শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
পারস্য কবি ওমর খৈয়াম, ইতিহাসের পাতায় অবাক বিস্ময়কর বহুমুখী প্রতিভার এক অমর নাম। বিশ্ব ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে খচিত। তার বহুমুখী প্রতিভার কারণে সারা বিশ্বের মানুষ ওমর খৈয়াম নামটির সাথে সুপরিচিত। তিনি তার সময়ের চেয়ে আধুনিক ছিলেন। তিনি প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও জরাজীর্ণ ইতিহাস বদলে দিয়ে নিজেই রচনা করে গেছেন নতুন ইতিহাস। যদিও তিনি আমাদের কাছে অন্যতম সেরা মুসলিম কবি হিসেবে পরিচিত কিন্তু তিনি ছিলেন একাধারে একজন দার্শনিক, গণিতজ্ঞ, জ্যোতির্বিদ, হাকীম ও শিক্ষক। তিনি অত্যন্ত জটিল ও রসকষহীন গণিত নিয়ে কাজ করেছেন। সেই তিনিই আবার লিখেছেন আধ্যাত্মিক, প্রেম ও দ্রোহের মধুর সব কবিতা। তিনি জ্যোতির্বিদ্যা নিয়ে কাজ করেছেন এবং প্রণয়ন করেছেন একটি পূর্ণাঙ্গ বর্ষপঞ্জিকা। আবার কখনো চতুষ্পদী কবিতার অমর সংকলন ‘রুবাইয়াত’ রচনা করেছেন। আধুনিক বীজগণিতের ভিত্তি তৈরি হয়েছে তার হাতে, কাজ করেছেন ইউক্লিডীয় জ্যামিতি নিয়েও। ভূগোল, বলবিদ্যা, খনিজবিজ্ঞান, আইন, এমনকি সঙ্গীতও বাদ যায়নি তার জ্ঞানপিপাসার তালিকা থেকে। জীবনের শেষ দিকে এসে হয়েছেন শিক্ষক। শিক্ষাদান করেছেন ইবনে সিনার দর্শন ও গণিত বিষয়ে। তার ছিল তীব্র জ্ঞান পিপাসা, তাই প্রচুর বই পড়তেন। বই পড়ার ব্যাপারে তার কোন বাদ বিচার ছিল না। যে কোন বিষয়ের বই তার কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় ছিল। বলা হয়ে থাকে, তার বই পড়ার নেশার কারণেই তিনি বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হতে পেরেছিলেন।
ওমর খৈয়াম ১০৪৮ খ্রিস্টাব্দের ১৮ মে পারস্যের বিখ্যাত বাণিজ্যিক শহর নিশাপুরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ইব্রাহিম খৈয়াম ছিলেন সে শহরের বিখ্যাত চিকিৎসক। ইতিহাসের কোথায় তার মায়ের নাম উল্লেখ না থাকার কারণে যা আমাদের অজানাই থেকে গেল। ওমর খৈয়ামের পুরো নাম ‘ঘিয়াথ আদ দীন আবু ফাতাহ ওমর ইবনে খৈয়াম নিশাপুরি’। নামের প্রথম অংশ ‘ঘিয়াথ আদ দীন’ অর্থ বিশ্বস্ত কাঁধ বা যাকে বিশ্বাস করা যায়। তার কোনো পুত্রসন্তান ছিল কিনা সে ব্যাপারে ইতিহাসে কোনো তথ্য পাওয়া যায় নাই। তথাপি ‘আবু ফাতাহ’ অর্থ ফাতাহের পিতা। ‘ইবনে খৈয়াম’ অর্থ খৈয়ামের পুত্র (অনেক ইতিহাসবিদ বলেন, ওমর তার বাবার কাজের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে নামের শেষে ‘খৈয়াম’ যুক্ত করেন)। এবং ‘নিশাপুরি’ অর্থ নিশাপুরে জন্ম। কিন্তু তার নামের ব্যাপারে বিতর্ক আছে কারণ, ‘খৈয়াম’ শব্দের অর্থ ‘যে ব্যক্তি তাঁবু তৈরি করে’। একদিকে শোনা যায়, তার বাবা ধনী চিকিৎসক ছিলেন। অন্যদিকে কেউ দাবি করছেন ওমরের বাবা খৈয়াম ছিলেন একজন তাঁবু তৈরির কারিগর। এখানে বিপরীত পক্ষের যুক্তি এরূপ যে, ইংরেজিতে অনেক মানুষের নাম ‘স্মিথ’ হলেও তারা আক্ষরিক অর্থের মতো কামার নয়।
্রআঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদাগ্ধ- উনিশ শতকে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য এই কবিতা লিখেছেন। আর ওমর খৈয়াম প্রায় হাজার বছর আগেই এই কবিতার বাণী নিজের জীবনে প্রতিফলিত করেছিলেন। পিতা এবং পিতৃতুল্য শিক্ষকের মৃত্যুতেও ভেঙে না পড়ে সংসারের হাল ধরেন তিনি। প্রথমে কিছুদিন নিশাপুরেই টুকটাক কাজ করেন। ১০৬৮ সালে তিনি সমরকন্দে চলে আসেন। সেখানে তিনি তার বাবার বন্ধু ও সে শহরের গভর্নর আবু তাহিরের অধীনে কাজ শুরু করেন। কিছুদিনের মধ্যেই ওমরের অসাধারণ গাণিতিক জ্ঞান দেখে তাকে সরকারি অফিসে চাকরি দেন তাহির। এর কয়েক মাস পরই ওমর রাজার কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। এই সময়ে তিনি বীজগণিত চর্চা করতে থাকেন। বীজগণিত দিয়েই নিজের গবেষণা জীবন শুরু করেন খৈয়াম। প্রথমেই তিনি অনুধাবন করেন, প্রচলিত গ্রীক পদ্ধতিতে ত্রিঘাত সমীকরণের সমাধান সম্ভব নয়। তাই নতুন পদ্ধতি নিয়ে ভাবতে শুরু করেন ওমর। ১০৭০ সালে মাত্র ২২ বছর বয়সেই তিনি এর সমাধান করে ফেলেন। সে বছর তিনি তার জীবনের অন্যতম সেরা কাজ, ‘ডেমনস্ট্রেশন অব প্রবলেমস অব অ্যালজেবরা অ্যান্ড ব্যালেন্সিং’ প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি বৃত্ত, প্যারাবোলার মতো কণিক ব্যবহার করা সহ ত্রিঘাত সমীকরণের একাধিক সমাধান পদ্ধতির উল্লেখ করেন। তবে তার সমাধানে ঋণাত্মক সংখ্যা এবং ঋণাত্মক রুট উপেক্ষিত ছিল। কেননা ঋণাত্মক সংখ্যা তখনো ইসলামিক গণিতবিদগণের মাঝে প্রচলিত হয়নি।তবে এই অসাধারণ কীর্তিতেও অতৃপ্ত ছিলেন ওমর। তিনি সবসময় চাইতেন, বীজগাণিতিক সমস্যার সমাধান বীজগাণিতিক কোনো সূত্র বা পদ্ধতি ব্যবহার করেই করতে। জ্যামিতিক পদ্ধতিতে ত্রিঘাত সমাধান করে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। আর এই অসন্তুষ্টি থেকেই রচনা করলেন ‘ট্রিটিজ অন ডেমনস্ট্রেশন অব প্রবলেমস অব অ্যালজেবরা অ্যান্ড ব্যালেন্সিং’। এখানে তিনি সম্পূর্ণ বীজগাণিতিক উপায়ে ত্রিঘাত সমাধান করেন। আর তার এই কাজই তখন তাকে প্রথম সারির গণিতবিদ হিসেবে খ্যাতি এনে দেয়। ওমর খৈয়ামের মৃত্যুর প্রায় পাঁচশো বছর পর্যন্ত ত্রিঘাত সমীকরণের তেমন কোনো উল্লেখযোগ্য উন্নতি হয়নি। ১৫৩৫ সালে নিকোলো টার্টাগিলা ত্রিঘাত সমীকরণ সমাধানের সাধারণ সূত্র তৈরি করলে বীজগণিত ওমর খৈয়াম যুগ থেকে এক কদম এগিয়ে যায় মাত্র।
১০৭৩ সালে ওমর খৈয়ামের জীবনের মোড় অন্যদিকে ঘুরে যায়। সেলজুক সাম্রাজ্যের সুলতান মালিক শাহ তাকে সেলজুকের রাজধানী ইস্ফাহানে আমন্ত্রণ জানান একটি অপরিবর্তনীয় এবং চিরস্থায়ী বর্ষপঞ্জিকা তৈরি করে দিতে। উল্লেখ্য, তখনকার সময়ে পঞ্জিকাগুলো স্থায়ী ছিল না এবং ঘন ঘন বছরের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন করা হতো। সুলতানের ডাকে সাড়া দিয়ে আরো কয়েকজন বিজ্ঞানীকে সাথে নিয়ে ১০৭৪ সালে সেলজুক গমন করেন ওমর খৈয়াম। সুলতান মালিক শাহ ওমরকে ভালো বেতন এবং সব রকম সুযোগ-সুবিধার নিশ্চয়তা দিলেন। প্রথমেই ওমর তাকে দিয়ে একটি অবজারভেটরি (মানমন্দির) তৈরি করিয়ে নিলেন। যেখান থেকে অন্তত ৩০ বছর আকাশ পর্যবেক্ষণ করা হবে। ৩০ বছরের লক্ষ্য এজন্য ঠিক করা হয়েছিল যে এ সময়ে শনি গ্রহ তার কক্ষপথে একবার ঘূর্ণন শেষ করবে। পর্যবেক্ষণে খৈয়াম ১০২৯.৯৮ দিনে ২.৮২ বছর হিসাব করলেন। সে হিসাবে এক বছরের দৈর্ঘ্য দাঁড়ায় ৩৬৫.২৪২২ দিন। বর্তমানে আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বছরের দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেছে ৩৬৫.২৪২১৮৯ দিন বা ৩৬৫.২৪২২ দিন। ওমর খৈয়াম যা বহু বছর আগে যা হিসাব করেছিলেন, তাই আধুনিক বিজ্ঞান প্রমাণ করলো । ওমর তার বর্ষপঞ্জির কাজ শেষ করেছিলেন ১০৭৮ সালে। পরের বছর থেকেই সুলতান মালিক শাহ নতুন বর্ষপঞ্জি হিসেবে ওমরের বর্ষপঞ্জি চালু করেন যা ২০ শতক পর্যন্ত প্রচলিত ছিল।
ওমর খৈয়াম একজন অসাধারণ কবি ছিলেন। আসলেই কি ছিলেন? তার ‘রুবাইয়াত’ পড়লে যে কেউ মুগ্ধ হতে বাধ্য। কিন্তু কেউ কেউ যে বলে থাকেন, রুবাইয়াতের একটি লাইনও ওমরের লেখা নয়। তবে অধিকাংশ ইতিহাসবিদই ‘রুবাইয়াত’কে ওমরের কবিতা বলে উল্লেখ করেছেন। এটি একটি কবিতা নয়, শত শত কবিতার সংকলন ইতিহাসবিদ সাঈদ নাফসির মতে, ‘রুবাইয়াতে’ প্রায় দুই হাজার চতুষ্পদী কবিতা আছে, যেগুলোর সব বর্তমানে পাওয়া যায় না। তবে সর্বনিম্ন সংখ্যাটিও বলে, ওমর প্রায় বারোশো এর মতো চতুষ্পদী কবিতা লিখেছেন। তার এই কবিতার সংকলন উনিশ শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত অবহেলিতই ছিল। ১৮৫৯ সালে এডওয়ার্ড ফিটজগেরাল্ড এই কবিতা সংকলনের ইংরেজি অনুবাদ ‘রুবাইয়াত অব ওমর’ প্রকাশ করলে ওমরের কবি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। তার কবিতাগুলো পশ্চিমা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। এমনকি তার নিজ দেশের চেয়েও বেশি। কাজী নজরুল ইসলামের বাংলা অনুবাদে ‘রুবাইয়াত-ই-ওমর খৈয়াম’ বইটি ১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয়। সৈয়দ মুজতবা আলী এর ভূমিকায় লিখেন, “জীবনবাদী ওমর খৈয়াম নজরুলকে খুব আকর্ষিত করেছিলেন। এ অনুবাদে অত্যন্ত চমৎকার ভাষাভঙ্গি ব্যবহৃত হয়। অন্যান্য অনুবাদকারের চেয়ে নজরুলের অনুবাদ অনুভূতির পরশে, যথাযথ শব্দের পারিপাট্যে উজ্জ্বল থাকবে এটাই স্বাভাবিক।” ওমর একজন বই প্রেমিক ছিলেন এবং প্রচুর পড়াশোনা করতেন।
ওমর খৈয়ামের জীবনের অনেক দিকই আমাদের অজানা। তার অনেক কাজও দুর্ভাগ্যজনক ভাবে হারিয়ে গিয়েছে কালের গ্রোতে। তার দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ধারণা করা হয়, তিনি বিয়ে করেছিলেন এবং তার একটি সন্তানও ছিল। ১১৩১ সালের ৪ ডিসেম্বর ওমর খৈয়াম তার জন্মস্থান নিশাপুরে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি মৃত্যুর আগে এমন একটি বাগানে তাকে সমাহিত করার কথা বলে গিয়েছিলেন, যেখানে বছরে দু’বার ফুল ফোটে। সেখানেই তাকে সমাহিত করা হয়েছিল। দীর্ঘকাল তার কবরের কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। ১৯৬৩ সালে প্রতœতাত্ত্বিক খননে তার কবর খুঁজে পাওয়া যায় এবং তা নিশাপুরে স্থানান্তরিত করা হয়। বর্তমানে সে স্থানটি দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। সেখানে খোঁদাই করে লেখা আছে...
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।