Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ত্বকের সৌন্দর্য্য ও বহুমাত্রিক চিকিৎসা

| প্রকাশের সময় : ২০ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

মূলত ত্বকের সুস্থতা নিশ্চিত করা ও সুন্দর ত্বক ফিরিয়ে আনতে অ্যায়েসথেটিকস চিকিৎসকরা কাজ করে যাচ্ছেন। পরিবেশ ও জিনগত কারণে একেকজনের ত্বকের ধরন একেক রকম হয়। আবার ত্বকের সমস্যার ধরনেও থাকে ভিন্নতা। এজন্য ত্বকের সমস্যার চিকিৎসাও সবার ক্ষেত্রে একরকম নয়।

ত্বক ও শরীরের চর্ম দুটি আলাদা জিনিস। কিন্তু অনেক সময় বিষয় দু’টিকে আমরা এক করে ফেলি। ত্বক বলতে আমরা সাধারনত মুখের গঠন বিন্যাসের উপরের অংশকেই বুঝি। আর চর্ম হলো শরীরের বাকী পুরো অংশ যাকে আবার শরীরের সবচেয়ে বড় অঙ্গও বলা হয় । আজ কথা বলব ত্বকের বেশ কিছু সৈান্দর্য্যহানিকর বিষয় নিয়ে। মূলত মুখে মেছতা, ব্রণ, এলার্জি, সাদা-কালো দাগ, অতিরিক্তলোম (নারীদের), চোখের নীচে কালো দাগ ,বলিরেখা, তিল,আচিল, ডাবলচিন ইত্যাদি সমস্যা দেখা দেয়। তাই এসব থেকে মুক্তহয়ে স্বাস্থ্যজ্জ্বল ত্বেই যে সবার প্রিয়। আমি বরাবরই বলে থাকি ত্বকের সৌন্দর্য্য ধরে রাখতে শুধু অ্যায়েসথেটিকস চিকিৎসাই নয় লাইফস্টাইল ও খাবার-দাবারের বিশাল ভুমিকা রয়েছে। সেই আদি থেকে প্রাকৃতিক ও ভেষজ চিকিৎসা নিয়ে প্রাচীন সুন্দরীরা ত্বককে লাবণ্যময় করে রাখতেন। আর আপনার ভেতর থেকে ত্বকের লাবণ্য ধরে রাখতেও কিছু বিষয় মেনে চলা উচিত। ‘সুস্থ ত্বক পেতে কী করবেন’- এ সম্পর্কে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো জেনে নিতে পারেন ।
ত্বকের সৌন্দর্যে কিছু করনীয় : ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখতে পুষ্টিকর খাবারের কোন বিকল্প নেই। শুধু ত্বকের বাহ্যিক পরিচর্চা করলে চলবে না, ভেতর থেকে ত্বকের দীপ্তি ধরে রাখতে হবে। এজন্য নিয়ম মেনে খাবার খেতে হবে।
পুষ্টিকর খাবার খেলে ত্বক ও চুল ভেতর থেকেই স্বাস্থ্যজ্জ্বল হয়। প্রতিদিন প্রচুর পানি পান করতে হবে। পানি কম পান করলে পানিশূন্যতা হয়। যার ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে আমাদের ত্বকে। ত্বকের সৌন্দর্য ধরে রাখতে ভিটামিন ই›র জুড়ি মেলা ভার। তাই ভিটামিন ই পেতে প্রচুর পরিমাণ মৌসুমি ফল ও শাকসবজি খেতে হবে।
প্রতিদিন ৩ রকমের মৌসুমী ফল ও ২ রকমের সবজি খেতে হবে। ফলের মধ্যে একটি থাকতে হবে ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল। অর্থাৎ টকজাতীয় ফল প্রতিদিন একটি করে খেতে হবে। আম, জাম, লটকন, জামরুল ইত্যাদি ত্বকের জন্য দারুণ উপকারি। এছাড়াও খেতে পারেন পেয়ারা আর কলা। প্রচুর শাকসবজিও বাজারে পাওয়া যায় যা আপনার ত্বককে বাড়তি পুষ্টি যোগান দিবে ।
নিয়মিত ব্যায়াম :ব্যায়াম যেমন শরীরের সুস্থতা নিশ্চিত করে তেমনি ত্বকও ভালো রাখে। ব্যায়াম করলে প্রচুর ঘাম হয় যা ভেতর থেকে ত্বক পরিষ্কার করে। তাছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম কর্টিসোল হরমোনের নিঃসরণের মাত্রা ঠিক রেখে মানুষের স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে নিয়মিত ব্যায়াম করলে সহজে বলিরেখা পড়ে না।
ঘরোয়া উপায়: রোদ বা বাইরে থেকে ফেরার পর ত্বকের ঘাম, ময়লা পরিষ্কার না করলে ত্বকের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়। তাই রোদ থেকে ফিরে বা ঘুমানোর আগে ত্বক পরিষ্কার করতেই হবে।
রোদের কারণে ত্বকে কালচে ভাব দেখা দিলে টমেটো লাগানো যেতে পারে। চোখের নীচে কালো দাগ দূর করার জন্য আলু বা শসা থেঁতো করে লাগালে উপকার পাওয়া যায়। ত্বকে শুধুমাত্র শসাই নয়, শসার খোসা ফেলে না দিয়ে থেঁতো করে ত্বকে লাগানো যায়, এতেও সমান উপকার। ত্বকের সুস্থতায় পুরো জীবনযাত্রারও পরিবর্তন করতে হবে। রাত জাগা যাবে না। রাতে অন্তত ৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে। প্রতিদিন একইসময় খাবার খেতে হবে।
নিয়মিত ত্বকের যত্ন নেওয়ার পরেও ত্বকে নানা ধরণের সমস্যা দেখা দিতে পারে। সমস্যা অবহেলা না করে ত্বকের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। আসুন দেখে নেই ত্বকের কোন ধরণের সমস্যায় কোন চিকিৎসা নেবেন।
লেজার চিকিৎসা : সাধারণভাবে বলতে গেলে লেজার এক ধরনের আলোকরশ্মি। ২০০৪ সালে বাংলাদেশে লেজার চিকিৎসা আসে। লেজার দিয়ে ত্বকের অবাঞ্চিত টিস্যু নষ্ট করে ফেলা হয়। সাধারণত যেসব ত্বকের রোগের ক্ষেত্রে লেজার চিকিৎসা করা হয় তাহলো ব্রণের দাগ, মেছতা, অবাঞ্চিত লোম, তিল, আঁচিল, শ্বেতী, ব্রনের গর্ত। এছাড়া অন্যান্য অ্যায়েসথেটিকস যেসব চিকিৎসা রয়েছে।
কসমেটিক সার্জারী : মূলত কসমেটিক সার্জারীর মাধ্যমে উপরোক্ত বিষয়গুলো চিকিৎসা গুলো করা হয়। এছাড়া ত্বকের সৌন্দর্যে আরও যেসব আধুনিক চিকিৎসা রয়েছে তাদের মধ্যে পি আর পি, বোটক্স, রেডিও সার্জারী, মাইক্রোনিডলিং, ফিলার, মাইক্রোডার্মাব্রেশন, মিনি পাঞ্চ-গ্রাফটিং ও ফিগার ডিজাইন ।
ভেষজ উপাদানে ত্বক পরিচর্চা : ত্বক পরিচর্জায় ভেষজ উপাদানের গুরুত্ব আদিকাল থেকেই চলে আসছে। রাসায়নিক উপাদানে তৈরি করা পণ্য এখন অনেকেই ব্যবহার করতে চান না। ফিরে যেতে চান প্রকৃতির কাছে। তাই প্রাকৃতিক বা ভেষজ উপাদানের প্রতিই তাদের মনোযোগ থাকে। ভেষজ উপাদানে কোন ক্ষতিকর পদার্থ নেই। মেলেও হাতের নাগালে। আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে ত্বক পরিচর্যায় সব ধরনের ডাল, সয়াবিন, গম, চাল, কাঠবাদাম, তিল, তিসি, আমলকী, বহেরা, হরিতকি, নিম, হলুদ, মধু, গোলাপ ফুল, গাঁদা ফুল, তুলসী পাতা, কলা পাতা, মেহেদী ব্যবহার করা হয়। এছড়াও আয়ুর্বেদিক কিছু ওষুধ ও হার্বস বা ভেষজ লতাগুল্ম ব্যবহার করা হয়।
ব্রণের চিকিৎসা : অনেক সময় তৈলাক্ত ত্বক ভালোভাবে পরিষ্কার না করলে লোমকূপে ময়লা জমে ব্রণ হতে পারে। আবার অনেকে ত্বক ফর্সাকারী ক্রিম, সিরাম ব্যবহার করেন। যার কারণে ত্বক খুব পাতলা হয়ে যায়। পরবর্তীতে ব্রণ বা নানা সমস্যা দেখা দেয়। ব্রণের সমস্যা দূর করার জন্য আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় কিছু ওষুধ ও ফুড সাপ্লিমেন্ট দেওয়া হয়। এতে এসব সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। এছাড়া ত্বকের ধরন অনুযায়ী ময়েশ্চারাইজার ক্রিম ও সানস্ত্রিন ব্যবহার করতে হয়। তবে আয়ুর্বেদিক বিশেষজ্ঞের পরামর্শে এগুলো ব্যবহার করা ভালো। ব্রণ থাকলে আয়ুর্বেদিক ফেসিয়ালের সময় স্ক্র্যাবিং করানো হয় না। এতে প্রদাহজনিত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
দাগ দূর করতে : যেকোন দাগের জন্য আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা আছে। ভেষজ উপাদানে তৈরি প্যাক ও হালকা মাসাজ এক্ষেত্রে ভালো। দাগের ধরন অনুযায়ী আয়ুর্বেদিক প্যাক লাগাতে হয়।
খুশকি : চোখের পাতা, ভ্রু ও মাথায় খুশকি থাকে অনেকের। খুশকির জন্য আয়ুর্বেদিক উপাদানে তৈরি প্যাক, ফুড সাপ্লিমেন্ট ও কিছু ওষুধ দেওয়া হয়। চিকিৎসকের পরামর্শে এই রোগের চিকিৎসা নিতে হবে।
নখ ফেটে গেলে: যাদের ত্বক অত্যন্ত নাজুক, নখ ভেঙে যায় ও হাতের তালু ফেটে যাওয়ার সমস্যা থাকে তাদের জন্য প্যারাফিনযুক্ত মেনিকিওর ও পেডিকিওর করানো ভালো। এটি ত্বককে মসৃণ করবে। আর ফাঙ্গাল ইনফেকশনের জন্য কিছু ওষুধ ব্যবহার করতে হবে।
সোরিয়াসিস: আয়ুর্বেদিক ও ইউনানী চিকিৎসাও ত্বকের সোরিয়াসিসের জন্য ভালো। একটু সময় লাগলেও ভেতর থেকে এই রোগের টক্সিন দূর হয়। এতে তেমন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও নেই।
চুল পড়া রোধে : মূলত প্রয়োজনীয় ভিটামিনের অভাবে চুল পড়ে যেতে পারে। বাহ্যিক কারণে খুব কমই চুল পড়ে। বাহ্যিক কারণে চুল মলিন হতে পারে। কিন্তু চুল পড়া বা ধুসর হয়ে যাওয়ার পেছনে মূল কারণ হলো প্রয়োজনীয় পুষ্টির অভাব। স্বাস্থ্যজ্জ্বল চুলের জন্য শরীরে কিছু অ্যানজাইম ও মিনারেল দরকার, যেগুলোর ঘাটতি থাকলে চুল পড়ে যায়। রাত জাগা, কোষ্ঠকাঠিন্য, হজম ও আইবিএস- এমন অনেক কারণেও চুল পড়ে। চিকিৎসার প্রথমেই চুল পড়ার কারণ খুঁজে বের করা হয়। তারপর চিকিৎসা দেওয়া হয়। চুল পড়া কমে গেলে ভেষজ উপাদানে তৈরি প্যাক লাগাতে হয়, যাতে চুল হয় ঝলমলে। অর্থাৎ চুল ভালো রাখতে ভেতর ও বাহির উভয় ধরনের যত্নের দরকার।
ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে : ত্বক উজ্জ্বল করার জন্য কিছু আয়ুর্বেদিক ফেসিয়াল আছে। তবে যাদের গাঁয়ের রঙ কালো বা বাদামি তাদের পুরোপুরি ফর্সা হওয়া কখনই সম্ভব না। কারণ, এই চিকিৎসায় ত্বকের মেলানিনের পরিমাণ কমায় না। কোনরকম রাসায়নিকের ব্যবহার না হওয়ায় আয়ুর্বেদিক ফেসিয়ালে ত্বকের লাবণ্য আসতে কিছুটা সময় লাগে। তাই ত্বকের জন্য আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা বা ফেসিয়াল করাতে চাইলে ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে হবে।
কিছু খাবার আছে যেগুলো ত্বক ভেতর থেকে উজ্জ্বল করে। কলা, আপেল, নানা রকম মৌসুমী ফল ও নানারকম রসালো ফলে ভিটামিন এ ও সি থাকে। এগুলো প্রচুর পরিমাণে খেলে ত্বক ভেতর থেকেই অনেকটা উজ্জ্বল হয়। এসবের পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া ফেসপ্যাক ব্যবহারেও উপকার পাবেন।
খরচ: আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার খরচ সম্পর্কে ধারণা দিলেন সৌন্দর্য বিশেষজ্ঞ আয়েশা সিদ্দীকা। তিনি জানান, এই চিকিৎসায় ত্বকের সমস্যার ধরনভেদে ১৫,০০০- ২০,০০০ টাকা লাগে। তবে একসাথে নয়, প্রতিবার (সাধারণত প্রতিমাসে) চিকিৎসায় ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা খরচ হয়। ত্বকের সমস্যার ধরনভেদে ১০/১২ বার এই চিকিৎসা প্রয়োজন হতে পারে।
ওয়াক্সিং: ওয়াক্সিং করানোর পর অনেকের ত্বকে র‌্যাশ দেখা দিতে পারে বা ত্বক লাল হয়ে যেতে পারে। এই সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে ওয়াক্সিংয়ের পর পর যতটা সম্ভব ঢোলা কাপড় ব্যবহার করুন। অ্যালোভেরা জেল বা বরফ লাগালেও উপকার পাবেন। একজন রূপ বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘ওয়াক্সিং করানোর পর সমস্যা দেখা দিলে তাৎক্ষণিকভাবে টক দই লাগাতে হয়। এতে সমস্যা অনেকটা কমে যায়। তবে সমস্যা বেশি হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।’ ত্বকের যেকোন সমস্যায় সঠিক চিকিৎসাপদ্ধতি অনুসরণ করুন। আর সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতি মেনে চলুন। মনে রাখা ভালো, সুস্থ ত্বক মানেই সুন্দর ত্বক।

ডা. জাহেদ পারভেজ বড়ভুঁইয়া
সহকারি অধ্যাপক (চর্ম, যৌন ও অ্যালার্জি)
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল,ঢাকা ।
জাহেদ’স হেয়ার এন্ড স্কিনিক
পাস্থপথ, ঢাকা। সেল-০১৭০৭-০১১২০০।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ত্বক

১২ নভেম্বর, ২০২১
৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২০
২৭ ডিসেম্বর, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন