Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

মুখোশধারীদের হামলা দিল্লির জেএনইউ’তে

উত্তাল ভারত

ইনকিলাব ডেস্ক | প্রকাশের সময় : ৭ জানুয়ারি, ২০২০, ১২:০৪ এএম

দিল্লির জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় (জেএনইউ) চত্বরে গত রোববার সন্ধ্যার দিকে লাঠিসোটা নিয়ে হামলা চালিয়েছে ৫০ জনেরও বেশী মুখোশধারী দুষ্কৃতি। এসময় তারা ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট ঐশী ঘোষের মাথা ফাটিয়ে দেয়। হামলায় আহত হন আরও অন্তত ৩৪ জন শিক্ষার্থী এবং শিক্ষক। তাদেরকে গুরুতর আহত অবস্থায় অল ইন্ডিয়া ইন্সটিটিউট অফ মেডিক্যাল সায়েন্স বা এইমস হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

হামলাকারীরা সবাই এই এবিভিপি-র সদস্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে থেকে হামলাকারীদের আনা হয়েছে বলে অভিযোগ ছাত্র ইউনিয়নের। শুধু ছাত্রছাত্রীদের নয়, তাদের হামলায় শিক্ষকরাও আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। দিল্লি পুলিশ কয়েকজন মুখোশধারী দুষ্কৃতীকে শনাক্ত করতে পেরেছে। একটি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। তবে পুলিশ গতকাল শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি। জেএনইউয়ের শিক্ষার্থী ও ফ্যাকাল্টি সদস্যদের অভিযোগ, পুলিশকর্মী ও নিরাপত্তা রক্ষীরা চত্বরে ‘নীরব দর্শক’ হয়ে ছিল যখন মুখোশধারী গুন্ডারা হামলা চালাচ্ছিল। হামলার পরে দুষ্কৃতীদের পালানোর সুযোগ করে দেয়ার অভিযোগও জানায় তারা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা বেশ কয়েকমাস ধরে হোস্টেল ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছিলেন। প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে সিংহভাগ ছাত্রছাত্রী পরীক্ষা এবং রেজিস্ট্রেশন বয়কট করেছেন। অন্যদিকে হিন্দু পুনরুত্থানবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয়া স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের ছাত্র সংগঠন অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ বা এবিভিপি এই আন্দোলনের প্রতিবাদ করেছে।

সংবাদ সংস্থা এএনআইয়ের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, মুখোশ পড়া বেশ কিছু নারী-পুরুষ লাঠি হাতে এগিয়ে আসছেন। এক ছাত্রী চিৎকার করে তাদের প্রশ্ন করছেন, ‘এটা কী হচ্ছে! তোমরা কারা? মেয়েদের হোস্টেলে কেন ঢুকছ! আমাদের ভয় দেখাতে এসেছ?’ ওই ভিডিওতেই শোনা যাচ্ছে কিছু ছাত্রী স্লোগান দিচ্ছেন, ‘এবিভিপি গো ব্যাক।’

পুলিশের কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত তদন্ত রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ। ছাত্রছাত্রীরা এই প্রশ্নও তুলছেন, যখন মুখোশধারী হামলাকারীরা ক্যাম্পাসে তান্ডব চালাচ্ছিল, তখন পুলিশ সেখানে হাজির ছিল। কিন্তু তারা নীরব দর্শক হয়ে ছিল বলেও অভিযোগ।

বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে হামলার পরে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরও প্রতিক্রিয়া আসতে শুরু করেছে। এসবের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিক্রিয়া এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের। তিনি টুইট করেছেন, ‘জেএনইউ-এর ঘটনার ছবি দেখছি। স্পষ্ট ভাষায় এই হিংসার নিন্দা করছি। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে।’ জয়শঙ্কর এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর আর আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে পিএইচডি করেছেন। আরেক প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও অর্থমন্ত্রী নির্মলা সিতারমন বলেন, ‘জেএনইউয়ের আজকের ছবি ভয়াবহ। যে বিশ্ববিদ্যালয়কে আমি জানতাম, তা তীব্র বিতর্ক এবং মতামতের জায়গা ছিল, হিংসার নয়। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় আজকের ঘটনার নিন্দা করছি।’

তীব্র জানিয়ে গতকাল কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধী বলেন, ‘দেশজুড়ে রোজ ক্যাম্পাস ও কলেজগুলিতে হানা দেওয়া হচ্ছে। বিজেপি সরকারের সাহায্য নিয়ে হয় পুলিশ নয়তো দুষ্কৃতীরা হানা দিচ্ছে।’ তার কথায়, ‘প্রতিদিন ভারতের যুব ও ছাত্র সমাজের কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে। মোদি সরকারের সক্রিয় প্ররোচনায় ভারতের যুবাদের উপর দুষ্কৃতীদের ভয়ংকর হামলা একেবারেই প্রত্যাশিত নয়।’ রাহুল গান্ধী লিখেছেন, ‘শাসনক্ষমতায় থাকা ফ্যাসিবাদীরা ছাত্রদের সাহস দেখে ঘাবড়ে গেছে। আজকের হামলা তারাই প্রতিফলন।’

মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে সাংবাদিকদের উদ্দেশে বললেন, ‘জেএনএই-তে এই হামলা আমাকে ২০০৮ সালের ২৬ নভেম্বর ঘটে যাওয়া মুম্বই হামলার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। যারা এই ধরনের হামলা করছে, আর মুখোশে নিজেদের মুখ লুকোচ্ছে, তারা সত্যিই কাপুরুষ। এদেরকে যত দ্রæত সম্ভব খুঁজে বের করে শাস্তি দেয়া উচিত।’ কারও মদতে এই হামলা হয়েছে কি না, তার উত্তরে উদ্ধব বলেন, ‘সব পরিষ্কার হয়ে যাবে কারও মদত রয়েছে কি না! এক এক করে সবকিছুই পরিষ্কার হয়ে যাবে। এটা কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ তদন্ত করে দ্রæত পদক্ষেপ নেয়া।’

সিপিআইএম-এর সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, যিনি নিজেও ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন একসময়ে, তিনি বর্তমান ছাত্র ইউনিয়ন প্রেসিডেন্ট ঐশী ঘোষের মাথা থেকে রক্ত ঝরার ভিডিওটি রি-টুইট করে লিখেছেন, ‘এই ভিডিও দেখেই বোঝা যাচ্ছে আরএসএস, বিজেপি দেশের কী অবস্থা করতে চাইছে। কিন্তু আমরা ওদের এটা করতে দেব না।’ ছাত্রদের ওপরে হামলার প্রতিবাদ জানিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী, প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম। ছত্তিসগড়ের রাজধানী রায়পুরে ছাত্রদের ওপরে হামলার বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে।

এদিকে, ক্যাম্পাসে মুখোশধারীদের তান্ডবের ঘটনায় ফের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের রাস্তা ধরলেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) উপাচার্য এম জগদেশ কুমার। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের কাঠগড়ায় তোলেন তিনি। গতকাল টুইটারে তিনি লেখেন, ‘আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মধ্যে কয়েক জন হিংসার রাস্তা বেছে নেওয়াতেই আজ এমন পরিস্থিতি জেএনইউ-তে। যারা আন্দোলনে অংশ নেননি, তাদেরও পড়াশোনাতেও ব্যাঘাত ঘটানো হয়েছে। পরীক্ষায় নাম নথিভুক্তিকরণ প্রক্রিয়ায় বাধা দিতে সার্ভারেরও ক্ষতি করেছে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। হাজার হাজার শিক্ষার্থীকে নাম নথিভুক্তিকরণে বাধা দেয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজকর্ম অচল করে দেয়াই ওদের উদ্দেশ্য। এটা একধরনের গুন্ডামি, যা জেএনইউয়ের নীতির পরিপন্থী। কাউকে রেয়াত করা হবে না। কড়া পদক্ষেপ করা হবে।’

উপাচার্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের সংগঠনও। তাকে সরানোর দাবিতে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দকে খোলা চিঠি দিয়েছেন অধ্যাপকরা। তাতে বলা হয়, ‘ইট-পাথর, লোহার রড এবং লাঠি হাতে একটা দলকে গতকাল বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। হস্টেলে ঢুকে ব্যাপক ভাঙচুর ও তান্ডব চালায় তারা। তাতে ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ-সহ অনেকেই আহত হয়েছেন। অধ্যাপকদের ডাকা বৈঠকেও হামলা চালানো হয়। এর জন্য সরাসরি জেএনইউ কর্তৃপক্ষকেই দায়ী করছি আমরা। গোটা ঘটনায় নিরপেক্ষ তদন্তের আর্জি জানাচ্ছি আমরা। কিন্তু এম জগদেশ কুমার দায়িত্বে থাকাকালীন তা সম্ভব নয়। অবিলম্বে ওকে সরানো হোক।’

মুখোশধারীদের তান্ডবের প্রতিবাদে পথে নেমেছেন দেশের বিভিন্ন রাজ্যের শিক্ষার্থীরা। সোমবার সকালে গেটওয়ে অব ইন্ডিয়ার সামনে জমায়েত করেন মুম্বইয়ের বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীরা। দিল্লি ও আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও পথে নামেন। দুপুরে পথে নামেন কলকাতার যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুণের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার শিক্ষার্থীরাও। জেএনইউ-তে তান্ডবের প্রতিবাদে এ দিন জয়পুরে পথে নামেন রাজস্থান বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অব ইন্ডিয়া (এনএসইউআই)-র সদস্যরা। তার পাল্টা হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বিক্ষোভের ডাক দেয় এবিভিপি-র শিক্ষার্থীরাও। তা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে।

ইতিমধ্যেই জেএনইউ-তে হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জেএনইউয়ের পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষও। লন্ডনের অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির তরফেও জেএনিউয়ের পাশে থাকার বার্তা দেয়া হয়েছে। সূত্র : টিওআই, টাইমস নাউ, এনডিটিভি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ