পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অত্যন্ত মর্মান্তিক, হৃদয়বিদারক। সড়ক দুর্ঘটনায় নিমেষে একটি পরিবার শেষ। আমরা প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনার খবর পত্র-পত্রিকায় পড়ি। দুর্ঘটনার এসব খবর পড়তে পড়তে হৃদয়সহা হয়ে গেছে। সাধারণ ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে, এটাই যেন স্বাভাবিক। তবে এসব দুর্ঘটনার মধ্যে কিছু দুর্ঘটনা এমনই যে হৃদয় ভেঙ্গে যায়। হাহাকার সৃষ্টি হয়। এমনই একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে। বাংলাদেশ ব্যাংকের যুগ্ম পরিচালক সাইফুজ্জামান তার পরিবার নিয়ে বান্দরবান বেড়ানো শেষে প্রাইভেট কারে ঢাকা ফিরছিলেন। গাড়িতে ছিল তার স্ত্রী, দুই কন্যা ও একমাত্র ছেলে। গাড়িটি সাইফুজ্জামান নিজেই চালাচ্ছিলেন। সকাল সাড়ে সাতটার দিকে চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকু-ের ফৌজদারহাট-বন্দর বাইপাস সংযোগ সড়ক এলাকায় একটি লরির সঙ্গে মুখোমুখি ধাক্কায় গাড়িটি ধুমড়ে-মুচড়ে যায়। নিহত হন সাইফুজ্জামান এবং তার দুই মেয়ে। স্ত্রী ও ছেলে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। স্ত্রী জানে না তার স্বামী ও দুই মেয়ে নেই। ছেলে জানে না তার বাবা ও দুই বোন নেই। শেষ হয়ে গেল একটি উজ্জ্বল ও আলোকিত পরিবার। এ দায় কার? এ প্রশ্নের উত্তর নিয়ে অনেক বিতর্ক চলতে পারে। তবে যে ক্ষতি হয়ে গেল তা কি আর কোনো দিন পূরণ হবে? হবে না। হবার নয়। এমনিভাবে প্রায় প্রতিদিন দেশের কোনো না কোন পরিবার নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ২০১৮ সালে সারাদেশে ৫ হাজার ৫১৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছে ৭ হাজার ২২১ জন। আহত হয়েছে ১৫ হাজার ৪৬৬ জন। এ বছরের হিসাব তারা এখনও করেনি। এই যে ৭ হাজার ২২১ জন নিহত হয়েছে, তারা কোনো না কোনো পরিবারের সদস্য। অনেকে কর্মজীবী, অনেকে উপার্জনক্ষম। আহতদের মাঝেও এমন রয়েছে। তাহলে আহত-নিহতদের পরিবারগুলোর কী দুর্দশার মধ্যে আছে, তা আমরা কয়জন খোঁজ রাখছি? সরকারও কি খোঁজ রাখছে? রাখছে না। বলা বাহুল্য, সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের একজন বা একাধিক সদস্যের মৃত্যু ও পঙ্গু হয়ে যাওয়া যে কী যন্ত্রণা বয়ে আনে, তা ভুক্তভুগী পরিবার ছাড়া কারও পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। ব্যক্তিটি যদি কর্মক্ষম বা একমাত্র উপার্জনকারী হয়, তবে সেই পরিবারটির অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ে। আর পঙ্গুত্ব বরণকারীর জীবন হয়ে উঠে অর্থহীন এবং পরিবারেরও বোঝায় পরিণত হয়। এমনকি তার চিকিৎসা করতে গিয়ে পরিবারকে নিঃস্বও হতে হয়। প্রায় প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় উপার্জনকারী ব্যক্তির মৃত্যুতে বা পঙ্গুত্ব বরণে অনেক পরিবার অস্তিত্ব বিপন্নের মুখোমুখি এবং নিঃস্ব হওয়ার পথে চলেছে। স্বাভাবিকভাবে মনে হতে পারে এই ক্ষতি শুধু পরিবারের হচ্ছে। এর বাইরে সচেতনভাবে চিন্তা করলে যে কেউ বুঝতে পারবেন, সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু পরিবারই নয়, দেশও অনেক কর্মক্ষম এবং মেধাবী মানুষ হারাচ্ছে, যারা তাদের অবস্থান থেকে দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলছিল। যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসেবে দেখা গেছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের ৩৭ শতাংশই পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি।
দুই.
জীবন অমূল্য, তবে কিছু কিছু বিশেষ মানুষ আছেন যাদের অকাল মৃত্যুতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যায়। একজন ডাক্তার, একজন শিক্ষক, একজন প্রকৌশলী, একজন ব্যবসায়ী, একজন সেলিব্রেটি এরকম বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে দেশকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অবদান রাখছেন, তাদের একজনের মৃত্যুতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়, তা পূরণ করা শুধু সময়ের ব্যাপার নয়, সম্ভবও হয় না। একজন মেধাবী ও অমিত সম্ভাবনাময় ছাত্র বা ছাত্রী, যে দেশের ভবিষ্যতের কান্ডারি, দেশকে এগিয়ে নেবে, নেতৃত্ব দেবেÑতার মৃত্যুতে দেশের এগিয়ে যাওয়াও ব্যাহত হয়। আবার একজন শ্রমিকের মৃত্যুও দেশের অর্থনীতিতে ক্ষত সৃষ্টি করে। সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোন না কোন এলাকায় উৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত কর্মক্ষম ও বিশেষ শ্রেণীর মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এ মৃত্যুর হার এখন এতটাই অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে যে, তা যেমন উদ্বেগের তেমনি দেশের অর্থনীতি এবং অগ্রযাত্রার ক্ষেত্রেও অশনি সংকেত হয়ে দেখা দিয়েছে। বছর কয়েক আগে একটি ইংরেজি দৈনিকে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে দেখানো হয়েছে, দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের শতকরা ৭৩ ভাগ উৎপাদনশীল খাতের সাথে জড়িত। সরকারি হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ থেকে ২ শতাংশ ক্ষতি হয়। এই বিশ্লেষণ থেকেই বোঝা যায়, লাগামহীন সড়ক দুর্ঘটনা কিভাবে দেশের অর্থনীতিকে ভয়াবহভাহ ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতিদিন গড়ে ৮ জন মানুষ মারা যায়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ৩০ জন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ৪৮ জন। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী বছরে ৩ হাজার, বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ১২ হাজার এবং অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে ১৮ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায়। এসব পরিসংখ্যান পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়। এর বাইরে যে আরও অনেক দুর্ঘটনায় মানুষ আহত-নিহত হয়, তা সব সময় পত্র-পত্রিকায় আসে না। ফলে বলা যায়, সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির হার বাংলাদেশের জন্য অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি তার মেধা এবং কর্মদক্ষতারও মৃত্যু হচ্ছে। এর প্রতিক্রিয়া পড়ছে পুরো অর্থনীতিতে। বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘সাধারণ সময়ের চেয়ে ঈদের ছুটিতে সড়ক দুর্ঘটনা ২ থেকে ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি পায়।’ সড়ক দুর্ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটে বর্ষা মৌসুমে। বিশেষ করে জুলাই ও আগস্টে। বিশেষজ্ঞরা এ দুটি মাসকে ‘ডেডলিয়েস্ট মান্থ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিলের চেয়ে উক্ত দুই মাসে শতকরা ৩০ ভাগ দুর্ঘটনা বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হিসিবে গবেষকরা বলেছেন, বর্ষা মৌসুমে রাস্তা-ঘাট ভেজা ও পিচ্ছিল থাকে। গাড়ির ব্রেক কম ধরে এবং বৃষ্টিতে গাড়ির উইন্ডশিল্ড ঘোলা হয়ে যাওয়ায় চালকদের দেখতে অসুবিধা হয়। এ সময়ে চালকদের উচিত গাড়ির স্বাভাবিক গতি অর্ধেকে নামিয়ে গাড়ি চালানো। গাড়ি চালকদের এ ব্যাপারে সতর্ক করে গাইড লাইন দেয়া বা তারা নিজেরা কতটা সচেতন, তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে। তার উপর গাড়ি চালকদের যোগ্যতা ও দক্ষতা নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন উঠেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশের বেশির ভাগ চালকের সঠিক ড্রাইভিং লাইসেন্স নেই। এ যে কত মারাত্মক ঘটনা তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভুয়া বা জাল লাইসেন্সধারী এসব চালকদের হাতে মানুষের জীবন নিরাপদ, এ চিন্তা কোন সুস্থ্য মানুষ করতে পারে না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হওয়ার কারণ রয়েছে, এসব ড্রাইভারদের হাতে ড্রাইভিং লাইসেন্স নয়, ‘লাইসেন্স টু কিল’ তুলে দেয়া হয়েছে। পত্র-পত্রিকায় ড্রাইভারের ভুলের কারণে দুর্ঘটনা ঘটলে তাদেরকে ‘ঘাতক’ বলা হলে সংশ্লিষ্টরা নাখোশ হন। চরম আপত্তি জানিয়ে বলেন, ড্রাইভারকে ঘাতক বলা যাবে না। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, তাদের কাছে কোটি কোটি সাধারণ ও অসাধারণ মানুষের জীবনের চেয়ে গুটিকয় ভুয়া লাইসেন্সধারী ও অপরাধী গাড়ি চালকদের জীবনের মূল্য বেশি। কোন সভ্য দেশে এ ধরনের আচরণ কল্পনাও করা যায় না। আমরা সরকারের কাছ থেকে দিন বদলের কথা অনেক শুনেছি। দুঃখের বিষয়, সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর ক্ষেত্রে তো কোন পরিবর্তন দেখা যায় না। বরং সরকার আইন করলে তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর বাধার মুখে পড়ে পিছিয়ে যায়। নতুন সড়ক আইন বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সরকার এখন থমকে গেছে। এ আইন বাস্তবায়ন নিয়ে কত কথা বলা হচ্ছে! এ আইন শাস্তি দেয়া বা জরিমানার জন্য নয়, সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বলে ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে। এর কার্যকর সময় ছয় মাস পিছিয়ে দিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা হবে। দুঃখের বিষয় দেখা যাচ্ছে, সচেতন তো হচ্ছেই না, উল্টো দুর্ঘটনা বেড়ে চলেছে। প্রতিদিন অনেক পরিবার নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয়, পরিবহন সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের মধ্যে এ নিয়ে কোনো দুঃখ প্রকাশ করতে দেখা যায় না। বরং তারা ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্সধারীদের পক্ষ হয়ে কথা বলেন। তারা কি পারেন না, ভুয়া লাইসেন্সধারী ড্রাইভারের সংখ্যা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নিতে? কিংবা তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে? লাইসেন্স প্রদানকারী সংস্থা বিআরটিএ এবং ট্রাফিক পুলিশ বিভাগের সাথে বসে ভুয়া লাইসেন্স বন্ধ এবং যাদের কাছে ভুয়া লাইসেন্স পাওয়া যাবে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ কি তারা নিতে পারেন না? এসবই করা যায়, যদি সদিচ্ছা থাকে।
তিন.
ইংরেজি দৈনিক পত্রিকাটির গবেষণামূলক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের বেশির ভাগের বয়স ১৪ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এবং তারা অর্থনৈতিক কর্মকা-ের সাথে জড়িত। বাংলাদেশে একজন শিক্ষিত মানুষ সাধারণত ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে এবং ৪০ বছর বা তার পরে ক্যারিয়ারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে। অশিক্ষিত বা কমশিক্ষিত মানুষ ১৮ বছরের আগেই তার কর্মজীবন শুরু করে। এদের প্রত্যেককেই জীবন-জীবিকার তাগিদে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছুটতে হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শ্রমজীবী মানুষরাই সবচেয়ে বেশি সড়ক পথ ব্যবহার করে। বাস ও ট্রেনের ছাদ বা ট্রাকে তাদের যাতায়াত বেশি। ফলে দুর্ঘটনার ঝুঁকিও তাদের বেশি থাকে। এদের মধ্যে যার উপর পুরো পরিবারের চালিকাশক্তি নির্ভর করে তার মৃত্যু পরিবারটিকে বিপর্যয়ের দিকে, এমনকি ধ্বংসও করে দেয়। সে যদি আহত হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, তাহলেও পরিবারে বিপর্যয় নেমে আসে। এতে যেমন পরিবারের সদস্যদের দারিদ্র্য বৃদ্ধি পায় তেমনি এই দারিদ্র্য দেশের অর্থনীতিতেও চাপ সৃষ্টি করে। আর একজন শিক্ষিত ও বিশেষ ব্যক্তির মৃত্যু হলে, শুধু তার পরিবারই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, দেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনীতিসহ বহুমুখী খাতে তিনি যে অবদান রাখছিলেন, তা থেমে যায়। বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হয়, যা পূরণ করা সম্ভব হয় না। সড়ক দুর্ঘটনায় যদি একজন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি কর্মকর্তার মৃত্যু হলে, তার অবদান থেকে দেশ যেভাবে বঞ্চিত হয়, তা কি পূরণ করা সম্ভব? একজন রাজনীতিবিদের মৃত্যু হলে দেশ কি তার নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় না? আর ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে নব দম্পতি এবং আগামী প্রজন্মের মেধাবী ছাত্র-ছাত্রী তো প্রতিনিয়তই মারা যাচ্ছে। অর্থনীতিতে এরা যে অবদান রেখে চলছিল এবং আগামীতে অবদান রাখতে পারতো, শুধু মাত্র চালকদের অসতর্কতা ও বেপরোয়া মনোভাবের কারণে দেশ তাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিষয়গুলো সরকার বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় গভীরভাবে চিন্তা করে বলে মনে হয় না। মন্ত্রী বা এমপিদের মধ্যে এমন প্রবণতা দেখা যায় যে, তারা এসব বিষয়কে নিছক দুর্ঘটনা বলে দায় সারেন। দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, তবে এর হার কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায়, এদিকে যদি তারা মনোযোগ এবং কার্যকর উদ্যোগ নিতেন, তবে সাধারণ মানুষের দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা হিসেবে মেনে নিতে আপত্তি থাকত না। কোন উদ্যোগ থাকবে না, অদক্ষ ও ভুয়া লাইসেন্সধারী চালক অবাধে গাড়ি চালাবে, তাদের ভুলে মানুষের জীবন যাবে আর একে দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়া কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। পত্র-পত্রিকায় এসব গাড়ি চালকদের যখন হত্যাকারি বলা হয়েছিল, তখন এক সময়ের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী চরম অসন্তুষ্ট হয়ে আপত্তি জানিয়ে ছিলেন। এদের হত্যাকারি বলা যাবে না বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। তিনি চালকদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন। এতে চালকরা প্রশ্রয় পেয়ে তাদের বেপরোয়া মনোভাব চালিয়ে যায়। মন্ত্রী যদি তখন ভুয়া লাইসেন্সধারী চালকদের পক্ষ না নিয়ে তাদের সংশোধনে কার্যকর ভূমিকা নিতেন এবং দুর্ঘটনায় নিহত-আহতদের দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভূমিকা উপলব্ধি করতেন, তবে সড়ক দুর্ঘটনা অনেকাংশেই কমে যেত।
চার.
সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন যেভাবে কর্মক্ষম মানুষের মৃত্যু হচ্ছে এবং এটি যে একটি জাতীয় সমস্যায় পরিণত হয়েছে, এ নিয়ে সরকারের কোন বিচলন আছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে না। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার দুর্ঘটনাকে ¯্রফে দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখছে। দুর্ঘটনার কারণ কি এবং কিভাবে কমানো যায়, এ ব্যাপারে সরকার নিষ্ক্রিয়। অথচ সর্বক্ষেত্রেই জনসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা বিধান করা সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। সড়ক দুর্ঘটনার হার যেখানে দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, একটি অন্যতম প্রধান সমস্যায় পরিণত হয়েছে এবং উৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, বিষয়টি সরকারকে গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ২০১১ সালে মস্কোতে জাতিসংঘ সদস্য দেশগুলোয় ২০২০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় কমিয়ে আনার জন্য সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল। বাংলাদেশও এর সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে। দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশ কেবল সংহতি প্রকাশ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে রয়েছে। উল্লেখিত লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট কোন পরিকল্পনা বা কর্মসূচি নেয়নি। সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে এ ধরনের কর্মসূচি প্রণয়নে সরকারের উদাসীনতা কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। বলা যায়, দুর্ঘটনা কমাতে যে ধরনের কার্যকর সড়ক ব্যবস্থাপনা প্রণয়ন করা প্রয়োজন, সে ধরনের কোন ব্যবস্থাপনা দৃষ্টিগোরচর হচ্ছে না। ফলশ্রতিতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রায় প্রতিদিন অমূল্য জীবন ঝরে পড়ছে। যার যায় কেবল সে জানে কথাটি এখন শুধু ব্যক্তি বা পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত নয়, এটি দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার সাথেও জড়িয়ে গেছে। উৎপাদনশীল খাতে নিয়োজিত যেসব ব্যক্তির প্রাণ যাচ্ছে এবং যে ক্ষতি হচ্ছে, দেশের স্বার্থে সরকারকে এখন তা জানতে হবে, উপলব্ধি করতে হবে। দেশে সড়ক দুর্ঘটনার হার কমিয়ে আনার জন্য যা করা প্রয়োজন, তা করতে হবে। জাল লাইসেন্সধারী গাড়ি চালকদের অরিজিনাল লাইসেন্সের আওতায় আনতে হবে। সড়ক-মহাসড়কগুলোর যেসব অংশ ‘ব্ল্যাক পয়েন্ট’ বা বিপজ্জনক হিসেবে চিহ্নিত, সেগুলো সংস্কার করে নিরাপদ করতে হবে। ২০১১ সালে ঢাকা-আরিচা সড়কের জোকা এলাকায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ বেশ কয়েক জন দুর্ঘটনায় মারা যাওয়ার পর দেশব্যাপী সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে জনমত গড়ে উঠে। তখন সড়ক ও জনপদ বিভাগ ঢাকা-আরিচা সড়কের বাঁক প্রশস্ত, সোজা ও সড়ক বিভাজন স্থাপন করার পরিকল্পনা নেয়। এতে এ সড়কে দুর্ঘটনার হার হ্রাস পায়। সদিচ্ছা থাকলে যে সড়ক দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা যায়, তা এ ঘটনাই তার প্রমাণ। বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এবং মানুষকে বাঁচাতে হলে সড়ক-মহাসড়কগুলোর সংস্কার, আইনের যথাযথ প্রয়োগ, সড়ক ও যানবাহনের ফিটনেস উন্নয়ন, চালকের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং যাত্রীদের সচেতন হওয়ার বিকল্প নেই।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।