শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
(পূর্বে প্রকাশিতের পর)
টম বলল, আমি তোমায় যা বলেছিলাম তার উত্তর পেলে তো।
হুম, পুঁচকে ছোঁকড়ার জন্য এটা বাজে সংবাদ।
যদিও ছোঁকড়াটাকে পছন্দ করি না তারপরও বেশ ভন্দ্রভাবে কথাটা বলেছি। ভয় আর বেদনা ওর সরু মুখখানিকে বিকৃত করেছে আর ওর শরীরটাকেও কেমন কুঁকড়ে ফেলেছে । তিন দিন আগেও বেশ চটপটে, অনুগত ছিল। অথচ এখন তাকে প্রৌঢ়ের মতো দেখাচ্ছে। আর যদি সে ছোঁকড়া বাড়ী ফেরার সুযোগ পায় তবুও সেই চনমনে তারুণ্য ফিরে পাবে বলে মনে হয় না।
তার জন্য করুণা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই যদিও তা আমার অপছন্দের ও আতংকের। সে একেবারে চুপ মেরে গেছে আর মুখ, হাত, শরীর সব ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। সে আবার গিয়ে তার জায়গায় বসল আর বড় বড় চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে। টম খুব আন্তরিক, সে ছোঁকড়ার ঠান্ডায় জমে যাওয়া হাতগুলো নিজের হাতের ভেতর নিতে চাইছিল কিন্তু ছোঁকড়াটা ভেঙচি দিয়ে হাতটা দ্র‘ত সরিয়ে নিল।
নিচু স্বরে বললাম, মনে হচ্ছে ও ভেতর ভেতর ভেঙে পড়েছে, ওকে একা থাকতে দাও।
টম বিষন্ন মুখে ওর কাছ থেকে সরে গেল। সে ছোঁকড়াটাকে উষ্ণতা দিতে চেয়েছিল যাতে করে এই উত্কন্ঠিত সময় পেরিয়ে যায় আর নিজেকে নিয়ে ভাবতেও মন চাইছিল না।
কিন্তু আমি বিরক্ত হচ্ছিলাম যদিও আমার মৃত্যু ভাবনা ছিল না কারণ এটা ভাবার তো হেতু নেই।
তবে মনে হয় সময় এসে গেছে ভাবার আর এটা ছাড়া অন্য কোন কাজও নেই।
টম আবারও বকতে শুরু করেছে। সে আমায় জিজ্ঞেস করল, তাহলে তুমি ওদের শেষ করবে, পারবে তো ? আমার নীরবতা ভেঙে সে আবার ব্যাখ্যা করতে শুরু করল, সে আগষ্ট থেকে এ পর্যন্ত ছয় জনকে ধরাশায়ী করেছে।
টম পরিস্থিতি উপলব্ধি করতে পারছে না আর আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, সে বুঝতেও চায় না। হয়তো আমি নিজেও উপলব্ধি করতে চাইছি না যদি এটা আমায় কষ্ট দেয়। বুলেট আর গুলির অভ্যর্থনায় আমার পুরো শরীর পুড়ছে।
এত কিছুর পরও একটাই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তবু নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছি। পুরোটা রাত ভাবনায় ডুবে থাকা। টম এবার থেমেছে আর তাকে আমার চোখের কোণ থেকে সরে যেতে দেখলাম। তাকেও অনেক ফ্যাকাশে দেখাচ্ছে আর অনেকটা কুঁকড়ে গেছে। নিজের মনে বলে ফেললাম, সময় এসে গেছে। অন্ধকারে ঘুলঘুলি দিয়ে একটা হালকা আলোর আভা কয়লার স্তূপে পড়েছে যেন মনে হচ্ছে আকাশে মরচের দাগ পড়েছে। ছাদের ফুটো দিয়ে একটা নক্ষত্র দেখতে পেলাম। আজকের রাতটা অনেক পবিত্র আর শীতল।
দরজা খুলে গেল আর দুজন প্রহরীর সাথে এক স্বর্ণকেশী লোক ভারী পোশাকে ঢুকল। আমাদের স্যালুট জানিয়ে বলল, আমি ডাক্তার। এই কঠিন সময়ে তোমাদের পাশে থাকতে আমায় পাঠানো হয়েছে।
তার কন্ঠস্বর বেশ মার্জিত এবং স্বতন্ত্র।
জিজ্ঞেস করলাম, তোমার এখানে কি প্রয়োজন ?
সফল পরিসমাপ্তি টানতে তোমাদের জীবনের এই অন্তিম মুহুর্তের কষ্টের তীব্রতা যথাসাধ্য লাঘব করতে চাই।
তুমি এখানে কেন এসেছ ? আরও অনেকেই আছে যারা সবাই হসপিটালে।
মুখের ভঙ্গিমা হঠাত পাল্টে বলল, আমাকে এখানে পাঠানো হয়েছে।
ওহ, তোমরা কি ধুমপান করবে ? আমার কাছে সিগারেট এমনকি সিগারও আছে।
আমাদের ইংলিশ সিগারেটস আর পুরোস নিতে সাধলেও আমরা প্রত্যাখ্যান করলাম।
তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম সে বেশ উত্তেজিত। তাকে বললাম, তোমাকে কি কৃপা দেখাতে পাঠানো হয়নি ? তোমায় আমি চিনি।
যেদিন আমায় গ্রেপ্তার করে আনা হলো সেদিন ফ্যাসিস্টদের সাথে তোমাকে দেখেছি।
আমি বলেই চলছিলাম কিন্তু হঠাত করেই অদ্ভুত কিছু একটা খেলে গেল আমার ভেতরে কারণ ডাক্তারের এই উপস্থিতি আমাকে তেমন ভাবাচ্ছে না। আমি এখানে কারো ওপরে আধিপত্য স্থাপন করেছি তাহলে আমায় যেতে হচ্ছে না। কিন্তু কথা বলার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছি। একটু নড়েচড়ে অন্যদিকে চোখ ফেরালাম। একটু পরে মাথাটা তুলতেই দেখি সে আমার দিকে কৌতুহলী চোখে তাকিয়ে আছে। প্রহরীরা মাদুর পেতে বসেছে। ওদের মাঝে একহারা লম্বা গড়নের পেড্রো তার বুড়ো আঙুল মোচড়াচ্ছে আর অন্যজন কিছুক্ষণ পরপরই মাথা ঝাঁকিয়ে ঘুম তাড়াবার চেষ্টা করছে।
পেড্রো ডাক্তারকে হঠাত জিজ্ঞেস করল, তোমার কি আলো প্রয়োজন ?
সে মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। তাকে বেশ বুদ্ধিদীপ্ত মনে হলেও অতটা খারাপ মনে হয়নি। ওর নীল শীতল চোখ দেখে বুঝতে পারলাম, তার আবেগটা কম। পেড্রো ঘর থেকে বেরুল আর একটা তেল বাতি এনে ঘরের কোণে বেন্চিতে রাখল। আলোটা অসহ্য হলেও একেবারে বেকার নয়। ওরা গত রাতে আমাদের পুরো অন্ধকার ঘরে ফেলে গিয়েছিল। ছাদে আলোর বৃত্তের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘোর লাগল চোখে। হঠাত করেই উঠে দাঁড়াতেই শরীরে এক প্রচন্ড আঘাতে কুঁকড়ে গেলাম আর চোখে অন্ধকার দেখলাম। মৃত্যু বা ভয় নয় অন্য কোন চিন্তা মাথায় ভর করেছিল। আমার গাল জ্বলে যাচ্ছিল আর মাথা ভারী হয়েছিল।
আমি নড়েচড়ে বসলাম আর আমার সহযোদ্ধাদের দিকে তাকালাম। টম দু›হাতে মুখ ঢেকে রেখেছে। ঘাড়ে একটা শ্বেত চর্বির দলাটাই দেখা যাচ্ছে। ছোট্ট হুয়ানের সবচেয়ে খারাপ অবস্থা, তার মুখটা হা হয়ে গেছে আর নাকটা কাঁপছে। ডাক্তার তার কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রেখে প্রবোধ দিল কিন্তু তার চোখ দুটো একেবারে অপলক। তারপর সে বেলজিয়ানের হাত হুয়ানের অলক্ষ্যে তার কবজিতে স্পর্শ করল। হুয়ান একেবারে নির্বিকার। ডাক্তার তার কবজিতে আঙুল রেখে নাড়ি পরীক্ষা করতে শুরু করল। তারপর কিছুটা পিছিয়ে আমার দিকে ফিরল। কিন্তু পেছন দিকে আমি ঝুঁকে ছিলাম আর তাকে দেখলাম আস্তিন থেকে ঘড়ি বের করে কিছু সময় তাকিয়ে ছিল তবু হুয়ানের কবজি ছাড়ল না। কিছু সময় পর অলস ভঙ্গিতে কবজি ছেড়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে পড়ল। (অসমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।