Inqilab Logo

শক্রবার ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ০৬ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

কাম্য পরিবেশ সুরক্ষায় পাখির প্রভাব ও অবদান

আফতাব চৌধুরী | প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০১ এএম

পৃথিবীর সকল জীব একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। খাদ্যশৃঙ্খলের মাধ্যমে একে অন্যের উপর এই নির্ভরশীলতার নাম বাস্তুতন্ত্র। মানুষ যেমন আলো-বাতাস-পানি ছাড়া বাঁচে না, তেমনি পশু, পাখি তথা জীবজগতও আলো-বাতাস-পানি ছাড়া বাঁচে না। তরুরাজি বৃক্ষলতার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এই পারস্পারিক নির্ভরশীলতা পৃথিবীকে করেছে সুন্দর, শোভন ও বাসযোগ্য। এর বিচ্যুতি হলেই পৃথিবীর জীবজগত ও প্রাণিকূল মহাসংকটে পতিত হবে। বিভিন্ন সভ্যতার মতো আধুনিক এ সভ্যতাও একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে না, তার নিশ্চতায়ই বা কোথায়?

পৃথিবীর আদিযুগে মানুষ যে পরিবেশে বসবাস করতো, সেখানে প্রাণিজগতের কেউ তার মিত্র ছিল না। সবাই শত্রæ এবং তাদের কেউ কেউ অনেক ভয়ংকর ও প্রাণঘাতি ছিল। কেবল মাত্র পাখি তাদের ভয়ের কারণ ছিল না। বলা যায়, মানুষ প্রকৃতি থেকে দুটি বড় উপহার পেয়েছে, তার একটি হলো উদ্ভিদ আর অন্যটি হলো পাখি। পাখি, উদ্ভিদ অরণ্যকে পরিপূর্ণতা দান করেছে আর মানুষ পাখি থেকে তার বাস্তব প্রয়োজন ও বিনোদনতৃষ্ণা মিটিয়েছে। আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও পাখির মাধ্যমে তার মেধা ও কল্পনাকে বিকশিত করেছে। পাখি থেকে মানুষ উড়োজাহাজের চিন্তা ভাবনা করেছে। তাই মানুষের জীবনের সাথে পাখিদের জীবন যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় দ্রæত বনায়ন বাস্তবায়নে পাখির ভূমিকা অনস্বীকার্য। ঋতুচক্রের পরিবর্তনের ফলে উত্তর গোলার্ধের শীত প্রধান অঞ্চলে যখন প্রচন্ড বরফ পড়ে তখনই বিভিন্ন প্রজাতির পাখিরা দক্ষিণগোলার্ধের অপেক্ষাকৃত উষ্ণমন্ডলীয় অঞ্চলে ছুটে আসতে থাকে। তাই আমরা দেখতে পাই প্রতিবছরই হেমন্তের বিদায় লগ্নে যখন শিশির ঝরা শুরু হয় মৌসুমী হাওয়ায় শুনা যায় শীতের আগমনী ধ্বনি, তখনই সুদুর সাইবেরিয়া অঞ্চল থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে পালে পালে ডানা ঝাপটিয়ে নানা ধরনের পাখি আমাদের দেশে ছুটে আসে। একইভাবে শীত প্রধান অঞ্চলসমূহে আবার বরফগলা শুরু হলে এসব পাখিরা নিজ নিজ দেশে ফিরে যায়। আমাদের দেশে এসব পাখি অতিথি পাখি নামে সমধিক পরিচিত। অতিথি পাখি আসতে শুরু করলে আমাদের দেশের চরাঞ্চল, জলাভূমি, বিল-হাওর ইত্যাদি এদের কলকাকলিতে মুখরিত হয়ে ওঠে। জলকেলিতে কিচির-মিচির ছন্দে এরা তখন জলাভূমির পরিবেশকে মোহনীয় করে তোলে। বিশেষ করে সাগরতীরবর্তী বিভিন্ন চরাঞ্চলে ঘন সবুজ বন-বনানীতে এসব অতিথি পাখি তাদের সাময়িক নিবাস গড়ে তোলে। আমাদের দেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, বাগেরহাট এলাকার নদীবিধৌত অঞ্চলে এবং সিলেট, সুনামগঞ্জ, ময়মনসিংহের বিভিন্ন হাওর ও বিলে শীতের মৌসুমে হাজার হাজার অচেনা পাখির মেলা বসে।দেশান্তরী এসব পাখির মূল বাসভ‚মি শীতপ্রধান এলাকা। সাইবেরিয়াসহ হিমালয়ের বনাঞ্চলে এদের বাস। শীত বাড়তেই এরা পাড়ি জমায় হাজার মাইল দূরদেশে। প্রাণী বিজ্ঞানীদের কথায়, বাংলাদেশের পাখি দু’শ্রেণীর। আবাসিক আর অনাবাসিক। অতিথি পাখিরা অনাবাসিক শ্রেণীর।

শীতের মৌসুমে আসা অতিথি পাখিদের মধ্যে রয়েছে- বালিহাঁস, পাতিহাঁস, লেজহাঁস, পেরিহাঁস, চমাহাঁস, জলপিপি, রাজসরালি, লালবুবা, পানকৌড়ি, বক, শামুককনা, চখাচখিম সারস, কাইমা, শ্রাইক, গাঙ কবুতর, বনহুর, হরিয়াল, নারুন্দি, মানিকজোড়- নাম না জানা কতো কী পাখী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাখিদের মধ্যে পৃথিবীর চৌম্বক শক্তিকে স–ক্ষ¥ভাবে উপলব্ধি করার বিস্ময়কর এক ক্ষমতা আছে। পথের নিশানা এদের ভুল হয় না কখনো। কোথায় কতো উচ্চতায় অনুক‚লে বাতাস মিলবে, সেটি অনুভব করার শক্তিও আছে এদের। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাসও এরা আগেভাগেই পেয়ে যায়। সে জন্যে নিজ দেশে যখন শীতের তীব্রতা বাড়তে থাকে, তখনই দেশত্যাগ করতে শুরু করে ওরা।

এ সময় কিছু শিকারী এসব পাখি শিকারে তৎপর হয়ে উঠে। তারা বিভিন্নভাবে জাল ও ফাঁদ পেতে রাখে পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে। তারা ফাঁদে ফেলে এসব পাখি বন্দী করে অত্যন্ত নির্মমভাবে শহরে, বাজারে নিয়ে চড়া দামে বিক্রি করে থাকে। আমরা জানি আমাদের দেশে পাখি শিকারীদের জন্য কড়া আইন বলবৎ রয়েছে কিন্তু আইন থাকলে কি হয়, তার প্রয়োগ নেই বললেই চলে। দেখা যায় আইনের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করে নিষিদ্ধ অভয়ারণ্যে পাখি শিকারীরা অবাধ বিচরণ করে থাকে। তারা বিভিন্ন জাতের হাঁস ও অন্যান্য প্রজাতির পাখি নির্বিচারে নিধন করে থাকে। এসব শিকারী জ্যান্ত পাখিদের বন্দী করে খাঁচায় পুরে এদের মুক্ত জীবনকে চিরদিনের মতো স্তব্দ করে দেয়। ভাষাহীন এসব জীবের তখন আর কিছু করার থাকে না। ধুকে ধুকে শুধু মরতে থাকে। পাখি কিন্তু আমাদের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার অন্যতম সহায়ক, এ কথাটি নানা কারণে স্বীকৃত। প্রধানতঃ পাখির মল ত্যাগের ফলে চারা উৎপাদনের মাধ্যমে দ্রæত বনায়ন সম্ভব হয়ে উঠে। এদিকে পাখির বিষ্টা ভূমির উর্বরতা শক্তি বাড়ায়। অন্যদিকে বসতি বিস্তার, ফুল থেকে ফল উৎপাদনে পাখির ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব ছাড়াও পাখিরা ফলমূল, পোকা-মাকড়শা এবং কীটপতঙ্গ খেয়ে জীবন ধারণ করে থাকে। ফলে জমির ফসলকে কীটপতঙ্গের হাত থেকে রক্ষা করতে পাখি এক অগ্রণী ভূমিকা পালন করে থাকে।

ওয়াশিংটন বিশ্ববন্যপ্রাণী তহবিলের তথ্যে জানা যায়, পরিযায়ী পাখিরা মানবতাকে বলে দিয়েছে পৃথিবীর আবহাওয়া পরিবর্তন হচ্ছেÑ হতভাগ্য ক্যানরি পাখির মতো পরিযায়ী পাখিরাও বিশ্বে পরিবেশ পরিবর্তনের কারণে বিপন্ন হয়ে পড়েছে। এই রির্পোটের লেখক এডাম মারখাম বলেছেন, বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে অনেক পাখির প্রজাতির দেশান্তরী চক্রকে মারাত্মকভাবে ধ্বংস করে দিবে। এতে কার্বন-ডাই অক্সাইড ও অন্যান্য ‘মিন হাউস গ্যাস’-এর নির্গমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে সরকারসমূহের প্রতি আহŸান জানানো হয়েছে। বিশ্বব্যাপী উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে দেখা যাচ্ছে, জনসংখ্যা ও স্বাস্থ্যে যে প্রতিক্রিয়া পড়েছে তার ব্যাপারে ক্রমবর্ধমান উদ্বেগের মধ্য দিয়েই এই রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এদিকে তেল ও গ্যাস কোম্পানিগুলো এবং কয়েকটি তেল উৎপাদনকারী দেশ জোর দিয়ে বলছে যে, তেল ও গ্যাস জ্বালানির নির্গমনের কারণেই বিশ্বে ভূপৃষ্ঠে তাপমাত্রা সাড়ে তিন ডিগ্রি ফারেনহাইট বৃদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে,পরিবেশগত পরিবর্তনের কারণে দেশান্তরী পাখির বিভিন্ন প্রজাতি বিপন্ন হয়ে পড়েছে। আসা-যাওয়ার দুস্তর পথপরিক্রমায় বিভিন্ন ধরণের প্রতিকূল পরিবেশের মোকাবিলা করতে হয় এদের। কোন কোন ক্ষেত্রে দেশান্তরী পাখি লক্ষ লক্ষ কিলোমিটার পথ পাড়ি দেয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ডের কারণেও বর্তমানে দেশান্তরী বা পরিযায়ী পাখিদের আবাসস্থল ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন হয়েছে। বন উজাড়, পানি দূষণ ও উপকূলীয় এলাকার উন্নয়নের কারণেও সকল পাখির আবাসস্থল মারাত্মকভাবে সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যেই পাখিদের দেশান্তরী হবার ধরন পরিবর্তন সম্পর্কে বিজ্ঞানী ও পাখি পর্যবেক্ষকরা পর্যবেক্ষন করেছেন। স¤প্রতি প্রজাপতির উপর এক রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা গেছে প্রজাতি দেশান্তরী হবার প্রবণতাও গত শতকের তুলনায় দেড়শো কিলোমিটার উত্তরে চলে গেছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণেই তা হয়েছে।

মার্কিন প্রাণী বিশেষজ্ঞ ড. জেফ পাইস বলেছেন, পাখিরা এদিক সেদিক চলে যেতে পারলেও তাদের আবাসস্থলের পক্ষে তা সম্ভব নয়। রিপোর্টে বলা হয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠের বৃদ্ধি উপকূলীয় এলাকায় বন্যা মরসুমের সময় পরিবর্তন কোন কোনও এলাকায় শুষ্ক আবহাওয়ার কারনে পাখিরা আবহাওয়া সম্পর্কিত হুমকির সম্মুখীন। পরিবেশ ব্যবস্থায় উপকূলীয় জলাশয়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো আবহাওয়া পরিবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উপকূলীয় এলাকায় দেশান্তরী পাখির সমৃদ্ধ বিচরণক্ষেত্র। এখানে তাদের খাবার পাওয়া যায় অফুরন্ত। বিশাল পথ অতিক্রম করে শরীরে তাদের যেসব ক্ষয়-ক্ষতি হয় উপকূলীয় এলাকায় বিচরণ ক্ষেত্রে এমন সব পাখির খাদ্য পাওয়া যায় যাতে সে ক্ষয়-ক্ষতি পূরণ করতে পারে। গত শতাব্দীতে সমুদ্রস্তর ১০ থেকে ২৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পায় এবং এই বৃদ্ধির হার আগামী একশো বছরে দুই থেকে পাঁচগুণ বুদ্ধি পেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকায় বন্যার পাশাপাশি সমুদ্র স্তর ও উপকূলীয় এলাকায় পানির ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিতে পারে। স্পর্শকাতর উপকূলীয় এলাকায় এত দ্রæত গাছপালা ও প্রাণিজগতের পরিবর্তনের ফলে পাখিরা তাদের খাদ্যের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। উদাহরণ স্বরূপ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসন্তকালের দেশান্তরী পাখির সময় পরিবর্তনের বিষয়ে বলা যায়। এই পাখিরা মিশিগান এলাকায় পূর্বের সময়র চেয়ে আগে এসে পৌঁছায়। এই হার প্রতি বছরে একদিন করে এগিয়ে আসছে। বিজ্ঞানী ও পাখি বিশেজ্ঞরা জানান, অন্যত্রও এ ধরণের আচরণ পরিলক্ষিত হচ্ছে। ভূমিতে উষ্ণতা দেশান্তরী পাখির জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। উত্তর আমেরিকা, ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা ও দক্ষিণাঞ্চলীয় আফ্রিকা এ-ধরণের আবহাওয়ার উদাহরণ। যে প্রধান প্রধান ১৪টি জলাশয় দেশান্তরী পাখির বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, সেগুলো আজ আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারনে হুমকির সম্মুখীন। যেসব এলাকার পাখি ভয়াবহ হুমকির সম্মুখীন সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের জলাশয়সমূহ,পূর্বাঞ্চলীয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চেসাপিকেও ডেলওয়ারন উপসাগর, সুরিনামের কোপেনাম নদী এবং বাংলাদেশের সুন্দরবন এলাকা।

আধুনিক পক্ষী বিজ্ঞানের হিসাবে বিশ্বে ১২০০ প্রজাতির পাখি আছে। এ পাখিরা এলো কিভাবে আজ থেকে ৩০ কোটি বছর আগের সময়ের দানব সদৃশ ডাইনোসর পানিস্থল তোলপাড় করে বেড়াতো। এরা ছিল মেরুদন্ডী ও শীতল রক্তের প্রাণী। এই সরীসৃপ গোষ্ঠী তাদের দেহের গড়ন ও স্বভাবের জন্য শেষ পর্যন্ত জীবন সংগ্রামে টিকে থাকতে পারলো না। তবে তাদের একটি প্রজাতির সামনের হাতে চামড়ার পর্দা ছিল। তারা জীবন সংগ্রামে মাঝে মধ্যে হাতকে ডানার মত ব্যবহার করে চলে। এক সময় ডানার সাহায্যে উড়তে শুরু করে। হয়ে গেলো ডানাওয়ালা ডাইনোসর। এদের হাত ধরে আরো কয়েক ধাপ পরে এসে পক্ষীত্বের পথে পা বাড়ায়। জীববিজ্ঞানিরা প্রাচীন শিলা খুঁজে যে ফসীল সংগ্রহ করেছেন তা থেকে পাখিদের গোত্র, বংশ পরিচয় নির্ণয় করা সম্ভব হয়েছে। মূলত সরীসৃপ থেকে পাখির ক্রম বিবর্তন শুরু হয়। ডানা ওয়ালা ডাইনোসর এর মতো ডানা আজকের পাখিদের মূল বৈশিষ্ট্য। ডানার সাহায্যে পাখি মেন ভাসতে পারে তেমনি তার চলার গতিও পায়। ডানার গড়ন ও দৈর্ঘের সাথে পাখির উড়ার শক্তির সম্পর্ক আছে। আবার বিভিন্ন জাতের পাখিদের ডানার ধরনেও পার্থক্য থাকে। যেমন বেশিরভাগ গায়ক পাখির ডানা ছোট ও গোলাকার।

পাখি প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি। পৃথিবীর অন্যান্য প্রাণীর সাথে এর তফাৎ অনেকখানি। এমন কি শ্রেষ্ঠ জীব বলে স্বীকৃত মানুষও অনেক ক্ষেত্রে এর সমকক্ষ নয়। এটা সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহর এক অপার রহস্য। আমাদের জলবায়ূ ও প্রাকৃতিক পরিমন্ডল পাখি বসবাসের পক্ষে অনুকূল। এতদঅঞ্চলে এক সময় প্রচুর পাখি দেখা যেত। এখানে ছিল অনেক প্রজাতির স্থানীয় পাখি। আবার শীতে আসতো অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। আমাদের শৈশবে তথা ৫০ বৎসর আগে পরিযায়ী পাখির ডাকে চোখ তুলো দেখতাম পাখিদের উড়োওড়ি। এরা কখনো চক্রাকারে, কখনো বাঁকা চাঁদের মতো, কখনো এলোমেলো ভাবে উড়ে যেত। এদের কেউ কেউ উড়ার সময় শব্দ করতো। কখনো নিঃশব্দে উড়তো। এখন আর দেখি না তাদের। আমাদের কিশোর কিশোরী, যুবক-যুবতীরা পাখির প্রতি যতখানি কৌতুহলী হওয়া উচিত, ঠিক ততখানি হয়নি। আইপ্যাড, পিসি, ল্যাপটপ, মোবাইল তাদের যতখানি আকর্ষণ করে, ততখানি আকর্ষণ করে না পাখি, প্রকৃতি কিংবা বন্যপ্রাণী। পাখিদের দৈহিক রঙ বা বর্ণ বৈচিত্র ও কন্ঠস্বরের ভিন্নতা জেনেই মানুষেরা পাখি চেনে। পাখি কিভাবে উড়ে ভৌগলিক বা রাষ্ট্রীয় সীমারেখা তারা অনায়াসে অতিক্রম করতে পারে। তাদের প্রয়োজন হয় না পাসপোর্ট কিংবা ভিসার। তাদের পৃথিবী উন্মুক্ত, তারা যে দেশে খুশী উড়ে যেতে পারে। অন্য প্রাণীদের পক্ষে তা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়। বিভিন্ন পরিবেশে বসবাস, কিংবা পরিযায়ী হওয়া,বাসা বানানো, সন্তান লালন-পালন, খাদ্য সংগ্রহ, নিজের পরিচর্যা করা, দেশান্তরি হওয়ার উদ্দেশ্য কি, তারা কি ধরনের রোগ জীবাণু বহন করে এগুলো আজ পক্ষি বিজ্ঞানের বিষয়। এ নিয়ে পৃথিবীতে চলছে গবেষণা। পাখি মানুষের কি কাজে আসে বা উপকারে আসে, তা কেন ক্ষতি হয় কিনা এসব জানার জন্যই পক্ষি বিজ্ঞানের সাধনা। এগুলো জানতে পারলে রহস্যলোকের চাবি খুলে যাবে। সুদূর অতীতের ডাইনোসরের বংশধরেরা যে আজ রঙ মাধুর্যে, সৌন্দর্য এবং মনোহর কন্ঠধ্বনিতে আমাদের আনন্দের উপকরণে পরিণত হয়েছে তার ইতিহাস পড়লে মনে হবে পাখির ‘বিবর্তন’ রূপকথার মতো।

পাখি এখন যেমন প্রকৃতিতে আছে তেমনি আছে সৌখিন পাখি পালকদের খাঁচায়ও। যাকে বলা হয় ‘কেইজ বার্ড’। পৃথিবী জুড়ে এখন কেউজ বার্ডের রমরমা ব্যবসা। মুক্ত পুঁজির রাজ্যে পাখিও পণ্য হয়ে গেছে। পাখি খাঁচায় বন্দী করার প্রচেষ্টা সেই আদি যুগ থেকে পাখিদের কয়েকটি ছাড়া অন্যরা পোষ মানেনি। কেউ কেউ গৃহপালিত হয়ে গেছে যেমন হাঁস মুরগী পায়রা ইত্যাদি। পাখিরা বনে সুন্দর খাঁচার ভেতর কখনো থাকে না অচিন পাখি। খাঁচার পাখির জীবন শৃঙ্খলিত। বনের পাখি মুক্ত। তাইতো পাখিকে বলা হয়ে থাকে মুক্ত বিগঙ্গ। আদিযুগের গুহা গাত্রে, বিভিন্ন ভবনে পাখিদের ছবি আঁকা আছে।

আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতিতে পাখির উপস্থিতি প্রতুল তেমনি বিশ্বসাহিত্যে পাওয়া পাখিদের নিয়ে অমর সাহিত্য গাঁথা। মানুষের বাাঁচার জন্যই পাখির দরকার। প্রয়োজন প্রকৃতির স্যান্নধ্যতা। হয়ত তাই কবি বলেছেন ‘‘ ফিরিয়ে দাও সে অরণ্য, লও এ নগর’। এ হচ্ছে মানুষের আদিম আকুতি। এই কাক্সক্ষা তার মর্মকথা বোঝার লোক কই? আমরা কি বুঝি সে আর্তি? দেশ এখন ইট পাথরের জঞ্জ¡ালে পরিপূর্ণ। বায়ূদূষণে, শব্দ দূষণে মানুষের জীবন নাভিশ্বাস। সময় কোথায় আমাদের প্রকৃতি দেখার। কান পেতে শোনার-বাদলের ধারা। কিংবা পাখির কলকাকলী ? নগরায়ণ ও শিল্প কারখানা স্থাপনের দোহাই দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড়, নদী, জলাশয়, কৃষিজমি গ্রাস করে চলছি। যেখানে মানুষের হাত লেগেছে সেখানেই বিপদগ্রস্ত হয়েছে প্রকৃতি বন বনানী, জীব জগৎ পশুপাখি তথা বন্য প্রাণী।

স¤প্রতি চট্টগ্রামে পাখি পর্যবেক্ষক ইনাম আল হক পৃথিবী থেকে পাখি বিপন্ন হওয়ার জন্য মানুষের সৌখিনতাকেই দায়ী করেছেন। মানুষের বাড়িঘর রাস্তা শিল্প কারখানা গড়তে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে পাখির আবাসস্থল। যার পরিপ্রেক্ষিতে বিলুপ্ত হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। তিনি তার পর্যবেক্ষণের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন দেশের দক্ষিণাঞ্চল তথা বৃহত্তর চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি পাখির বসবাস। তারপরও এতদাঞ্চলের ৫০ টি প্রজাতির পাখি সংকটাপন্ন অবস্থায় আছে। দেশের মানুষ আদৌ বুঝতে পারে নি পাখির গুরুত্ব। যদি তারা বুঝতো প্রকৃতি বনাঞ্চল, জলাশয় রক্ষা করতো নিজের স্বার্থেই। পাখি মানুষকে শুধু আনন্দ ও বিনোদন দেয় না, তারা আমাদের আর্থ ও সামাজিক কাজে যথেষ্ট ভূমিকা রাখে। পাখিদের দ্বারা সৃজিত হয় বনায়ন, পাখিদের কিছু প্রজাতি ইঁদুর, সাপ, পোকা মাকড় খেয়ে খাদ্য উৎপাদনে সহায়তা করে। গৃহপালিত পাখি থেকে আমরা আমিষ পেয়ে থাকি। পাখি পচাগলা মৃত খেয়ে পরিবেশকে নানাভাবে দূষণ মুক্ত রাখতে সাহায্য করে।

পৃথিবীতে এমন কিছু পচাগলা আছে যা শকুনেরা খেয়ে সাবাড় করে। ধরা যাক আনথ্রাগবাহিত মরা। অন্য যে কোন প্রাণী যারা মৃত পশু যা তারা খাওয়ার পর বিষ্ঠা বা মলের মাধ্য ঐ রোগের জীবাণু ছড়িয়ে যায়। কিন্তু যদি শকুন তা খায় তবে তার মল থেকে তা আর রোগ ছড়াবে না। শকুনের পেটে এমন এনজাইম আছে যা বিশেষ বিশেষ রোগ জীবাণু খেয়ে ধ্বংস করতে সক্ষম। এক সময় আমাদের চারপাশে প্রচুর শকুন দেখা যেত। এখন দেখা যায় না। বিগত ত্রিশবছর আগে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার তথা বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, মিয়ানমার ও ভিয়েতনামে প্রায় চার কোটি শকুন বসবাস করতো। এখন তা কমতে কমতে দুই লাখে এসে ঠেকেছে। বাংলাদেশে আছে মাত্র দুইশতটি। ডাইক্লোয়েনাক নামে গবাদি পশুর একটি ওষুধ শকুন মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে পশু বিজ্ঞানিরা জানাচ্ছেন। পাখি নাবিকের উদ্ধারকারী হিসাবে বিবেচিত সিগাল তাদের অন্যতম। সমুদ্রে বা নদীতে জাহাজের আগে আগে তারা উড়ে পথ দেখায়। পনের ও ষোল শতকে নাবিকেরা জাহাজে করে কাক বা অন্য প্রজাতির পাখি বয়ে বেড়াতো। তারা যখন পথের বা উপকূলে দিশা হারিয়ে ফেলত, তখন পাখিদের আকাশে উড়িয়ে দিত। পাখি তখন উড়ে স্থলভাগের দিকে ছুটে যেত আর নাবিকেরা তার অনুসরণে এগিয়ে যেত উপকূলের ঠিকানায়।

পাখিদের মধ্যে যারা সিলেট অঞ্চলে বসবাস করছে তাদের পঞ্চাশটি আজ অস্তিত্বের সংকটে। এরা যদি হারিয়ে যায়, তাহলে শুধু বাংলাদেশ নয় বিশ্বের মাত্রচিত্র থেকেও হারিয়ে যাবে। বিশ্বে বিপন্ন কিন্তু বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলে এখনো টিকে আছে সেসব প্রাণী তাদের মধ্যে বনমোরগ, রাজধন, বড়ময়না, হরিয়াল, হুতোম পেঁচা, কাদাখোচা ধূতিয়াল, রাজহাঁস, পান চিরা ইত্যাদি। প্রকৃতির এই অমূল্য সম্পদ পাখির উপকারিতা অশেষ। সেটা এখন আমাদের উপলব্ধিতে না এলেও যখন পাখি শূন্য হয়ে যাবে তখন আমরা টের পাবো।

পাখিহীন বিশ্ব তখন আমাদের কাছে কেমন লাগবে; আমরা একবারও কল্পনা করেছি? বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় গত কয়েক দশক বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে। আধুনিক সুযোগ সুবিধার কারণে গ্রাম আর গ্রাম নেই। শহরের সকল সুবিধা এখন গ্রামে বিদ্যমান। কিন্তু তার নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া হিসাবে আমরা প্রকৃতির কি যে ক্ষতি করে চলেছি তা অনুভব করতে পারছেন না ? ইতোমধ্যে আমাদের অনেক অচেনা পশু পাখি হারিয়ে গেছে। আমরা আমাদের প্রকৃতিকে উন্নয়নের নামে নিজেরাই ধ্বংস করে চলছি। এই বিধ্বংসী কার্যকলাপ কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না। প্রকৃতি, পশু, পাখি আমাদের বন্ধু এদের রক্ষা করতেই হবে।

পাখি পর্যবেক্ষণ এখন আনন্দময় ও আকর্ষণীয় শখ হিসাবে বিবেচিত। এতে করে পাখির যত বৈচিত্র্য, মনোহরি গঠন, পালকের সৌন্দর্য, কন্ঠস্বরের বিভিন্নতা ও মাধুর্যতা সর্বোপরি স্বভাবের নিজস্বতার কারণে পাখি সন্বন্ধে কত অনুসন্ধিৎসা, কতবেশি তা তাদের পাখি বিষয়ক পত্র-পত্রিকা, বই প্রকাশনা থেকে অনুমান করা যায়। পাখি বিষয়ে অন্তত একখানা বই আছে এমন পরিবারের সংখ্যা ইংল্যান্ডে এক লক্ষ এবং আমেরিকায় আড়াই লক্ষ। ইংল্যান্ডে প্রতি সপ্তাহে পাখি বিষয়ক একটি করে বই বা সাময়িকি প্রকাশিত হয়। সুসংবাদ এই যে, আমাদের দেশে পাখি পর্যবেক্ষকদের সৌখিন দলে কিছু মানুষ একত্রিত হচ্ছে পাখি ও প্রকৃতিপ্রেমীরা বিভিন্ন স্থানে নানা নামে বার্ড ক্লাবও প্রতিষ্ঠিত করেছেন। এভাবে যদি দেশে পাখি পর্যবেক্ষণের দল বাড়ে, তাতে করে পাখি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের আগ্রহ বাড়বে। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি হবে। মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। আমাদের নতুন প্রজন্মের মধ্যে গড়ে উঠবে সহমর্মিতা ও আগ্রহ এবং প্রকৃতি বাঁচানোর তাগিদ। প্রকৃতির কাছাকাছি যত মানুষ যাবে ততবেশি করে চিনবে প্রকৃতির অমূল্য সম্পদ পাখিকে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাখির

১৯ নভেম্বর, ২০২১
৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১
২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
১৩ ডিসেম্বর, ২০২০
২৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন