বাংলাদেশের জনজীবন ও অর্থনীতিতে ফারাক্কা বাঁধের বিরূপ প্রতিক্রিয়া
ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রবাহিত গঙ্গার ওপর নির্মিত ভারতের ফারাক্কা বাঁধের প্রতিক্রিয়া যেমন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক
জালাল উদ্দিন ওমর
আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা অর্জন করেছি কাক্সিক্ষত এই স্বাধীনতা। এক সাগর রক্তের বিনিময়ে আমরা অর্জন করেছি একটি স্বাধীন পতাকা। আয়তনে ছোট হলেও বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দেশ। এদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতির দেশ। স্বাভাবিক ভাবেই এদেশে রয়েছে ভোগ্য পণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বিশাল এক বাজার। ভৌগোলিকভাবে কৌশলগত অবস্থান বাংলাদেশকে করেছে আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। প্রাকৃতিক এবং পরিবেশগতভাবে এদেশের ভূমি কৃষিকাজের জন্য খুবই উপযোগী। অসংখ্য নদ-নদী এবং হাওর-লেকে সমৃদ্ধ এই বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদের বিরাট এক আঁধার। বাংলাদেশের বিশাল উপকূলজুড়ে বঙ্গোপসাগরের অবস্থান বাংলাদেশের অর্থনৈতিক গুরুত্বকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। কর্ণফুলী নদী এবং বঙ্গোপসাগরের মোহনায় অবস্থিত চট্টগ্রাম বন্দর অর্থনৈতিক উন্নয়নের অবারিত এক সুযোগ সৃষ্টি করে চলেছে। বাংলাদেশের সামনে রয়েছে ব্লু-ইকোনমিতে এগিয়ে যাবার বিরাট এক হাতছানি। এদেশের মাটির নিচে লুকিয়ে আছে তেল, গ্যাস এবং কয়লাসহ অতি প্রয়োজনীয় এবং মূল্যবান খনিজ পদার্থের বিশাল এক সমাহার। প্রকৃতির দান সুন্দরবন বাংলাদেশকে বিশ^ মানচিত্রে আলাদা একটি পরিচিতি দান করেছে। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতসহ অসংখ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্বলিত স্থান এদেশের পর্যটন খাতকে অত্যন্ত সমৃদ্ধ করেছে। সব মিলিয়ে আমার প্রিয় বাংলাদেশ যেন অফুরন্ত সম্ভারনার এক জনপদ। এই সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে আমরা এগিয়ে যেতে চাই আরো বহুদূর।
বাংলাদেশের নিকটতম এবং বৃহত্তম প্রতিবেশী হচ্ছে ভারত। বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারতের অবস্থান। বাংলাদেশের সাথে ভারতের দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। আয়তন, জনসংখ্যা, সামরিক বাহিনী সব দিক দিকেই ভারত একটি বৃহৎ দেশ। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম জনসংখ্যা ভারতে বসবাস করে। ভারতের হাতে রয়েছে পারমাণবিক অস্ত্র। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারত বাংলাদেশকে সাহায্য করেছে। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক বরাবরই ভালো থাকে, এখনো আছে। ভারত তার সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত রাজ্যসমূহে মালামাল পরিবহনের জন্য বাংলাদেশের ভূখ-কে করিডোর হিসেবে ব্যবহার করছে। চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারের জন্য ভারত অনুমতি পেয়েছে। বাংলাদেশ কয়েক বছর থেকেই ভারত হতে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। এখন সুন্দরবনের রামপালে ভারত যৌথ উদ্যোগে বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করছে। বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের বিশাল এক বাজার সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা যেমন নিয়মিতভাবে ভারত সফর করছেন, ঠিক তেমনি ভারত সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও নিয়মিতভাবে বাংলাদেশ সফর করছেন। উভয় দেশের সরকার প্রধানই ইতোমধ্যে একে অন্যের দেশ সফর করেছেন। উভয় দেশের নেতারাই ভারত বাংলাদেশের সম্পর্ককে উচ্চ মাত্রার বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু ভারত কর্তৃক সীমান্ত হত্যা এখনো বন্ধ হয়নি এবং তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে ভারত এখনো কোন চুক্তি করেনি। আমরা আশা করবো, বন্ধুত্বের নিদর্শন হিসেবে ভারত সীমান্ত হত্যা বন্ধ করবে এবং তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে সহসাই একটি চুক্তি সম্পন্ন করবে। আর এর মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক আরো এগিয়ে যাবে।
ভারতের মতোই চীন বাংলাদেশের আরেকটি প্রতিবেশী দেশ। তবে চীনের সাথে সরাসরি বাংলাদেশের কোনো সীমান্ত নেই। চীন এবং বাংলাদেশের মাঝখানে ভারতের সেভেন সিস্টার্স নামে পরিচিত রাজ্যগুলো অবস্থিত। আয়তন, জনসংখ্যা এবং সামরিক বাহিনীর দিক দিয়ে চীন বিশাল একটি দেশ। চীনের জনসংখ্যা সবচেয়ে বেশি এবং সেখানে বসবাস করে প্রায় একশত ত্রিশ কোটি মানুষ। ভারতের মতো চীনও পারমাণবিক অস্ত্রে সমৃদ্ধ একটি দেশ। চীন জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং ভেটো ক্ষমতার অধিকারী দেশ। চীনের অর্থনীতি এখন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং বিকাশমান অর্থনীতি। চীনের উৎপাদিত পণ্য সারা পৃথিবীর বাজার দখল করেছে। রপ্তানির ক্ষেত্রে চীনের অবস্থান এখন পৃথিবীর শীর্ষে। পাশাপাশি বিশ^ রাজনীতিতে চীন এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে চলেছে। স্বাভাবিকভাবেই চীনের মতো একটি শক্তিশালী দেশের বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা যে কোন দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং নিরাপত্তার জন্য যেমন অত্যন্ত সহায়ক, ঠিক তেমনিভাবে তার শত্রুতা এবং অসহযোগিতা যে কোনো দেশের শান্তি, স্থিতিশীলতা, উন্নয়ন এবং নিরাপত্তার জন্য বিরাট এক হুমকি। বাংলাদেশের সাথে চীনের বরাবরই একটি ভালো সম্পর্ক বিরাজমান। বাংলাদেশ এবং চীনের নেতারা নিয়মিতভাবে একে অন্যের দেশ সফর করছেন এবং উভয় দেশের নেতারাই তাদের মধ্যকার সম্পর্ককে আরো উন্নত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। অতীতে বাংলাদেশের অনেক বড় বড় প্রকল্প চীনের সহায়তায় নির্মিত হয়েছে। চীন বর্তমানে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে টানেল তৈরির কাজ করছে এবং চট্টগ্রামের আনোয়ারায় চীন নির্মাণ করছে চায়না অর্থনৈতিক জোন। আমরা আশা করবো, অতীতের মতো বাংলাদেশের উন্নয়নে চীন আরো বেশি সহায়তা করবে এবং এর মাধ্যমে বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত এবং ক্ষুদ্র একটি দেশ। তবে কৌশলগত কারণে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বাংলাদেশের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের তিনদিকেই ভারত, যা বর্তমান বিশ্বের আরেকটি উদীয়মান পরাশক্তি। ভারতের সাথে বর্তমান বাংলাদেশ সরকারের সম্পর্ক অনেক বেশি বন্ধু ভাবাপন্ন। আবার আরেক পরাশক্তি চীনের সাথেও বাংলাদেশের ভালো সম্পর্ক। কিন্তু চীন এবং ভারত পরস্পর শত্রু ভাবাপন্ন। সীমান্ত সমস্যা, তিব্বত সমস্যা এবং শক্তির প্রতিযোগিতার কারণে ভারত এবং চীন পরস্পর শত্রু ভাবাপন্ন এবং তাদের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরেই বিরাজ করছে বৈরী ভাব। এক কথায় দীর্ঘদিন থেকেই চীনের সাথে ভারতের অঘোষিত একটি যুদ্ধ চলছে। আবার বাংলাদেশের প্রতিবেশী মিয়ানমারের সাথেও চীনের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। আবার ভারতের চিরশত্রু পাকিস্তান হচ্ছে চীনের পরম বন্ধু। ফলে ভারত এবং চীনের সাথে সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সতর্ক পন্থা অবলম্বন করতে হবে। ভারতের সাথে বাংলাদেশের বেশি বন্ধুত্ব চীনের কাছে যেমন অপছন্দ, ঠিক তেমনিভাবে চীনের সাথে বেশি বন্ধুত্ব ভারতের কাছে অপছন্দ। একইভাবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বৈরিতা চীনের কাছে যেমন পছন্দ, ঠিক তেমনিভাবে চীনের সাথে বাংলাদেশের বৈরিতা ভারতের কাছে পছন্দ। কথাগুলো অবিশ্বাস্য এবং অতিরঞ্জিত মনে হলেও এটাই কিন্তু সত্য এবং বাস্তবতা। কারণ শত্রুর শত্রু বন্ধু এবং শত্রুর বন্ধুও শত্রু। একইভাবে বন্ধুর বন্ধু বন্ধু এবং বন্ধুর শত্রুও শত্রু। বর্তমান বিশ্বের রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে যে ঐক্য এবং দূরত্ব, তার মাপকাঠি কিন্তু এটাই এবং এটার ভিত্তিতেই সম্পর্ক, মেরুকরণ এবং বিভাজন চলছে। মূলত এ নিয়মেই আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এখানে আদর্শ কোনো ফ্যাক্টর নয়। যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু বলেই চীন, রাশিয়া, ভেনিজুয়েলা, উত্তর কোরিয়া সাথে ইরানের ভালো সম্পর্ক। একইভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শত্রু বলেই সিরিয়ার সাথে চীন, রাশিয়া এবং ইরানের ভালো সম্পর্ক। একই সাথে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরাইলে প্রধান শত্রু বলেই হামাস এবং হিজবুল্লাহর সাথে সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের ভালো সম্পর্ক। একইভাবে চীন এবং মায়ানমার উভয়েই যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বৈরী ভাবাপন্ন বিধায়, তাদের মধ্যে রয়েছে মিত্রতা। একইভাবে ভারতের শত্রু হওয়ায় পাকিস্তান হয়েছে চীনের মিত্র। বাংলাদেশের সাথে বহিঃবিশ্বের সম্পর্ক এই বাস্তবতার বাইরে নয়। সুতরাং বৃহৎ এবং পরস্পর বৈরী ভাবাপন্ন দুই রাষ্ট্র চীন এবং ভারতের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে সাবধানে পথ চলতে হবে। কোনো ধরনের আবেগ নয় বরং বাস্তবতার ভিত্তিতে প্রত্যেক রাষ্ট্রকে সম্মান করতে হবে এবং তাদের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশকে তার অবস্থান ঠিক রাখতে হবে এবং স্বকীয়তা বজায় রাখতে হবে। অপরের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি যেমন সম্মান প্রদর্শন করতে হবে, ঠিক তেমনি নিজের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বকেও সুরক্ষিত করতে হবে। নিজের অবস্থানকে অক্ষুণœ এবং সুদৃঢ় করে তবেই ভারত এবং চীনের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। নিজের স্বকীয়তাকে কখনো বিসর্জন দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে ব্যালেন্স অব পাওয়ার এবং ব্যালেন্স অব রিলেশান বজায় রাখতে হবে এবং কারো বিরাগভাজন হওয়া যাবে না। বৃহৎ শক্তিকে কৌশলেই হ্যান্ডেল করতে হবে এবং সাবধানে অগ্রসর হতে হবে। আমরা চাই, সবার সাথে বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা।
পরিশেষে যে কথাটি বলতে চাই, তা হচ্ছে ভারত এবং চীন উভয় রাষ্ট্রের সাথেই আমাদের বন্ধুত্ব রক্ষা করতে হবে। এবং সেটা সম্ভব। যদি আমরা আমাদের স্বকীয়তাকে অক্ষুণœ রাখি এবং এরপর যুক্তি-তর্কের সাথে সামনে অগ্রসর হই তাহলে সেটা অবশ্যই সম্ভব। আর সেই সম্পর্কের ভিত্তিতেই বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হবে। যদি সেই সম্পর্কের ব্যালেন্স নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে বাংলাদেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কোনো অবস্থাতেই বাংলাদেশ যেন ভারত এবং চীনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের শিকার না হয়। চীন-ভারতের দ্বন্দ্বে বাংলাদেশ যেন পিষ্ঠ না হয়। কারো সাথে বেশি বন্ধুত্বও করা যাবে না। আবার কারো বিরাগভাজনও হওয়া যাবে না। আমরা আশা করবো, সরকার এক্ষেত্রে দূরদর্শিতার পরিচয় দিবেন; ভারত এবং চীন উভয়ের সাথেই সুসম্পর্ক বজায় রাখবেন। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভারতীয় এবং চীনা ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ অনেক বেশি প্রয়োজন। বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং নিজস্ব স্বার্থ ও স্বকীয়তাকে অক্ষুণœ রেখে ভারত এবং চীনের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখবে এবং ভারত ও চীনের কারিগরি, প্রযুক্তিগত এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ শান্তি, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
লেখক : প্রকৌশলী ও কলামিস্ট
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।