Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

নতুন শ্রমবাজার অনুসন্ধান এবং আগাম অর্থনৈতিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ৫ মে, ২০২০, ১২:০৪ এএম

মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে বাংলাদেশের শ্রমবাজার হুমকির মধ্যে পড়েছে। দেশগুলোতে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশের শ্রমিকরা দেশে ফেরার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। দেশগুলো শ্রমিক ফিরিয়ে নেয়ার তাকিদ দেয়া শুরু করেছে। শুধু সউদী আরব থেকেই ১০ লাখ শ্রমিক ফেরত নেয়ার জন্য দেশটি বাংলাদেশকে বলেছে। দেশগুলো এখন এমন হুমকি দিচ্ছে, নিজ নাগরিকদের ফিরিয়ে নাও, নাহলে বিভিন্নভাবে তাদের সমস্যায় ফেলা হবে। ফলে বাংলাদেশের শ্রমিকদের মধ্যে চরম অনিশ্চয়তা এবং আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্যের বাজার ধ্বসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে এক সউদী আরবেই নারী-পুরুষ মিলিয়ে বাংলাদেশী শ্রমিক রয়েছে ৪১ লাখ ৪৪ হাজার ৯৭২ জন। অন্যান্য দেশগুলোতেও কয়েক লাখ শ্রমিক রয়েছে। এসব দেশ এতদিন বিদেশি শ্রমিক নির্ভর হয়ে কাজ চালাত। এখন তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ২০৩০ সালের মধ্যে নিজেদের শতকরা ৭০ ভাগ শ্রমিক নিয়োগ করবে। অর্থাৎ তারা এখন নিজেদের লোক দিয়ে উন্নয়নমূলক কাজ চালাবে। ইতোমধ্যে সউদী আরব ‘সউদীয়ান’ পলিসি অবলম্বন করেছে। তারা তাদের কাজে নিজেদের নাগরিকদের নিয়োগ করবে। ফলে যে মধ্যপ্রাচ্য দেশের রেমিট্যান্সের অন্যতম প্রধান উৎস হিসেবে বিবেচিত, তা এখন অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। নিশ্চিতভাবেই এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতে পড়বে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, করোনাভাইরাস বিশ্ব অর্থনীতিকে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে। ‘তরল স্বর্ণ’ খ্যাত যে তেল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে যুদ্ধবিগ্রহ চালিয়ে যাচ্ছে, সেই তেলের দামই যুক্তরাষ্ট্রে ব্যারেল প্রতি শূন্য ডলারে নেমে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যের অর্থনীতির ভিত্তি এই তেলের দামও সর্বনিম্ন পর্যায়ে বিরাজ করছে। ইউরোপের দেশগুলো করোনা সামাল দিতে গিয়ে লকডাউন করে সব বন্ধ করায় অপূরণীয় ক্ষতির মুখে পড়েছে। এই ক্ষতি যাতে আর প্রলম্বিত না হয়, এ জন্য নিরুপায় হয়ে করোনার প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই লকডাউন ধীরে ধীরে তুলে দিচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র একদিকে মৃত্যু ও আক্রান্তের মিছিল, অন্যদিকে লকডাউন তুলে দেয়ার মধ্য দিয়ে চলছে। এসব করা হচ্ছে শুধু বিপুল অর্থনৈতিক ক্ষতি থেকে রক্ষা এবং আগামীর অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা সৃষ্টির কথা মাথায় রেখে। উন্নত বিশ্বসহ করোনায় আক্রান্ত প্রতিটি দেশই করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক মন্দাবস্থার কথা মাথায় রেখেই এখন পরিকল্পনা করছে। আমাদের দেশে করোনা মোকাবেলায় সরকার ইতোমধ্যে ৯৫ হাজার কোটি টাকার বেশি আর্থিক প্রণোদনা ঘোষণা করেছে। এসব প্রণোদনা আপৎকালীন পরিস্থিতি সামাল দিতে সহায়ক হলেও এবং অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টি এখনো পুরোপুরি বোঝা না গেলেও করোনা পরবর্তী পরিস্থিতিতে যে কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে, তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না। অর্থনীতিবিদরা বর্তমান অর্থনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থাকে ‘আর্টিফিসিয়াল স্থিতাবস্থা’ বলে আখ্যায়িত করছেন। করোনা পরবর্তী সময়ে অর্থনীতির টানাপড়েনের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠবে। তার কিছু আলামত এখনই প্রকাশিত হচ্ছে। গার্মেন্ট খাতের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়। অন্যান্য শিল্পখাতের উৎপাদন স্থবির। আর্থিক খাতগুলোর লেনদেন ও বিনিয়োগ অচল অবস্থায় রয়েছে। এসব খাত পরিপূর্ণভাবে চালু হতে কত সময় লাগবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। ফলে করোনা পরবর্তী সময়ে খরচ কমাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে অনিবার্যভাবে শ্রমিক-কর্মকর্তা ছাঁটাই করতে হবে। এমনকি দেখা যাবে, বাসা-বাড়িতে যারা বেতন দিয়ে কাজের লোক রাখতেন, তারাও খরচ কমাতে তাদের বাদ দেবেন। এছাড়া দোকানপাট বন্ধ থাকায় লাখ লাখ দোকান কর্মচারি ছাঁটাইয়ের কবলে পড়বে। সবমিলিয়ে দেশে বেকারের সংখ্যা অস্বাভাবিক হয়ে যাবে। এর চাপ পুরো অর্থনীতির ওপর পড়বে। এর সাথে যদি বিদেশ থেকে লাখ লাখ শ্রমিক ফেরত আসা শুরু করে, তবে একদিকে যেমন রেমিটেন্স কমবে, তেমনি দেশের অর্থনীতিও দুর্বল হবে। করোনার এ সময়ে অর্থনীতির এই চাপ এবং মন্দাবস্থার বিষয়টি খুব একটা বোঝা না গেলেও করোনা পরবর্তী সময়ে তা যে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, তাতে সন্দেহ নেই। যদিও যুক্তরাজ্যের দ্য ইকোনোমিস্ট পত্রিকার করা এক তালিকায়, করোনা সংকটে অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশ শীর্ষ দশে রয়েছে, তারপরও করোনা পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতি যে যথেষ্ট কঠিন হয়ে দাঁড়াবে, তা আন্দাজ করা যায়।
বন্যার সময় এর ক্ষয়-ক্ষতি পুরোপুরি বোঝা না গেলেও, বন্যা চলে যাওয়ার পর বোঝা যায়, সে কী ভয়ংকর থাবা বসিয়ে দিয়ে গিয়েছে। করোনার বিষয়টি এখন এমনই হয়ে দাঁড়িয়েছে। করোনা প্রতিরোধ নিয়ে ব্যস্ত থাকা এবং আর্থিক প্রণোদনা ও ত্রাণ বিতরণের কারণে অর্থনীতির ভয়াবহ ক্ষতির বিষয়টি এখন পুরোপুরি উপলব্ধি করা যাচ্ছে না। পরবর্তীতে এর প্রতিক্রিয়া যে অত্যন্ত ভয়াবহ হবে, তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। মধ্যপ্রাচ্যে আমাদের রেমিট্যান্সের যে বিশাল বাজার, তা ধীরে ধীরে ক্ষয়ীষ্ণুতার দিকে ধাবিত। মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতার কারণেই এ বাজার সংকুচিত হচ্ছে। তবে আমাদেরকেও প্রবাসের শ্রমবাজার ধরে রাখতে বিকল্প বাজার খুঁজতে হবে। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বিকল্প হিসেবে আফ্রিকার দেশগুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। এ দেশগুলো হতে পারে আমাদের শ্রমবাজারের নতুন ডেস্টিনেশন। সরকারের উচিৎ হবে, নির্ভরযোগ্য ম্যানপাওয়ার প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে বসে আলাপ-আলোচনা করে নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি এবং তার সম্ভাবনা নিয়ে এখনই পরিকল্পনা করা, যাতে একদিকে মধ্যপ্রাচ্যের বাজার সংকুচিত হলেও অন্যদিকের বাজার উন্মুক্ত হয়। এতে শ্রমবাজার হারানোর শঙ্কা যেমন ঠেকানো যাবে, তেমনি রেমিট্যান্সেরও উন্নতিও ঘটবে। পাশাপাশি করোনা পরবর্তী সময়ে কোন কোন খাত ও শ্রেণী সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার এবং কী ধরনের অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হবে, তা আগাম চিন্তা করে সরকারকে এখনই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।



 

Show all comments
  • শওকত আকবর ৫ মে, ২০২০, ৯:৪৩ এএম says : 0
    প্রিয় সম্পাদক সাহেব,আপনার লেখার প্রতিটি লাইন পড়েছি।আমি বেশ বুঝতে পাড়ছি যে,এক অনাখাংঙ্খিত অনিশ্চিত ভবিস্বাতের মুখোমুখি দাড়িয়ে আছি।আমাদের জন্য এক ভয়াবহ দুর্ভিখ্খ ও দুঃসহ জীবন অপেখ্খা করছে।আপনার লিখনি যেন আমাকে নতুন পথ দেখাতে শুরু করছে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: শ্রমবাজার

১৭ নভেম্বর, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন