চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
মাওলানা আবদুর রাজ্জাক
॥ এক ॥
মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব। চিন্তা-গবেষণার মহান দায়িত্ব দেয়া হয়েছে মানুষকে। চিন্তা-গবেষণার যোগ্যতা হিসেবে দেয়া হয়েছে বিবেক ও জ্ঞানের শ্রেষ্ঠত্ব। তাদেরকে সে জ্ঞান ও বিবেক খাটিয়ে স্বীয় জীবনের কল্যাণের পথ উন্মোচন করতে চিন্তা-গবেষণার তাগিদ প্রদান করা হয়েছে। পবিত্র কালামে পাকে মহান আল্লাহ ঘোষণা করেছেন, “তবে কি তারা লক্ষ্য করে না উটের প্রতি, কীভাবে তা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং আকাশের প্রতি, কীভাবে তাকে উঁচু করা হয়েছে এবং পাহাড় সমূহের প্রতি, কীভাবে তাকে প্রথিত করা হয়েছে এবং ভূমির প্রতি, কীভাবে তা বিছানো হয়েছে”। (সূরা গাশিয়া ১৭-২০)
ইসলাম চিরন্তন শাশ্বত জীবন ব্যবস্থা। মানুষের প্রয়োজনীয় সকল কাজের দিকনির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। তাই ইসলামের আলোকে জীবন পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়, সেগুলোর সমাধানকল্পে গবেষণা একটি অপরিহার্য বিষয়।
গবেষণা কী?
গবেষণা হলো সত্য অনুসন্ধানের বৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়া। যার সাধারণ অর্থ হলো সত্য ও জ্ঞানের অনুসন্ধান। এর সমার্থবোধক শব্দ হলো জিজ্ঞাসা, তদন্ত, অন্বেষা, অনুসন্ধান, বিকিরণ এবং নিরূপণ।
গবেষণা হলো জিজ্ঞাসার উত্তর অন্বেষণের লক্ষ্যে তদন্ত করা, তদন্তের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা। সংগৃহীত তথ্যের চিত্র অনুসন্ধান করে জিজ্ঞাসার উত্তর বের করা।
অন্যভাবে বলা যায়, গবেষণা হলো পুনঃ পুনঃ সন্ধান অর্থাৎ তুলনামূলক উন্নত পর্যবেক্ষণ করা, ভিন্ন প্রেক্ষিতে খোঁজা এবং বাড়তি জ্ঞানের সংযোজন করার সুশৃঙ্খল ব্যবস্থা।
কোনো নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে প্রাসঙ্গিক তথ্য সংগ্রহের জন্য বৈজ্ঞানিক ও সুসংবদ্ধ অনুসন্ধান হলো গবেষণা।
আরবিতে একে ‘বাহাস’ বলা হয়। যার অর্থ হলো মাটির ভিতর কোনো কিছু তালাশ করা, খুঁজে বের করা ইত্যাদি।
ইমাম রাগিব ইস্পাহানি বলেন, “বাহাস অর্থ হলো উন্মুক্তকরণ এবং কোন কিছুর অনুসন্ধান করা”। প্রকৃতপক্ষে গবেষণা বৈজ্ঞানিক তথ্যানুসন্ধানের একটি আর্ট।
“গবেষণাকে ইংরেজিতে বলা হয় ৎবংবধৎপয। উক্ত শব্দটি দুটি শব্দ ৎব এবং ংবধৎপয দ্বারা গঠিত। প্রথম শব্দের অর্থ হলো পুনঃ পুনঃ আর দ্বিতীয়টির অর্থ হলো অনুসন্ধান করা, কিছু খুঁজে বের করা। এক কথায় জ্ঞানের কোন শাখায় নতুন তথ্য সংগ্রহের জন্য ব্যাপক ও স্ব-যতœ তথ্যানুসন্ধান হলো গবেষণা”।
“রেডম্যান ও মরী বলেন, নতুন জ্ঞান আহরণের সুসংবদ্ধ চেষ্টা-প্রচেষ্টা হলো গবেষণা”।
“রাস্ক বলেন, গবেষণা একটি বিশেষ অভিমত যা মানস কাঠামোর অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিভঙ্গি। গবেষণায় যেসব প্রশ্নের অবতারণা করা যায় এর উদ্ঘাটন আগে কোনো দিন হয়নি এবং সেই গবেষণার মাধ্যমে সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়”। “গ্রীণ বলেন, জ্ঞানানুসন্ধানের আদর্শিত বা মানসম্মত পদ্ধতির প্রয়োগই গবেষণা”।
“সায়্যেদ শরীফ বলেন, দুটি বস্তুর ভিতর ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাবের দলিলের মাধ্যমে সম্পর্ক স্থাপনের নাম হলো গবেষণা”।
“ফানদালীল বলেন, উপস্থিত জ্ঞানের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যে সু-শৃঙ্খল অনুসন্ধান বা পর্যালোচনা, যা উদ্ধৃতি, প্রকাশ ও প্রচারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয় তা হলো গবেষণা।
ইসলামী গবেষণা
ধর্মীয় গবেষণা হলো এমন সকল বিষয় যাতে জীবনের যে কোনো দিক সংশ্লিষ্ট বিধি-বিধান স্পষ্টরূপে বর্ণনা করার প্রয়াস চালানো হয়। নিখুঁত পদ্ধতি, সঠিক উপলব্ধি, নির্ভুল বুঝের ভিত্তিতে গভীর অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে দীনের আলোকে কোনো সমস্যার সমাধান করার প্রচেষ্টা হলো ধর্মীয় গবেষণা। (লামহাত ফিল মাকতাবাহ)
“ড. উজ্জাজ আল খতবি বলেন, ইসলামী গবেষণা এমন সকল বিষয়ভিত্তিক অধ্যয়ন যা জীবনের যে কোনো একটি বিশেষ দিক সংশ্লিষ্ট বিধান, স্পষ্টভাবে বর্ণনা করবে। অথবা নির্ভুল পদ্ধতি, সঠিক উপলব্ধি, গভীর নিরীক্ষণ, যথাযথ অনুধাবনের ইসলামী মূল্যবোধ ও এর বিধানের মধ্য দিয়ে সামাজিক, অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের প্রয়াস চালাবে”।
“যাকি উদ্দীন শাবান বলেন, শরীয়তের কর্ম সম্পর্কিত বিধিমালা তাফসিলি দলিল থেকে বের করার জন্য ফিকাহ শাস্ত্রবিদদের সামর্থ্য নিয়োজিত করা”।
“আধুনিক উসূলবিদ আবদুল ওয়াহহাব বলেন, শরীয়তের বিস্তারিত দলিল-প্রমাণের মাধ্যমে শরীয়তের কোনো হুকুম বের করার চেষ্টা ও শ্রম ব্যয় করা হলো গবেষণা”।
ইসলামে গবেষণার গুরুত্ব
ইসলাম ধর্মে গবেষণার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কোরআন ও হাদিসের বিভিন্ন ধরনের গবেষণার ব্যাপারে বিশেষভাবে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে। পবিত্র কালামে পাকের অমোঘ ঘোষণা “নিশ্চয়ই মহাকাশ ও পৃথিবী সৃষ্টিতে এবং দিবা-রাত্রির আবর্তনের মধ্যে বোধ সম্পন্ন লোকদের জন্য নিদর্শন রয়েছে। যারা দাঁড়িয়ে, বসে ও শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে এবং মহাকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টির বিষয়ে চিন্তা-গবেষণা করে এবং বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! এ সবকিছু তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। সব পবিত্রতা একমাত্র তোমারই। আমাদের তুমি দোজখের শাস্তি হতে বাচাও।” (সূরা আল-ইমরান ১৯০-৯১)
কোরআন নাজিলের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কালামে পাকে আল্লাহতায়ালা বলেন, “আমি একে আরবি ভাষায় কোরআন রূপে অবতীর্ণ করেছি, যাতে তোমরা বুঝতে পারো।” (সূরা ইউসুফ-২)
যারা চিন্তাভাবনা করে তাদেরকে জ্ঞানী আর যারা চিন্তা-ভাবনা করে না তদেরকে মূর্খ আখ্যায়িত করে কালামে পাকে আল্লাহ বলেন “আপনি বলে দিন, অন্ধ ও চক্ষুমান কি সমান হতে পারে? তোমরা কি চিন্তা করো না?” (সূরা আনআম-৫০)।
মহান আল্লাহ আরো বলেন “তবে কি এরূপ ব্যক্তি সে ব্যক্তির সমতুল্য হতে পারে? যে রাতের মুহূর্তগুলোয় ইবাদত করে, কখনও সিজদা অবস্থায়, কখনও দাঁড়িয়ে। যে আখেরাতকে ভয় করে এবং নিজ প্রতিপালকের রহমতের আশা করে। বল! যে ব্যক্তি জানে আর যে জানে না উভয় কি সমান? তার উপদেশ গ্রহণ তো কেবল বোধসম্পন্ন ব্যক্তিরাই করে” (সূরা জুম‘আ-৯)।
জ্ঞানী ও গবেষকদের মর্যাদা সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা জ্ঞানপ্রাপ্ত আল্লাহ তাদের মর্যাদা ঊর্ধ্বে করে দেবেন”। (সূরা মুজাদালা-১১)
সূরা বাকারার ২৬৬ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “এমনিভাবে আল্লাহ তোমাদের জন্য নিদর্শনসমূহ বর্ণনা করেন, যাতে চিন্তাভাবনা কর”।
সূরা নাহলের ৪৪ নং আয়াতে আল্লাহ বলেন, “সে রাসূলদেরকে উজ্জ্বল নিদর্শন ও আসমানি কিতাব দিয়ে পাঠানো হয়েছিল। হে নবী! আমি আপনার প্রতিও এই কিতাব নাজিল করেছি, আপনি মানুষের সামনে সেসব বিষয় ব্যাখ্যা করে দেন, যা তাদের প্রতি নাজিল করা হয়েছে এবং যাতে তারা চিন্তা করে।” (সূরা রূম-২২)
যারা জ্ঞান গবেষণার কাজে ব্যস্ত থাকবেন, আল্লাহ তাদের জিহাদ বা সিয়াম পালন করার মতো সাওয়াব দান করবেন। তাই রাসূল (সা.) এরশাদ করেন, শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করা জিহাদতুল্য। (আত-তারগীবওয়াত তারহীব) এই গবেষণার দ্বারা মানুষ কোনো সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হোক বা না হোক প্রত্যেকের বিনিময়ে আল্লাহ সাওয়াব রেখেছেন।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, “কোনো বিচার ফয়সালা দেয়ার ব্যাপারে ইজতেহাদ করে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হলে তাকে দুটি সাওয়াব আর ইজতেহাদে ভুল করলে তাকে একটি সাওয়াব দেয়া হয়।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।