পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
গত মঙ্গলবারের কলামে বলেছিলাম যে, ১৯৬২ সালের পর গালওয়ানে চীন-ভারতের মধ্যে এত বড় একটি সংঘর্ষ হলো যেখানে ১৬ বিহার রেজিমেন্টের অধিনায়ক কর্ণেল সন্তোষ বাবু সহ ২০ জন ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছে। ঐ কলামে আমি বলেছিলাম যে, ঐ সংঘর্ষের পটভূমি এবং তার সুদূর প্রসারী তাৎপর্য সম্পর্কে পরবর্তী কলামে অর্থাৎ আজ আলোচনা করবো। আসলে আজকে সেটি করারই ইচ্ছা আছে। কিন্তু ১৫ই জুনের পর আজ ৩০ জুন, এই ১৫ দিনে ঐ সীমান্তে অর্থাৎ গালওয়ান উপত্যকায় ব্যাপক সামরিক তৎপরতা শুরু হয়ে গেছে। সে সম্পর্কে কিছু না লিখলে আলোচনাটি অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। এর মধ্যে আরেকটি ঘটনা ঘটেছে। যেটি শুধুমাত্র লাদাখ সীমান্ত নয়, উপমহাদেশসহ গোটা এশিয়ার রাজনীতিতে একটি বিরাট টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে কাজ করবে বলে মনে হচ্ছে।
শনিবার ২৭ জুন বাংলাদেশের পত্র-পত্রিকার প্রকাশিত খবরে প্রকাশ, লাদাখ সীমান্তবিরোধে ভারতীয় ও চীনা বাহিনীর তুমুল উত্তেজনার সময় ভারতের পাশে দাঁড়ানোর প্রত্যয় ঘোষণা করেছে আমেরিকা। প্রধানত ভারতকে সাহায্য করার জন্যই ইউরোপে মোতায়েন মার্কিন সেনাদের সিংহভাগ সরিয়ে এনে তা এশিয়ায় মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে অনুষ্ঠিত এক সংবাদ সন্মেলনে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, বর্তমানে জার্মানীতে মোতায়েন রয়েছে ৫২ হাজার মার্কিন সেনা। সেখানে ২৫ হাজার সেনা রেখে অবশিষ্ট ২৭ হাজার সেনা এশিয়াতে মোতায়েন করা হবে। খবরে বলা হয়, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চীনা আগ্রাসন আমেরিকাকে উদ্বিগ্ন করেছে। লাদাখের চীন-ভারত সীমান্তে দুই দেশের এলএসি বা প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখায় চীন ভারত সেনা সংঘর্ষ আমেরিকার উদ্বেগ বাড়িয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী পম্পেও সরাসরি বলেন যে, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনস বা দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের আগ্রাসী ভূমিকায় আমেরিকা উদ্বিগ্ন। সে কারণেই জার্মানী থেকে সেনা সরানো হচ্ছে। এসব দেশের মধ্যে যাদের প্রয়োজন বেশি সেই সব দেশেই বেশি করে সেনা মোতায়েনে করা হবে। তিনি বলেন, চীনের লাল ফৌজ মোকাবেলায় আমরা কতখানি প্রস্তুত, সেটি এবার বোঝা যাবে। পম্পেও বলেন, আমরা এই সময়ের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিয়ে চিন্তিত। আমরা মনে করি, লাল ফৌজকে মোকাবেলায় উপয্ক্তু ব্যবস্থা নিতে কোনো অসুবিধা হবে না।
বাংলাদেশের একটি পত্রিকায় নয়াদিল্লী প্রতিনিধি লিখেছেন যে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই মন্তব্য আকস্মিক নয়। গত সপ্তাহেও তিনি ভারত সীমান্তে উত্তেজনা বৃদ্ধি করা এবং দক্ষিণ চীন সাগরে তৎপরতা বাড়ানোর জন্য চীনের সমালোচনা করেন। তিনি চীনের শাসক দল কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘দুর্বৃত্ত’ আখ্যা দেন। তিনি মনে করেন যে, হংকং, দক্ষিণ চীন সাগর বা ভারত সীমান্ত যেখানেই চীন যা কিছুই করছে, সে সবই সেদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সামগ্রিক চিন্তা ভাবনার প্রতিফলন।
ইউরোপ থেকে সৈন্য সরিয়ে এশিয়ায় আনায়ন চীন-ভারত বিরোধে এক নতুন ডাইমেনশন যুক্ত করলো। আমি সেজন্য প্রথমে বলেছি যে, চীন-ভারত বিরোধের মূল কারণ নিয়ে আজ যে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম সেটি কিছুটা ভিন্নখাতে প্রবাহিত হবে। আর তার কারণ হলো, চীন ভারত রণাঙ্গণে আটলান্টিক থেকে আগত বহি:শক্তির সম্ভাব্য হস্তক্ষেপ।
দুই
সীমান্তে যাদের বিরোধ তারা সকলেই শুধুমাত্র এশিয়ার দেশ নয়, তারা ভারতের প্রতিবেশী। ভারতের সাথে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ রয়েছে চীন, পাকিস্তান ও নেপালের। পাকিস্তানের সাথে বিরোধ রয়েছে আজাদ কাশ্মীর, গিলগিট, বাল্টিস্তান এবং লাদাখ নিয়ে। চীনের সাথে বিরোধ রয়েছে আকসাই চীন, লাদাখ, অরুণাচল এবং সিকিমের কয়েকটি সীমান্ত চৌকি নিয়ে। নেপালের সাথে বিরোধ রয়েছে উত্তরখান্ড সংলগ্ন তিনটি স্থান নিয়ে। এগুলো হলো লেপুলেখ, কালাপানি ও লিম্পিয়াধুরা। এসব বিরোধে আমেরিকা নিজেকে জড়াতে আসছে কেন? তারা ন্যাটো গঠন করে ইউরোপে সৈন্য পাঠিয়েছে। ইউরোপ যদি তাদের ভূখন্ডে বিদেশী সৈন্য অর্থাৎ মার্কিন সৈন্য গ্রহণ করে তাহলে সেটি তাদের নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু এশিয়াতে সৈন্য পাঠাতে হলে এশিয়ানদের মতামত গ্রহণ করা দরকার।
আমেরিকা গণতন্ত্র, মৌলিক অধিকার, ব্যক্তি ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতায় উচ্চকিত। কিন্তু পররাজ্যে আগ্রাসনের বেলায় সে ‘জোর যার মুল্লুক তার’ নীতি অনুসরণ করে। আটলান্টিক মহাসাগর পাড়ি দিয়ে উড়ে এসে সে আফগানিস্তানে হামলা চালালো কেন? কোন অধিকারে? তালেবানরা ভালো কি খারাপ, সেটি বুঝবে আফগানরা। মোল্লা ওমরের শাসনকাল ভালো ছিলো না খারাপ ছিলো সেটিও বুঝবে আফগানরা। কারণ, তালেবানরাও আফগান, মোল্লা ওমরও আফগান এবং আফগানিস্তানের শাসক গোষ্ঠিও আফগান। মারামারি কাটাকাটি হোক বা ইলেকশন হোক বা ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েক হোক- যেটাই হোক না কেন, সেটি ঠিক করবে আফগানিস্তানের জনগণ, যারা বিশ্বব্যাপাী আফগান হিসাবে পরিচিত। সেখানে মার্কিনীরা উড়ে এসে ১৯ বছর ধরে জুড়ে বসে আছে কেন? কোন অধিকারে?
একই কথা প্রযোজ্য ইরাকে। সাদ্দাম হোসেন ছিলেন ইরাকী। তার বিরোধীরাও হলেন ইরাকী। ইরাকীদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে মার্কিনীরা নাক গলাতে আসেন কোন অধিকারে? পৃথিবীর কেউ বলেনি যে ইরাকে রাসায়নিক অস্ত্র রয়েছে। পৃথিবীর কেউ বলেনি যে ইরাকে গণবিধ্বংসী অস্ত্র রয়েছে। অথচ সেই রাসায়নিক অস্ত্র এবং গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংস করার নাম করে মার্কিনীরা ইরাকে সামরিক অভিযান চালায় এবং দেশটি দখল করে নেয়। আজও তারা ১৭ বছর ধরে ইরাক দখল করে আছে এবং দেশটির বিপুল তেল সম্পদ লুন্ঠন করে নিচ্ছে। এই ১৭ বছরেও তো তারা কোনো গণবিধ্বংসী অস্ত্র পায়নি অথবা কোনো রাসায়নিক অস্ত্র পায়নি। তাহলে তারা বিশ্ব জনমতকে ধোঁকা দিয়ে, বিশ্ববাসীর কাছে ডাহা মিথ্যা কথা বলে তারা ইরাক নামক তেল সমৃদ্ধ পররাজ্য দখল করে আছে। এর বিরুদ্ধে কথা বলার লোক নেই। কারণ আমেরিকা পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র্।
তিন
লাদাখ সীমান্তে ভারতের পক্ষে আমেরিকা সৈন্য নামাবে কোন নীতির ভিত্তিতে? যে গালওয়ান উপত্যকাকে চীন-ভারত তথা আন্তর্জাাতিক সীমানা বলা হয় সেটি কি আর এখন আন্তর্জাতিক সীমানা রয়েছে? গত বছরের অগাস্ট মাসে ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল এবং লাদাখকে ভারতের ইউনিয়ন টেরিটরী ঘোষণার পর গালওয়ান উপত্যকা আর আন্তর্জাতিক সীমানা থাকেনা। বিষয়টি কিছুটা ব্যাখ্যা করা দরকার। বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে যুদ্ধ হয় সেই যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে ভারতের শিমলায় ভারতের পরলোকগত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মরহুম জুলফিকার আলী ভূট্টোর মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এটি ঐতিহাসিক শিমলা চুক্তি নামে পরিচিত।
এর আগে একটি বিষয় উল্লেখ করা দরকার। কাশ্মীর নিয়ে তিনটি পক্ষ জড়িত। তিনটি পক্ষ হলো পাকিস্তান, চীন ও ভারত। জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ ভারতের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। পাকিস্তান সেটি স্বীকার করেনা। পাকিস্তান মনে করে যে, ১৯৪৯ এবং ৫০ এর দশকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিলো যে জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখের জনগণ গণ ভোটের মাধ্যমে স্থির করবে যে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ স্বাধীন থাকবে নাকি ভারতে যোগ দেবে? নাকি পাকিস্তানের যোগ দেবে? অন্য দিকে পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে আজাদ কাশ্মীর, গিলগিট এবং বাল্টিস্তান। এই তিনটি অঞ্চল পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে। এটি ভারত মেনে নেয়নি। ৪৯ ও ৫০ দশকে জাতিসংঘের প্রস্তাবে বলা হয়েছিলো যে, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত স্থান সমূহেও গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। গণভোটের মাধ্যমে তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে।
শিমলা চুক্তিতে বলা হয়েছে, “Pending the final settlement of any of the problems between the two countries, neither side shall unilaterally alter the situation অর্থাৎ দুই দেশের মধ্যে (ভারত পাকিস্তান) বিরাজমান কোনো সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান না হওয়া পর্যন্ত কোনো পক্ষই স্থিতাবস্থার পরিবর্তন করবেনা। ভারত লাদাখকে কাশ্মীরের অঙ্গ মনে করে এবং সেই হিসাবে অঞ্চলটিকে তার নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। গত বছরের ৫ অগাস্ট লাদাখকে ভারতের ইউনিয়ন টেরিটরী করার পর ভারত একতরফাভাবে স্থিতাবস্থার পরিবর্তন ঘটালো। ফলে শিমলা চুক্তি আর কার্যকর রইলো না। পাকিস্তান ছাড়াও চীনও লাদাখকে নিজের অংশ মনে করে। চীনের কাছে লাদাখ আগে থেকেই বিরোধপূর্ণ একটি অঞ্চল ছিলো। লাদাখকে ভারতের ইউনিয়ন টেরিটরী করার ফলে চীনের কাছেও আর শিমলা চুক্তির কোনো মূল্য রইলো না।
এই অবস্থায় লাদাখে সীমান্ত সংঘর্ষতো পরের কথা, চীন যদি সমগ্র লাদাখ দখল করেও নেয়, তাহলে আইনগতভাবে ভারতের কিছু করার থাকবেনা। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক মহল ধারণা করেছিলেন যে, ১৫/১৬ জুনের রক্তাক্ত ঘটনার পর পরিস্থিতি হয়তো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, গালওয়ান তথা লাদাখ সীমান্তে ভারত ও চীন উভয় দেশই রণসাজে সজ্জিত হচ্ছে। উভয় দেশই সীমান্তের এধারে এবং ওধারে ট্যাংক, কামান, মর্টার ইত্যাদি মোতায়েন করেছে। ভারত এবং চীন উভয় দেশই হাজার হাজার সৈন্য ফরওয়ার্ড পজিশনে মোতায়েন করছে। দুইটি দেশই প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখার এধারে এবং ওধারে বিমান ঘাঁটি নির্মাণ করেছে। সেই বিমান ঘাঁটি থেকে উভয় দেশেরই জঙ্গী বিমান আকাশে উড়ছে।
আমরা জানিনা এর শেষ কোথায়। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করিনা, সর্বাত্মক যুদ্ধের দামামা বেজে উঠবে। যদি বেজে ওঠে তাহলে ভারতকে চরম মূল্য দিতে হবে। সে লাদাখ, অরুণাচল এবং সিকিম হারাবে। আমেরিকা ইতোমধ্যেই ভারতের পক্ষ নিয়েছে। এখন রাশিয়ার গতিবিধির ওপর আন্তর্জাতিক মহল তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।