Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতীয় পুলিশের বিরুদ্ধে টার্গেট কিলিংয়ের অভিযোগ মুসলিমদের

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৫ মার্চ, ২০২০, ১২:০১ এএম

দিনভর ব্যাটারিচালিত রিকশায় যাত্রী পরিবহন করে সন্ধ্যার আগেই বাবা-মার বাড়িতে ফিরে আসেন মোহাম্মদ আসিফ। কিন্তু গত ২০ ডিসেম্বর রাত হয়ে গিয়েছিল, আসিফ তখনও বাড়িতে ফেরেনি। তার বাবা-মা খুব চিন্তিত ছিলেন। সেদিন তাদের উত্তর ভারতের মিরাট শহরে শত শত মুসলিম ভারতের নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে পুলিশের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়েছিল। এ আইন কিছু মুসলমানের নাগরিকত্ব রক্ষায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারে। সেদিন রাত দশটার দিকে কোন একজন আসিফের বাবা-মাকে তাদের মৃত ছেলের ছবি পাঠিয়েছিল যা হোয়াটসঅ্যাপে প্রচারিত হয়। তার মুখ খোলা, তার বুকে ফাঁক হওয়া লাল গর্ত। গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান। আসিফের বাবা ফরেন পলিসিকে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি তাকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিল সে বলেছিল যে, সে একজন পুলিশ আমার ছেলেকে গুলি করেছে’।
আলেম আনসারী ছিলেন আসিফের প্রতিবেশী। যখন তিনি বৃদ্ধ বাবা-মাকে দেখাশোনা করেন না, আনসারী একটি রেস্তরাঁয় তন্দুরি ওভেনে চাপাতি বানানোর কাজ করতেন। বিক্ষোভ শুরু হলে রেস্তোরাঁর মালিক তাড়াতাড়ি বন্ধ করে আনসারিকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেন। বাড়িতে ফেরার পথে তিনি মাথায় গুলিবিদ্ধ হন। ‘গুলি তার খুলি ছিদ্র করে অন্য দিক থেকে বেরিয়ে এসেছিল’, -বলছিলেন তার ভাই সালাউদ্দিন। তিনি ফরেন পলিসিকে একটি ভিডিও দেখান, একটি কালো চামড়ার জ্যাকেট পরা বাইরের এক লোক আনসারির হাত ধরে বলে, ‘পুলিশ এই ব্যক্তিকে মেরে ফেলেছে, সে এই মাত্র মারা গেছে’। ফরেন পলিসির দেখা অন্য ক্লিপটিতে আনসারির মগজ ফুটপাতে ছড়িয়ে থাকেত দেখা গেছে। তিনি মাত্র ২১ বছর বয়সের এবং স¤প্রতি বিয়ে করেছিলেন।
আসিফ ও আনসারী ২০ জনেরও বেশি মুসলমানের মধ্যে ছিলেন, যাদের পরিবারগুলো বলেছিল যে, সেদিন মূলত হিন্দু পুলিশ কর্মকর্তারা উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মীরাটে হত্যাকান্ড চালিয়েছিল। আরও কয়েক হাজারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। তারপর থেকে ভারত জুড়ে নতুন নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে। তাদের মধ্যে অনেকেই কেবল মুসলমান নয় বিভিন্ন ধরনের পটভ‚মির ভারতীয় যারা তাদের দেশের প্রথম কেবল ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিক অধিকারের সীমাবদ্ধতা প্রয়োগের বিরোধিতা করে। ইদানীং বিক্ষোভগুলো মারাত্মক সা¤প্রদায়িক দাঙ্গায় পরিণত হয়েছে। গত সপ্তাহে নয়াদিল্লিতে মূলত হিন্দু জঙ্গিদের তান্ডবে ৪৬ জন নিহত হয়েছিল।
সাক্ষী এবং নাগরিক অধিকারকর্মীদের বিবরণ যদি সত্য হয়, তবে মীরাট ও উত্তর প্রদেশের অন্যান্য শহরগুলিতে পুলিশ গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করেছিল সহিংসতায় প্ররোচিত করতে, সহিংসতা বাড়াতে, বহু সংখ্যক ভারতীয়কে রাস্তায় নামিয়ে আনতে এবং মুসলমান ও হিন্দুদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে। নাগরিক অধিকারকর্মীরা বলছেন, এরপর থেকে সহিংসতার সময় পুলিশ প্রায়শই পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে অথবা সক্রিয়ভাবে হিন্দুদের পক্ষ নিয়েছে।
উত্তরপ্রদেশে যে প্রথম পুলিশি সহিংসতা হয়েছিল তা ভারতীয়দের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ভারতের সর্বাধিক জনবহুল রাষ্ট্র হিসাবে এটি রাজনৈতিক শক্তির একটি দুর্গ যার বিষয়গুলি তার সীমানা ছাড়িয়ে অন্যত্র প্রভাব ফেলে। বিতর্কিত জম্মু ও কাশ্মীরের বাইরে এটি ভারতের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার রাজ্য। এই রাজ্যের ২০ কোটি মানুষের একপঞ্চমাংশই মুসলিম। মীরাট শহরে প্রায় ৪০ শতাংশ বাসিন্দা মুসলিম, যার মধ্যে অনেক দলিত মুসলমানও রয়েছেন। যাদের পূর্বপুরুষরা হিন্দু বর্ণবাদী ব্যবস্থার অধীনে তথাকথিত অস্পৃশ্য হিসাবে নিপীড়ন থেকে রক্ষা পেতে হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলামে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। ভারতের ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর জটিল কাঠামোর অংশ হিসাবে, ১৯৪৯ সালে দেশ বিভাগের পর থেকে এই স¤প্রদায়গুলি বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শান্তিতে বাস করেছে। যদিও এই শান্তিটি মাঝে মধ্যে সা¤প্রদায়িক সহিংসতার শিখা দ্বারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ২০ ডিসেম্বর মীরাটের ঘটনাগুলির একটি আলাদা বৈশিষ্ট্য ছিল, কারণ তারা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাথে সংঘর্ষে জড়িত ছিল না। অভিযোগগুলি সত্য হলে, মুসলমানরা পুলিশের ইচ্ছাকৃত টার্গেটে পরিণত হয়েছিল।
প্রতিবাদ এবং সংঘর্ষ ডিসেম্বরের শুরুতে ফিরে আসে, যখন ভারতীয় সংসদ একটি নতুন জাতীয়তা আইন পাস করে। আইনটিকে অনেক মুসলিম সমান নাগরিক হিসাবে তাদের মর্যাদার জন্য হুমকি বলে মনে করেন। আইনটি আশেপাশের দেশগুলি থেকে আসা অভিবাসীদের ভারতীয় নাগরিকত্বের একটি বিশেষ ট্র্যাক দেয় - তবে কেবলমাত্র যদি আবেদনকারীরা হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, পার্সী, জৈন বা খ্রিস্টান হন। সমালোচকরা বলছেন যে, আইনটি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু-অধ্যুষিত রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি বাস্তবায়ন, অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের মধ্যে সমর্থন বাড়ানো এবং সা¤প্রদায়িক উত্তেজনা দমনের একটি নির্মম চেষ্টা। সমালোচকরা আরও বলছেন যে, ২০১৯-এর শেষ প্রান্তিকসহ ছয় বছরেরও বেশি সময় ধরে ধীর গতিতে বাড়া একটি ক্রমবর্ধমান অর্থনীতিসহ অন্যান্য ইস্যু থেকে বিভ্রান্ত করতে মোদি আইনটি ব্যবহার করছেন।
ভারতীয় মুসলমানরা সর্বদা মোদির রাজনীতিতে আতঙ্কিত ছিল। ২০০২ সালে গুজরাট রাজ্যে তিনি ক্ষমতায় ছিলেন, যখন প্রায় এক হাজার মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় নিহত হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে এই গণহত্যায় তীব্র সমর্থন এবং হত্যাকান্ড বন্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা না গ্রহণের অভিযোগ করা হয়েছিল। ২০০৫ সালে, মার্কিন সরকার দাঙ্গায় সন্দেহজনক ভ‚মিকার জন্য তাকে ক‚টনীতিক ভিসা প্রত্যাখ্যান করেছিল।
মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ উত্তরপ্রদেশে হত্যাকান্ডের পক্ষে প্রকাশ্যে অনুমোদন দিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষ বলেছেন, ক্ষতিগ্রস্থদের ‘কুকুরের মতো গুলি’ করা হয়েছিল এবং ‘সুযোগ পেলে আমরা এখানেও করবো’। দিল্লির ফায়ারব্র্যান্ডের বিজেপি রাজনীতিবিদ কপিল মিশ্র তার সমর্থকদের ‘বিশ্বাসঘাতকদের গুলি করার’ আহ্বান জানিয়েছেন। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী গেরুয়াধারী হিন্দু সন্ন্যাসী যোগী আদিত্যনাথ কোনও প্রতিবাদকারী আইন ভঙ্গ করতে গিয়ে ধরা পড়লে ‘প্রতিশোধ নেয়ার’ শপথ করেছিলেন। তার বেশিরভাগ অনুসারী মূলত মুসলমানদের ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করেছিলেন।
সমালোচকরা বিজেপি রাজনীতিবিদদের মুসলমানদের লক্ষ্য করে পুলিশী সহিংসতা এবং এমনকি উৎসাহ দেয়ার অভিযোগ করেছেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্টের সামনে মামলাগুলি নিয়ে আসা বিশিষ্ট নাগরিক অধিকার আইনজীবী সঞ্জয় হেগড়ে বলেছিলেন, তাদের মন্তব্য ‘আশেপাশের লোকজনকে গুলি করে বিক্ষোভ বন্ধ করার জন্য পুলিশকে দেয়া নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অপব্যবহার করে’। ‘অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পুলিশ সদস্যদের জবাবদিহির জন্য ডাকা হবে না’ -তিনি বলেন। অল ইন্ডিয়া প্রগ্রেসিভ উইমেনস অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি এবং ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পলিটব্যুরোর সদস্য কবিতা কৃষ্ণন ফরেন পলিসিকে বলেছেন যে, বেশিরভাগ ক্ষতিগ্রস্থকে বুকের ওপরে গুলি করা হয়েছিল, যা ইঙ্গিত দেয় যে, অপরাধীদের জনগণকে ছত্রভঙ্গ করার অভিপ্রায় ছিল না, বরং হত্যাই উদ্দেশ্য।
মুসলমানরা সচেতন যে, ন্যায়বিচারের রাস্তা হবে ক্লান্তিকর। মীরাটের এক ভুক্তভোগীর ভাই সালাউদ্দিন বলেছিলেন যে, তার ভাইয়ের মৃত্যুর ১০ জনেরও বেশি সাক্ষী রয়েছেন, তবে কেউ প্রতিশোধ নেয়ার ভয়ে সামনে আসতে রাজি নয়। তিনি বলছিলেন যে, পরিবার ভিডিওটিতে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীর সাথে কথা বলার জন্য তার সন্ধান করছে। কিন্তু তাদের বলা হয়েছে, ঐ ব্যক্তি শহর ছেড়ে চলে গেছে। পুলিশ পাথর নিক্ষেপ ও বিভিন্ন ধরনের সহিংসতার জন্য কয়েকশ’ লোককে গ্রেফতার করেছে এবং সন্দেহভাজনদের তালিকায় তারা নাম যুক্ত করেই চলেছে। অনেক তরুণ যুবক মীরাট ও উত্তর প্রদেশের অন্যান্য শহরে মুসলিম অধ্যুষিত পাড়াগুলিতে তাদের বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে। কোনও অন্যায় কাজের কারণে নয়, বরং তারা ভয় পাচ্ছে যে, পরবর্তীতে তাদের গ্রেফতার করা হতে পারে।
উত্তরপ্রদেশ কর্তৃপক্ষ বলছে, ২০ ডিসেম্বর বিজনোর শহরে দু’জন বিক্ষোভকারীর মৃত্যুর জন্য পুলিশ দায়ী। পুলিশ আত্মরক্ষার জন্য গুলি করলে তারা বিদ্ধ হয়েছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। মীরাটে পুলিশ বলেছিল যে, প্রতিবাদকারীরা দুর্ঘটনাক্রমে একে অপরকে গুলি করেছে বা ভুক্তভোগীরা অন্য কোথাও মারা গেছে। তবে সংঘর্ষের ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে যে, পুলিশ বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল। দিল্লির আনসারির পরিবারের প্রতিনিধিত্বকারী আইনজীবী আলী জায়েদী বলেছেন, পুলিশ দাবি করেছে যে, বেনামি হিসেবে হাসপাতালে আনার আগে আনসারী অন্য কোথাও মারা গিয়েছিল, -এটি অসত্য। তিনি ফরেন পলিসির সাথে শেয়ার করেছেন এমন একটি ভিডিওতে, পুলিশ কর্মকর্তাদের আনসারির লাশ একটি কালো গাড়িতে নিয়ে যেতে দেখা যায়। জায়েদী বলেন, ‘পুলিশ নিজেদের বাঁচানোর চেষ্টা করছে’।
ভারতে অনেক মুসলমান সন্দেহ করছেন যে, তাদের সরকার ভারতীয় সমাজে তাদের স্থান অস্বীকার করতে কাজ করছে এবং নতুন আইনটি কেবল প্রথম পদক্ষেপ। নাগরিক অধিকারকর্মীরা অভিযোগ করেছেন, মোদি সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চাপ দেয়ার জন্য মুসলমানদের মধ্যে ভয় জাগিয়ে তুলেছে। কৃষ্ণন বলেছিলেন, উত্তর প্রদেশে হিন্দু পুলিশ কয়েকজন মুসলমানের বাড়িঘর দখলে নিয়ে তাদের বলেছিল যে, ‘শিগগিরই তাদের সম্পত্তি এবং বাড়িঘর (হিন্দুদের) হয়ে উঠবে’।
এতে ক্ষতিগ্রস্থদের পরিবার দ্বিগুণ বিধ্বস্ত হয় এবং তারা বলেছে যে, তারা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে যথাযথ মর্যাদায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছে, তবে ভারত কেন তাদের বাড়ী হবে না বুঝতে পারছেন না। আনসারির ভাই সালাউদ্দিন বলেন, ‘তারা কেন আমাদের পাকিস্তানে যেতে বলছে, পাকিস্তান কি আমাদের চাচা?’ ‘আমরা ভারতীয়, আমরা ভারতকে ভালবাসি, আমাদের পূর্বপুরুষরা ভারতে থাকাকেই বেছে নিয়েছিলেন। এটি আমাদের স্বদেশও’। ফরেন পলিসি।



 

Show all comments
  • ABU ABDULLAH ৫ মার্চ, ২০২০, ১০:৪২ পিএম says : 0
    MODI NO WELL COME TO BANGLADESH
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ