পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সমাজে অলসতা ও অকর্মণ্যতা এত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে গেছে, যার ফলে এক শ্রেণির লোক জীবন যাপনের জন্য ভিক্ষাবৃত্তিকে প্রধান অবলম্বন হিসেবে ধারণ করে রেখেছে। অথচ ইসলাম ধর্মে ভিক্ষাবৃত্তিকে একটি অত্যন্ত নিকৃষ্টতম পেশা বলে গণ্য করা হয়েছে। সক্ষম ও স্বাস্থ্যবান ব্যক্তিদের জন্য এটি মস্তবড় অপরাধ। দরিদ্র, অক্ষম ও উপায়হীন ব্যক্তিদের জন্য ভিক্ষা করার অনুমতি থাকলেও ইসলাম এর প্রতি উৎসাহ দান করে না। কোরআন ও হাদীসে এর অপরকারিতা ও ব্যবসা-বাণিজ্য করে সম্মানজনক ও হালাল জীবিকা উপার্জনের প্রতি বার বার তাগিদ দেয়া হয়েছে। তাছাড়া শ্রমের গুরুত্বের প্রতি ইসলাম বিশেষ জোর দিয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআন ও হাদীস হতে অসংখ্য উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে। উদাহরণ স্বরূপ এখানে মাত্র কয়েকটি আয়াত ও হাদীসের উল্লেখ করা হল: আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘এবং (হে মানব) সত্য সত্যই আমি তোমাদেরকে দুনিয়াতে সুদৃঢ় স্থান দান করেছি এবং তোমাদের উপজীবিকার জন্য (সেখানে) নানাবিধ উপায় সৃষ্টি করে দিয়েছি। (কিন্তু) তোমাদের কৃতজ্ঞতা খুবই সামান্য’ (সূরা: আ’রাফ, ১ম রুকু, ১৪ নং আয়াত)। ‘আর তোমাদের নিদ্রাকে কি বিশ্রামের (উপকরণ) করে দেইনি। আর রাতে কি তোমাদের আচ্ছাদন করে দেয়নি, আর দিনকে কি রুজি-রোজগারের অবলম্বন স্বরূপ করে দেইনি’ (সূরা: নাবা, আয়াত: ৯-১১)। ‘তোমরা এই সময় (ব্যবসা-বাণিজ্যের দ্বারা) আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করলে তোমাদের উপর কোন অপরাধ বর্তাবে না’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৯৮)।
জীবিকা নির্বাহের অবলম্বন সম্বন্ধে আল্লাহ তাআলা-এর উপরোক্ত নির্দেশগুলো ছাড়াও কোরআনে আরও বহু আদেশ রয়েছে। জীবিকা অর্জনের জন্য মানব সমাজকে তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করার উপদেশ দান করেছেন। সূরা নেসা তে’ আল্লাহপাক এরশাদ করেন, ‘হে মোমেনগণ! তোমরা নিজেদের (জাতীয়) ধন-সম্পদগুলোকে পরস্পরের মধ্যে অন্যায়ভাবে গ্রাস করো না, তবে সকল পক্ষের সম্মতিক্রমে বাণিজ্য সূত্রে, তাতে দোষ নেই, আর (সাবধান!) তোমরা পরস্পরকে হত্যা করো না, নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি করুণাশীল’ (সূরা: নেসা, রুকু- ৫, আয়াত: ২৯)।
এই উক্তিতে আল্লাহ তাআলা মুসলমানদেরকে যৌথ কারবার করতে বলেছেন। তিনি ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আদেশ করে নিজেদের ধন অন্যায় রূপে ভোগ করতে নিষেধ করেছেন। সূরা বাকারাতে আরও বলেন, ‘অথচ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন আর সুদকে করে দিয়েছেন হারাম’ (রুকু- ৩৮ আয়াত: ২৭৫)। তেজারত বা ব্যবসা এক দিকে যেমন জনসাধারণের পক্ষে অশেষ উপকারী অন্যদিকে সাধুতার অভাব ঘটলে এই ব্যবসা-বাণিজ্যই হয়ে দাঁড়ায় দেশের ও জাতির সর্বনাশের প্রধানতম কারণ। হজরত আবু সাঈদ (রা.) কর্তৃক বর্ণিত, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘কেয়ামতের দিন সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত ব্যবসায়ীগণ, পয়গম্বর, সত্যপরায়ণ (সিদ্দীক) এবং শহীদদের সহচর হবেন।’ হুজুর (সা.) আরও বলেন, ‘সর্বাপেক্ষা অধিক হালাল সেই উপজীবিকা যা মানুষ নিজে কামাই করে আর সততার সাথে ব্যবসা করে উপার্জন করে।’ ‘ইয়াহইয়াউল উলুম’ নামক কিতাবে আরও বর্ণিত আছে, “তোমাদের অবশ্যই ব্যবসা অবলম্বন করা উচিত, যেহেতু দশ ভাগের নয় ভাগ উপজীবিকা ব্যবসার মধ্যে নিহিত আছে।” হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেন, হুজুর (সা.) বলেন, ‘ফজরের (নামাজের) পর বৈধ উপায়ে জীবিকা অর্জন করা ফরজ বা অপরিহার্য কর্তব্য।’
একবার হজরত (সা.) এর নিকট জিজ্ঞাসা করা হলো যে, ‘কোন উপায়ে জীবিকা অর্জন করা সর্বাপেক্ষা সুন্দর?’ তিনি বললেন, ‘যা হস্ত দ্বারা লাভ করা যায় তা এবং সততার সাথে প্রত্যেক ব্যবসা।’ মহানবী (সা.) আরও বলেন, ‘যে ব্যক্তি কায়িক পরিশ্রম দ্বারা জীবিকা অর্জন করে তা অপেক্ষা অধিকতর বৈধ উপজীবিকা আর কেউই উপভোগ করতে পারে না। আল্লাহর নবী হজরত দাউদ (আ.) স্ব-হস্তে উপার্জিত জীবিকা উপভোগ করতেন’ (ইয়াহইয়াউল উলুম)।
আল্লাহ ও আল্লাহর রসূল (সা.) জীবিকা উপার্জনের প্রতি যেখানে অত্যন্ত গুরুত্ব আরোপ করেছেন, সেখানে ভিক্ষাবৃত্তির কঠোর নিন্দাও করেছেন। হুজুর (সা.) বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে কোনো ব্যক্তির পক্ষে কঠোর বোঝা বহন করা ভিক্ষাবৃত্তির অবলম্বন করা অপেক্ষা বহু গুণে উত্তম। কেননা, ভিক্ষা চাইলে কেউ দেয় আবার কেউ দেয়ও না, এতে মানবতার অপচয় ঘটে’ (বোখারী)। রসূলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘তোমার পক্ষে বোঝা বয়ে যাওয়া কর্তব্য। কিন্তু সাবধান! ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন করো না’ (বোখারী)। অপর এক হাদীসে বলা হয়েছে, ‘যে ব্যক্তি ভিক্ষাবৃত্তির হাত হতে উদ্ধার পাওয়ার জন্য এবং সন্তান-সন্ততি প্রভৃতি পরিবারবর্গের প্রতিপালনের উদ্দেশ্যে ও প্রতিবেশীদের দুঃখ-কষ্ট নিবারণের আকাক্সক্ষায় বৈধ উপায়ে পার্থিব সম্পদের অন্বেষণ করে, সে ব্যক্তি কলুষবিহীন পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় মুখ নিয়ে আল্লাহর সমীপে উপনীত হবে’ (ইয়াহইয়াউল উলুম)।
আনসার সম্প্রদায়ের এক ব্যক্তি হুজুর (সা.) এর নিকট উপস্থিত হয়ে সওয়াল করল। হুজুর (সা.) তাকে বললেন, ‘তোমার ঘরে কোনো জিনিস আছে কি?’ সে উত্তর করল, ‘মাত্র একখানা কম্বল আছে। তার কতকাংশ গায়ে দিয়ে থাকি এবং কতকাংশ বিছিয়ে থাকি, আর একটি ছোট পেয়ালা আছে, যার দ্বারা পানি পান করে থাকি।’ হুজুর (সা.) বললেন, ‘সেই দুইটি জিনিস আমার কাছে উপস্থিত কর।’ আনসারী তা উপস্থিত করলে হুজুর (সা.) তা নিজের হাতে নিয়ে বললেন, ‘এই জিনিস কে খরিদ করবে?’ উপস্থিত লোকদের মধ্যে হতে এক ব্যক্তি বলল, ‘এক দেরহাম (আমাদের টাকার এক তৃতীয়াংশের কিছু বেশি) মূল্যে এই দুইটি জিনিস আমি কিনতে প্রস্তুত আছি।’ তারপর হুজুর (সা.) দুই বা তিন বার বললেন, ‘এক দেরহামের বেশি দিতে রাজি আছে কে?’ আর এক ব্যক্তি বলল, ‘আমি দুই দেরহাম দিতে প্রস্তুত আছি।’ অতঃপর হুজুর (সা.) তার নিকটে ঐ জিনিস দুইট বিক্রয় করলেন এবং সেই দুইটি দেরহাম আনসারীকে প্রদান করে বললেন, ‘এর এক দেরহাম দ্বারা খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করবে এবং অপর দেরহাম দ্বারা একটি কুড়াল খরিদ করে আমার নিকট নিয়ে আসবে।’ অতঃপর আনসারী কুড়াল ক্রয় করে হুজুর (সা.) এর নিকট উপস্থিত হলে তিনি তাঁর পবিত্র হাত দ্বারা হাতলী সংযোগ করে দিলেন এবং বললেন, ‘যাও, এটা দ্বারা জঙ্গল হতে লাকড়ী (কাঠ) কেটে বিক্রয় করতে থাক। ১৫ দিনের মধ্যে যেন তোমাকে দেখতে না পাই।’ আনসারী প্রস্থান করল এবং কাঠ কেটে বিক্রয় করতে আরম্ভ করল। যখন দ্বিতীয়বার হুজুর (সা.) এর নিকট উপস্থিত হলো, তখন দশ দেরহাম তার নিকট সঞ্চয় হয়েছিল। তন্মধ্যে কয়েক দেরহামের বস্ত্র ও খাদ্যদ্রব্য ক্রয় করা হয়েছিল। হুজুর (সা.) তাকে বললেন, ‘ভিক্ষাবৃত্তি করলে কেয়ামতের দিন তোমার মুখে যে কলঙ্ক-কালিমা লিপ্ত হতো, তা অপেক্ষা এটি উত্তম।’ অতঃপর তিনি বললেন, “যে ব্যক্তি অত্যন্ত ক্ষুধার্ত (অথচ উপায়হীন) এবং সে ব্যক্তি অত্যন্ত ঋণী (অথচ শোধ করবার উপায় নেই) এবং যে ব্যক্তি ‘দিয়াত’ দিতে আদিষ্ট হয়েছে (অথচ সে দরিদ্র) মাত্র এই তিন প্রকারের লোক ব্যতীত আর কারও পক্ষে ভিক্ষা চাওয়া জায়েজ নয়।”
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।