Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন ও গণতন্ত্র

আধুনিক ফ্যাসিবাদের দিকে এগিয়ে চলেছে ভারত-১

বিজনেস ইনসাইডার | প্রকাশের সময় : ২১ ডিসেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম | আপডেট : ১২:০৬ এএম, ২১ ডিসেম্বর, ২০১৯

ভারতে নাগরিকত্ব আইনের একটি বিতর্কিত সংশোধনী সম্প্রতি পাস হয়েছে, যা সারা দেশে মারাত্মক বিক্ষোভের সূত্রপাত করেছে এবং যার ফলে দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন।
গত ১১ ডিসেম্বর ভারতের সংসদে ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের একটি সংশোধনী পাস হয়, যা দেশটির নাগরিক হওয়ার জন্য নির্দেশিকা নির্ধারণ করে। ২০১৯ সালের সংশোধনীর মাধ্যমে এই বিলে ধর্মীয় পরিচয়কে নাগরিকত্বের ভিত্তি হিসেবে নির্ধারণ করা হয়েছে। যেখানে বলা হয়েছে, যেসব হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধ, জৈন, পার্সী এবং খ্রিস্টান ধর্মীয় সংখ্যালঘু প্রতিবেশী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ পাকিস্তান, বাংলাদেশ এবং আফগানিস্তান ছেড়ে পালিয়ে এসেছে তাদের নাগরিকত্ব দেয়া হবে।

সংশোধিত আইনটিকে সমালোচকরা ইসলামবিরোধী বলে অভিহিত করেছেন এবং তারা বলেছেন যে, এটি ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদেরকে আরও কোনঠাসা করে তুলেছে। এর প্রতিক্রিয়ায় সারা দেশে সহিংস বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, যার ফলে ইতিমধ্যে ছয়জন মারা গিয়েছে। পুলিশের সাথে সংঘর্ষে আরও অসংখ্য মানুষ আহত ও গ্রেফতার হয়েছে।

নাগরিকত্ব বিল নিয়ে যে লড়াইটি শুরু হয়েছে, তা সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে দেশটিতে ধর্মান্ধতার ক্রমবর্ধমান জোয়ারের প্রতিফলন করে। বিশেষত, এই বিল ১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতের ১৪ শতাংশ মুসলিম জনগণকে আতঙ্কিত করে তুলেছে।

বিলে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু-জাতীয়তাবাদী সরকারকে এমন একটি দেশ তৈরিতে আরও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের অধিকার আরও বাড়াতে সমর্থন করে এবং প্রশাসন ও জনজীবনে আরও বৈষম্যে তৈরির সুযোগ করে দেয়।
ভারতের নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫ সালে প্রথম গৃহীত হয়েছিল, যাতে দেশটির নাগরিকত্ব সম্পর্কিত বিস্তারিত দিক-নির্দেশাবলী উল্লেখ করা হয়েছিল। এটি বেশ কয়েকবার সংশোধন করা হয়েছে, যার মধ্যে ২০০৩ সালে সংশোধনীর মাধ্যমে সরকারকে তার সমস্ত নাগরিকের জাতীয় নিবন্ধকরণ (এনআরসি) রাখার অনুমতি দেয়া হয়েছে। যদিও মুসলিম-সংখ্যাগরিষ্ঠ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম ছাড়া এটি অন্য কোথাও এখনও কার্যকর করা হয়নি।
নাগরিকত্ব আইনের সাম্প্রতিক সংশোধনী (স্থানীয়ভাবে ‘সিএবি’ বা ‘সিএএ’ হিসাবে পরিচিত) ভারতের সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় গত ১০ ডিসেম্বর ও পরেরদিন উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভায় পাস হয়। প্রেসিডেন্ট রাম নাথ কোবিন্দের সাক্ষরের মাধ্যমে এই বিলে আইনে পরিণত হয়।

এই বিলটি ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও মোদির ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভারতীয় জনতা পার্টির অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা অমিত শাহের দ্বারা প্রবর্তন করা হয়েছিল। এতে বলা হয়েছে যে, তিন প্রতিবেশী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ থেকে ২০১৫ সালের আগে ভারতে প্রবেশ করা নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেয়া হবে। উল্লেখযোগ্যভাবে, এই আইনটিতে মুসলিম অভিবাসীদের বাদ দেয়া হয়েছে। এর কারণ হিসেবে ভারতের একজন সংসদ জানিয়েছেন, তারা এই মুসলিম দেশগুলিতে ধর্মীয় নিপীড়নের মুখোমুখি হচ্ছে না।
বিলে প্রতিবেশী দুই বৌদ্ধ দেশ মায়ানমার এবং শ্রীলঙ্কাকেও বাদ দেয়া হয়েছে, যারা সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বড় ধরনের শরণার্থী সংকট ভোগ করেছে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ফ্রন্টলাইন অনুসারে, ভারতের তামিলনাড়– রাজ্যে ১০০ টিরও বেশি শিবিরে প্রায় ৫৯,০০০ শ্রীলঙ্কার তামিল শরণার্থী রয়েছেন এবং আরও প্রায় ৩০,০০০ এই শিবিরের বাইরে বাস করেন।

এই বিলে উপেক্ষা করা হয়েছে মিয়ানমারে বার্মিজ সামরিক বাহিনীর হাতে জাতিগত ও ধর্মীয় নির্মূল হওয়া রোহিঙ্গা মুসলমানদেরকেও। যাদেরকে জাতিসংঘকে বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত সংখ্যালঘু বলে গণ্য করেছে। সরকার ভারতে বসবাসরত আনুমানিক ৪০,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীকে তাদের নিজ রাষ্ট্রে ঝুঁকির মধ্যে থাকা সত্তে¡ও নির্বাসন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

এ বিষয়ে দেয়া এক বিবৃতিতে অমিত শাহ বলেন, ‘মোদি সরকার একমাত্র যেই ধর্ম অনুসরণ করে তা হ’ল ভারতের সংবিধান।’ বিবৃতিতে তিনি বলেন যে, ‘বিলটি ভারতের সংখ্যালঘুদের বিরোধী নয় এবং প্রতিটি ভারতীয় নাগরিকের অধিকারও সমানভাবে সুরক্ষিত থাকবে।’ বিলটি আসাম এবং অন্যান্য আদিবাসী অঞ্চলে প্রযোজ্য নয়।
মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসংঘের হাই কমিশনারের একজন মুখপাত্র এই আইনটিকে ‘নীতিগতভাবে বৈষম্যমূলক’ আখ্যায়িত করেছেন এবং বলেছেন যে, এটি ভারতের গণতান্ত্রিক কাঠামোর পরিপন্থী। এ বিষয়ে পররাষ্ট্রনীতি বিশ্লেষক রবি আগড়াওয়াল এবং ক্যাথরিন সালাম বলেছেন, ‘যদিও নিপীড়িত মানুষদের রক্ষা করার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য, তবুও এটি একটি শক্তিশালী জাতীয় আশ্রয় ব্যবস্থার মাধ্যমে করা উচিত যা সমতা এবং অ-বৈষম্যে নীতির ভিত্তিতে করা হবে, এবং যা অত্যাচার এবং অন্যান্য মানবাধিকার থেকে সুরক্ষার প্রয়োজনে সবার জন্য প্রযোজ্য হবে, কোন বর্ণ, ধর্ম, জাতীয় উৎস বা অন্য কিছুর ভিত্তিতে কোনও পার্থক্য করা ছাড়াই।’ তারা বলেন, ‘আইনটি সত্যিকারভাবে এই অঞ্চলের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার বিষয়ে নয়, বরং, ধর্মকে নাগরিকত্বের ভিত্তির অংশ হিসাবে তৈরি করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাকে চ্যালেঞ্জ জানায়।’

চলতি মাসে ভারতে নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী সহ হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভে নেমেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৫ ডিসেম্বর, উত্তর প্রদেশের আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় এবং নয়াদিল্লির জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া - দু’টি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে পুলিশ ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে, সেখানে পুলিশ শিক্ষার্থীদের উপর লাঠিচার্জ এবং টিয়ার গ্যাস ব্যবহার করে। বিক্ষোভ দমাতে এমনকি কর্তৃপক্ষ সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে বাধ্য হয় এবং আসামে কারফিউ জারি করা হয়। (চলবে)



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারত


আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ