সাহিত্য জুড়ে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যে অংশ রয়েছে, সানজিদা তার ওপর গবেষণা করেছেন। তিনি এ বিষয়ে গবেষণা শুরু করেন ২০১২/২০১৩ শিক্ষাবর্ষে। সানজিদা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ওপর হুমায়ূন আহমেদের নয়টি উপন্যাস ও নয়টি গল্প ছিলো তার গবেষণার মূল বিষয়। সানজিদা বলেন, তাঁর থিসিস রচনা করতে গিয়ে তিনি বুঝলেন, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে বস্তুত কোনো গবেষণাই হয়নি। সানজিদা প্রশ্ন রেখেছেন, হুমায়ূন আহমেদ দেশের সবচেয়ে পাঠক প্রিয় কথা শিল্পী। শরৎ সাহিত্য যদি পিএইচডি ডিগ্রীর বিষয় হয় তাহলে হুমায়ূনকে নিয়ে হবেনা কেন?

তিন
এই সংবাদটির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবং খুশির বিষয় এই যে, অবশেষে হুমায়ুন আহমেদ পিএইচডি গবেষণার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়েছেন। সানজিদা তার নয়টি উপন্যাস ও নয়টি গল্প নিয়ে থিসিস লিখেছেন এবং পিএইচডি পেয়েছেন, সেটি ভালো কথা। কিন্তু হুমায়ুন আহমেদের সাহিত্যের পরিধি বিশাল এভং ব্যাপক। রকমারী প্রকাশনা থেকে তার গ্রন্থের সংখ্যা বলা হয়েছে প্রায় তিন শত। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহেই রয়েছে প্রায় দেড় শত বই। আসলে তার সব বই আমার সংগ্রহে ছিলো। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের লেখার এমন আকর্ষণীয় ও জাদুকরী প্রভাব রয়েছে যে, তার বই সেলফে রাখা যায় না। কোনো মেহমান আপনার বাড়ীতে বেড়াতে এস যদি আপনার বুক সেলফে হুমায়ূনের কোনো উপন্যাস দেখেন তাহলে তিনি সেই বইটি কয়েক দিনের জন্য ধার চাইবেন। এরপর আর ফেরৎ দেওয়ার খবর নাই। এভাবে হুমায়ূনের বইগুলির প্রায় অর্ধেক আমার হাত ছাড়া হয়ে গেছে।

হুমায়ুন আহমেদের লেখাগুলি পড়ার পর আমার সুচিন্তিত অভিমত এই যে, হুমায়ূনসাহিত্যের ওপর যদি কোনো পিএইচডি থিসিস লিখতে হয় তাহলে সর্বাগ্রে লিখতে হবে, হুমায়ুন সাহিত্যে মানবিকতা। আরো লেখা যায় হুমায়ুন সাহিত্যের ভাষা। তার ভাষা এত প্রাঞ্জল এবং ঝরঝরে যে আবাল বৃদ্ধ বনিতা, অর্থাৎ যে কোনো বয়সের মানুষ তার লেখা একবার পড়া শুরু করলে শেষ না করে আর উঠতে পারেন না। আমার নিজের ক্ষেত্রেই এমনটি বহুবার ঘটেছে। পড়া শুরু করলে রাত কাভার হয়ে গেছে।

হুমায়ূনসাহিত্যের সবচেয়ে বড় সাফল্য হলো এই যে, তার রচনাবলী বাংলাদেশের বই বাজার থেকে সমরেশ মজুমদার, সুনীল গাঙ্গুলী, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ভারতীয় লেখক, যারা বাংলাদেশের বাজারে একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাদেরকে সম্পূর্ণ না হলেও তিনি বিপুল ভাবে হটিয়ে দিয়েছেন। হুমায়ুন সাহিত্য নিয়ে এই ডক্টরেট দেওয়ার উদ্যোগ আমরা বিপুল ভাবে সমর্থন করি। আমরা চাই, তার বইয়ের কিছু শিক্ষণীয় দিক গবেষকরা তুলে আনবেন। তাঁর প্রায় প্রতিটি পুস্তকের শুরুতে বিখ্যাত মনিষীদের সব বিখ্যাত কোটেশন দেওয়া আছে। তাঁর ৩০০ পুস্তকে উদ্ধৃত ৩০০ কোটেশন সংকলিত করলে একটি বুকলেট হতে পারে। শেষ জীবনে তিনি রসূলে পাকের (স.) জীবন রচনায় হাত দিয়েছিলেন। তার একটি বা দুটি চ্যাপ্টার আমি পড়েছি। এই দুই একটি অধ্যায়ে তিনি যেসব তথ্য দিয়েছেন, সেগুলি অমূল্য। মনে হয়, যেন তিনি সাগর সেঁচে মানিক এনেছেন। যদি তিনি বইটি শেষ করে যেতে পারতেন তাহলে মুসলমানরা এক দুর্লভ জীবনীগ্রন্থ পেতেন।

চার
হুমায়ূনসাহিত্যে ডক্টরেট দেওয়ার এই আনন্দ সংবাদের পাশাপাশি একটি সতর্ক সংকেত দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি। হুমায়ূন আহমেদ আজ নাই। কিন্তু তাঁর ইন্তেকালের পরের কয়েক বছরেও অন্য কেউ উঠে আসলেন না যিনি হুমায়ূন আহমেদকে রিপ্লেস করবেন। আসলে কেউ কারো রিপ্লেসমেন্ট হয়না। কিন্তু নিজস্ব স্টাইলে এক বা একাধিক কথা সাহিত্যিক অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা নিয়ে উত্থিত হতে পারেন। দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে সেটি হয়নি। হুমায়ূন আহমেদের পর যিনি যেখানে ছিলেন, তিনি সেখানেই আছেন। এছাড়া নতুন কেউ বিপুল পাঠকপ্রিয়তা নিয়ে উঠে আসেননি। অথচ প্রতিবেশী পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকিয়ে দেখুন। সুনীল গাঙ্গুলী মারা গেছেন। কিন্তু জায়গা খালি নাই। শীর্ষেন্দু এবং সমরেশ মজুমদার রয়ে গেছেন। পিছে পিছে উঠে এসেছেন সুচিত্রা ভট্টাচার্য্য। আরো আছেন বাণী বসু, সঙ্গীতা বন্দোপাধ্যায় প্রমুখ।

কবিতার ক্ষেত্রেও একই করুণ দশা। শামসুর রহমান এবং আল মাহমুদ দুজনেই ইন্তেকাল করেছেন। কিন্তু সেই জায়গায় কেউ আর উঠে আসেননি। অথচ বাংলাদেশের পাশের দেশ পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন কবির নাম আমাদের দেশের কবিরা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন। এদের মধ্যে উল্লেখ করা যেতে পারে জয় গোস্বামী, শংখ ঘোষ, সুভাস মুখোপাধ্যায়-এদেরকে বাংলাদেশের বড় বড় অনুষ্ঠানে মেহমান করে আনা হয়।

হুমায়ূন আহমেদের সমকক্ষ না হোক, তার কাছাকাছি কেউ যদি উঠে আসতে না পারেন তাহলে বাংলাদেশের কথা সাহিত্যের বাজার ভারতীয়দের, অর্থাৎ সমরেশ বাবুদের দখলে আবার চলে যাবে। গত বছরের ফেব্রুয়ারীর বই মেলায় সেই আলামত দেখা গেছে। মেলার বাইরে চারুকলা ইন্সটিটিউটের সামনের দুধারে ফুটপাতে সমরেশে বাবুদের বই সাজানো ছিলো। মেলা থেকে কোনো বই না কিনে খালি হাতে বেরিয়ে অনেককে ঐ ফুটপাত থেকে বিপুল সংখ্যায় বই কিনতে দেখা গেছে। এটি একটি অশনি সংকেত।
[email protected]



 

Show all comments
  • Iqbal Ahmed ২২ জুলাই, ২০২০, ৯:১২ এএম says : 0
    Very good analysis with a full of frustrations and hateful words. You cannot stand and compete with hates and frustrations. Good writers are most welcome, but restrictions will produce substandard quality. So in order to get real excellent writes, the fist thing needed is the open environment policy. In the bright atmosphere crated by Rabindranath, we are blessed by extraordinary contributions of Nazrul, Jibananada etc. Their extraordinary talents opened space for them. The intention of this article is not to make a fair competition, rater to put the seed of hates and crimes, which is the general purpose of this . The more and more you do, the more you are falling down.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পিএইচডি

২১ মে, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন