পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশ একই সাথে উন্নয়নশীল ও জনবহুল দেশ। পরিবেশের ভারসাম্য ঠিক রেখে টেকসই উন্নয়ন দেশের প্রধান লক্ষ্য। টেকসই উন্নয়নে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা প্রতিনিয়ত বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে, যার মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উল্লেখযোগ্য। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার মধ্যে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কারণ প্লাস্টিক অপচনশীল অবস্থায় দীর্ঘদিন পরিবেশে থেকে যায়। বাংলাদেশে প্লাস্টিকের মাথাপিছু ব্যবহার মাত্র পাঁচ কেজি যেখানে বিশ্বে গড় প্লাস্টিকের ব্যবহার প্রায় বিশ কেজি। এই পরিসংখ্যান থেকে আমরা সহজেই প্লাস্টিক বর্জ্যরে পরিমাণ নিয়ে কিছুটা ধারণা পাই। প্লাস্টিক বর্জ্যরে মধ্যে রয়েছে বোতল, চালের বস্তা এবং প্লাস্টিক ব্যাগ। কিন্তু অন্য সব দেশের মতো বাংলাদেশের প্লাস্টিক বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা গড়ে না উঠায় পরিবেশগত মারাত্মক প্রভাব নিয়ে তা মানব জীবন ও বিভিন্ন প্রাণীর জন্য হুমকি হয়ে দেখা দিচ্ছে এবং প্রতিনিয়ত এই প্লাস্টিক বর্জ্য সৃষ্টির হার বৃদ্ধি পাচ্ছে।
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা জনবহুল শহর হওয়ায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমস্যার মধ্যে রয়েছে। এক গবেষণায় জানা যায়, ঢাকা শহরে প্রতিদিন মাথাপিছু ৫৬০ গ্রাম বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, এর মধ্যে প্লাস্টিক অন্যতম। তাছাড়া বিশ্বব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, ঢাকা শহরে দৈনিক ৭ হাজার মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সেই সাথে দেশের ৩২৪ টি পৌরসভা ও ১১ টি সিটি কর্পোরেশনেও বর্জ্য উৎপাদনের হার বেড়েই চলছে। দেশের শহর গুলোতে যে পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে এবং কত ধরণের বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে তার সঠিক ও বিস্তারিত গবেষণা তথ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কাছে নেই। সেই সাথে আর্থিক ও ব্যবস্থাপনা সক্ষমতা ঘাটতি থাকায় শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করা পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন করাও জটিল হয়ে উঠছে।
প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য পানির সঙ্গে মিশে এর গুনাগুন নষ্টের সাথে সাথে পানিতে থাকা জীববৈচিত্রের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলছে। নদী ও সাগরে প্লাস্টিক ও পলিথিনের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বর্তমান সময়ে সমুদ্রের সম্পদ নিয়ে যে বিস্তর গবেষনা চলছে, প্লাস্টিক বর্জ্য এর জন্য মারাত্বক হুমকির কারণ হতে পারে। ২০১২ সালের এক গবেষণায় দেখা গিয়েছিল যে, প্রায় ১৬৫ মিলিয়ন টন বর্জ্য প্লাস্টিক সমুদ্রে ভাসমান অবস্থায় আছে, যা প্রায় ৭০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণীকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। সমুদ্রে যে হারে প্লাস্টিক বাড়ছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে প্রবাল প্রাচীরের ভবিষ্যতের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। সমুদ্র বিজ্ঞানীদের মতে, সমুদ্রের পানির উষ্ণতা বৃদ্ধির পর দ্বিতীয় বড় হুমকিটি প্লাস্টিক বর্জ্য যা প্রবাল প্রাচীরের রোগাক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি ২০ গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
উৎপাদিত বর্জ্যগুলো শেষ পর্যন্ত সংগ্রহ, পরিবহন ও অপসারণের পর জায়গা হয় ল্যান্ডফিল সাইটে। স্তূপাকারে জমা করা বর্জ্যরে জন্য যে জায়গা ব্যবহার করা হয় তার ধারণক্ষমতা দিন দিন শেষ হয়ে যাচ্ছে। ল্যান্ডফিল করার জন্য অবশ্যই কিছু নিয়ম মানা জরূরি। এনভায়রমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ) এ বিষয়ে বেশ কিছু নীতিমালা উল্লেখ করেছে। ১৯৯১ সালের এই নীতিমালা অনুযায়ী ল্যান্ডফিল সাইটের ৩০ মিটার এর মধ্যে কোন জলাশয় থাকবে না, ১৬০ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোন খাবার পানির নলকূপ থাকতে পারবে না এবং ৬৫ মিটার দূরত্বের মধ্যে কোন ঘরবাড়ি, স্কুল বা পার্ক থাকতে পারবে না। তাই ল্যান্ডফিলিংটি অত্যন্ত অপব্যয়ী হিসাবে বিবেচিত হয়। জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও উন্নয়নশীল কাঠামো গড়ে উঠায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ল্যান্ডফিল সাইটের জায়গা বৃদ্ধি করা সহজ নয়। যেসব স্থানে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য ল্যান্ডফিল তৈরি করা হয়, পরবর্তীতে এর ফলে ভূমি জমিগুলি ভালোভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হয় না এবং সেখানে প্লাস্টিকের বর্জ্যগুলি সহজেই জলপথে বয়ে যেতে পারে বা বন্যার পানিতে সমুদ্রে পতিত হতে পারে। প্লাস্টিক বর্জ্যের বেশির ভাগই যেহেতু মাটিতে থেকে যাচ্ছে, তাই এগুলো মাটি ও পানির গুণগত মান নষ্ট করছে। তাছাড়া, প্লাস্টিকগুলি ল্যান্ডফিলে ক্ষয় হয়ে গেলে তারা মাটি এবং আশেপাশের পরিবেশে দূষণকারী (ফ্যাথলেট এবং বিসফেনল) পদার্থ মুক্ত করতে পারে।
প্লাস্টিক সাধারণত পেট্রোলিয়াম বা প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে উদ্ভূত হয়, এই প্লাস্টিক বর্জ্যে যে পরিমাণে সঞ্চিত শক্তি রয়েছে তা অন্য কোনও বর্জ্যরে তুলনায় বেশি পরিমাণে সঞ্চিত শক্তি দেয়। প্লাস্টিকে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করলে কিছু শক্তি ফিরে আসে। প্রকৃতপক্ষে, প্লাস্টিক থেকে যে পরিমাণ শক্তি উৎপাদন করা যায় তা প্রায় কয়লা এবং জ্বালানি তেল থেকে উৎপাদিত শক্তির সমান। তাই প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরী, উল্লেখযোগ্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি। কিন্তু, প্লাস্টিক জ্বালানি প্রক্রিয়াতে বায়ুমন্ডলে বিপজ্জনক পদার্থগুলি নির্গত হতে পারে, যার ফলে পরিবেশ এবং স্বাস্থ্যের উপর ক্ষতিকর প্রভাব তৈরি করবে। প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে জ্বালানি তৈরি করে যে তাপ উৎপন্ন হয় তা দিয়ে টারবাইন ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। যদি এই প্রকল্পটি সারাদেশের পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোতে করা হয় তাহলে বর্জ্য অনেকাংশে কমে যাবে। এতে দেশের জ্বালানি চাহিদা অনেকখানি মেটানো সম্ভব হবে। এছাড়াও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য বর্জ্যের কিছু অংশ পুড়িয়ে ফেলা যেতে পারে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বর্জ্য পুড়িয়ে প্রায় ৯০ শতাংশ বর্জ্য কমিয়ে ফেলা সম্ভব।
অনেক প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করা যায় এবং উদ্ধার করা উপকরণগুলিকে দ্বিতীয় বারের মতো ব্যবহার করা যেতে পারে। যদিও পুনর্ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে কার্যকর উপায়। তবে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ ও বাছাইয়ের ক্ষেত্রে অসুবিধার কারণে এই পদ্ধতিটি পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে না। বাংলাদেশ সরকার প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে। সেই সাথে বেসরকারি পর্যায়ে প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ করায় অনেক বর্জ্য কমে যাচ্ছে। বাংলাদেশে প্রতিবছর ৬৩৩,১২৯ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপন্ন হয়, এর ৫১ শতাংশ পুনঃব্যবহার করা হচ্ছে যার পরিমাণ ৩২৩,০০০ টন। বাংলাদেশে প্রায় দুই হাজার শিল্পকারখানা রয়েছে, যার মধ্যে ৫০-৬০টি সরাসরি প্লাস্টিক টুকরা বিদেশে রপ্তানি করছে। তাছাড়াও প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করে বিভিন্ন ধরনের খেলনা তৈরি করা হচ্ছে।
প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারে, এটি এমন প্লাস্টিক যা জীবের ক্রিয়া দ্বারা পঁচে যায়। বিশেষত যে সকল প্যাকেজিং জৈব বর্জ্য থেকে সহজে পৃথক করা যায় না, সেখনে বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক ব্যবহার করে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা রয়েছে। বায়োডিগ্রেডেবল প্লাস্টিকগুলো জীব দ্বারা কার্বন ডাই অক্সাইড এবং জলের মধ্যে সম্পূর্ণ বিপাক হতে পারে, কিন্তু অক্সো-বায়োাডিগ্রেডেবল প্লাস্টিক গুলি পরিবেশে ধাতু ছেড়ে দিতে পারে।
প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য যে বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, তার মধ্যে জৈব ও অজৈব বর্জ্য আলাদা করে সংরক্ষণ অন্যতম। প্রাথমিক স্তর থেকে বর্জ্য আলাদা করা নিয়ে একটি নীতিমালা করা হয়েছে। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে প্লাস্টিক বর্জ্য প্রতিরোধ করতে সরকারের সাথে প্রত্যেক স্তরের মানুষ এর অংশগ্রহণ জরুরি। সেই সাথে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার্থে প্লাস্টিক বর্জ্য গুলো সম্পদে রূপান্তর করার প্রকল্প হাতে নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।