Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রূপগঞ্জের পাটকলগুলো দেড়যুগ ধরে বন্ধ

নষ্ট হচ্ছে মেশিনারিজ

খলিল সিকদার, রূপগঞ্জ (নারায়ণগঞ্জ) থেকে | প্রকাশের সময় : ২৩ ডিসেম্বর, ২০২০, ১২:০০ এএম

প্রাচ্যের ড্যান্ডিখ্যাত নারায়ণগঞ্জের আদমজী জুট মিল ও কুমুদিনী ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টের পাটকলসহ পাট ব্যবসার ব্যাপক খ্যাতি ছিল। শীতলক্ষ্যার তীরে গড়ে ওঠা অনেক কারখানাতে কাজ করতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন এসে ভিড় করতো। তবে এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম পাটকল আদমজী জুট মিল বন্ধ হওয়ার কয়েক বছরের ব্যবধানে নারায়ণগঞ্জে আরও অন্তত ১২টি পাটকল বন্ধ হয়ে যায়। এতে বন্ধ হয়ে যাওয়া পাটকলের মেশনারিজ নষ্ট হচ্ছে। পাশাপাশি শ্রমিকদের পাওনাদি বুঝে না পাওয়ায় চরম বিপাকে রয়েছেন তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বন্ধ হওয়া পাটকল কারখানাগুলোর অবকাঠামোও বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আবার যেগুলোর অবকাঠামো এখনও বর্তমান সেগুলোর বেশির ভাগেরই মেশিনারিজ বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। এসব পাটকলের অবকাঠামো এখন ব্যবহৃত হচ্ছে গোডাউন হিসেবে।

সূত্র জানায়, পাট উৎপাদন নির্ভরশীল হওয়ায় ৭০’র দশকে রূপগঞ্জের শীতলক্ষ্যার পাড়ে গড়ে ওঠে ৮টি পাটকল। রাষ্ট্রায়ত্ত¡ একটি ও বেসরকারি ২টি ছাড়া বাকি ৫টি পাটকলের কিছু এক যুগ আর কিছু পাটকল বন্ধ হয় প্রায় দেড় যুগ আগেই। এসব পাটকলের মধ্যে রয়েছে, কাঞ্চন পৌর এলাকার নবাব আশকারী জুট মিল, মাশরিকি জুট মিল, উত্তরা জুট মিল ও নবারন জুট মিল কাঞ্চন ও ভুলতার সাত্তার জুট মিল, এলাইড জুট মিল, গাউছিয়া জুট মিলসহ ৭টি পাটকল। এছাড়া জুটো ফাইবার নামে তারাবো এলাকায় একটি সরকারি রাষ্ট্রায়ত্ব পাটকল রয়েছে।
জেলার এসব পাটকলগুলোকে ঘিরে ২০-২৫ হাজার শ্রমিকের জীবিকা নির্বাহ করতো। ৯০ দশক পরবর্তি পাটের চাহিদা কমতে থাকায় মিলগুলো গুণতে থাকে লোকসান। ফলে রাষ্ট্রায়ত্ত¡ একটি ও বেসরকারি ২টি ছাড়া বাকি ৫টি পাটকল গত প্রায় দেড়যুগ আগেই বন্ধ হয়ে যায়।

অভিযোগ রয়েছে এসব কলকারখানায় কর্মরত শ্রমিকরা দীর্ঘদিন পার হলেও তারা মালিকপক্ষের কাছ থেকে ব্যক্তিগত তহবিলের টাকা, বকেয়া বেতন ও সার্ভিসের টাকা পাননি। এছাড়া মিল বন্ধের পর সরকারিভাবে অথবা মালিকপক্ষও শ্রমিকদের কোন কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেননি।

ছাত্তার জুট মিলস মডেল হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক আবুল কালাম আজাদ জানান, কাঞ্চন পৌরসভা ও ভুলতার আতলাশ পুর মৌজার ছাত্তার জুট মিলস ও এলাকার কেন্দুয়া এলাকার নবাব আশকারী জুট মিলে প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করতো। এ দুটি কারখানা লোকসান দেখিয়ে কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দেয়। শুধু তাই নয়, এসব কারখানা বিক্রি করতেও বাধ্য হন তারা। ২০০৫ সালে ছাত্তার জুট মিলটি সিনহা গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেন সাবেক পাটমন্ত্রী এমএ ছাত্তার।

অপর এক সূত্র জানায়, কাঞ্চন এলাকার মাশরিকি জুট মিলে প্রায় ৩ হাজার শ্রমিক, মুড়াপাড়া ইউনিয়নের বানিয়াদি এলাকার এলাইড জুট মিলে ১ হাজার শ্রমিক কাজ করতো। এসবের মধ্যে এলাইড জুট মিল একবার বন্ধের পর গত ২০১৮ সালের প্রথম দিকে দেড় শতাধিক শ্রমিক নিয়ে পুনরায় মিলটি চালু করা হয়। পরে পাট সঙ্কট ও চাষি না থাকায় লোকসানের কারণে গত দেড় মাস আগে এটি আবারো বন্ধ হয়ে হয়ে যায়। একই এলাকার গাউছিয়া জুট মিলে ১৪শ’ শ্রমিক কাজ করতো। এদিকে শ্রমিকরা তাদের পাওনার দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন সংগ্রাম করেও কোনও ক‚ল কিনারা না পেয়ে এদের অনেকেই ফিরে গেছেন গ্রামে। অনেকেই পেশা বদলে যোগ দিয়েছেন অন্য কোনও প্রতিষ্ঠানে।

জেলার অন্য জুট মিলগুলোর মধ্যে রয়েছে সিদ্ধিরগঞ্জে মনোয়ারা জুট মিল, তাজ জুট প্যাকিং কোম্পানি, প্রাইম জুটেক্স, শীতলক্ষ্যার পূর্বতীরে সোনাকান্দার সারোয়ার জুট মিল, নবীগঞ্জে জামাল জুট মিল, উত্তর নদ্যার আমিন ব্রাদার্স জুট অ্যান্ড কোম্পানি, কাঁচপুর বাজার এলাকায় নওয়াব আব্দুল মালেক জুট মিল, আনোয়ার জুট মিল, এলাইড জুট মিল, মাশরিকি জুট মিল, তারাব এলাকায় নিশান জুট মিল ও গাউছিয়া জুট মিল। এই পাটকলগুলো যেমন আদমজী জুট মিলের দেখাদেখি গড়ে উঠেছিল তেমনই বন্ধও হয়ে গেছে আদমজী বন্ধ হয়ে যাওয়ার প্রভাবেই। এগুলোর মধ্যে সিদ্ধিরগঞ্জের মনোয়ারা জুট মিল প্রায় ২০ বছর ধরে বন্ধ রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে এর পরবর্তী সময়ে। নানা সমস্যায়ও টিকে আছে রূপগঞ্জ উপজেলার তারাবোর টাটকী এলাকায় অবস্থিত নিউ ঢাকা জুট মিল, উত্তরা জুট মিল ও কাঞ্চনে নবারুন জুট মিল এবং বন্দরের মদনপুরে অবস্থিত সুরুজ জুট স্পিনিং নামে পাটের সুতা তৈরির একটি কারখানা।

জানা যায়, পাকিস্তানের অন্যতম ধনাঢ্য আদমজী পরিবারের তিন ভাই এ. ওয়াহেদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী ও গুল মোহাম্মদ আদমজী যৌথভাবে আদমজী জুটমিল প্রতিষ্ঠা করেন। নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার তীরে সিদ্ধিরগঞ্জের সুমিলপাড়ায় আদমজী জুটমিল গড়ে ওঠে ২৯৭ একর জমির ওপর। ১৭০০ হেসিয়ান ও ১০০০ সেকিং লুম দিয়ে এই মিলের উৎপাদন শুরু হয় ১৯৫১ সালে। ওই সময় এই মিলের উৎপাদন থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬০ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হতো। তখন মিলে তাঁতকল বসানো হয় ৩ হাজার ৩০০টি। আদমজী জুট মিলে উৎপাদিত চট, কার্পেটসহ বিভিন্ন প্রকার পাটজাত দ্রব্য দেশের চাহিদা পূরণ করে রফতানি হতো চীন, ভারত, কানাডা, আমেরিকা, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। ১৯৭৪ সালে আদমজী জুটমিল জাতীয়করণ করে জুটমিল করপোরেশনের হাতে ন্যাস্ত করা হয়। এরপর থেকে অব্যাহতভাবে লোকসানে ছিল জুটমিলটি। মিলটিতে ২৪ হাজার ৯১৬ কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শ্রমিক চাকরি করতেন।

পাট অধিদফতরের নারায়ণগঞ্জস্থ সহকারী পরিচালকের কার্যালয়ের মুখ্য পরিদর্শক রুহুল আমিন বলেন, রূপগঞ্জে অবস্থিত মালেক জুট মিল, নবারূন জুট মিল, উত্তরা জুট ফাইবার্স, নিউ ঢাকা ইন্ডাস্ট্রিজ ও বন্দরের মদনপুরে অবস্থিত সুরুজ জুট স্পিনিং মিলে কাঁচাপাটের চাহিদা রয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জের পাশে ডেমরায় লতিফ বাওয়ানী ও করিম জুট মিল এবং নরসিংদীতে ইউএমসি ও বাংলাদেশ জুট মিল চালু রয়েছে। বন্ধ পাটকল কিভাবে সচল করবেন কিংবা রক্ষণাবেক্ষণে ভূমিকা কি এ নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাটকল

২৫ ডিসেম্বর, ২০২০

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ