পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আবহমানকাল ধরেই যৌতুকের দাবিতে মেয়েদের নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। সরকারের বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরের যৌতুক প্রথার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফলতা সে অর্থে আসছেই না। সামাজিক এই ব্যাধি ছড়িয়ে পড়েছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। গ্রাম থেকে শহরে, উচ্চবিত্ত থেকে নিন্মবিত্ত সব জায়গায়ই এই ব্যাধির প্রকোপ বাড়ছেই দিন দিন।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৪ জন নারী। হত্যা করা হয়েছে আরও ২ জনকে। একইভাবে ফেব্রুয়ারিতে নির্যাতনের শিকার হয় ৪ জন। হত্যার শিকার হয় ৫ জন নারী। এর পরের মাসে অর্থাৎ মার্চে ১১ জন নারীকে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতন করা হয়। এসময় হত্যা করা হয় ৯ জনকে। এপ্রিল মাসে নির্যাতনের শিকার হয় ১০ নারী এবং নির্যাতনের কারণে মৃত্যু হয় ৬ জনের। মে মাসে নির্যাতিত হয় ৬ জন। একই সময় মৃত্যু হয় ৩ জন নারীর। জুন মাসে নির্যাতিত হয় ৯ জন নারী। এসময় হত্যা করা হয় ৫ জনকে। জুলাই মাসে নির্যাতনের শিকার হয় ৭ জন নারী। মৃত্যু হয় ২ জনের। আগস্টে নির্যাতনের শিকার হয় ৭ জন। মৃত্যু হয় আরও ১ জনের। তবে সেপ্টেম্বরে এ চিত্র ভয়াবহ রূপ নেয়। শুধু সেপ্টেম্বরে যৌতুকের দাবিতে নির্যাতিত হয় ১৬ জন নারী। হত্যা করা হয় ৫ জনকে। শুধু চলতি বছরই নয়, যৌতুকের দাবিতে গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৬৫ জন নারী নির্যাতনের শিকার এবং ৫২ জন নারী হত্যার শিকার হয় বলে মহিলা পরিষদের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
মানুষের জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে আরও আগেই। কিন্তু প্রাগৈতিহাসিক কালের নারী নির্যাতনের চিত্রের কোনো পরিবর্তন নেই। দেশ থেকে যৌতুকপ্রথা দূর করতে সরকার ১৯৮০ সালে যৌতুক নিরোধ আইন প্রণয়ন করেছিল। ওই আইনে বলা হয়েছিল, যৌতুক গ্রহণকারী ও যৌতুক প্রদানকারী উভয়ই সমান অপরাধী। তারা উভয়েই সর্বোচ্চ এক বছর মেয়াদের কারাদ- বা সর্বোচ্চ পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা অথবা উভয় প্রকার দন্ডে দন্ডিত হবে। ৩৮ বছর আগে আইনটি প্রণীত হলেও এ আইনের প্রয়োগ খুব একটা দেখা যায়নি। বরং যৌতুক আদান-প্রদান হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে- কখনো সরাসরি, কখনো বা অন্যভাবে। বরপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী কনেপক্ষ যৌতুক দিয়েই গেছে। আর যৌতুক না দেওয়ায় কত নারী যে নির্যাতনের শিকার হয়েছে, কত নারীর সংসার ভেঙেছে, আর কত নারী যে খুন হয়েছে, তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। কিন্তু যৌতুক চাওয়ার জন্য কারও শাস্তি হয়েছে, এমনটা খুব কমই দেখা গেছে।
সরকার যৌতুক আদান-প্রদান প্রতিরোধে ১৯৮০ সালের আইনটি সংস্কারের উদ্যোগ নেয়। ২০১৮ সালের মে মাসে ‘যৌতুক নিরোধ আইন ২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন দেয়। নতুন আইনে শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ দুটিই বাড়ানো হয়েছে। নতুন আইনে বলা হয়েছে, কেউ যৌতুক দাবি করলে তিনি পাঁচ বছরের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। আইনের পাঁচ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কাউকে ক্ষতিগ্রস্ত করার জন্য কেউ যদি যৌতুকসংক্রান্ত মিথ্যা মামলা দায়ের করেন, তারও সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের জেল থেকে সর্বনিন্ম এক বছরের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন। এই আইনের অধীনে সংঘটিত অপরাধ আমলযোগ্য ও জামিন অযোগ্য হবে তবে আপসযোগ্য হবে।
কনের পরিবার কর্তৃক বর বা তার পরিবারকে প্রদত্ত হস্তান্তরিত সম্পদ হলো যৌতুক। অন্যভাবে, যৌতুক হলো নববধূর নির্দিষ্ট সম্পত্তি, যা বিয়ের সময় বরের মালিকানা এবং নিয়ন্ত্রণে থাকে। সাধারণ অর্থে যৌতুক বলতে বিয়ের সময় বরকে কনের অভিভাবক কর্তৃক প্রদেয় অর্থ বা মূল্যবান সামগ্রীকে বুঝায়। এছাড়া বর-কনের আত্মীয়, অভ্যাগত অতিথিরাও সাধারণত স্বেচ্ছায় নবদম্পতিকে উপহার দিয়ে থাকেন, যা তারা তাদের নতুন সংসারে সুবিধামত ব্যবহার করতে পারেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নারীর ক্ষমতায়ন বা বাল্যবিয়ে বন্ধ করতে গেলেও আগে দরকার যৌতুকপ্রথা বন্ধ করা। তবে শুধু যারা যৌতুক নিচ্ছে, তারা নয়। যারা দিচ্ছে, তারাও অপরাধী। তাদের মতে, যৌতুক প্রথা কমেনি তো বটেই, উলটো এটি যেনো দিন দিন বেড়েই চলেছে। একসময় এটা একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এখন এটা সব জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছে। উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্ত, নিন্মবিত্ত সবার মধ্যেই এটা ছড়িয়ে আছে। সকল ধর্ম-বর্ণের মধ্যে এই যৌতুক প্রথা এখনও আসন গেড়ে বসে আছে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক রিপোর্টে দেখা যায়, দেশের ৮৭ ভাগ মেয়ে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। এর সিংহভাগই হচ্ছে যৌতুকের কারণে। বিয়ের ১০ বছর পরও যৌতুকের কারণে মেয়েদের নির্যাতন করা হচ্ছে, তার পরিবারের উপর চাপ দেয়া হচ্ছে। এটা বন্ধ করা না গেলে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্যবিয়ে বন্ধ বা মেয়েদের সম্মানজনক অবস্থায় কখনও নিয়ে যাওয়া যাবে না।
যৌতুকের ধরন গ্রাম এবং শহর ভেদে ভিন্ন। গ্রামের বিষয়গুলো দৃশ্যমান। সেখানে এখনো এটা প্রচলিত আছে যে, যৌতুক না দিলে মেয়ের বিয়ে হবে না। বয়স বেশি হলে যৌতুক বেশি দিতে হবে। মেয়ে কালো হলে যৌতুক ছাড়া বিয়ে দেওয়া যাবে না। মেয়ের শারীরিক কোনো ত্রুটি মানেই যৌতুক নিশ্চিত। এসব প্রতিবন্ধকতা যুগের পর যুগ একই রকম চললেও সম্প্রতি শহরে চলছে যৌতুকের নানান ‘ফরম্যাট’। এখানে উচ্চবিত্তরা চাকরি, গাড়ি, বাড়ি ইত্যাদি দিচ্ছে। যারা দিচ্ছে এবং নিচ্ছে, তাদের সামাজিকভাবে বয়কট না করলে এর থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় নেই।
সমাজের এই মারাত্মক ব্যাধিটি বন্ধে সর্বপ্রথম আইনের সংশোধন প্রয়োজন। তবে আইনের পাশাপাশি সামাজিক সচেতনতাও অত্যন্ত জরুরি। যারাই যৌতুক দিচ্ছে বা নিচ্ছে উভয়ই সমান অপরাধী। তাদের বয়কট করলে এই ব্যাধিটা অনেকটাই সেরে উঠবে। এর জন্য প্রয়োজন প্রচার-প্রচারণা, কর্মশালা, সেমিনার। এসবের মাধ্যমে এটা যে একটা ব্যাধি, তা মানুষকে বোঝাতে হবে। তাহলেই যৌতুক না দিতে পেরে আর কোনো মা-বাবাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে না। কোনো মেয়েকেও আর পোহাতে হবে না মৃত্যু যন্ত্রণা।
লেখক: ফ্রিল্যান্স রাইটার
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।