শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
মুক্তিযুদ্ধ শুরু ও শেষ হয়েছে অনেক আগে। দেশ এখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। অসংখ্য নারীদের প্রশংসনীয় কর্ম উদ্যম সারা পৃথিবীকে অবাক করে দিচ্ছে। তাদের অবাক করা কর্মকান্ড ও সফলতার ফল স্বরুপ গ্রাম,গঞ্জ থেকে শুরু করে আত্মজার্তিক ক্ষেত্রে পর্যন্ত নারী সমাজের ক্ষমতায়নের পথ সম্প্রসারিত করে দিয়েছে। নারী যে এখন গৃহবন্দি প্রাণী নয় আর বেগম রোকেয়ার অবরোধ বাসিনীও নয় তা লোক সমাজে তারকা জ্যোতির মতো আলো দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে বিশ্বদরবারে ।
কবি নজরুল ইসলাম কিশোর বয়স থেকে নারী বান্ধব নামে পরিচিত। নারীদের কাছে সম্মানের আসনে অধিষ্ঠিত। সমাজে তাদের দুঃখ-দুর্দশা,লাঞ্চনা-বঞ্চনা দেখে বলেছিলেন-
“সাম্যের গান গাই,আমার কাছে পুরুষ-রমণী কোন ভেদাভেদ নাই।”
আরো বলেছেন-
যে যুগে পুরুষ দাস ছিল নাক,নারীরা আছিল দাসী
বেদনার যুগ,মানুষের যুগ,সাম্যের যুগ আজি
কেহ রহিবেনা বন্দী কাহারও উঠেছে ডঙ্কা বাজি।”
বিশ্ব ব্যাপি নারীদের ক্ষমতায়ন দেখে কবি নজরুলের সেই বাণী বারবার মনে পড়ে।
শরীর ও মন মানসিকতার তারতম্যে নারী ও নর আলাদা নামে পরিচিত হলেও উভয়েই আল্লাহ শ্রেষ্ট জীব মানুষ। আল্লাহর পরম অনুগ্রহে পুরুষ নারীকে সহযাত্রী পেয়ে সৃষ্টির সূচনা লগ্ন থেকে জীবনের নৌকায় উজান পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরম শক্তি অর্জন করেছে। বেঁচে থাকার স্বার্থে নারী ও পুরুষ হাতে হাত রেখে খাদ্য উৎপাদনের ব্যবস্থা ধরিত্রিকে মনুষ্য বাসের উপযোগী করে তুলেছে। সেই মহতী নারীকে পৃথিবীর ইতিহাসে নানা ধর্মে মানুষ বলে স্বীকার করতে চায়নি। আত্মাহীন,বিবেকহীন প্রাণী বলে অভিহিত করেছে।
বহুদিন ধরে অপমানিত,লাঞ্চিত,পশুত্বের স্তরে নিমর্জিত এই নারীকে প্রথমেই মহান মর্যাদায় অভিষিক্ত করেছেন আমাদের নবীজি। তিনি বলেছেন-“মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত।”
“নারী ও পুরুষ একে অপরের ভূষণ”সর্বশ্রেষ্ট মহামানবের এই অমিয় বাণী যে নারীদের জীবনকে ইসলামের শুরু থেকে মহিমান্মিত করেছে। আমাদের মহাগ্রন্থ কুরআনের পঙক্তিতে পঙক্তিতে নারী জাতিকে নানা ভাবে নন্দিত করা হয়েছে।
তাতেই আমরা বুঝতে পারি নারী জীবনের শুরু থেকে মহান মর্যাদার অধিকারি ছিলেন এবং তার প্রমাণও আমরা পাই ইসলামি যুগে আব্বাসীয় যুগে এবং মোগল আমলে। কিন্তু দূভাগ্যক্রমে আস্তে আস্তে আমাদের নারী সমাজ এই প্রশংসনীয় মহান মর্যাদা থেকে বিচ্যুত হয়। কুরআনে স্পষ্টত বলা আছে-নারী ও পুরুষ উভয়েই সমান। কাজেই নারী ও পুরুষ উভয়কে নিজ নিজ কর্ম ক্ষেত্রে ভালো কাজ করতে হবে। পৃথিবীর কর্মক্ষেত্রে নিজের পরিবার,সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য যত ভালো ও মঙ্গলজনক কাজ করে যেতে পারবে। তাতেই শুভ এবং সুন্দরের অভিযাত্রী হবে।
কিন্তু বহুদিন দুর্ভাগ্যক্রমে বাংলাদেশের পুরুষ শাসিত সমাজ,অশিক্ষায়-কুসংস্কার এবং একশ্রেণীর বর্ণবাদী হিন্দু মনমানসিকতার কারণে বৃটিশ আমলের শেষের দিক থেকে বাঙালি মুসলমানদের জীবনে অনেক অধঃপতন নেমে আসে। প্রকৃত জ্ঞান ও শিক্ষা থেকে তার বঞ্চিত হয়। নারীদের সমঅধিকার পালনের কোন সুযোগ দেয়নি। লেখাপড়ায়,জ্ঞান-গরিমায় মুসলিম মেয়েরা ছিল বিশেষ করে অবহেলিত আমাদের এই দেশে। অল্পকিছু কুলীন অভিজাত শ্রেণীতে দেখা যায় কয়েকজন মেয়ে অদম্য উৎসাহ নিয়ে এবং পারিবারিক পরিবেশের বদৌলতে নিজেদের কে বিকশিত করার সুযোগ পেয়ে এই দেশের নারী জাগরণের পথকে সুগম করেছে। তারই ফলশ্রুতিতে আজকের বাংলাদেশে নারীদের জীবনে বিজয়ের মহতী উৎসব । মুসলমান এই নারীদের সূচনা লক্ষ্য করা যায় পাকিস্থান সৃষ্টির পর থেকে। কিন্তু খুব ধীরে ধীরে। তাও ছিলো শহর কেন্দ্রিক এবং একাডেমিক শিক্ষার ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার এই যে,পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে প্রথম ১৯৫২ সালে প্রতিবাদী হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এগিয়ে আসে পরবর্তীতে গোটা বাংলাদেশের মেয়েরা ১৯৭১ সাল
স্বাধীনতার দীপ্য চেতনায় উৎজীবিত হয়ে যে ভাবে দুঃখ,দারিদ্র,বিপত্তি,পরিবার ও সমাজের নানা রকমের বেড়াজাল ডিঙিয়ে নিরস্ত্র,নিঃসহায় অবস্থায় অসীম সাহসিকতায় স্বাধীনতাকে সফল করার লক্ষ্যে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অজানা এক আনন্দ মঞ্জিলে দিকে সম্পূর্ণ এগিয়ে গিয়েছিল এখন ভাবতে অবাক লাগে এই শ্রেণীর হাজার হাজার শিশু,কিশোরি,যুবতি,নারীদের কথা। যদিও এই অজানা বঞ্চিত,লাঞ্চিত,নির্যাতিত নারী গোষ্টিকে কোন কালে আজ পর্যন্ত অনেকেই জানি না। কিন্তু শিকার করতেই হয় এই দুঃসাহসি নারীদের অসীম সাহসিকতার কারণেই (পুরুষদের কথা বাদ দিয়ে বলছি) বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের মানচিত্র মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে সম্প্রতি স্থান করে নিয়েছে।
খরস্রোতা নদীর মতো বাংলাদেশের উন্নয়নের ধারাতে প্রবাহিত করার পিছনের সমগ্র নারী সমাজের অবদান থাকলেও কিছু কিছু নারী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর উগ্র পৈশাচিকতাকে উপেক্ষা করে যে সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছিলো তাদের কথা খুব কমই আমরা সভা-সমিতিতে উচ্চারণ করি। তাদের প্রতি যে আমাদের যে অপরিশোধ্য কত ঋণ তা স্বীকার করিতো নাই আবার মনেও রাখি না। তেমন একটি বীর সাহসি কিশোরি মেয়ের কথা অনেক অনেক বছর পরে হৃদয় মথিত আবেগে, সসঙ্কিত,বিনম্র,ভক্তি ও প্রশংসায় বলতে চাই। যারা এই সাহসিকা নারীর কথা জানি না,জানার চেষ্টাও করি না তাদের জানার জন্য আমার এই কলম ধরা। উপরে নারীদের সমদ্ধে অনেক কথাই বলেছি। এখন এমন একটি কিশোরি নারীর কথা বলবো মুক্তিযুদ্ধের সময় বয়স ছিল চৌদ্দ। বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজিবপুর উপজেলা শংকর মাধবপুর ইউনিয়নে। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনী যখন রাজধানী ঢাকায় হায়েনার মতো বাঙ্গালিদের উপর অত্যাচারের স্টিম রোলার চালাচ্ছিলো তখন মানুষ দিশেহারা ও বাস্তুহারা হয়ে দিগি¦দিক জ্ঞানশুন্য অবস্থায় চারিদিক পাগলের মতো নিরাপদ আশ্রয়ের আশায় ছুটাছুটি করছিলো অজানার পথে ধাবিত হচ্ছিলো সেই পথেরই একজন এই কিশোরী মেয়ে তারামন। কিছুদিন সে ও তার পরিবার নিজ গ্রাম থেকে অন্যত্র সরে গিয়ে পাশের গ্রামে অস্থায়ী ভাবে সহযোগিতা ও সহানুভূতির আড়ালে নিজেদের ঠাই করে নেয়।
এই সময় অভুক্ত কিছু মুক্তিযোদ্ধারা সঙ্গপনে রান্না করার জন্য এই মেয়ের তল্লাশে ছিলো। ঠিক এমন সময় পেয়ে গেলো তারামনকে। সে অত্যন্ত খুশি মনে এবং এটা দায়িত্ব মনে করে অভুক্ত মুক্তিযোদ্ধাদের রান্নার ভার কাধেঁ তুলে নেয়। তারামনকে এই দায়িত্বের দিয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদেরই একজন, নাম-মুহিব হাবিলদার। তারামনের মাকে অনেক কষ্টে রাজি করিয়ে মুহিব হাবিলদার তারামনকে ধর্ম মেয়ে হিসেবে গ্রহণ করে। এই ভূমিকা পালনে আরো অনেক মুক্তিযোদ্ধার সাহায্য ছিলো। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলো আজিজ মাস্টার। কিছুদিন পরে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে থাকতে থাকতে কিশোরী তারামনের মধ্যেও সংগ্রামের স্পৃহা জেগে ওঠে। যাদের রান্না করতো তাদের সম্মতিতে এবং অনুপ্রেরণায় তারামন বিবিকে যেতে হলো কোদালকাঠির দশঘরিয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে। সেখানে প্রথমে সে কাজ করতো বাসন পরিস্কার,রান্না ও অস্ত্র পরিস্কার। পিতৃহীন এই মেয়ের সংসার ছিলো ভারী। ভাইবোন ছিলো সাতজন। এদের সকল চিন্তা মাথায় রেখেও উপরি এই সব দায়িত্বের স্থান থেকে বিচ্ছুত হয়নি। ধর্ম বাবা এবং সেই আশ্রয় দাতা মুহিব হাবিলদার তাকে অস্ত্র চালানোর প্রাথমিক প্রশিক্ষণ দেয়। রাইফেল চালানো বিষণ কষ্টসাধ্য ব্যাপার হওয়ায় শেষে তাকে স্টেন গান চালানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কর্ম যন্ত্রনায় কিশোরী এই নারী মা ভাইবোনের সমস্ত দায়িত্ব পালন করেও হয়ে ওঠে একজন লড়াকু সৈনিক। তার জীবন পরিক্রমা এগোতে থাাকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশ মুক্ত করার স্বপ্নে। রবীন্দ্রনাথ এর মৃন্ময়ীর মতো গাছের ডালে ডালে,পথে প্রান্তরে নিজের ইচ্ছে মতো ঘুরে বেড়ানোর সময় হলেও সে কিন্তু তার মধ্যে একটি কঠিন দায়িত্বে ব্রত নিয়ে ছিলো। লাবণ্য ভরা মুখে নবীণ কিশোরী সবুজ শ্যামল গ্রামে দশজন কিশোরীর ভান করে গাছ বসে থাকতো ঠিকই কিন্তু তার চোখ থাকতো হানাদারদের গতিবিধির উপর। মাঝে মাঝে পাগলির অভিনয় করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত। মুখে কালি দিয়ে উপুড় হয়ে গড়াতে গড়াতে একেবারেই পাক হানাদারদের কাছে চলে যেত। অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে শক্রদের অবস্থান,অস্ত্রের গোডাউন, কোথায় গিয়ে অস্ত্র চালাতে হবে এই সব তথ্য অসীম সাহস বুকে ধরে সংগ্রহ করে আনত। তারপর সুযোগ বুঝে পরিকল্পনা অনুযায়ি শুরু করতো অপারেশন। একদিন ঘটে গেলো একটি মজার ঘটনা মনে হলো রবীন্দ্র নাথের মৃন্ময়ী যেনো এখানে কিশোরী তারামন বিবি হয়ে সামনে এসে দাড়াল। কিন্তু তারামন বিবি গ্রামের দুদার্ন্ত প্রকৃতির পাড়া বেড়ানো সাধারণ গ্রামীণ মেয়ে নয়। দেশ বাঁচানোর সংগ্রামে নানান ছলচাতুরির পারদর্শি একজন গ্রামীণ সাহসি কিশোরী। একদিন গ্রামের দশ পরিবারের মতো মুক্তিযোদ্ধা খেতে বসেছে । এইবার তার এক নতুন উদ্যোগ,পাকিস্তানিদের ঘায়েল করার জন্য সুপারি গাছের উপরে ওঠে দূরবীণ হাতে তার চোখ জোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে গান বোর্ডে পাকহানাদাররা কোন পথে এগিয়ে আসতেছে তাদের দিকে। চোখে পড়ল পাকবাহিনীর একটি গানবোর্ড তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তারামন সুরুত করে নেমে পড়ল গাছ থেকে,নেমেই মুক্তিযোদ্ধারের ইশারা করলো যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিজে। নিজেও সহযোদ্ধাদের সাথে অস্ত্র চালাতে শুরু করলো। শত্রু রা তার এই উপস্থিত বুদ্ধির কারণে পরাস্ত হতে বাধ্য হলো। শুধু একবার নয়,কয়েকবারই সে সরাসরি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। অনেক সময় প্রতিবন্ধী বেশে পাক বাহিনীর সামনে নানান ভঙ্গিতে ঘোরাফেরা করে সংবাদ সংগ্রহ করেছে। মাঝে মাঝে বোবা হয়ে তাদের কোনো কথারই উত্তর দেয়নি। মাঝে মাঝে একনাগাড়ে কাদতে কাদতে পাক বাহিনীদের সেসামাল করে দিতো। হঠাৎ করে এই পাড়ে হানাদার বাহিনীর আসার আভাস পেলে ফুরুৎ করে নদী সাতরিয়ে ওপারে চলে যেত। দুঃসাহসি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীদের এমন ভাবে বোকা বানিয়ে তারামন বিবি বাঙ্গালি মহিলাদের জীবনকে যে ভাবে গৌরবাত্মিত করেছে এমন ঘটনা ইতিহাসে বিরল। শিক্ষাহীন,বিদ্যাহীন,দুঃখদারিদ্রে লালিত এই কিশোরী মেয়ের যে কর্ম আমরা দেখতে পাই ইতিহাসে তার উদাহরণ বিরল।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।