Inqilab Logo

রোববার ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশি খেসারত দিতে হচ্ছে গ্রাহকদের

সরদার সিরাজ | প্রকাশের সময় : ২১ জুন, ২০২০, ১২:০৩ এএম

গত ১৮ মে প্রকাশিত আইইইএফএ’র প্রতিবেদন মতে, ‘বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র বেশি স্থাপন করায় মোট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মাত্র ৪৩% ব্যবহার করা হয়, বাকি ৫৭% বিদ্যুৎ কেন্দ্র অলস বসিয়ে রেখে কেন্দ্র ভাড়া দেওয়া হয়। এ কারণে বিদ্যুতে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়ছে। গত অর্থ বছরে অলস বসিয়ে রেখে বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে ৯ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে সরকার। ২০৩০ সালেও বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা প্রয়োজনের তুলনায় ৫৮% বেশি থাকবে।’ অনুরূপ কথা সরকারি প্রতিষ্ঠান পাওয়ার সেলের প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে। গত ২২ মে এক দৈনিকে বলা হয়েছে, পাওয়ার সেলের প্রতিবেদন মতে, ‘করোনার কারণে তিন মাসে (এপ্রিল-জুন) বিদ্যুৎ খাতে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২০,২২০ কোটি টাকা। করোনাকাল দীর্ঘ হলে আগামী ডিসেম্বর পর্যন্ত নয় মাসে ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪০,৬০০ কোটি টাকা। চাহিদা হ্রাস পাওয়ায় বিদ্যুৎ বিক্রি কম হওয়ায়, বন্ধ রাখলেও বেসরকারি কেন্দ্রগুলোর রেন্টাল চার্জ প্রদান, প্রকল্প ব্যয় বৃদ্ধিসহ উৎপাদন, বিতরণ ও সঞ্চালন খাতে এই লোকসান গুণতে হবে বিদ্যুৎ বিভাগকে। বিদ্যুৎ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, তারা আপতত বিনা সুদে ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ চেয়েছেন। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, করোনার কারণে বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক ক্ষতি হবে। ক্ষতি পূরণে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে ভর্তুকি বাড়ানোর জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।’ বলা বাহুল্য, বিদ্যুৎ খাতের ভর্তুকির পরিমাণ পাহাড় সমান। এটা শুধু করোনাকাল নয়, বহুদিন আগে থেকেই চলছে। গত ১৮ ফেব্রæয়ারি জাতীয় সংসদে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘গত ১০ বছরে বিদ্যুৎ খাতে সরকার ৫২,২৬০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়েছে।’ করোনার কারণে এর সঙ্গে যদি আরও ৪০,৬০০ কোটি টাকা যোগ হয়; তাহলে, মোট ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ৯৩ হাজার কোটি টাকা, যার দায় পড়বে জনগণের উপর। এই বিশাল ভর্তুকির জন্য প্রধানত দায়ী সর্বোচ্চ মূল্যের রেন্টাল ও কুইক রেন্টালের বিদ্যুৎ ক্রয়। তাই সূচনালগ্ন থেকেই এর বিরুদ্ধে জনমত প্রবল। তথাপিও এটা বন্ধ করা হয়নি। বরং এর মেয়াদ কয়েকবার বাড়ানো হয়েছে। উপরন্তু এটা সব সময় ক্রয় করা হয়েছে টেন্ডার ছাড়াই। তাও আবার নির্দিষ্ট কয়েকটি কোম্পানির কাছ থেকেই ক্রয় করা হয়েছে। সর্বোপরি এর বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা যাবে না বলে আইনও করা হয়েছে! উল্লেখ্য যে, করোনার আগের ভর্তুকি হ্রাস করার জন্য গত ১১ বছরে ১০ বার বিদ্যুতের মূল্য বাড়ানো হয়েছে ব্যাপক হারে। আর নতুন করে যদি ৪০,৬০০ কোটি টাকা যুক্ত হয়; তাহলেও এই বিশাল ভর্তুকি হ্রাস করার জন্য হয়তো বিদ্যুতের মূল্য পুনরায় বাড়ানো হতে পারে। অথচ, স্বল্প ব্যয় সম্বলিত সরকারি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো সংস্কার করে চালু করা হলে অত্যন্ত ব্যয়বহুল এই ভাড়া ভিত্তিক বিদ্যুৎ ক্রয় করা লাগতো না। ফলে ভর্তুকির পরিমাণ পাহাড়সম হতো না এবং বারবার মূল্যও বাড়ানো লাগতো না। তাই টিআইবি সম্প্রতি এক বিবৃতিতে যত শীঘ্র সম্ভব রেন্টাল বিদ্যুৎ পদ্ধতি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহ আইন ২০১০ বাতিল ও পাওয়ার সিস্টেম মাস্টার প্ল্যান-২০১৬ কে নতুন করে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দেশে ২১ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ থাকলেও সরকারের অঙ্গীকার অনুযায়ী ২০২০ সালের মধ্যে দেশের মোট বিদ্যুৎ চাহিদার মাত্র ১০% নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাত থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা লক্ষণীয় নয়। এছাড়া, সঠিক পরিকল্পনার ঘাটতি এবং চাহিদা না থাকার পরও শুধুমাত্র ব্যবসায়িক কারণে একের পর এক কয়লা ও তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের ফলে জ্বালানি খাতে সংকট আরও প্রকট হয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতের দ্বিতীয় প্রকট সমস্যা হচ্ছে, বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, সরবরাহ ব্যবস্থার উন্নয়নের দিকে সেভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ফলে আগের সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমেই ক্যাপাসিটির অনেক বেশি বিদ্যুৎ সরবরাহ করতে হচ্ছে। এতে প্রায়ই মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটছে বিভিন্ন স্থানে। উপরন্তু গ্রাম ও মফস্বলে প্রায়ই লোডশেডিং চলছে। রাজধানীসহ সব শহরে লোডশেডিং কম কিন্তু ভোল্টেজ আপ-ডাউন ব্যাপক।
দেশের বিদ্যুৎ খাতের তৃতীয় মারাত্মক সমস্যা হচ্ছে, কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ও বাংলাদেশের ফুসফুস খ্যাত সুন্দরবনের পাশে নির্মাণ করা হচ্ছে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। যা নিয়ে প্রবল বিরোধিতা আছে বিভিন্ন মহলে। এই বন বারবার দেশের জানমালকে রক্ষা করছে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও বন্যা থেকে। যার হালনাগাদ প্রমাণ আমফান। এই আমফানের আঘাতে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। উপরন্তু বহু মানুষ নিহত ও আহত হয়েছে। অথচ সুন্দরবনের কারণে আমাদের ক্ষতি হয়েছে সামান্যই। এরূপ ঘটনা আগেও হয়েছে বহুবার। যেমন: সিডর, আইলা, রোয়ানু, ফনি, বুলবুল ইত্যাদি। তবুও সেই সুন্দরবনের মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে কয়লা ভিত্তিক রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হচ্ছে (এছাড়া, বনটির বৃক্ষ ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং প্রকৃতি বিধ্বংসী নৌযান চালানো ও শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা হচ্ছে)। এছাড়া অন্যান্য স্থানেও আরও কয়েকটি বড় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হচ্ছে, যা খুবই ব্যয়বহুল ও পরিবেশের প্রধান শত্রু। তাই পরিবেশবাদীরা, বিদ্যুৎ খাতের বিশেষজ্ঞগণ, বুদ্ধিজীবীরা, সর্বোপরি সাধারণ মানুষ কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ব্যাপারে প্রবল আপত্তি জানাচ্ছেন। কিন্তু সরকার এসবে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি। বায়ু মন্ডলের উঞ্চতা ব্যাপক বৃদ্ধির কারণে পৃথিবী ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে, যা রোধ করার জন্য জাতিসংঘের উদ্যোগে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি-২০১৫ হয়। সেই চুক্তি বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করছে। বহু দেশ কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করে দিচ্ছে এবং নতুন করে এ ধরণের প্ল্যান্ট গ্রহণ করছে না, যার অন্যতম হচ্ছে ভারত ও চীন। চীন তার কয়লা খনি পর্যন্ত বন্ধ করে দিচ্ছে। ২০১৯ সালে ৫০০ সক্রিয় কয়লা খনি বন্ধ করে দিয়েছে। দূষণ কমিয়ে আনা ও উত্তোলন খাতে আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে চীন ছোট ছোট কয়লা খনি বন্ধ করছে বলে সিনহুয়ার খবরে প্রকাশ। সম্প্রতি চীনা বিনিয়োগে মিশরে ৬,৬০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার কয়লা ভিত্তিক একটি বিদ্যুৎ প্রকল্প অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করেছে দেশটি। বাংলাদেশ সরকার এসব দিকে ভ্রুক্ষেপ না করে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণে অনড় রয়েছে। তাও বিপুল পরিমাণে বিদেশি ঋণে। অথচ দেশে বিএনপি সরকারের সময়ে প্রণীত কয়লার খসড়া নীতি চূড়ান্ত করা হয়নি। এমনকি দেশে আবিষ্কৃত বিপুল কয়লা মজুদ থাকার পরও তা উত্তোলন না করে ব্যাপক মূল্যে ভারত থেকে আমদানিকৃত কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালানো হচ্ছে ও হবে। অথচ, প্যারিস চুক্তি অনুযায়ী, অদূর ভবিষ্যতেই কয়লার ব্যবহার নিষিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আর সেটা হলে হঠাৎ করে আমাদের বিদ্যুৎ খাতে যেমন ঘোর অন্ধকার নেমে আসবে, তেমনি বিপুল অংকের বিদেশি ঋণও গচ্চা যাবে সুদসহ! তেমনি অবস্থা হতে পারে তেল নির্ভর বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের ক্ষেত্রেও।
করোনা জীবাশ্ম জ্বালানি বন্ধ করার ক্ষেত্রকে কয়েক ধাপ এগিয়ে দিয়েছে। কারণ, করোনা মোকাবেলার লক্ষ্যে বিশ্বের প্রায় সব দেশে লকডাউনের কারণে সবকিছু বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ব্যাপক হ্রাস পেয়েছে। ফলে কার্বন নিঃসরণও ব্যাপক কমে গেছে। ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা গত জানুয়ারি-এপ্রিল ৬৯টি প্রধান কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণকারী দেশের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ‘করোনাভাইরাস মহামারীর মুখে বিশ্বজুড়ে লোকজন ঘরে থাকতে বাধ্য হওয়ায় গড়ে দৈনিক কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের পরিমাণ ১৭% কমেছে। আইইএ’র গ্লােবাল এনার্জি রিভিউতেও ১০০ দিনের বিদ্যুতের চাহিদা বিশ্লেষণ করে গত ৩০ এপ্রিল বলা হয়েছে, ‘এ বছর বিশ্বজুড়ে জ্বালানির চাহিদা ৬% কমবে। তাই কার্বন নিঃসরণের হার ৮% কমবে। গত ১০ বছরের মধ্যে এটাই হতে যাচ্ছে কার্বন নিঃসরণের সর্বনিম্ন হার। করোনা মহামারির কারণে স্থবির বিশ্বে জ্বালানি তেল ব্যবহার প্রায় ৪০% কমেছে। ফলে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ৩৭% ও পিএম ২.৫ মাত্রা ১০% কমেছে। এছাড়া, জীবাশ্ম জ্বালানির বিনিয়োগও ২০% কমেছে বলে সংস্থাটি জানিয়েছে সম্প্রতি। করোনাত্তোরও বিশ্ববাসী এই অবস্থা ধরে রাখার চেষ্টা করবে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে আনার লক্ষ্যে। ফলে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার দিনে দিনে ব্যাপক কমে যাবে আর নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার অনেক বাড়বে তা নিশ্চিত। স্মরণযোগ্য যে, জাতিসংঘে ‘ক্লাইমেট সামিট’ অনুষ্ঠিত হয় গত ২৩-২৪ সেপ্টেম্বর। তাতে সব বক্তা জলবায়ুর ব্যাপক পরিবর্তনের কারণে সৃষ্ট সংকট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এটা প্রতিরোধ করার আহ্বান জানান। এর পরিপ্রেক্ষিতে সম্মেলনে জাতিসংঘ অনুন্নত দেশগুলোর জন্য ২০০ কোটি ইউরোর তহবিল বাড়িয়ে ৪০০ কোটি ইউরো করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ৭৭টি দেশ জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের প্রতিশ্রæতি দিয়েছে। ৬৫টি দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসার প্রতিশ্রুতি দেয়। সর্বোপরি বিশ্বের ১৩০টি ব্যাংক জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পে ঋণ দেয়া থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। এই ব্যাংকগুলোর বাজার মূলধন প্রায় ৪৭ ট্রিলিয়ন ডলার। অ্যামাজনের প্রধান বেজোস ২০৪০ সালের মধ্যে তাঁর কোম্পানিকে কার্বন নিরপেক্ষ করার অঙ্গীকার করেছেন। ইতোপূর্বে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার জন্য খাদ্য, সিমেন্ট, টেলিকমিউনিকেশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন প্রায় ৯০টি কোম্পানি ‘উই মিন বিজনেস’ গঠন করেছে ২০১৮ সালের জুনে, যাদের বাজার মূলধনের পরিমাণ ২.৩ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি। এই জোটের অনেক কোম্পানি ২০৫০ সালের মধ্যে নিজেদের কার্বন নিঃসরণের হার শূন্যে নামিয়ে আনতে সম্মত হয়েছে। এই জোটের অন্যতম হচ্ছে, নসলে, সেইন্ট-গবিন, লরিয়েল ইত্যাদি। গুগল নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ খাতে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করার ঘোষণা দিয়েছে। মাইক্রোসফটও বৈশ্বিক জলবায়ু রক্ষায় ‘ক্লাইমেট ইনোভেশন ফান্ড’ নামে নিজেদের একটি তহবিলে শত কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে গত জানুয়ারিতে। বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডে প্রকাশ, ২০১৯ সালের নভেম্বরের শেষে ভারতে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ৮৫ গিগাওয়াট স্পর্শ করেছে। ২০২০ সালে ভারতের নবায়নযোগ্য জ্বালানি সক্ষমতা ১০০ গিগাওয়াট ছাড়ানোর পথে থাকায় ২০২২ সাল নাগাদ ১৭৫ গিগাওয়াট পরিচ্ছন্ন জ্বালানি সক্ষমতা অর্জনের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রাও দ্রæত অর্জিত হবে। ভারত হচ্ছে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী দেশ। প্রথম হচ্ছে চীন। অনেক দেশে আকাশ,জল ও স্থল পথে যানবাহন চালানো হচ্ছে সৌর বিদ্যুৎ দিয়ে।
আমাদের দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ১৯,৬৩০ মেগাওয়াট। কিন্তু গড়ে প্রতিদিন উৎপাদন হচ্ছে ৭-৮ হাজার মেগাওয়াট। আর চাহিদা না থাকায় বাকি ক্ষমতার কেন্দ্রগুলো বসিয়ে রাখা হচ্ছে। অথচ সারা দেশের গ্রাম ও মফস্বলে বিদ্যুৎ এখনো অনেক লোডশেডিং হচ্ছে প্রতিদিন। দেশে এখন বিদ্যুতের চাহিদা হচ্ছে, ১২ হাজার মেগাওয়াট, ২০৩০ সালে হবে ৩৩ হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালে হবে ৫২ হাজার মেগাওয়াট। ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়ে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ঘণ্টায় ৪৬৪ কিলোওয়াট, যা আগামী ২০৩০ সালে ৮১৫ ও ২০৪১ সালে হবে ১,৪৭৫ কিলোওয়াট। উইকিপিডিয়ার তথ্য মতে, ভারতে ২০১৮-১৯ সালে গড়ে জনপ্রতি বিদ্যুৎ ব্যবহার হয়েছে ১,১৮১ কিলোওয়াট/ঘণ্টায়। অর্থাৎ বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে জনপ্রতি বিদ্যুৎ ব্যবহারের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। এই বিশাল পার্থক্য হয়েছে মূলত দেশের সঞ্চালন ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না হওয়ায়। তাই ব্যাপক লোড শেডিং করতে হচ্ছে। উপরন্তু বহু কেন্দ্র বসিয়ে রেখে বিপুল ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। তাই সঞ্চালন ব্যবস্থা ২০৪০ সাল পর্যন্ত উৎপাদিত বিদ্যুৎ সরবরাহের উপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে এখনই। নতুবা অত্যন্ত ব্যয়বহুল একই কাজ করতে হবে বারবার। তাতেও ভর্তুকির পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি পাবে। অপরদিকে, বিদ্যুতের তার মাটির নিচ দিয়ে নিয়ে যাওয়ার কাজটি দ্রুত শেষ করতে হবে দেশব্যাপী একযোগে। তাহলে লাইন নিরাপদ হবে। প্রি-পেইড মিটারও যথাশিগগির প্রয়োজন মোতাবেক স্থাপন করতে হবে দেশের সর্বত্রই। তাহলে বিলের ঝামেলা ও ভুতুড়ে বিল এবং দুর্নীতি বন্ধ হবে। সিস্টেম লসও কমবে। উপরন্তু সকল গ্রাহককে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী প্রযুক্তি ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে হবে।
অপরদিকে, বিশ্বের সাথে সঙ্গতি রেখে ও পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে দেশে অবশ্যই নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাড়াতে হবে ব্যাপক। সে সুযোগও আছে যথেষ্ট। গত ৩ নভেম্বর ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সভায় উপস্থাপিত ‘কয়লার শ্বাসরুদ্ধ: কার্বন বিপর্যয়ের মুখে বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘সৌরশক্তি ব্যবহার করেই ৫৩ গিগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে বাংলাদেশের।’ আর সম্প্রতি টিআইবি বলেছে, ‘দেশে ২১ হাজার মেগাওয়াট নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের সুযোগ আছে।’ বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনায়ও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ১০% করার কথা বলা হয়েছে। সে মোতাবেক ২০২০ সালের মধ্যে দুই হাজার মেগাওয়াট ও ২০৪১ সালে আট হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন হওয়ার কথা। নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয় অতি নগণ্য ও পরিবেশ বান্ধব। তথাপিও দেশে নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের পরিমাণ খুবই কম।বিদ্যুৎ বিভাগের তথ্য মতে, ‘দেশে সোলার হোম সিস্টেম ব্যবহারের মোট সংখ্যা ৫০ লাখ ৫৯ হাজার ৬৯। আর মোট গ্রাহকসংখ্যা ৫৮ লাখ ৪ হাজার ২২৩ জন। গত ১০ বছরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে যোগ হয়েছে ৩৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ, যার সিংহভাগ হচ্ছে সোলার হোম সিস্টেমের। বর্তমানে সৌরভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৩৪০ মেগাওয়াট ও বায়ু ভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা প্রায় ৪ মেগাওয়াট’। বিশ্বে বর্তমানে স্থাপিত সোলার সিস্টেমের মোট সংখ্যা প্রায় ৬২ লাখ। তন্মধ্যে বাংলাদেশেই প্রায় ৫১ লাখ। কিন্তু এ দেশে যে হারে সোলার সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে, সে হারে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় না। এর এফিশিয়েন্সি মাত্র ০.৬%, যা বিশ্বের চেয়ে ২১% কম। অবশ্য, সায়েন্স ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা দ্বিতীয় প্রজন্মের উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সৌর প্যানেল আবিষ্কার করেছেন ২০১৮ সালের প্রথম দিকে, যার এফিশিয়েন্সি ৪.৩২%। আগামী বছর দুয়েকের মধ্যে এর এফিশিয়েন্সি ১০% এর ওপরে যাবে, যা বর্তমানের চেয়ে ২০ গুণ বেশি বলে জানানো হয়েছিল। কিন্তু সেই দুই বছর শেষ হয়েছে। তথাপিও এ বিষয়ে আর কিছু জানা যায়নি। এই অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানীরা নতুন অধিক কার্যক্ষমতাসম্পন্ন সোলার সেল আবিষ্কার করেছেন, যার কার্যক্ষমতা প্রায় ৫০%।আগে গড়ে সোলার সেলের কার্যক্ষমতার হার ছিল সর্বোচ্চ ১৫-২০%। এখন এই ক্ষমতা কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের নবআবিষ্কৃত এই সোলার সেল দেশে ব্যবহার করতে পারলে সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি হবে। তাই এদিকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার। এছাড়া, দেশে বর্জ্য থেকে অনেক বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সুযোগ রয়েছে। সব শহরেই প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে বর্জ্য সৃষ্টি হয়। গত ২৩ অক্টোবর ঢাকায় একটি অস্ট্রেলীয় কোম্পানির সঙ্গে বর্জ্য বিদ্যুৎ উৎপাদনে সমঝোতা স্মারক সই করেছে কুষ্টিয়া পৌরসভা। এই বর্জ্য দিয়ে তারা প্রতিদিন ১০০ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে। এরূপ ব্যবস্থা দেশের সব শহরেই করার জন্য কঠোর নির্দেশ জারী করা জরুরি। তাহলে বিদ্যুৎ উৎপাদন যেমন বাড়বে, তেমনি শহরের পরিবেশ রক্ষা হবে। এতে আর্থিক কিছু ক্ষতি হলেও পরিবেশের উন্নতি হবে ব্যাপক। অন্যদিকে, বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনেরও ব্যাপক সুযোগ রয়েছে সারা দেশে। বঙ্গোপসাগরের বিশাল উপকুলে কয়েকটি ভাসমান পরমাণু বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট করারও সুযোগ আছে আমাদের। এ ধরনের প্ল্যান্ট রাশিয়া চালু করেছে এবং চীনে প্রক্রিয়াধীন আছে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিদ্যুৎকেন্দ্র


আরও
আরও পড়ুন