Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিশ্ব ইজতেমা ও তাবলীগ জামাত

মাওলানা মুহাম্মদ ওলীউর রহমান | প্রকাশের সময় : ১০ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০৫ এএম

তাবলীগ জামাত হলো একটি অরাজনৈতিক আন্তর্জাতিক ধর্মীয় দাওয়াতী সংস্থা। ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস এবং ইবাদতসমূহের অনুশীলনও শিক্ষাদানই হচ্ছে তাবলীগ জামাতের মূল কর্মসূচি। আল্ল­াহর হুকুম এবং নবী (সা.) এর তরীকা বা আদর্শের প্রতি মানুষকে আগ্রহী করে তুলা এবং মানুষের অন্তরে ইসলামের চিন্তা-চেতনাকে জাগ্রত করাই তাবলীগের অন্যতম লক্ষ্য। ছয়টি মৌলিক বিষয়কে সামনে রেখে তাবলীগ জামাত তার কার্যক্রম পরিচালনা করে। সেই মৌলিক বিষয়গুলো হলো ১. কালেমা, ২. নামাজ, ৩. ইলম ও জিকির, ৪. একরামুল মুসলিমীন (বড়দের সম্মান করা, ছোটদের স্নেহ করা এবং আলেম-উলামাদের শ্রদ্ধা করা) ৫. সহীহ নিয়ত, ৬. দাওয়াত ও তাবলীগ। বিশ্বের প্রায় প্রতিটি জনপদেই রয়েছে তাবলীগ জামাতের দাওয়াতী তৎপরতা।

উপমহাদেশের মুসলমানদের ধর্মীয় জীবনের চরম এক দুঃসময়ে ১৯১০সালে ভারতের রাজ্যস্থান মেওয়াতে মাওলানা ইলিয়াস দেহলবী (রহ.) তাবলীগ আন্দোলন এবং তাবলীগ জামাতের গোড়াপত্তন করেন। তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) ভারতের ঐতিহাসিক দেওবন্দ মাদরাসা থেকে শায়খুল হিন্দ মাহমূদ হাসান দেওবন্দী (রহ.) এর কাছে হাদীসের অধ্যয়ণ শেষ করে মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গুহী (রহ.) ও মাওলানা খলিল আহমদ সাহারানপুরী (রহ.) এর কাছে আধ্যাত্মিক দীক্ষা ও খেলাফত লাভ করেন। তিনি দাওয়াত ও তাবলীগের যে কর্মনীতি প্রণয়ন করেছিলেন তা সর্বপ্রথম তৎকালীন যুগশ্রেষ্ট আলেম শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান, মাওলানা মুফতি কেফায়াতুল্লাহ, মাওলানা আশরাফ আলী থানবী সহ দারুল উলুম দেওবন্দের আলেমদের কাছে পেশ করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের উলামায়ে কেরামগণ অনেক চিন্তা-ফিকির করে এসব নীতিমালার মধ্যে কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) কে এ কাজ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। ১৯২০ সালে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) দিল্লিতে তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম শুরু করেন। শুরু থেকেই তাবলীগ জামাতের সার্বিক তত্ত¡াবধানের দায়িত্ব গ্রহণ করে দারুল উলুম দেওবন্দ। তাবলীগ জামাতে যত কিতাবাদির তা’লিম দেওয়া হয় তার সবই রচনা করেছেন এই দারুল উলুম দেওবন্দের উলামাই। এভাবে সারা বিশ্বে তাবলীগ জামাতের গুরুত্ব ও বৈধতা মুসলমানদের কাছে জোরালোভাবে তুলে ধরেছেন এই দেওবন্দ সিলসিলার উলামায়ে কেরামগণ। মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) এর জীবদ্দশায়ই তাবলীগ জামাতের কার্যক্রম দক্ষিণ এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৪৪ সালে মাওলানা ইলিয়াস (রহ.) এর ইন্তেকালের পর তাবলীগ জামাতের আমীরের দায়িত্ব দেওয়া হয় তারই সুযোগ্য সন্তান মাওলানা ইউসুফ (রহ.) কে। মাওলানা ইউসুফের ইন্তেকালের পর আমীরের দায়িত্ব প্রদান করা হয় মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.)কে। মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.) তার ইন্তেকালের পূর্বে সারা বিশ্বে তাবলীগের কাজের ব্যাপকতা অনুভব করে দশ সদস্য বিশিষ্ট একটি ‘আলমী শূরা’ (আর্ন্তজাতিক পরিচালনা কমিটি) গঠন করেন। যাতে এই শূরা সদস্যরা পরামর্শের ভিত্তিতে সারা বিশ্বের তাবলীগ জামাতের কাজ পরিচালনা করতে পারেন। মাওলানা এনামুল হাসান (রহ.) ১৯৯৫ সালে ইন্তেকাল করেন।

পঞ্চাশের দশকে মাওলানা আব্দুল আজিজ ও তার কয়েকজন সঙ্গী-সাথীর প্রচেষ্টায় ঢাকায় তাবলীগ জামাতের কাজের সূচনা হয়। কিছু দিনের মধ্যে বাংলাদেশের মুসলমানদের একটি বিরাট অংশ তাবলীগ জামাতের সাথে সম্পৃক্ত হয়ে যায়। বিশ্ব ইজতেমা বিশ্ব তাবলীগ জামাতের সর্ববৃহৎ ইজতেমা বা সমাবেশ। তাবলীগ জামাতের বাৎসরিক কাজের হিসাব, পর্যালোচনা ও দাওয়াতী কাজের আরো বিস্তৃতি ঘটানোর লক্ষ্যেই বিশ্ব ইজতেমার আয়োজন করা হয়।

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার উপকন্ঠে শিল্প নগরী টঙ্গীর সুবিশাল ময়দানে প্রতি বছর অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব ইজতেমা। বাংলাদেশের তাবলীগ জামাতের প্রধান মারকাজ হলো ঢাকার কাকরাইল মসজিদে। বাংলাদেশ সহ মুসলিম বিশ্বের লাখ লাখ ধর্মপ্রাণ মুসলমান বিশ্ব ইজতেমায় অংশ গ্রহণ করেন। মুসলিম জাহানের অন্যতম বৃহৎ এই সমাবেশের জন্য প্রায় ১৭৫ একর জায়গার উপর খাটানো হয় বিশাল প্যান্ডেল। এই জায়টি ১৯৯৫ সালে সরকারীভাবে বিশ্ব ইজতেমার জন্য স্থায়ীভাবে বরাদ্দ দেয়া হয়। বিশ্ব ইজতেমার ময়দানের দক্ষিণ-পশ্চিমে তুরাগ নদী, উত্তরে টঙ্গি-আশুলিয়া বাইপাস সড়ক এবং পূর্বের কিছু অংশে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক এবং বাকি অংশে চারটি রাষ্ট্রায়াত্ত শিল্প কারখানা রয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্য, মধ্যএশিয়া, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া, পাকিস্তান, ভারত ও ইউরোপীয় দেশসমূহসহ বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশ থেকে মুসল্লিরা অংশ গ্রহণ করেন বিশ্ব ইজতেমায়। আগত মুসল্লিদের সুবিধার্থে সরকারী-বেসরকারীভাবে বিভিন্ন কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। বিশ্বইজতেমার মাঠে প্রবেশের জন্য প্রায় ১৭টি প্রবেশ পথ রয়েছে। এছাড়া তুরাগ নদীর উপর সেনাবাহিনী বেশ কয়েকটি ভাসমান ব্রীজ তৈরী করে। ইজতেমার মাঠের ভিতরে থাকে প্রায় আড়াইশ মোকাব্বির মঞ্চ। যেখান থেকে পাঁচ ওয়াক্তের নামাজের জন্য আযান দেয়া হয়। বয়ান শুনার জন্য মাঠজুড়ে স্থাপন করা হয় প্রায় পনের হাজার ছাতা মাইক। এছাড়া স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা আরো কয়েক মাইল পর্যন্ত মাইকের ব্যবস্থা করে থাকেন। আগের তুলনায় ইজতেমার মাঠকে অনেক উন্নত করা হয়েছে। মাঠের চার পাশে বেশ কিছু বহুতল বাথরুম তৈরী করা হয়েছে। বাঁশের খুঁটির উপর চট লাগিয়ে মাঠে ছাউনি তৈরী করা হয়। এর পর বিভিন্ন জেলা থেকে আগত লোকেদের জন্য জেলা ভিত্তিক খিত্তা নম্বর এবং খুঁটি নম্বর দিয়ে ভাগ করা হয়, যাতে আগত মুসল্লিরা নিজেদের অবস্থার নির্ণয় করতে পারেন। শুধু মাত্র বিদেশী মেহমানদের জন্য তৈরী করা হয় টিনের চাল ও বেড়া দিয়ে আলাদা ঘর। সংযোগ দেয়া গ্যাস ও বিদ্যুৎ। নিজস্ব স্বেচ্ছা সেবকদের দিয়ে তৈরী করা হয় বিদেশী মেহমানদের জন্য কঠোর নিরাপত্তা বলয়। স্থাপন করা হয় সারা মাঠজুড়ে পানি সরবরাহের জন্য পাইপ লাইন। এরপর তাবলীগ জামাতের নিজস্ব প্রকৌশলীদের দিয়ে অত্যন্ত নিখুঁতভাবে তৈরী করা হয় লোকেশন ম্যাপ। সবগুলো কাজই করেন তাবলীগ জামাতের স্বেচ্ছাসেবক কর্মীরা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, বিশ্ব ইজতেমার জন্য শুধু তাবলীগ অনুসারীদের মৌখিক দাওয়াত ছাড়া কোন প্রকার পোস্টার, লিফলেট, মাইকিং কিংবা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ছাপানো হয় না। বিশ্বইজতেমা যদিও শুরু হয় শুক্রবারে এবং সমাপ্ত হয় রবিবারে কিন্তু দুই দিন আগেই ইজতেমার মাঠ কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে যায়। একারণে দেশর সর্ববৃহৎ জুমুআর জামাত অনুষ্ঠিত হয় টঙ্গীর ময়দানে। বিশ্ব ইজতেমার পুরো আয়োজনটাই একটি বিষ্ময়কর ব্যাপার।

প্রথম বিশ্বইজতেমা শুরু হয় ১৯৪৬ সালে ঢাকার কাকরাইলে। ১৯৪৮ সালে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় চট্রগ্রামে। এর পর ১৯৫৮ সালে ইজতেমা অনুষ্ঠিত হয় নারায়নগঞ্জে। ১৯৬৬ সালে অনুষ্ঠিত হয় টঙ্গীর পাগার নামক স্থানে। ১৯৬৭ সাল থেকে তুরাগনদীর পূর্বতীরে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। বিশ্ব ইজতেমার মত একটি বৃহৎ ধর্মীয় সম্মেলনের আয়োজক হিসেবে বাংলাদেশ মুসলিম বিশ্বের কাছে এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করেছে।

মুসলিম বিশ্বের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিশ্বইজতেমার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। গোটা মুসলিম বিশ্বের অবস্থা আজ খুবই নাজুক। মুসলিম বিশ্বের বর্তমান দুর্বস্থার অন্যতম কারণ হচ্ছে ঐক্যহীনতা ও পারস্পরিক দ্ব›দ্ব কলহ। বিশ্ব ইজতেমায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলমান এবং ধর্মীয় নেতারা এসে সমবেত হন। তাই বিশ্ব ইজতেমা মিল্লাতের বৃহত্তর ঐক্য প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিরাট অবদান রাখতে পারে, যা মুসলিম মিল্লাতের চলমান নাজুক ও বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণের জন্য সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন। বিশ্ব ইজতেমা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি মুসলিম মিল্লাতের ঐক্য ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রাখুক, এই আমাদের একান্ত প্রত্যাশা।
লেখক: প্রাবন্ধিক

 



 

Show all comments
  • M ismail Kabir Ahmed ১০ জানুয়ারি, ২০২০, ১০:১৩ পিএম says : 0
    tablegeager murobbider amar anorod tabliger murobbira jate sheikh hasina allahr pote dawat den konona prime minister kono kaj shoro korte shaikh mujiber photote sordda janaya boro ekta shirik koritece jahar jonno amara porajati shirik gonahe nimijjito hoiteci pls. take care
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: বিশ্ব ইজতেমা


আরও
আরও পড়ুন