পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রভাব বিস্তার নিয়ে এক শ্রেণির স্থানীয় রাজনৈতিক নেতার কর্মকান্ড শিক্ষার মানোন্নয়নের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথমেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সময়োপযোগী পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছিল। এ ক্ষেত্রে নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগকে শিক্ষার মানোন্নয়নে একটি মাইল ফলক অর্জন হিসেবে গণ্য করা যায়। ২০১০ সালে গৃহীত শিক্ষানীতির ভালমন্দ দিক নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলেও একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের উদ্যোগ অনেক বড় পদক্ষেপ। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর থেকেই নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতার আলোকে একটি সময়োপযোগী শিক্ষানীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়নে বিভিন্ন সময়ে প্রায় প্রতিটি সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষা কমিশন গঠনসহ নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও বাস্তবে কোনো সরকারই দেশবাসীকে একটি পূর্ণাঙ্গ নতুন সময়োপযোগী শিক্ষানীতি উপহার দিতে পারেনি। সে অর্থে মহাজোট সরকারের গৃহীত শিক্ষানীতি পূর্ণাঙ্গ কিনা, সময়োপযোগী কিনা, আধুনিক শিক্ষা, নৈতিক ও কর্মমুখী শিক্ষার সমন্বয় সম্ভব হয়েছে কিনা, শিক্ষার বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ এই শিক্ষানীতিতে আছে কিনা, তা নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও সাহস করে একটি নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের উদ্যোগকে স্বাগত জানাতে কার্পণ্য করা সমীচীন নয়। তবে গত এক দশকেও নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের সুফল দৃশ্যমান হচ্ছে না। এটি অবশ্যই চিন্তার বিষয়। নতুন শিক্ষানীতি বাস্তবায়নে যে হারে বাজেট বরাদ্দের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে তা পুরোপুরি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। তবে হাজার হাজার কোটি টাকার অবকাঠামো উন্নয়ন, বছরের প্রথম দিনেই কোটি কোটি শিক্ষার্থীর হাতে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক তুলে দেয়া, শিশুদের ঝরে পড়া রোধ করতে এবং দরিদ্র পরিবারের সন্তানদের স্কুলমুখী করতে স্কুল ফিডিং, মেয়েদের শিক্ষাবৃত্তিসহ নানা উদ্যোগের মধ্য দিয়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাঙ্গনে এক প্রকার ইতিবাচক চাঞ্চল্য দেখা দিয়েছে। তবে প্রায় এক দশক ধরে নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিও বন্ধ রাখা, দক্ষ ও মানসম্মত শিক্ষকের কথা বাদ দিলেও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে শ্রেণি কার্যক্রম চালানোর মতো প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নিয়োগ নিশ্চিত করতে ব্যর্থতার চিত্র এখনো প্রকট। এই মুহূর্তে দেশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষকের ঘাটতি ৫০ হাজারের বেশি। হাজার হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয় চলছে কার্যত কোনো প্রধান শিক্ষক ছাড়াই। দু’জন বা তিনজন শিক্ষক দিয়ে প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত ৭টি শ্রেণির কার্যক্রম কোনো রকমে চালিয়ে নেয়া হচ্ছে হাজার হাজার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। কোথাও কোথাও স্থানীয়ভাবে নামমাত্র বেতনে খন্ডকালীন শিক্ষক দিয়ে জরুরি প্রয়োজন মেটানোর সংবাদ পাওয়া যায়। শিক্ষকের ঘাটতি অর্ধলক্ষাধিক, আবার চাকরিরত শিক্ষকদের মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ মানসম্মত শিক্ষক হিসেবে গণ্য হতে পারেন, এমন শিক্ষকের সংখ্যাও নগণ্য। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো, বিনামূল্যে বই ও বৃত্তির সুযোগ সুবিধা ইত্যাদির চেয়ে মানসম্মত শিক্ষক, কারিকুলাম, শিক্ষাপ্রণালী, সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশ, শৃঙ্খলা ও স্বচ্ছতা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাঙ্গনের মূল সংকট এখানেই।
একযুগ আগে দেশে রাজনৈতিক সংকটের মুখে সৃষ্ট ওয়ান-ইলেভেন সরকার বিরাজনীতিকরণের যে উদ্যোগ নিয়েছিল তার প্রথম আঘাতটি লাগে দেশের শিক্ষাঙ্গনে। সে সময় রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতার কারণে হাজার হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ভেঙ্গে দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এড-হক কমিটি গঠন করে বিদ্যালয় পরিচালনা শুরু হয়। পরবর্তিতে মহাজোট সরকার গঠনের পর সংসদ সদস্যদের হস্তক্ষেপে নতুন কমিটি গঠিত হলেও এক শ্রেণির শিক্ষক ও স্থানীয় প্রভাবশালী মহল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে যথেচ্ছভাবে পরিচালনার সুযোগ নিয়ে লুটপাটের আখড়ায় পরিণত করতে নিয়মিত কমিটি গঠনে নানাবিধ অন্তরায় সৃষ্টি করতে দেখা যায়। নিয়মিত কমিটি হলে অভিভাবক ও শিক্ষানুরাগী এলাকাবাসীর প্রতিনিধিদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ থাকায় একচেটিয়া লুটপাট ও দখলদারিত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না। তবে অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডারবাজি বা কমিশন বাণিজ্যের মতো দেশের কোথাও কোথাও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচনকে সরাসরি প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রিত করার মধ্য দিয়ে দখলদারি পরিবেশ সৃষ্টির অভিযোগও অনেক। এ ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তারে রক্তক্ষয়ী সংর্ঘষে হতাহতের ঘটনার খবর প্রায়শ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হতে দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া স্থানীয় সামাজিক-রাজনৈতিক বিভেদকে পুঁজি করে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ শিক্ষক ও প্রধানশিক্ষক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে মামলাবাজির প্যাঁচে ফেলে এ অজুহাতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিয়মিত কমিটি গঠন ঠেকিয়ে রাখছে বছরের পর বছর ধরে। পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এভাবে দুর্নীতি, বিশৃঙ্খলা, লুটপাটের মধ্য দিয়ে শিক্ষার মান ও ঐতিহ্য হারিয়ে অস্তিত্বের সংকটে পড়ছে। কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান যেনতেন প্রকারে পাবলিক পরীক্ষায় উচ্চ গ্রেড অর্জনের প্রতিযোগিতায় নেমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের হয়রানি ও অনৈতিক বাণিজ্যের শিকারে পরিণত করা হচ্ছে। যেনতেন প্রকারে পাসের হার ও জিপিএ-৫ প্রাপ্তির হার বৃদ্ধিকে তারা বিজ্ঞাপণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বছর শেষে ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য, বর্ধিত হারে টিউশন ফি নির্ধারণের মাধ্যমে বিদ্যালয়কে বাড়তি আয়ের ভাগ-বাটোয়ারার মৌরসিপাট্টায় পরিণত করছে। দেশের মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে গজিয়ে ওঠা লুটপাট চক্রের সবিস্তার প্রতিবেদন সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকায় লিড নিউজ হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বিদ্যালয় পরিচালনা পরিষদ (এসএমসি) ও গভর্নিং বডি(জিবি)’র অনিয়ম-দুর্নীতি ও কর্মকাÐের নানা অসঙ্গতি ও ব্যত্যয় তুলে ধরা হয়। ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক পদ-পদবি, উপরিমহলের ছত্রছায়া ও প্রভাব ব্যবহার করে একেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে পরিণত করাই যেন তাদের মূল লক্ষ্য। সমাজের হিতৈষী, শিক্ষানুরাগী ও ত্যাগী মানুষগুলোর নিরলস শ্রম, অকুণ্ঠ দান ও ত্যাগের মূল্যে গড়ে ওঠা একেকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে সেই সব ব্যক্তি ও পরিবারের সদস্যদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনার বাইরে রেখে তারা যে একচ্ছত্র দখলদারিত্ব কায়েম করছে তাতে পুরো সমাজই অপুরণীয় ক্ষতির সন্মুখীন হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার সাথে জড়িত দানশীল ব্যক্তি ও তাদের পরিবার কোনো রাজনৈতিক বিচার-বিবেচনাকে প্রাধান্য না দিয়ে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিতে ত্যাগী মনোভাব নিয়ে এগিয়ে এলেও রাজনীতির মোড়ক ব্যবহার করে তাদের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও আন্তরিক অভিপ্রায় থেকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বঞ্চিত করার হীন প্রয়াসের মধ্যে রয়েছে সমাজকে পিছিয়ে দেয়ার অপরিণামদর্শী ষড়যন্ত্র। নিছক দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি, রাজনৈতিক শ্লোগানবাজি ও প্রভাব বিস্তারের অনৈতিক তৎপরতা দিয়ে শিক্ষাব্যবস্থাকে ইতিবাচক ধারায় উন্নীত করে সমসাময়িক বিশ্বের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
দেশের অর্থনীতি ভালো নেই। আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও দেশের অথর্নৈতিক প্রবৃদ্ধি পরিসংখ্যানে সন্তোষজনক হলেও খোদ অর্থমন্ত্রীও অর্থনীতির মন্দার কথা অকপটে স্বীকার করেছেন। দেশ থেকে নানাভাবে বছরে হাজার কোটি ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। ঘুষ-দুর্নীতি, লুটপাটের কালোটাকায় বিদেশে সম্পদ গড়ছে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী, আমলা, রাজনীতিবিদ, এমনকি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত কেউ কেউ কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি ও কমিশন বাণিজ্য করে বিদেশে সম্পদ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছে। সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিশন বাণিজ্য, অবৈধ মাদক ব্যবসায়, অস্ত্র চোরাচালান থেকে শুরু করে সামাজিক হানাহানি, নারীদের নিরাপত্তাহীনতা, সামাজিক অবক্ষয়, পৈশাচিকতা ও সামগ্রিক নিরাপত্তাহীনতার জন্য আমরা কাকে দায়ী করব? কেউ কেউ এর জন্য দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দায়ী করলেও মূলত এর পেছনে কাজ করছে শিক্ষার মানহীনতা, অনৈতিকতা, লুটপাট ও দখলদারিত্বের সংস্কৃতি। এখন দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে দলীয় রাজনৈতিক শ্লোগানবাজির খোয়াড়ে আবদ্ধ করে ফেলা হয়েছে। জাতিকে যারা উন্নত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন, যারা দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ সমৃদ্ধ ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপরেখা তুলে ধরছেন তাদেরকে প্রথমেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে দলীয় রাজনীতির লেবাসধারী লুটেরা দখলবাজদের বিরুদ্ধে নির্মোহ নিরপেক্ষ শক্ত অবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। ক্যাসিনো জুয়াড়ি, মাদক-সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজদের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কঠোর অবস্থানের কিছুটা প্রতিফলন ইতোমধ্যে দেশের মানুষ দেখেছে। সরকারি দলের অঙ্গ সংগঠন যুবলীগ-ছাত্রলীগের এক শ্রেণির নেতা নিজেদেরকে আইনের ধরাছোঁয়ার ঊর্ধ্বে থাকা বিশেষ সুবিধাভোগী, ক্ষমতার অবিচ্ছেদ্য অংশীদার বলে ভাবতে শুরু করেছিল। জিকে শামীম, খালেদ মাহমুদ, ঈসমাইল স¤্রাট থেকে শুরু করে ওমর ফারুক চৌধুরী পর্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তিরা প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে চলমান দুর্নীতি, মাদক ও জুয়া বিরোধী অভিযানে আটক, বহিষ্কারের সন্মুখীন হওয়ার পর দেশবাসী কিছুটা আশার আলো দেখেছে। কিন্তু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলীয় রাজনৈতিক দখলদারিত্বের ভূত তাড়াতে না পারলে কোনো অভিযানেই দেশ থেকে দুর্নীতি, অস্বচ্ছতা, অবক্ষয় ও অনৈতিক ব্যবস্থা স্থায়ীভাবে রোধ করা সম্ভব নয়। একইভাবে চাঁদাবাজি, কমিশন বাণিজ্য ও অনৈতিক কর্মকাÐের অভিযোগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতা শোভন-রাব্বানিদের বহিষ্কার করলেও ছাত্রলীগ নেতাদের বেপরোয়া কর্মকান্ড রোধ করা সম্ভব হয়নি। বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার ফাহাদ হত্যার পর অভিযুক্তরা মামলায় আটক হওয়ার পরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। দীর্ঘ ২৮ বছর পর অনুষ্ঠিত ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত ডাকসু ভিপি নুরুল হক নুর ও সহযোগীদের ডাকসু ভবনে ঢুকে নির্মমভাবে পিটিয়েছে ছাত্রলীগের ক্যাডাররা। এভাবেই দেশের সবচেয়ে প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনটির গৌরবময় ঐতিহ্য নির্মমতা, পৈশাচিকতা ও বেপরোয়া অপরাধ প্রবণতার অন্ধকারে হারিয়ে যেতে বসেছে। এরই সাথে সাথে দেশের শিক্ষাঙ্গন ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জ্ঞান-বিজ্ঞান, সুশিক্ষা, নীতি-নৈতিকতা, সৃজনশীলতা, সাম্য, মৈত্রী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ চর্চার সুযোগ, পরিবেশ ও ক্ষেত্র ক্রমে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় জাতি ক্রমে পিছিয়ে পড়তে শুরু করেছে। দেশে উচ্চ শিক্ষার সার্টিফিকেটধারী লাখ লাখ যুবক বেকার ঘুরে বেড়ালেও প্রতিবেশী দেশের অর্ধশিক্ষিত যুবকরা উচ্চ বেতনের চাকরি বাগিয়ে নিয়ে দেশ থেকে শত শত কোটি টাকা পাচার করে দেয়ার বাস্তবতা থেকে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দুবর্লতা, কর্মমুখী শিক্ষার অকার্যকারিতা ও নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতাই ধরা পড়ে। এভাবে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিকভাবে দেশকে দুর্বল ও পঙ্গু করে দেয়া হচ্ছে। দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম ও নিরাপত্তাহীনতা দূর করতে হলে প্রথমেই শিক্ষাব্যবস্থা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনৈতিক-রাজনৈতিক দখলবাজি থেকে মুক্ত করে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
উপযুক্ত কর্মসংস্থানের অভাবে দেশের লাখ লাখ শিক্ষিত তরুণ হতাশার অন্ধকারে ডুবে যাচ্ছে। অনেকেই মাদক ও অপরাধ জগতের দিকে পা বাড়াচ্ছে। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় দেশে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, রফতানিমুখী শিল্পে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আশানুরূপ না হলেও যা হচ্ছে তাতে দেশের বেকার তরুণ সমাজের কর্মসংস্থানের সুযোগ বিদেশিদের দ্বারা বেহাত হয়ে যাচ্ছে। গার্মেন্ট খাতসহ বেশ কিছু সেক্টরে ৫ লক্ষাধিক ভারতীয় কর্মী অবৈধভাবে কাজ করে দেশ থেকে প্রতি মাসে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। অবৈধ ভারতীয়দের কাজ দেয়ার অজুহাত হিসেবে দেশে দক্ষ কর্মীর অভাবের কথা বলা হয়। তবে সিপিডি’র গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়োগদাতারা দেশীয় কর্মী নিয়োগের চেষ্টা না করেই কোনো অদৃশ্য কারণে ভারতীয়দের নিয়োগ দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা ভারতে পাচার করার এবং দেশকে রাজস্ব বঞ্চিত করার অবাঞ্ছিত তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। দেশে একটি সরকারি টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় এবং তার অধীনস্থ অন্তত ৬টি সরকারি টেক্সটাইল কলেজ ছাড়াও টেক্সটাইল, ফেব্রিক্স ও ফ্যাশন ডিজাইনিংসহ সরকারি বেসরকারি মিলিয়ে এ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান রয়েছে শতাধিক। দেশের সব সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের পাশাপাশি এসব প্রতিষ্ঠান যদি দেশের রফতানিমুখী সেক্টরের জন্য দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করতে না পারে তাহলে বুঝতে হবে আমাদের শিক্ষায় বড় ধরনের গলদ রয়েছে। তবে লাখ লাখ ভারতীয় কর্মী নিয়োগের পেছনে ভিন্ন শক্তির প্রভাব বলয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ পরিস্থিতি সামাজিক-অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে দেশকে এক গভীর সংকটের মুখে ঠেলে দিতে উদ্ধত হয়েছে। দেশের প্রায় সব রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সাধারণ মানুষের আস্থাহীনতায় পড়ার বাস্তবতা যে কোনো দেশের সরকার ও প্রশাসনের জন্য বিপজ্জনক দুর্বলতা। শিক্ষাব্যবস্থাকে রাজনৈতিকভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে এ অনাস্থার পরিবেশ সমাজের মর্মমূলে শিকড় বিস্তার করেছে। সরকারি দলের সাথে সংশ্লিষ্ট এক শ্রেণির অতি উৎসাহী নেতাকর্মী ও বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পোশাকধারী দলবাজ ব্যক্তিরা এর জন্য দায়ী। ইউনিয়ন-থানা থেকে শুরু করে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ যখন ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের সন্ত্রাসে কলঙ্কিত হয়, দেশের প্রত্যন্ত এলাকা থেকে শুরু করে রাজধানী ঢাকার সিটি নির্বাচনে যখন শতকরা আশিভাগ ভোটার ভোট কেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকেন, তখন তা দেশের গণতন্ত্র ও রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের অনাস্থা হিসেবেই গণ্য হয়। যে কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার জন্য এটি অশনি সংকেত। সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যতই দুর্বল বা নেতৃত্বশূন্য হোক না কেন। এ ধরনের বাস্তবতায় ক্ষমতাসীন সরকার দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকেই ধীরে ধীরে নিজেদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বানিয়ে ফেলতে শুরু করে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এটি একটি আত্মঘাতি প্রবণতা। এ থেকে উত্তরণের প্রায় সব ধাপই সরকার ও সরকারি দলের নেতাকর্মী ও সরকারি প্রশাসনের হাতে। প্রথমত ধর্ম-বর্ণ, সামাজিক- রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অবস্থান নির্বিশেষে সমাজের সব মানুষের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও আইনের শাসন নিশ্চিত করার মাধ্যমেই এ ধরনের পরিস্থিতির উত্তরণ সম্ভব। শিক্ষার জাতীয় লক্ষ্য ও জাতীয় সংবিধানে উল্লেখিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতির সমন্বিত বাস্তবায়ন ছাড়া শান্তিপূর্ণ, সমৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। সংবিধানের দ্বিতীয় অধ্যায়ের ৮ থেকে ২৫ পর্যন্ত ১৭টি অনুচ্ছেদে বর্ণিত রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো আমাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা ও সুশাসনের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। অষ্টম অনুচ্ছেদের শুরুতেই সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাসকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এরপর এই অনুচ্ছেদে গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং সামাজিক-অর্থনৈতিক সুবিচারের অর্থে সমাজতন্ত্রকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। আজকে আমাদের দেশে যে সর্বগ্রাসী অবক্ষয়, লুণ্ঠন, সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও অবিচারের সংস্কৃতি, আমাদের রাষ্ট্রীয় মূলনীতির অনুসরণ থেকে বিচ্যুতির মাধ্যমেই সূত্রপাত ঘটেছিল। বিশেষত দেশের শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষানীতি ও শিক্ষাকারিকুলামকে ধর্মীয় মূল্যবোধ, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ন্যায়বিচারের নীতির সাথে সমন্বিত করতে না পারার ব্যর্থতা আমাদের চলমান বিপর্যয়ের কারণ। শরিষার ভেতরের ভূতকে আগে তাড়াতে হবে। শিক্ষা কারিকুলাম থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রশাসনের ভেতরকার দুর্বলতা চিহ্নিত করার পাশাপাশি শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতার দাপট, লুটপাট-দখলবাজির রাজনৈতিক প্যারাসাইট দূর করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ ছাড়া কোনো বিচ্ছিন্ন পুলিশি অভিযানে দুর্নীতি, লুটপাট ও সন্ত্রাস বন্ধ হবে না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।