Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, ০৪ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনের সঠিক প্রয়োগ চাই

পারভীন রেজা | প্রকাশের সময় : ৩১ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

মানুষের পারষ্পরিক নির্ভরশীলতার কারণে সৃষ্টি হয়েছে পরিবার ও সমাজ। সমাজের প্রতিটি মানুষের ব্যক্তি জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো বিয়ে। বিয়ে মানব জীবনের এক পবিত্র বন্ধন। কিন্তু বাংলাদেশে অধিকাংশ নারীর বিয়ের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে যৌতুক নামক সামাজিক ব্যাধি। অথচ যৌতুক বিয়ের কোনো শর্ত বা উপাদান নয়। আইনের কোথাও এর স্বীকৃতি নেই। সর্বপ্রথম কিভাবে বা কোথায় যৌতুক আদান প্রদান শুরু হয়েছিল সে সর্ম্পকে কোনো তথ্য পাওয় যায় না। ধারণা করা হয়, হিন্দু স¤প্রদায় থেকে এ প্রথাটি সামাজিক রীতিতে পরিণত হয়েছে। কারণ হিন্দু আইনে নারীদের উত্তরাধিকার সূত্রে সম্পত্তির কোনো অংশ দেওয়া হয় না। তবে বিয়ের সময় কন্যাপক্ষ বিপুল অংকের টাকা বা মূল্যবান দান সামগ্রী বরপক্ষকে পণ বা যৌতুক হিসেবে দিয়ে থাকে। কালের আর্বতে এই পণ প্রথার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিবর্তিত হয়ে যৌতুক রূপে শুধু হিন্দু সমাজে নয়, সমাজের সকল ধর্মে সর্বস্তরে ভয়াবহরূপে নির্যাতনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

যৌতুকের কারণে প্রতিদিন পবিত্র মধুর বিয়ের বন্ধন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মেয়ে এবং মেয়ের অভিভাবকদের জীবন হয়ে উঠছে দুর্বিষহ। যৌতুক দানে অপারগ পিতামাতা অপমান ও লাঞ্ছনার শিকার হচ্ছেন। নারীরা বিভিন্ন পর্যায়ে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। প্রতিবছর যৌতুকের কারণে বহু নারী আত্মহত্যা করছে। এভাবে যৌতুক প্রথাই সমাজে নারী নির্যাতনের পথকে প্রশস্থ ও দীর্ঘস্থায়ী করছে। কিন্তু সরকারি ও বেসরকারিভাবে এ সর্ম্পকিত নির্যাতন, হত্যার সঠিক হিসাব নেই। কারণ শুধুমাত্র যারা রির্পোট করে তাদেরটাই প্রকাশিত হয়। বহু অজানা নির্যাতনের খবর চাপা পড়ে যায়। যৌতুকের নির্মম পরিণতিতে অনেক অপ্রত্যাশিত আসামাজিক অবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে যা আইনগতভাবে নিষিদ্ধ।

আইনের দৃষ্টিতে যৌতুক: বাংলাদেশে যৌতুক নিরোধ সংক্রান্ত আইন আছে। ১৯৮০ সালের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনের ২ ধারায় যৌতুকের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) আইন ২০০৩ এর ২ (ঞ) ধারায়ও যৌতুকের অর্থ বলা হয়েছে। আইন মোতাবেক ‘যৌতুক’ অর্থ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দিতে সক্ষম হওয়া কোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানত যা একপক্ষ অন্যপক্ষকে বিয়ের আগে বা পরে বা বিয়ের সময় দেয়। যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনে ‘বর’ বা ‘কনে’ যে কোনো পক্ষ অন্য পক্ষকে যে সম্পদ দিয়েছে বা দেবে বলে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাই যৌতুক হিসেবে গণ্য হয়।

২০০৩ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে যৌতুক বলতে ‘বরপক্ষ’ কর্তৃক কন্যাপক্ষের কাছে দাবিকৃত অর্থ-সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদকেও যৌতুকের অর্ন্তভুক্ত করেছে যা ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনে ছিল না। ১৯৮০ সালের যৌতুক নিরোধ আইনে যৌতুক বলতে যে কোনো সম্পত্তি বা মূল্যবান জামানতকে বোঝানো হয়। উভয় আইনের প্রেক্ষিতে যৌতুক বলতে মূলত সম্পত্তি, জামানত ও ব্যাপক অর্থে অর্থ সামগ্রী অর্থাৎ অর্থের সাথে সম্পৃক্ত সকল জিনিসই যৌতুক। এভাবে ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন যা ২০০৩ সালে সংশোধিত, ১৯৮০ সালের যৌতুকের সজ্ঞাটি বি¯তৃৃত করে যুগোপযোগী করেছে।

যৌতুকের পরিণতি: সামাজিক বাস্তবতায় আমরা দেখতে পাই, বিয়ের সময় ছেলে পক্ষ যৌতুক নিয়ে বিয়ে করলে বিয়ের পরে কারণে অকারণে আরও বেশি পাওয়ার জন্যে স্বামী ও স্বামীল আত্মীয়-স্বজন নির্যাতন করতে থাকে। এছাড়া যৌতুকের লোভে নিম্ন মধ্যবিত্ত পুরুষরা একাধিক বিয়ে করে থাকে আ সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণ হয়ে পড়ে। সামান্য কারণে স্ত্রীকে তালাক দিয়ে যৌতুক নিয়ে আবার বিয়ে করে। আবার কিছু ক্ষেত্রে স্বামী কোনো কিছু না বলে দিনের পর দিন স্ত্রীকে বাবার বাড়িতে থাকতে বাধ্য করে। এমনকি স্ত্রীর সম্পত্তির লোভে স্বামীরা অলস জীবন কাটায়। প্রতিবছর যৌতুকের কারণে অসংখ্য নারী শারীরিকভাবে নির্যাতিত হয়, শারীরিকভাবে নির্যাতনের পর নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় (যেমন: পিটিয়ে, অগিদগ্ধ করে ইত্যাদি) এসিড নিক্ষেপের শিকার হয়, যৌতুকের দাবি আদায়ে ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে স্বামী কর্তৃক তালাকপ্রাপ্ত হয়, বা নির্যাতন থেকে স্বেচ্ছায় মুক্তির জন্য মহিলারা আত্মহত্যা করে। অথচ বাস্তবে এর বিরূদ্ধে মামলা কার হয় হাতে গোনা কয়েকটি মাত্র। ইউএনডিপি কর্তৃক এক রির্পোটে প্রকাশিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের ৫০% বিবাহিত মহিলা যৌতুকের কারণে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।

যৌতুক নিরোধকল্পে আইনগত বিধান : দক্ষিন এশিয়ায় সর্বপ্রথম ভারত যৌতুক সমস্যা নিয়ন্ত্রন করার উদ্দেশ্যে ১৯৬১ সালে আইন পাস করার পদক্ষেপ নেয় যা The Dowry Prohibition Act,, ১৯৬১. পরবর্তীকালে পাকিস্তান আমলে এ সম্পর্কিত আইন প্রনয়ন করা হলেও তা শুধুমাত্র পশ্চিম অংশের জন্য প্রযোজ্য থাকে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে যৌতুক সমস্যা ক্রমাগত নারীর প্রতি বর্বরতম নিষ্ঠুর আচরণের দিকে এগুতে থাকলে তা প্রতিরোধকল্পে আইন প্রণীত হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে যৌতুক নিষিদ্ধ করার জন্য যে সকল আইন আছে তা হলো: যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইন, ১৯৮০ (সংশোধিত ১৯৮৪) এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)। উল্লেখ্য, এই আইনসমূহ বাংলাদেশে বসবাসরত সকল ধর্মের মানুষের জন্য প্রযোজ্য।
১৯৮০ সালের যৌতুক নিষিদ্ধকরণ আইনের ৩ ধারা মোতাবেক যৌতুক নেওয়া ও দেওয়া দুটোই নিষিদ্ধ এবং অপরাধ। যদি কেউ যৌতুক দেয় ও বা গ্রহণ করে বা আদান প্রদানে সহায়তা করে বা কুপ্ররোচনা দেয় এরকম সকলেই আইনে শাস্তি পাবে। যে কোনোভাবে যৌতুক দাবি করার করুক না কেন সে সর্বাধিক ৫ বছর এবং ১ বছরের নীচে নয় মেয়াদের কারাদন্ড বা ৫০০০ টাকা জরিমানা বা উভয়দন্ডে দন্ডিত হতে পারে। এই আইনের ৪ ধারায় শুধুমাত্র প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে কনের অভিভাবকের কাছ থেকে যৌতুক দাবি করার জন্য দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। যদিও বাস্তবে কেউ যৌতুক দাবি করলেও সাক্ষী প্রমান রাখে না তাই অপরাধ প্রমান করা কঠিন হয়ে যায়। বিশেষ করে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেনীর নারীরা বেশি এসব সমস্যার সম্মুখীন হয়।

নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ১১ ধারার ক ও খ উপধারায় যৌতুকের শাস্তির বিধান সন্নিবেশিত হয়েছে। তবে এখানে বিয়ের পরে যৌতুকের জন্য নির্যাতনের শাস্তির বিধান বিধিবদ্ধ করা হয়েছে। এই আইনের মাধ্যমে যৌতুক কেন্দ্রিক নির্যাতনের প্রতিকারের ব্যস্থা রাখা হয়েছে। ১১ ধারার ক ও খ উপধারা অনুযায়ী যদি কোনো নারীর স্বামীর কোনো আত্মীয়-স্বজন যৌতুকের কারণে উক্ত নারীর-মৃত্যু ঘটান, মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করেন, মারাত্মক জখম করেন বা সাধরন জখম করেন তবে তার শাস্তি হলো, মৃত্যু ঘটানোর জন্য মৃত্যুদন্ড ও জরিমানা; মৃত্যু ঘটানোর চেষ্টা করার জন্য যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও জরিমানা; মারাত্মক জখমের জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড বা অনধিক ১২ বছর কিন্তু অন্যুন ৫ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ড; মারাত্মক জখমের জন্য অনধিক ৩ বছর কিন্তু অন্যুন ১ বছর সশ্রম কারাদন্ড এবং এর অতিরিক্ত অর্থদন্ড। এছাড়া এই আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী গঠিত একটি বিশেষ ট্রাইবুনালের উল্লেখ আছে য়েখানে নির্যাতনের বিচার পরিচালিত হবে। এই আইনে রুদ্ধদ্বার কক্ষে বিচারের সুবিধাও আছে। কারণ নির্যাতনের সঠিক বিচারের ক্ষেত্রে আদালতের ভ‚মিকা সবার আগে।

পরিবার হচ্ছে সমাজের ভিত্তি। যৌতুকের লোমহর্ষক পরিণতি পরিবার ও সমাজে চলতে থাকলে পারিবারিক সৌহার্দ্য ও সামাজিক মূল্যবোধ নষ্ট হয়ে যাবে। তাই সুস্থ পারিবারিক পরিবেশ বজায় রাখার জন্য যৌতুকের সহিংসতা রোধ করতে হবে।



 

Show all comments
  • ওবাইদুল ইসলাম ২ ফেব্রুয়ারি, ২০২০, ৬:০৮ পিএম says : 0
    প্রতি মকসজিদে জুম্মার খুতবার বয়ানে ও ওয়াজিদের ওয়াজে যৌতুকের বিরুদ্ধে বয়ান দেওয়া বাধ্যতামূলক করতে হবে ।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: যৌতুক


আরও
আরও পড়ুন