Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

আমাদের পাটকল বন্ধ করতে হচ্ছে কেন?

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ৫ জুলাই, ২০২০, ১২:০১ এএম

দেশের সরকারি পাটকল বন্ধ হতে হতে সর্বশেষ ২৬টিতে এসে ঠেকেছিল। তার মধ্যে মনোয়ার জুট মিল ছাড়া ২৫টি ছিল উৎপাদনে। তাও চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে গত ১ জুলাই। এই মিলগুলোর মধ্যে ঢাকায় ৭টি, চট্টগ্রামে ১০টি ও খুলনায় ৮টি অবস্থিত। ফলে দেশের পাটকলে সরকারের অংশগ্রহণের অবসান ঘটেছে। পাটকলগুলো বন্ধ সম্পর্কে সরকারিভাবে বলা হয়েছে, বন্ধ পাটকলগুলোর সব স্থায়ী শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের মাধ্যমে অবসর দেওয়া হবে এবং শ্রমিকদের সব পাওনা পরিশোধ করা হবে। তাদের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। এই পাটকলগুলো আগামী ছয় মাসের মধ্যে পিপিপির (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) আওতায় সংস্কার করে চালু করা হবে এবং তাতে পুরানো দক্ষ শ্রমিকদের চাকরিতে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত যে ৮,৯৫৪ জন পাটকল শ্রমিক অবসরে গেছেন, তাদেরও সব পাওনা একসঙ্গে বুঝিয়ে দেওয়া হবে। গত ৪৮ বছরের মধ্যে ৪৪ বছর ধরে অব্যাহতভাবে মোট ১০,৬৭৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে সরকারি পাটকলগুলো। বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গত ৩ জুলাই জরুরি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ‘পাটকল শ্রমিকরা তো আমাদেরই লোক এদেরকে ঠকানো যাবে না। প্রধানমন্ত্রী পাটকে ভালবাসেন। এই পাট আবার এগিয়ে যাবে। তাই শ্রমিক ভাইদের আমরা কোনোভাবেই ঠকাবো না। তাদের ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন, শ্রমিকরা যে টাকা পাবে তার অর্ধেক নগদ টাকা আর বাকী অর্ধেক সঞ্চয়পত্রে (১১.০৪% সুদে) দেয়ার জন্য। মোট পাওনার পরিমাণ ৫ হাজার কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হয়েছে। ৩ দিনের মধ্যে শ্রমিকরা জানতে পারবেন কে কত পাবেন। আগামী সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে সকলেই পাওনা পেয়ে যাবেন।’ খবরে প্রকাশ, সংশ্লিষ্ট মিলগুলোতে প্রায় ২৬ হাজার অস্থায়ী বা বদলী শ্রমিক রয়েছে। তারা বাড়তি কোনো সুবিধা পাবে না। সংশ্লিষ্ট মিল এলাকায় শ্রমিক ও তাদের পরিবার-পরিজনের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে। মিলগুলোতে কড়া পুলিশী ব্যবস্থা মোতায়েন করা হয়েছে। ফলে মিলের ভেতরে সুনসান নীরবতা বিরাজ করছে।

পূর্ব বাংলার পাটের সুখ্যাতি ছিল বিশ্বব্যাপী। সে পাটের সুফল দিয়ে একদা ডান্ডি-পিন্ডি গড়ে উঠেছে। কিন্তু এ দেশের পাটচাষিদের ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। তাই সাবেক পূর্ব পাকিস্তানে প্রচন্ড আন্দোলনের সময় পাট ও কাগজের বিষয়টি খুবই প্রাধান্য পেয়েছিল পাকিস্তানের দুই অংশের ব্যাপক বৈষম্য বা পার্থক্য তুলে ধরতে। জানা মতে, ১৯৫১ সালে নারায়ণগঞ্জের দি বাওয়া জুট মিলস স্থাপনের মাধ্যমে এ অঞ্চলে বড় আকারে পাট শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বিশ্বের সর্ববৃহৎ পাটকলের স্থান নেয় আদমজী জুট মিলস। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় পাটকল স্থাপনের সুবাদে রফতানি আয়ের প্রধান খাত হয়ে দাঁড়ায় পাট। ১৯৭০ সাল পর্যন্ত এখানে পাটকলের সংখ্যা ৭৭টিতে উন্নীত করা হয়েছিল। এসব পাটকলের সব শ্রমিক মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীনতার পর মানুষের মনে ব্যাপক আশা সঞ্চারিত হয়েছিল পাটের ভবিষ্যৎ নিয়ে। কারণ, ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে এ দেশের সব শিল্প-কারখানা জাতীয়করণ করে বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে পরিচালনা করা হয়। সে মতে, বিজেএমসির আওতায় ৮৭টি পাটকল যাত্রা শুরু করে। কিন্তু দেশবাসীর আশা ভঙ্গ হতে বেশিদিন লাগেনি। স্বাধীনতার পরপরই এ দেশের পাট মহা ষড়যন্ত্রের কবলে নিপতিত হয়। এরই অংশ হিসাবে মাঝে মধ্যে পাট কলে আগুন, পাট গুদামে আগুন, পাট বহনকারী নৌকা ও বার্জ ডুবে যাওয়া ইত্যাদি ঘটতে থাকে। এছাড়া, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, স্বজনপ্রীতি ইত্যাদি চরম আকার ধারণ করে। ফলে পাটকলগুলোতে লোকসান শুরু হয়। অপরদিকে, একই সময়ে ভারতে একের পর এক নতুন পাটকল প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং সেগুলো লাভজনক হয়। এ দেশের পাটকলগুলোও স্বাধীনতার আগে লাভজনক ছিল, যার অন্যতম ছিল আদমজী জুট মিলস, যার লাভ দিয়ে কর্তৃপক্ষ এ দেশে অনেকগুলো কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিল। এই মিলটিও স্বাধীনতার পর লোকসানের মুখে পড়ে ব্যাপক দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণে। একই ঘটনা ঘটে অন্য পাটকলেও। এভাবে ধারাবাহিক লোকসানের কারণে ৩৫টি মিল সাবেক মালিকের কাছে ফেরত দেওয়া হয় এবং কিছু মিল ব্যক্তিমালাকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়। এভাবে বিজেএমসির মিলের সংখ্যা কমতে কমতে সর্বশেষে ২৬টি টিকে ছিল। বলা দরকার, কোনো সময়ই পাটচাষিরা পাটের ন্যায্যমূল্য পায়নি। এমনকি হাটে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করতে পারেনি ক্রেতার অভাবে। তাই প্রচন্ড ক্ষোভে-দুঃখে তারা বহুবার পাটে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে রাস্তা-ঘাটে। বর্তমানেও পাটের মূল্য খুব কম। চাষিরা পাটচাষে নিরুৎসাহী হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় সরকারি পাট কলগুলোও চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেওয়া হলো। ফলে পাটের দুর্গতি আরও বেড়ে যাবে নিঃসন্দেহে। উপরন্তু এই ২৫টি পাটকল বন্ধ হওয়ার ফলে সংশ্লিষ্ট এলাকায় যে বাজার, আবাসন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল, সেগুলোও চরম ক্ষতির মুখে পড়বে ।

গত বিএনপি-জামায়াত সরকারের সময় আদমজী জুট মিলসহ অনেকগুলো মিল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। আদমজী জুট মিল এলাকায় ইপিজেড নির্মাণ ও অন্য মিলগুলোর মধ্যে কিছু মিল ব্যক্তি মালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এ নিয়ে বর্তমান সরকারি দল-আ’লীগ ব্যাপক প্রতিবাদ-আন্দোলন করেছিল। সে সময় আদমজী জুট মিল বন্ধ করার পেছনে বিশ্বব্যাংকের কারসাজি ছিল বলে বিবিসির খবরে প্রকাশ। উক্ত খবর মতে, ‘বাংলাদেশ পাটকল কর্পোরেশনের বিপণন মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মামুনুর রশিদ বলেন, ‘২০০২ সালের দিকে আদমজী জুট মিল বন্ধ হয়ে যায় বিশ্বব্যাংকের ফর্মুলায়। সেই সময় বিশ্বব্যাংকের লোনে ইন্ডিয়াতে বড় মিল স্থাপিত হয়েছে। এতে ইন্ডিয়া লাভবান হলো, আমাদের সব বায়ার তারাই পেল।’ উক্ত খবরে আরও বলা হয়, ‘ফ্রান্সের প্যারিসে গত ৯ বছর ধরে পরিবার নিয়ে বসবাস করে আসছেন তৃণা খান। সেখানে স্থানীয়দের নানান ধরনের পাটজাত পণ্য ব্যবহার করতে দেখেছেন তিনি। অথচ সেই পাটপণ্য ব্যবহারকারী সেই বিদেশি ক্রেতাদের অধিকাংশই জানেন না এই পাটের উৎপাদন হয় বাংলাদেশে। মিসেস খান বলেন, ‘আমি প্যারিসসহ আশেপাশের ছোট শহরগুলোতে মানুষকে পাটের জিনিসপত্র ব্যবহার করতে দেখেছি। এমনকি ফাইভস্টার হোটেলগুলোতেও দেখি আমাদের দেশের পাটের তৈরি কার্পেট। কিন্তু তারা এই সব জিনিসই কিনেছে ভারতের কাছ থেকে। কেউ জানেই না যে পাট বাংলাদেশে উৎপাদন হয়।’ এ খবর থেকে প্রমাণিত হয় যে, আমাদের পাটপণ্য নিয়ে তেমন কোনো প্রচার নেই। সে সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করছে ভারত। অন্যদিকে, দক্ষ জনশক্তির অভাব, প্রযুক্তিগত দুর্বলতা এবং বিপণনে দক্ষতা না থাকার কারণে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞগণ। এই অবস্থাই আ’লীগ ক্ষমতায় এসে অনেক বন্ধ জুট মিল চালু করেছিল এবং বন্ধ করার জন্য বিএনপি-জামায়াত সরকারের কঠোর সমালোচনা করেছিল। কিন্তু মিলগুলো চালু করা হলেও ঠিকমত বেতন দিতে পারেনি কখনোই। শ্রমিকদের প্রায় সময়ই আন্দোলন করতে হয়েছে বেতনের দাবিতে। আর এখন মিলগুলো চূড়ান্তভাবে বন্ধ করে দেওয়া হলো। অর্থাৎ বিএনপির পদ অনুসরণ করলো আ’লীগ। তাও দেশবাসীর চরম দুর্দিনে। করোনা মহামারীসৃষ্ট বৈশ্বিক মহামন্দায় সব কর্ম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দেশের অসংখ্য মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক শ্রেণির মানুষ কর্ম হারিয়ে যখন দিশেহারা হয়ে পড়েছে, অনাহারে-অর্ধাহারের সম্মুখীন হয়েছে, ঠিক তখন। এছাড়া, এই ২৫টি পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার ব্যাপারে আরও নানাবিধ প্রশ্ন দেখা দিয়েছে জনমনে। সে প্রশ্নগুলো হচ্ছে, লোকসানের অজুহাতে যখন সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো, তখন এ দেশেরই বেসরকারি খাতের অনেক পাটকল মুনাফা করছে। জানা মতে, বর্তমানে দেশে যে পাট ও পাটজাত পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে, তার ৯৫% বেসরকারি পাটকলের। সরকারি পাট কলগুলোর এই লোকসানের জন্য সংশ্লিষ্ট শ্রমিকরা কর্তৃপক্ষকে দোষারূপ করে বলেছেন, সময়মত পাট ক্রয় না করা, মিলগুলো সংস্কার না করা এবং ব্যাপক দুর্নীতির কারণেই দেশের সরকারি জুটমিলগুলো লোকসানের মুখে পড়েছে, যার সঙ্গে শ্রমিকদের বিন্দুমাত্র সংশ্লিষ্টতা নেই। লোকসানের জন্য দায়ী সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তারা আরও বলেছেন, বিশ্বে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা যেখানে বাড়ছে, সেখানে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলগুলোর আধুনিকায়ন করা হলে শ্রমিক ছাঁটাই নয়, বরং নতুন শ্রমিকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। পিপিপির আওতায় ৬ মাসের মধ্যে বন্ধ হয়ে যাওয়া মিলগুলো সংস্কার করে চালু করা হবে বিষয়ে বলা হচ্ছে। কিন্তু ইতোপূর্বে সংস্কার করে জুটমিল চালু করতে হবে শর্ত দিয়ে যেসব জুটমিল ব্যক্তিমালিকানায় ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো কিন্তু চালু করা হয়নি। যারা শর্ত দিয়ে মিলগুলো নিয়েছিলেন, তারা সেই শর্ত পালন করেননি, ভঙ্গ করেছেন। এমনিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পাওনা পরিশোধের জন্য বারবার পত্র দেয়া সত্তে¡ও পাওনা পরিশোধ করেননি। উপরন্তু, মিলের যাবতীয় মেশিনারি ও স্থাপনা সরকারের অজান্তে বিক্রি করে দিয়েছেন। তাই বেসরকারি খাতে দেয়া চারটি পাটকল ফিরিয়েও নিয়েছে সরকার। এই অবস্থায় সদ্য বন্ধ হওয়া ২৫টি জুটমিলের ভবিষ্যৎ পিপিপির বেসরকারি অংশের মালিকরা শর্ত ভঙ্গ করবেন না তার নিশ্চয়তা কী? দ্বিতীয়ত সংস্কার করে মিলগুলো যদি চালুই করা হবে, তাহলে কি সংস্কার করার মতো অর্থ সরকারের কাছে নেই? নিশ্চয় আছে। এমনকি, যে ৫ হাজার কোটি টাকা দিয়ে শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হচ্ছে, সে অর্থ দিয়েই তো মিলগুলো সংস্কার করা যেতো। তবুও এসব পথে না গিয়ে বেসরকারি খাতকে সঙ্গে নেওয়া হচ্ছে কেন? সর্বোপরি দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার কারণেই মিলগুলোর লোকসান হয়েছে। সেগুলো দূর না করে মিলগুলো বন্ধ করা কেন? মাথা ব্যথার ওষুধ কি মাথা কেটে ফেলা? অপরদিকে, মাত্র ১০ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি লোকসানের কারণে যদি ২৫টি জুট মিল বন্ধ করে প্রায় ২৫ হাজার স্থায়ী শ্রমিক এবং আরও প্রায় অনুরূপ সংখ্যক অস্থায়ী শ্রমিককে বেকার করা হয়, তাহলে প্রায় ১১ বছরে ৯৩ হাজার কোটি টাকার মতো ভর্তুকি দিয়ে বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ প্লান্ট চালু রাখা হচ্ছে কেন? সর্বোপরি দেশের সরকারি পাটকলগুলোকে সংস্কার করার জন্য সম্ভবত যুক্তরাজ্যের সাথে একটি চুক্তি করা হয়েছে কিছুদিন আগে। সে চুক্তি বাস্তবায়িত হলে তো মিলগুলো বন্ধ করার দরকার হতো না। নাকি সে চুক্তির পরিপ্রেক্ষিতেই মিলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হলো?

বাংলাদেশের পাট বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। এছাড়া, এ দেশের বিজ্ঞানীরা পাটের জীন আবিষ্কার করেছেন। পাট থেকে পলিব্যাগও আবিষ্কার করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সেই ব্যাগের নামকরণ করেছেন ‘সোনালী ব্যাগ’, যা ঢাকায় অবস্থিত একটি পাটকলে উৎপাদন শুরু করা হয়েছিল। এই ব্যাগ পচনশীল। ফলে পরিবেশবান্ধব। এর আগে বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম সরকারের সময় দেশের এক বিজ্ঞানী পাটপাতা থেকে কাগজের মন্ড আবিষ্কার করেছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতে তখন অনেক সরকারি জুটমিলে পাটপাতা থেকে কাগজের মন্ড তৈরি করা শুরু হয়েছিল। অথচ এই ব্যবস্থা চালু থাকলে পাটের দুর্দিন এতো হতো না। দেশে কাগজেরও সংকট সৃষ্টি হতো না। যা’হোক, জার্মানিতে পাটপাতা থেকে সুস্বাদু চা উৎপাদন হচ্ছে, যা দেশটিতে খুবই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অপরদিকে, পরিবেশ রক্ষার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির মতো সিনথেটিক তথা পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার বিরোধী হয়ে উঠেছে বিশ্ববাসী। তাই বিভিন্ন দেশে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৮টি দেশও পলিথিন ব্যবহার বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে ঐ দেশগুলোয় বিপুল পরিমাণে পাটের ব্যাগের চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। তাই পাট বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল জুট স্টাডি গ্রুপের হিসাব অনুযায়ী, বর্তমানে বিশ্বে বছরে পাঁচ হাজার কোটি পিস শপিং ব্যাগের চাহিদা রয়েছে। এছাড়া, আন্তর্জাতিক প্রাকৃতিক আঁশ সমিতির হিসাব অনুযায়ী, ২০২০ সালের পর শুধু যুক্তরাষ্ট্রের বাজারেই দেড় হাজার কোটি ডলারের শপিং ব্যাগের বাজার তৈরি হবে। এছাড়া পাটের শপিং ব্যাগ, শৌখিন ও আসবাব সামগ্রী তৈরির কাঁচামাল উৎপাদনেরও সুযোগ রয়েছে। ফলে রফতানির অন্যতম খাত হয়ে উঠতে পারে। সেই বাজার ধরতে আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো এরই মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে। সম্ভাবনাময় আন্তর্জাতিক বাজারের ১০ শতাংশও দখল করতে পারলে শুধু এই পাট দিয়েই আমাদের বছরে ৫০ হাজার কোটি টাকা আয় করা সম্ভব বলে পাট খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের অভিমত। এমনকি, তারা গার্মেন্টের ন্যায় পাটকে নিয়েও স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। তবে এজন্য আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কারখানা স্থাপন করতে হবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্য প্রবেশের জন্য গবেষণা বাড়ানো ও আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদা মাফিক পণ্য তৈরির জন্য দেশে দক্ষ জনবল তৈরি করা প্রয়োজন। জানা গেছে যে, দেশের পাট কারখানাগুলোতে মাত্র পাঁচ-সাত ধরনের ইয়ার্ন তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু ভারতের কারখানাগুলোতে ১১০টির বেশি ইয়ার্ন তৈরি করা হচ্ছে। ফলে সুতাভিত্তিক পণ্য তৈরিতে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছি না। অথচ এক সময় পাট দিয়ে শুধু দড়ি, চট, ছালা তৈরি হতো। পাট দিয়ে এখন শত শত ধরনের ব্যবহার্য জিনিস তৈরি হচ্ছে। ঘরের দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস থেকে শুরু করে বিশ্বের নামীদামী গাড়ির ভেতরের কাপড়, বডি, কাপড়, বিছানার চাদর, টুপি, ফার্নিচার, শার্ট, প্যান্ট এমনকি জিনসও এখন তৈরি হচ্ছে পাট থেকে। উপরন্তু হোম টেক্সটাইল, হোম ফার্নিশিং বিশেষ করে পর্দার কাপড়, কাভার ও শৌখিন কাপড় এবং লাইফ স্টাইল পণ্য ও গিফট তৈরি করা সম্ভব পাট থেকে। এসব বহুমুখী পণ্য তৈরি করে ভারতের পাটকলগুলো এখনও লাভ করছে। ভারত বাংলাদেশ থেকে পাটের কাঁচামাল কিনে সেটা প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে বিদেশে বিক্রি করছে এবং মুনাফা গড়ছে। এই অবস্থায়ও পাটের প্রধান ও সর্বোৎকৃষ্ট মানের উৎপাদনকারী দেশ-বাংলাদেশের পাটকলগুলো লোকসান দিচ্ছে, যা অযৌক্তিক-অগ্রহণযোগ্য। তাই সরকারি ২৫টি মিল বন্ধ করে দেওয়া কেউই মেনে নিতে পারছে না। এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোও। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এর তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে।

যা’হোক, বিশ্বব্যাপী পাট ও পাটপণ্যের চাহিদা বেড়েছে ব্যাপক। এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করা আবশ্যক। এ জন্য প্রয়োজন খুব দ্রুত দেশের পাটকলগুলোকে আধুনিক ও প্রযুক্তিভিত্তিক করা, বৈশ্বিক চাহিদা মাফিক পাটপণ্য উৎপাদন ও বাজারজাত করা, সোনালী ব্যাগ তৈরি ও দেশের অভ্যন্তরে বাজারজাত করে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার কঠোরভাবে বন্ধ করা, সব পাটকলে স্বল্প সুদে প্রয়োজনীয় ব্যাংক ঋণ প্রদান, দক্ষ লোক নিয়োগ, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অব্যবস্থাপনা বন্ধ করা জরুরি। তাহলে পাটের কদর বৃদ্ধি পাবে, ঐতিহ্য ফিরে আসবে, কৃষকরা লাভবান হবে, দেশের পরিবেশের উন্নতি হবে, রফতানি অনেক বাড়বে। দেশের সার্বিক কল্যাণ হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

Show all comments
  • Sabbir ১৬ জুলাই, ২০২০, ৩:১৭ এএম says : 0
    I'm feeling lucky to say that, Today, I found something special for me. Many thanks for this.
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাটকল

২৫ ডিসেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন