শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
বিশ্বসাহিত্যে বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন অনেক অনুজ কবি-সাহিত্যিক। এ সব বিখ্যাত কবির মধ্যে হোমার, গ্যাটে, সেক্সপিয়র, টলস্টয়, হাফিজ, রুমি, শেখ সাদি, ফেরদৌসী, ওমর খৈয়াম, রবীন্দ্রনাথ প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়। এদের দ্বারা অনেক কবি-সাহিত্যিকই প্রভাবিত হয়েছেন। এর মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের উপর প্রভাব লক্ষ্য করা যায় ফারসি কবি ওমর খৈয়ামের। শুধু নজরুল নন, অনেক বাঙালি কবিই খৈয়াম দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন বা খৈয়ামের ভাব সম্পদ তাঁদের কাব্যে গ্রহণ করেছে এদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মোহিতলাল মজুমদার, বুদ্ধদেব বসু প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
রবীন্দ্র যুগে জন্ম গ্রহণ করেছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। রবীন্দ্র সূর্য যখন মধ্য গগণে তখন অনেক কবিই রবীন্দ্র প্রভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। এ বলয় থেকে তারা কিছুতেই যেন বের হতে পারছিলেন না। নজরুলের সমসমায়িক কবিদের উপর রবীন্দ্র প্রভাব এমনই প্রকট হয়েছিল যে, তিরিশের কবিরা এর বিরুদ্ধচারণে কবিতা লেখেন। কিন্তু নজরুল এ বৃত্তের বাইরে ছিলেন। তিনি তার কাব্য-কবিতায় প্রাতিস্বিক এক পরিমÐল গড়ে তোলেন, যেখানে শুধু তিনিই রাজা। রবীন্দ্রনাথ কিংবা বাঙালি আর কোনো অগ্রজ কবিদের দ্বারা নজরুল প্রভাবিত না হলেও ফারসি কবিদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। বিশেষ করে মহাকবি হাফিজ ও ওমর খৈয়াম দ্বারা তিনি বেশি প্রভাবিত হয়েছিলেন। এর কারণও ছিল। নজরুল সরাসরি ফারসি থেকে অনুবাদ করেছিলেন তাঁদের চার পংক্তির কবিতাÑরুবাইয়াত। আর এ অনুবাদ করতে গিয়েই নজরুল ওমর খৈয়ামের ধ্যান-ধারণা, চিন্তা-ভাবনা তথা ওমর-দর্শনের সাথে পরিচিতি লাভ করেনÑ যা থেকে তিনি অনেকটাই প্রভাবিত হন।
কাজী নজরুল ইসলাম ওমর খৈয়ামের কাব্য অনুবাদ করতে গিয়ে সেগুলোকে ছয় ভাগে ভাগ করেছেন। তা হলো :
১.শিকায়া-ই- রোজগার অর্থাৎ গ্রহের ফের বা অদৃষ্টের প্রতি অনুযোগ।
২.হজও অর্থাৎ ভÐ-বকধার্মিকদের প্রতি শ্লেষ-বিদ্রæপ।
৩.ফিরাফিয়া ও ওসালিয়া অর্থাৎ প্রিয়ার বিরহ ও মিলন বিষয়ক কবিতা।
৪.বাহারিয়া অর্থাৎ বসন্ত, ফুল, পাখি বা প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা।
৫.কুফরিয়া অর্থাৎ ধর্মশাস্ত্র বিরুদ্ধ কবিতাসমূহ। স্বর্গ-নরক, বাহ্যিক উপাসনার অসারতা, পাপ-পূণ্যের ভয় ইত্যাদি বিষয়ক কবিতাগুলো এর অন্তর্ভুক্ত।
৬.মুনাজাত অর্থাৎ খোদার কাছে প্রার্থনা। তবে এ প্রার্থনা সাধারণ লোকের প্রার্থনার মতো নয়, এ প্রার্থনা সুফিজমের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত।
নজরুলের কাব্য বা কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে সেগুলোকেও আমরা ছয় ভাগে ভাগ করতে পারি। যেমন :
১.নৈরাজ্যবাদী কবিতা। ২.প্রেম ও নারী বিষয়ক কবিতা। ৩.প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা। ৪.বিদ্রোহ ও সামবাদী কবিতা। ৫.ইশ্বর স্তুতি বা ধর্মীয় ভক্তিমূলক কবিতা। ৬.আধ্যাত্মিক বা ভাববাদী কবিতা।
কবিতার শ্রেণিকরণেও ওমর খৈয়ামের সঙ্গে নজরুলের কিছুটা মিল লক্ষ্য করা যায়, তবে কবিতা বিশ্লেষণ করতে গেলে তাতে পুরোপুরি সাদৃশ্য পাওয়া যাবে না। যেমন ওমরের প্রার্থনামূলক কবিতার সঙ্গে নজরুলের প্রার্থনা বা ভক্তিমূলক কবিতার বৈপরীত্য চিত্রই লক্ষ্য করা যায়। তেমনি খৈয়ামের বাহারিয়া বা প্রকৃতি বিষয়ক কবিতা কিংবা প্রিয়ার প্রেম-বিরহ বিষয়ক কবিতার সঙ্গে নজরুলের প্রকৃতি বা নারীপ্রেম বিষয়ক কবিতার মধ্যে সাদৃশ্য সামান্যই। তবে ওমরের আপাত ধর্মশাস্ত্র বিরুদ্ধ কবিতাসমূহ বা স্বর্গ-নরক, বাহ্যিক উপাসনার অসারতা, পাপ-পূণ্যের ভয় ইত্যাদি বিষয়ক কবিতাগুলোর সঙ্গে নজরুলের সাম্যবাদী চেতনামূলক কবিতাগুলোর ভাব-সাদৃশ্য পাওয়া যায়। আমাদের মনে হয় নজরুল খৈয়ামের এ সমাজ-বিদ্রোহমূলক কবিতাগুলো পড়েই তিনি সাম্যবাদী চেতনামূলক কবিতাগুলো লিখতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। ওমর খৈয়াম যেমন সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি,ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন তেমনি নজরুলকেও দেখা যায়। ওমর সমাজপতিদের উদ্দেশ্যে বলেছেনÑ
হে শহরের মুফতি! তুমি বিপদগামী কম তো নও
পানোন্মত্ত আমার চেয়ে তুমিই বেশি বেহুশ হও।
মানব-রক্ত শোষ তুমি, আমি শুষি আঙুর-খুন
রক্ত-পিয়াসু কে বেশি এ দুজনের, তুমিই কও।
আর নজরুল বলেছেনÑ
ক্ষুধাতুর শিশু চায় না স্বরাজ, চায় দুটো ভাত একটু নুন
বেলা বয়ে যায় খায় নি কো বাছা, কচি পেটে তার জ্বলে আগুন।...
কেঁদে বলি , ওগো ভগবান তুমি আজিও আছ কি? কালি ও চুন
কেন ওঠে না ক’ তাহাদের গালে, যারা খায় এই শিশুর খুন।
ওমর এ ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী কণ্ঠে বলেনÑ
খাজা! তোমার দরবারে মোর একটি শুধু আরজি এইÑ
থামাও উপদেশের ঘটা, মুক্তি আমার এই পথেই।
দৃষ্টিদোষে দেখছ বাঁকা আমার সোজা-সরল পথ
আমায় ছেড়ে ভালো করো ঝাঁপসা তোমার চক্ষুকেই।
যে সমস্ত মোল্লা-মৌলবি, ভÐ পির-দরবেশ ধর্মীয় উপাসনায় আস্তানা গেঁড়ে সরল সাধারণ মানুষদের স্বর্গের লোভ ও নরকের ভয় দেখিয়ে উদর সংস্থান করে ওমর তাদের ঘৃণা করেছেন। এ নীতিবাগিশরা হয়ত অহংকার করে বলবেন তারা মদ পান করেন না। কিন্তু তারা এমন কিছু ভয়ংকর পাপ করছেÑ যার পাশে মাতাল-বদরা শিশুর সমান।
শুধু মোল্লা-মৌলবি, ধর্মান্ধরা নয়, নজরুলের কাছে কমবেশি সবাই পাপী। ভÐামি আর ছল-চাতুরিতে কারো চেয়ে কেউ কম নয়। এটাই নিষ্ঠুর বাস্তবতা। তাই নজরুল তাঁর ‘‘পাপ’’ কবিতায় কাউকেই ছাড় দেন নি। তিনি কোনো লুকোচুরি না করে সরাসরি বলেছেনÑ
আদম হইতে শুরু করে এই নজরুল তক সবে
কম-বেশি করে পাপের ছুরিতে পূণ্যে করেছে জবেহ।
বিশ্ব পাপস্থান
অর্ধেক তার ভগবান আর অর্ধেক শয়তান।
ধর্মান্ধরা শোনো
অন্যের পাপ গনিবার আগে নিজেদের পাপ গোনো।
ওমর খৈয়ামের দর্শনের মূলে একটা গভীরতর নৈরাশ্য ও বেদনা লুকায়িত আছে। নিন্দুকেরা তাঁকে নাস্তিক-কাফের উপাধি দিলেও তিনি একেবারে ধর্মে অবিশ্বাসী ছিলেন না। এই সৃষ্টি যে নিরর্থক তিনি তা মনে-প্রাণে গ্রহণ করতে পারে নি। এই জীবন যদি অর্থহীন হয়, মানুষ যদি নিয়তির ক্রীড়ানক হয় এবং মৃত্যুর পর যদি মানুষের কোনো অস্তিত্ব না থাকে তবে এ পৃথিবীর সৃষ্টির উদ্দেশ্য কী? এ সংশয়বাদিতার কারণেই তিনি পাপ-পূণ্যে সমান বিশ্বাসীÑ
এক হাতে মোর তসবি খোদার, আর হাতে মোর লাল গøাস
অর্ধেক মোর পূণ্য¯œাত, অর্ধেক পাপে করল গ্রাস।
পরিশেষে বলা যায়, ধর্মান্ধরা কি মনে করল কি করল না, সে চিন্তা যেমন ওমর খৈয়াম করেন নি তেমনি কাজী নজরুল ইসলামও করেন নি। তাদের দুজনেরই বিশ্বাস ছিল মানুষের প্রতি মানুষের ভালোবাসা থাকলে, মানুষ মানুষকে শোষণ না করলে, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে গেলেÑ সেটাই হবে প্রকৃত স্বর্গ। আর এ কারণেই তাদের বিদ্রোহ ছিল প্রচলিত জীর্ণ সমাজ-ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। আর এ দিক দিয়েই ওমর খৈয়াম ও নজরুল ইসলামের সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।