Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দাঙ্গা নয়, দিল্লিতে প্রকাশ্যে ‘মুসলিম নিধন’ হয়েছে

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৩ মার্চ, ২০২০, ১২:০০ এএম

১৯৫৪ সালের আগস্টে একদল শ্বেতাঙ্গ তরুণ পরিকল্পিতভাবে লন্ডনের নটিং হিলে কালোদের ওপর লোহার রড, গোশত কাটার ছুরি আর দুধের বোতল নিয়ে হামলা করছিল। এক পুলিশ সদস্য জানিয়েছিলেন যে ৩০০ লোকের ওই দাঙ্গাবাজেরা স্লোগান দিচ্ছিল, ‘আমরা কৃষ্ণাঙ্গ কুত্তাদের খতম করছি। তাদেরকে তোমরা কেন দেশে ফেরত পাঠাচ্ছ না?’ এক সপ্তাহ ধরে ওই হামলা চলে। ওই ঘটনা এখনো ‘নটিং হিল রায়ট’ নামে উল্লেখ করা হয়। বিষয়টি তেমন ছিল না। এটি ছিল সপ্তাহব্যাপী চলা বর্ণবাদী হামলা। ওল্ড বেইলিতে ৯ শ্বেতাঙ্গ তরুণকে সাজাদানকারী বিচারপতি স্যালমন এটিকে ‘কৃষ্ণাঙ্গ বধ’ হিসেবে অভিহিত করেছিলেন।

বর্ণবাদী সহিংসতাকে ‘দাঙ্গা’ হিসেবে অভিহিত করার দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এটিকে টার্গেট করা হামলা হিসেবে পরিচিতি না দিয়ে সাধারণ সহিংসতামূলক হাঙ্গামা হিসেবে চালিয়ে দেয়ার প্রয়াস থেকে এই চেষ্টা। গত সপ্তাহে ভারতীয় রাজধানী দিল্লির কিছু অংশে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদেরা একে ‘দাঙ্গা’ ও ‘সা¤প্রদায়িক সহিংসতা’ হিসেব অভিহিত করছেন। ব্যাপারটি নটিং হিলের কৃষ্ণাঙ্গদের উপর চালানো আক্রমণকে ‘দাঙ্গা’ হিসাবে বর্ণনা করার মতোই। গত সপ্তাহে দিল্লি যা দেখেছে, তা হ’ল সেই ‘নিগ্রো শিকার’ এর সমতুল্য, যা মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা চালিয়েছে। তাদের বেশিরভাগই ছিল প্রধানত ভারতের শাসকদল বিজেপি’র সমর্থক। অনেকেই ‘জয় শ্রী রাম’ এবং ‘হিন্দুয়ান কা হিন্দুস্তান’ (হিন্দুদের জন্য ভারত) বলে স্লোগান দিয়ে মুসলিমদের ওপর টার্গেট করে সহিংসতা চালিয়েছিল।

এই সহিংসতা শুরু হয় স্থানীয় বিজেপি রাজনীতিবিদ কপিল মিশ্রের একটি সমাবেশে বক্তৃতা করার পর। তিনি বলেছিলেন, ‘পুলিশ যদি নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (সিএএ) বিরোধিতা করে রাজপথে অবস্থান গ্রহণকারীদের সরিয়ে না দেয়, তবে তিনি ও তার সমর্থকেরা তা করবেন।’ সিএএ নতুন একটি আইন। এতে প্রধানত প্রতিবেশী দেশগুলোর অমুসলিমদেরকে নাগরিকত্ব প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ভারত স্বাধীনতা লাভ করার পর এটিই মুসলিমদেরকে বাইরে রাখার প্রথম আইন, এর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ চলছে। কপিল মিশ্রের আল্টিমেটাম প্রদান করার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বিজেপি গ্যাঙগুলো সিএএবিরোধী বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালাতে শুরু করে। কয়েক দিনের মধ্যে তারা মুসলিমদের বাড়িঘর, দোকানপাট ও মসজিদ জ্বালিয়ে দেয়। অন্তত ৪৬ জন নিহত হয়েছে। এদের মধ্যে একজন পুলিশ সদস্যও রয়েছে।

এ সময় হিন্দুরাও আক্রান্ত হয়েছে, তাদের বাড়িঘরও পুড়েছে। এর ফলে অনেকে দিল্লির ঘটনাপ্রবাহকে সাধারণ বিশৃঙ্খলা এবং এমনকি প্রধানত মুসলিম সহিংসতা হিসেবেও চিত্রিত করছে। ১৯৫৮ সালে ‘কালো’দের অনেকে ইট ও ব্যাট হাতে প্রস্তুত হয়েছিল, কেউ কেউ শ্বেতাঙ্গদের ওপর হামলা করার জন্য সঙ্ঘবদ্ধও হয়েছিল। কিন্তু সেটি স্থানীয় কৃষ্ণাঙ্গদের ওপর বর্ণবাদী হামলার বিষয়টিকে আড়াল করেনি। দিল্লিতেও দেখা গেছে, হিন্দু উগ্রবাদী ও মুসলিমবিরোধী বৈরিতা প্রতিরোধ করতেই মুসলিমেরা সহিংসতা দিয়ে জবাব দিয়েছিল।

বিজেপি ‘হিন্দুত্ববাদী’ মতাদর্শে পরিচালিত দল। তারা ভারতের জন্য একমাত্র নির্ভরযোগ্য জীবনযাত্রার পথ হিসেবে হিন্দুত্বকে চায়। গত মাসে বিজেপি সরকারের কেন্দ্রীয় মন্ত্রী গিরিরাজ সিং বলেছিলেন, সব ভারতীয় মুসলমানের উচিত ছিল দেশ ভাগের সময় পাকিস্তানে চলে যাওয়া। ইউরোপের অনেক প্রতিক্রিয়াশীল গ্রুপের মতো বিজেপিও মূলধারার রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে কংগ্রেসের (স্বাধীনতার পর থেকে এই দলটিই বেশির ভাগ সময় শাসন করেছে) ব্যর্থতা ও দুর্নীতিতে অসন্তুষ্ট হওয়ার কারণেই মূলত বিজেপি জনসাধারণের সমর্থন লাভ করেছে। ২০১৪ সালে বিজেপি যখন ক্ষমতায় আসে, তখন এর হিন্দু উগ্রবাদ নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। আর গত বছরের নির্বাচনে বিপুল বিজয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে কোনো সংযম ছাড়াই বিশেষ নীতি বাস্তবায়নে লাইসেন্স দিয়ে দিয়েছে।

২০১৯ সালের আগস্টে সরকার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মিরের স্বায়ত্তশাসন মর্যাদা বাতিল করে এবং স্থানীয় বিক্ষোভ নৃশংসভাবে দমন করে। তারপর আসে ‘সিএএ’ ও ‘এনআরসি’। এটি মুসলিমদের নাগরিকত্ব নিয়ে দ্বিমুখী আক্রমণ। ভারতীয় মুসলিমরা আশঙ্কা করছে যে কয়েক প্রজন্ম ধরে ভারতে বসবাস করে এলেও তাদেরকে ‘বিদেশী’ ঘোষণা করা হবে, তারা হয়ে পড়তে পারে ভারতীয় রোহিঙ্গা। মুসলিমদের বাদ দেয়ার মাধ্যমে বিজেপির উগ্রবাদী মতাদর্শ প্রকাশ পেলেও সিএএর বিরোধিতায় হিন্দু ও মুসলিম উভয়েই নেমেছে। এতে গোঁড়ামির বিরুদ্ধে গণবিরোধিতার গভীরতা প্রমাণিত হচ্ছে। দিল্লিতে সহিংসতার মধ্যেও মুসলিম প্রতিবেশীদের হিন্দুদের ও হিন্দুদের সহায়তায় মুসলিমদের এগিয়ে আসার অনেক উদাহরণ দেখা গেছে। ভারতে যা হচ্ছে সেটি হিন্দু ও মুসলিমদের মধ্যকার সাধারণ ধর্মীয় সংঘাত নয়, বরং এটি ভারতের দুটি ভিশনের মধ্যকার রাজনৈতিক সংগ্রাম, তথা যারা ভারতকে একটি উন্মুক্ত ও সেক্যুলার জাতি হিসেবে দেখতে চায় এবং যারা একে উগ্র হিন্দু রাষ্ট্র দেখতে চায়, তাদের মধ্যকার লড়াই। এই লড়াইতে কে জয়ী হবে তা কেবল মুসলিমদের বা ভারতীয়দের জন্যই নয়, বরং আমাদের সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সূত্র : দ্য গার্ডিয়ান।



 

Show all comments
  • Hajarat Nur Ahammed Karim ৩ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৬ এএম says : 0
    তাদের হায়াত ছিল। উগ্র মানুষ ও দিল্লীর আইন বিভাগের খামখেয়ালিতে প্রান দিতে হল । আমি তাদের রুহের মাগফেরাগ কামনা করি। কিন্তু অনুরুপ ঘটনা দ্বিতীয় তৃতীয় বার না হওশার কোন গ্যারেন্টি নায় ।
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Sohel Rana ৩ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৭ এএম says : 0
    বিশ্বের সকল দেশে, মুসলমানদের ওপর জুলুম, নির্যাতন হবে এগুলো একেবারে স্বাভাবিক
    Total Reply(0) Reply
  • Saiful Islam ৩ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৮ এএম says : 0
    বাংলাদেশ বলতে যেমন বঙ্গবন্ধু বা আওয়ামীলীগকে বুঝানো হয় তেমনি ভারত মাতা জী জিন্দাবাদ গান্ধী বা কংগ্রেসকে বুঝানো হয় ! আজ কাশ্মীর বা নাগরিকত্ব ইস‍্যুতে বিজিপি সরকারের কাছে কংগ্রেস অসহায়ত্ব দেখে মনে হয় বাংলাদেশ বিএনপি অনেক শক্তিশালী দল এখনো টিকে আছে।
    Total Reply(0) Reply
  • Sharif Ahmmed Sandwipi ৩ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৮ এএম says : 0
    এটা মুসলমানদের দুর্বলতার ফসল। মুসলিম বিশ্ব এ-র জন্য পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে দায়ী। ভারতকে একক ভাবে দায়ী করা যাবে না এ হত্যা যজ্ঞের জন্য। ভারত কিভাবে এতো সাহস পেলো মুসলিম হত্যার জন্য? উত্তর ঃ ইসরাইল আমেরিকা যদি নির্বিচারে হত্যা করে যেতে পারে, যদি তাদের বিরুদ্ধ কোন অভিযোগ না উঠে মুসলিম বিশ্ব হতে, ভারতের বিরুদ্ধ উঠবে কেনো? ভারত কেনো পারবেনা? উক্ত রাষ্ট্র দুইটাই ভারতের বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র। কাজেই ভারত শিক্ষা নিয়েছে।ভারতকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রভাবিত করা হয়েছে মুসলিম হত্যার জন্য পরোক্ষভাবে। এ-র জন্য মুসলিম বিশ্ব একমাত্র মুসলিম বিশ্ব দায়ী।
    Total Reply(0) Reply
  • Saiful Islam ৩ মার্চ, ২০২০, ১২:৫৮ এএম says : 0
    মোদি ঠেকাও বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধাদের সম্মান বাচাঁও দল মত নিবিশেষে সবাই এক হও!
    Total Reply(0) Reply
  • Shamim Alam ৩ মার্চ, ২০২০, ১:০০ এএম says : 0
    পৃথিবীতে ধর্ম নিয়ে মারামারি অনন্তকাল বেঁচে থাকবে পূর্বেও যেমনটি ছিল।
    Total Reply(0) Reply
  • Mizan Ur Rahman Manik ৩ মার্চ, ২০২০, ১:০১ এএম says : 0
    সুপরিকল্পিতভাবে কিছু সন্ত্রাসীর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড। এটাকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলতে আমি রাজি নয়।কেননা,সকল হিন্দু(দিল্লির) এই হত্যাকাণ্ডের সমর্থক নয়।এমন কি বলতে গেলে কিছু সংখ্যক লোক ছাড়া কেউ এই হত্যাকাণ্ডকে সাপোর্ট করবে বলে আমি মনে করি না।কেননা,কোন ধর্মমতই উগ্রবাদিতাকে সমর্থন করে না।
    Total Reply(0) Reply
  • Jakir Al Faruki ৩ মার্চ, ২০২০, ১:০১ এএম says : 0
    পরিকল্পিত ভাবে মুসলিম নিধন, স্থায়ীভাবে ক্ষমতায় থাকার জোগার যন্ত্র।
    Total Reply(0) Reply
  • Md Jakaria ৩ মার্চ, ২০২০, ১:০১ এএম says : 0
    আপনারা এটাকে দাঙ্গা লিখছেন। কিন্তু এটা তো জেনোসাইড হবার কথা। একপক্ষ আক্রান্ত হলে সেটাকে কি দাঙ্গা বলা যেতে পারে!
    Total Reply(0) Reply
  • Kabir Hossain Mohammad Kabir ৩ মার্চ, ২০২০, ১:০২ এএম says : 0
    কোন মুসলিম দেশ বা মুসলিম জাতি কোন প্রকার কোন দেশ বা ব্যাক্তির উপর যুদ্ধ বা আঘাত করে তাহলে সেটাকে জঙ্গি হামলা বলা হয়। আর এর জন্য দায়ী মুসলিম দেশ বা জাতি। কারণ আমরা আমাদের প্রভুর মন জয় করে চলতে হয়। তাতে আমাদের জাত পাত গোল্লায় যাক। আজ পৃথিবীর একমাত্র নীপিিড়ত জাতি হল মুসলমান, যাদেরকে আঘাত করা একেবারেই সহজ কাজ। যা পৃথিবীর অনেক ছোট ছোট নৃগোষ্ঠি বা উপজাতির চাইতে সহজ।
    Total Reply(0) Reply
  • Alam ৩ মার্চ, ২০২০, ১:০৫ এএম says : 0
    Guardian said doesn't need to battling, just directly fire Muslim.
    Total Reply(0) Reply
  • ash ৩ মার্চ, ২০২০, ২:৩৫ এএম says : 0
    MODI BANGLADESH DESH E ASHLE, EBAR RAYOT HOBE BANGLADESH E TATE KONO SHONDEHO NAI ! PULISH , BGB, RAB KISU E KORTE PARBE NA
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Kamrazzaman Palash ৩ মার্চ, ২০২০, ১০:১০ এএম says : 0
    Allah a sob er bichar korba....One Day
    Total Reply(0) Reply
  • Md. Kamrazzaman Palash ৩ মার্চ, ২০২০, ১০:১১ এএম says : 0
    আপনারা এটাকে দাঙ্গা লিখছেন। কিন্তু এটা তো জেনোসাইড হবার কথা।
    Total Reply(0) Reply
  • jack ali ৩ মার্চ, ২০২০, ১১:৫৫ এএম says : 0
    Those who invited Modi the killer of muslim in our Holy land they are not muslim...
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ