Inqilab Logo

রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

‘তোদের মেরে ফেললেও কিছু হবে না’

নিউ ইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ১৪ মার্চ, ২০২০, ১২:০২ এএম

কাউসার আলি মানুষের ঘর রঙ করে দেন। কাজ শেষে বাড়ি যাওয়ার পথে তিনি মারামারির কবলে পড়েন। হিন্দু আর মুসলিমরা একে অপরের দিকে রাস্তায় পাথর ছুড়ছে। তার বাচ্চারা রাস্তার অপরপ্রান্তে। মারামারির কারণে তিনি সেখানে যেতে পারছেন না। অগত্যা কাউসার আলি পুলিশের সাহায্য চান। এটি ছিল তার মস্তবড় ভুল। পুলিশের কাছে সাহায্যের আর্জি নিয়ে যেতেই তাকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয় তারা।

তার মাথায় বাড়ি মারতে থাকে। তাকে ও আশেপাশের কয়েকজন মুসলিমকে মারতে থাকে তারা। প্রত্যেকের গা দিয়ে ঝরতে থাকে রক্ত। করজোড় করে ক্ষমা চাইতে থাকে তারা। এদের একজন শরীরের ভেতর জখম হয়ে দুই দিন পর মারা যায়। কিন্তু পুলিশ তাদের করুণ দশা দেখে হাসতে থাকে। লাঠি দিয়ে দুর্বল স্থানে খোঁচাতে থাকে। জাতীয় সঙ্গীত গাইতে বাধ্য করে। ২৪ ফেব্রুয়ারির এই পুরো ঘটনা ধরা পড়ে ভিডিওতে।

কাউসার আলি বলেন, ‘পুলিশ আমাদের সঙ্গে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছিল। বলছিল যে, আমরা যদি তোদের মেরেও ফেলি, কিছু হবে না।’ পুলিশের কথাই এখন পর্যন্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছে।

দিল্লিতে গত কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের সবচেয়ে ভয়ানক সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে। অনেকে মনে করেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকারের আমলে হিন্দু চরমপন্থার যে উদ্ভব ঘটেছে, তারই স্বাভাবিক পরিণতি এই দাঙ্গা। তার দল হিন্দু জাতীয়তাবাদের সহিংস সংস্করণকে বুকে টেনে নিয়েছে। দলটির নেতারা সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর প্রকাশ্যেই সহিংসতার ডাক দিয়েছে। সা¤প্রতিক মাসগুলোতে, মোদি এমন সব বিধি প্রনয়ণ করেছেন যেগুলোকে মুসলিম-বিরোধী হিসেবে দেখা হচ্ছে। যেমন, ভারতের একমাত্র মুসলিম রাজ্য জম্মু ও কাশ্মীরের রাজ্য মর্যাদা বাতিল করেছেন তিনি।

দিল্লির এই দাঙ্গায় পুলিশ বেশ স্বপ্রোণোদিতভাবে মুসলিমদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ফেব্রæয়ারির শেষের দিকে নয়া দিল্লিতে যেই লুণ্ঠন ও ভাঙচুর চালায় হিন্দু দাঙ্গাবাজরা, তাদেরকে সক্রিয়ভাবে সহায়তা দিয়েছে পুলিশ। রাজ্য পুলিশ হলেও দিল্লির পুলিশ সরাসরি মোদি সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে। এই পুলিশ বাহিনীতে মুসলিম সদস্যও খুব কম।

বেশ কয়েকটি ভিডিওতে দেখা গেছে যে, পুলিশ কর্মকর্তারা মুসলিম বিক্ষোভকারীদের মারছে অথবা পাথর ছুড়ছে। এমনকি হিন্দুদেরকে সহায়তার জন্যও ডাকছে।

এক পুলিশ অধিনায়ক বলেছেন যে, যখন সহিংসতা শুরু হলো, বিশেষ করে যেই পর্যায়ে হিন্দু দাঙ্গাবাজরা সহিংসতা শুরু করলো, তখন আক্রান্ত এলাকার পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয় নিজ নিজ স্টেশনে বন্দুক বা অস্ত্র রেখে আসার জন্য। সহিংসতার সময় নিউ ইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিকরা বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাকে একে অপরকে বলতে শোনেন যে, তাদের হাতে কেবল লাঠি আছে। এই দাঙ্গাবাজদের ঠেকাতে অস্ত্র দরকার ছিল। গবেষকরা বলছেন, পুলিশ ইচ্ছাকৃতভাবেই সেদিন রাস্তায় অল্প সংখ্যক সদস্য মোতায়েন করেছিল। তাদের হাতে কোনো অস্ত্রও ছিল না। ফলে সহিংসতা খুব দ্রুতই দাঙ্গায় পরিণত হয়। হিন্দুদের হাতে নিহত হয় অনেক মুসলিম।

দাঙ্গায় মারা যাওয়া পঞ্চাশেরও বেশি মানুষের পরিচয় সনাক্ত করা গেছে। এদের দুই তৃতীয়াংশই মুসলিম। মানবাধিকার কর্মীরা একে বলছেন সংঘবদ্ধ হত্যাযজ্ঞ। ভারতের জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ মুসলিম, দিল্লিতে ১৩ শতাংশ। কিন্তু দিল্লি পুলিশ বাহিনীতে মুসলিমদের সংখ্যা মাত্র ২ শতাংশ।

ভারতের পুলিশি সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরেই বেশ নিষ্ঠুর, পক্ষপাতী, সংখ্যালঘু-বিরোধী ও অনেকটাই কলোনিয়াল ধাঁচের। বৃটিশ শাসনের সময় যখন পুলিশ রাখা হয়েছিল জনগণের সেবার জন্য নয়, বরং বিদ্রোহী জনগণকে দমিয়ে রাখতে, সেখান থেকে পুলিশ এখনও বের হতে পারেনি।

তবে এখন পার্থক্য হলো যে, ভারতের তাবৎ আইন প্রয়োগকারী কাঠামোই বিজেপির আমলে রাজনীতিকৃত হয়েছে। মোদির দল যেসব রাজ্যের নিয়ন্ত্রণে আছে, সেখানে পুলিশের রোষানলে আনুপাতিক হারে খুব বেশি পড়েছে মুসলিমরা। যেমন, কর্ণাটকের এক মুসলিম স্কুল অধ্যক্ষকে স¤প্রতি দুই সপ্তাহের কারাদ- দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে। তার অপরাধ ছিল যে, তার শিক্ষার্থীরা নতুন অভিবাসন আইন নিয়ে একটি নাটিকা আয়োজন করেছিল, যেটি পুলিশ কর্মকর্তাদের মতে মোদি-বিরোধী ছিল।
হিন্দু জাতীয়তাবাদী ঢেউয়ে গা বিলিয়ে দেওয়ার বেলায় বিচারকরাও পিছিয়ে নেই। দিল্লির এক বিচারক স¤প্রতি বিস্ময় নিয়ে বলেছিলেন যে, কেন পুলিশ এখনও বিজেপির কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি যারা সহিংসতা উস্কে দিয়েছিল। তাকে ওই মামলা থেকে প্রত্যাহার করে অন্য রাজ্যে ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়। এছাড়া সুপ্রিম কোর্ট ধারাবাহিকভাবে সরকারের পক্ষে রায় দিয়েছে। কোর্টের অন্যতম বিচারপতি অরুন মিশ্র স¤প্রতি প্রকাশ্যেই বলেছেন, মোদি একজন ‘স্বপ্নদ্রষ্টা জিনিয়াস।’

বৃহস্পতিবার পার্লামেন্টে এক বিতর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ অঙ্গীকার করেছেন যে, ওই দাঙ্গায় দায়ীদের বিচারের আওতায় আনা হবে। তাদের বর্ণ, ধর্ম ও রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আমলে নেওয়া হবে না। কিন্তু তিনি ঠিকই পুলিশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। বলেছেন এই সহিংসতা হলো ষড়যন্ত্র। আরও বলেছেন, দাঙ্গায় উস্কানিদাতাদের সঙ্গে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। অনেক বিশেষজ্ঞই উষ্মা প্রকাশ করেছেন যে, যেসব ঘটনা ঘটেছে এর সঙ্গে ইসলামিক স্টেটের সম্পর্ক কোথায়!

ভারতীয় পুলিশের সদস্য সংখ্যা ৮০ হাজার। ২ হাজারেরও কম হলো মুসলমান। কমান্ডারদের মধ্যে মুসলমানদের সংখ্যা একেবারেই হাতে গোনা। সাবেক সংসদ সদস্য শহীদ সিদ্দিক বলেন, ভারতীয় পুলিশ অত্যন্ত উপনিবেশিক ধাঁচের ও বর্ণবাদী। তিনি বলেন, দুর্বলের প্রতি পুলিশের আচরণ সবচেয়ে বেশি সহিংস ও আক্রমণাত্মক।

ভারতের জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ হিন্দু। দিল্লির বেশ কয়েকটি এলাকায় হিন্দু গ্যাঙ প্রকাশ্যেই হুমকি দিয়েছে যে, এই সপ্তাহে অনুষ্ঠেয় হোলির আগেই মুসলমানরা যেন এলাকা ছেড়ে যায়। বেবি নামে এক মুসলিম নারী বলছিলেন, কয়েকদিন আগে দরজা খুলে দেখেন যে ৫০ জনের মতো পুরুষ দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। তাদের হাতে নোটবুক। তারা মুসলিমদের ঘরের ঠিকানা ধরে তালিকা করেছে। তিনি দ্রুতই সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছেন। শিগগিরই হয়তো এলাকা ছেড়ে যাবেন তিনি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ও আল্লাহ, আমাকে কেন হিন্দু বানাওনি তুমি? এটা কি আমার দোষ যে আমি মুসলিম হয়ে জন্ম নিয়েছিলাম?’ সূত্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস।



 

Show all comments
  • Md Ali ১৪ মার্চ, ২০২০, ১:১৮ এএম says : 0
    এটা মুসলিম নিযার্তনের একটা চিত্র মাত্র, এমন বহু মুসলিম আছে যার ছবি কেউ জানেনা, জানে সুধু উপরে এক মহান, সারা পৃথিবীর পরি পালক, মনে রাখবে যে দিন পাক রাউ করবে সে দিন আর সময় পাবে না,
    Total Reply(0) Reply
  • Muhammad Munir ১৪ মার্চ, ২০২০, ১:১৯ এএম says : 0
    ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ করোনাভাইরাস এর চেয়েও ভয়ঙ্কর । কতজন যে নিখোঁজ এবং কতজন যে হারিয়ে গেছে পরিবার থেকে, কতজন হাত-পা হারি য়ে পঙ্গু হয়েছে, তার কোন হিসাব নেই!প্রকৃত বাস্তবতা আরও ভয়ঙ্কর। বিশ্ব বিবেক কেন অমিত শাহের বিচার এর ব্যাপারে নীরব হয়ে আছে?
    Total Reply(0) Reply
  • Plabon Bhuiyan ১৪ মার্চ, ২০২০, ১:১৯ এএম says : 0
    আল্লাহ মুসলমানদের হেফাজত করুক,, যারা নির্বিচারে মানুষ হত্যা করে মানুষকে কষ্ট দেয় তাদের কোন ধর্ম হতে পারে না। ফেরাউন আসছিল পৃথিবীতে চলে গেছে নমরুদ আসছিল পৃথিবীতে চলে গেছে মুসলমানেরা তখনও ছিল এখনও আছে । আল্লাহ উত্তম বিচারক যিনি সকল ক্ষমতার মালিক।
    Total Reply(0) Reply
  • Mehedi Hasan ১৪ মার্চ, ২০২০, ১:১৯ এএম says : 0
    the most brutal and rubbish community in the world ,,they lacks knowledge ,ethics, humane and everything that a human should have.
    Total Reply(0) Reply
  • Mehedi Hasan Rahim Bin Syedul Hoque ১৪ মার্চ, ২০২০, ১:২১ এএম says : 0
    ঐ দিন বেশী দূরে নয়, যে দিন ভারতের পরিস্থিতি চায়নার চেয়েও আরো খারাপ হবে, তোরা আজ মুসলমানদের রক্ত নিয়ে যে ভাবে হলি খেলায় মেতে উঠছিস, একদিন তোদের রক্ত দিয়ে মুসলমানরা এই অপবিত্র ভারতকে পবিএ করবে, ভুলে যাস না একদিন এ ভারত মুসলমানরাই শাষন করছিল ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতেও করবে শুধু মাএ সময়ের অপেক্ষায়
    Total Reply(0) Reply
  • Enamul Islam ১৪ মার্চ, ২০২০, ১:২১ এএম says : 0
    হিন্দুত্ববাদ সন্ত্রাস উপমহাদেশব্যাপী ছড়িয়ে দিতে পারে সন্ত্রাসী মুদিরা । বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাপক সক্রিয় এরা। বাংলাদেশে শিক্ষা সেক্টর টা পুরোপুরি মুদি সন্ত্রাসীদের দখলে চলে গেছে। মোদি সন্ত্রাসীদের আক্রমণ যেকোনো সময় বাংলাদেশের মুসলমানদের উপর নেমে আসতে পারে
    Total Reply(0) Reply
  • Md abdur rahman ১৪ মার্চ, ২০২০, ৯:৪৭ এএম says : 0
    Allah bicar korbe
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Safiul Alam ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১, ৫:৪৩ পিএম says : 0
    এতো কিছুর পরেও আমাদের বাংলাদেশী শাসক দল সেই .........র .... ..... করে আর বলে এরাই নাকি ওদের পরীক্ষিত বন্ধু !!!
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: নিউ ইয়র্ক


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ