চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মাওলানা আবদুর রাজ্জাক
॥ তিন ॥
বুদ্ধিমান তারাই যারা ঈমান গ্রহণ করে এবং সর্বক্ষণ আল্লাহকে স্মরণ করে
এ বিষয়টি ছিল লক্ষণীয় যে, বুদ্ধিমান বলতে কাদেরকে বুঝায়? কারণ, সমগ্র বিশ্বে প্রতিটি মানুষই বুদ্ধিমান হওয়ার দাবিদার। কোন একজন একান্ত নির্বোধ ব্যক্তিও নিজেকে নির্বোধ বলে স্বীকার করতে প্রস্তুত নয়। সে জন্যই কোরআনে কারিম বুদ্ধিমানের এমন কয়েকটি লক্ষণ বাতলে দিয়েছে, যা প্রকৃতপক্ষেই বুদ্ধির মাপকাঠি হিসেবে গণ্য হতে পারে। প্রথম লক্ষণটি হলো আল্লাহতায়ালার প্রতি ঈমান আনা। লক্ষ্য করলে দেখা যায়, অনুভূত বিষয়ের জ্ঞান কান, নাক, চোখ, জিহ্বা প্রভৃতি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দ্বারাও লাভ করা যায়। নির্বোধ জীব-জন্তুর মধ্যেও তা রয়েছে। পক্ষান্তরে বুদ্ধির কাজ হলো, লক্ষ্যণীয় নিদর্শনাদির মধ্য থেকে গৃহীত দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে এমন কোনো সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যা অনুভবযোগ্য নয় এবং যার দ্বারা বাস্তবতার সর্বশেষ উৎকর্ষ লাভ করতে পারে। এই মূলনীতির প্রেক্ষিতে সৃষ্টি জগতের প্রতি লক্ষ্য করলে আসমান-জমিন এবং এর অন্তর্গত যাবতীয় সৃষ্টি ও সেগুলোর ক্ষুদ্র-বৃহৎ সামগ্রীর সুদৃঢ় ও বিস্ময়কর পরিচালন-ব্যবস্থা বুদ্ধিকে এমন এক সত্তার সন্ধান দেয়, যা জ্ঞান-অভিজ্ঞান ও শক্তি-সামর্থ্যরে দিক দিয়ে সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত এবং যিনি যাবতীয় বস্তু সামগ্রীকে বিশেষ হিকমতের দ্বারা তৈরি করেছেন। তারই ইচ্ছায় এ সমগ্র ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। বস্তুত সে সত্তা একমাত্র আল্লাহ জাল্লাহ-শানুহুরই হতে পারে।
মানুষের ইচ্ছা ও পরিকল্পনার ব্যর্থতা সর্বদা সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। কাজেই তাকে এই ব্যবস্থার পরিচালক বলা চলে না। সে জন্যই আসমান ও জমিনের সৃষ্টি এবং তাতে উৎপন্ন বস্তু নিচয়ের সৃষ্টি সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করলে বুদ্ধির সামনে একটি মাত্র পরিণতি সাব্যস্ত হয়ে থাকবে। আর তা হলো আল্লাহর পরিচয় লাভ, তার আনুগত্য এবং তারই জিকির করা। যে ব্যক্তি এ ব্যাপারে শৈথিল্য প্রদর্শন করবে সে বুদ্ধিমান বলে কথিত হওয়ার যোগ্য নয়। কাজেই কোরআন মাজিদ বুদ্ধিমানদের লক্ষণ বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছে, “বুদ্ধিমান হলো সে সমস্ত লোক যারা আল্লাহতায়ালাকে স্মরণ করে বসে, শুনে, ডানে, বায়ে অর্থাৎ সর্বাবস্থায় সর্বক্ষণ আল্লাহতায়ালার স্মরণে নিয়োজিত থাকে।”
এতে বোঝা গেল যে, বর্তমান পৃথিবী যে বিষয়টিকে বুদ্ধি এবং বুদ্ধিমানের মাপকাটি বলে গণ্য করে নিয়েছে, তা শুধুমাত্র একটা ধোঁকা। কেউ ধন-সম্পদ গুটিয়ে নেয়াকে বুদ্ধিমত্তা সাব্যস্ত করেছে, কেউ বিভিন্ন ধরনের কল-কব্জা তৈরি করা কিংবা বাষ্প-বিদ্যুৎকে প্রকৃত শক্তি মনে করার নামই রেখেছে বুদ্ধিমত্তা। কিন্তু সুস্থ বিবেক ও সুষ্ঠু বুদ্ধির কথা হলো তাই, যা আল্লাহতায়ালার নবী-রাসূলগণ নিয়ে এসেছেন। যাতে করে ইলম ও হিকমতের আলোকে পার্থিব ব্যবস্থা পরম্পরা নি¤œ থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ স্তরে উন্নীত হয়ে গিয়ে মর্ধবর্তী পর্যায়গুলোকে উপেক্ষা করেছে। বিজ্ঞান তোমাদেরকে কাঁচা মাল থেকে কল-কারখানা পর্যন্ত এবং কল-কারখানা থেকে বাষ্প-বিদ্যুতের শক্তি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছে। কিন্তু বুদ্ধির কাজ হলো আরও একটু এগিয়ে দেয়া যাতে তোমরা বুঝতে পারো, উপলব্ধি করতে পারো যে, আসল কাজটি কি মাটি, পানি বা লোহা-তামার, না মেশিনের; আর নাইবা সেগুলোর মাধ্যমে তৈরি বাষ্পের। বরং কাজটি তারই যিনি আগুন, পানি ও বায়ুকে সৃষ্টি করেছেন। যার ফলে এই বিদ্যুৎ, এই বাষ্প তোমরা পেতে পারছ। এ ব্যাখ্যার দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, সেসব লোকই শুধু বুদ্ধিমান বলে আখ্যায়িত হওয়ার যোগ্য, যারা আল্লাহকে চেনবেন এবং সর্বাবস্থায় সর্বক্ষণ তাকে স্মরণ করবেন।
সার কথা, আল্লাহতায়ালার সৃষ্টি ও সৃষ্ট জগতের ওপর চিন্তা-গবেষণা করে তার মহাত্ম ও কুদরত সম্পর্কে অবগত হওয়া একটি মহৎ ও উচ্চ পর্যায়ের ইবাদত। সেগুলোর মধ্যে গভীর মনোনিবেশ করে তা থেকে কোন শিক্ষা গ্রহণ না করা একান্তই নির্বুদ্ধিতা। উল্লিখিত আয়াতের শেষ বাক্যে আল্লাহর নিদর্শনসমূহ চিন্তা-গবেষণা করার ফলাফল বাতলে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, আল্লাহতায়ালার সীমাহীন সৃষ্টির ওপর যে লোক চিন্তাভাবনা করে সে লোক এ অবস্থায় না পৌঁছে পারে না যে, এসব বস্তু-সামগ্রীকে আল্লাহ নিরর্থক সৃষ্টি করেননি বরং এসবের সৃষ্টির পেছনে হাজারো তাৎপর্য নিহিত রয়েছে। সে সমস্তকে মানুষের সেবায় নিয়োজিত করে দিয়ে মানুষকে চিন্তাভাবনা করার আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে যে, সমগ্র পৃথিবী তাদের কল্যাণের জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে এবং তাদেরকে সৃষ্টি করা হয়েছে একমাত্র আল্লাহতায়ালার ইবাদত-আরাধনার উদ্দেশ্যে। এটাই হলো তাদের জীবনের লক্ষ্য।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।