পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
২০০২ সালের কথা। তখন ঢাকার মেয়র নির্বাচন। মনোনয়ন নিয়ে জোরালো তদবির এবং ফন্দিফিকির চলছে। আগে দল প্রার্থী বাছাই করত। এখন প্রার্থী দল বাছাই করবে। এর জন্য একটা গুণের দরকার তা হল, প্রার্থী ধনবান কিনা। সততা, দক্ষতা, শিক্ষা, দলের জন্য ত্যাগ-তিতিক্ষা বা অন্য গুণাবলি ধর্তব্যে আসবে না। এমন অবস্থায় ঢাকা মহানগরী বিএনপির সভাপতি হওয়া সত্ত্বেও সাদেক হোসেন খোকার ঢাকার মেয়র প্রার্থী হবার কোনো সম্ভাবনা নেই। সাবেক মেয়র মির্জা আব্বাসেরও নেই। তা হলে নমিনেশন কে পাবেন? কিছুদিন আগে একজন ব্যবসায়ী এক প্রকারের শর্ত দিয়েই বিএনপিতে যোগদান করেছেন এবং তিনিই ঢাকার মেয়র পদে নমিনেশন পাচ্ছেন বলে শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু একাজে প্রবল বাঁধ সাধলেন একজন রাজনীতিবিদ যিনি সত্যিকার অর্থে মাথা থেকে নখ পর্যন্ত রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি বললেন খোকা একজন রাজনীতিবিদ। ‘আমরা খোকাকে বাদ দিয়ে রাজনীতিকে একজন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করতে পারি না।’ দলের ভিতর যারা খোকার ঘনিষ্টজন বলে পরিচিত ছিলেন তারা এর পূর্বে খোকার পক্ষে স্বভাব সূলভ ভঙ্গিতে ঘুচুর ঘুচুর করা ছাড়া আর কোনো কথাই বলেননি। কিন্তু এই জোরালো আওয়াজের পর দলের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা সকলেই চুপসে গেলেন। সত্যই তার কথার যথার্থ কোনো উত্তর ছিল না।
সাদেক হোসেন খোকাই বিএনপির নমিনেশন পেলেন। এরপর তিনি প্রায় দশ বছর অবিভক্ত ঢাকার মেয়র পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। একজন রাজনীতিবিদের যথার্থ রাজনৈতিক এই মূল্যায়নে যিনি সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি ছিলেন দরাজ দিলের নিরেট রাজনীতিবিদ কে.এম. ওবায়দুর রহমান। ওবায়েদ ভাই ও খোকাভাই দুজনেই ইহজগতে নেই। মহান আল্লাহ তাদের বেহেস্ত নসিব করুন।
ওয়াকিবহাল মহলের জানা, ওবায়েদ ভাই এই শিক্ষা যার কাছ থেকে পেয়েছিলেন তিনিও ছিলেন জাতির এক মহান সন্তান। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। ’৭০ এর নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন প্রাদন কালে প্রসঙ্গক্রমে এমন কথা বলতেন। কাজী জাফরের ভাষায়, মুজিব মাথা থেকে নখ পর্যন্ত একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। সাদেক হোসেন খোকাও উদার দিলের একজন সাহসী রাজনীতিবিদ ছিলেন। খোকা ভাইকে নিয়ে দুটো কথা বলতে যেয়ে বর্তমানে কারণে-অকারণে বহুল আলোচিত অপর একজন রাজনীতিবিদ রাশেদ খান মেননের লেখার একটি লাইন স্মরণ করতে হচ্ছে। তিনি লিখেছিলেন, রাজনীতির জন্য বিরাট হৃদয় লাগে। উৎপাদন বৃদ্ধি না করে শুধু বিতরণের সাম্যতার দর্শনে বিশ্বাসী, চোরা-গুপ্তা পথের সংকীর্ণ কানা গলির রাজনীতির একাগ্র পথিক মেননের এমন উপলব্ধি ও বিশ্বাসে আমরাও বিস্মিত হয়েছি। তিনি এই উক্তিটি করেছিলেন মশিউর রহমান যাদু মিঞার উপর তার একটি লেখাতে। মেনন সত্যই বলেছেন, রাজনীতিতে আজ বড় মাপের মানুষের বড়ই অভাব। রাজনীতিবিদের নাম শুনলে মানুষ এখন ভয় পায়। বিগত শতাব্দির ২০ এর দশক থেকে শুরু করে ৬০ এর দশক পর্যন্ত রাজনীতির জগতে এমন কিছু ব্যক্তিত্বের আবির্ভাব ঘটেছিল এবং বাংলা অঞ্চলে যাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, হক, ভাসানী, সহোরাওয়ার্দী থেকে এবং পরবর্তীতে মুজিব, মশিউর, মিজান চৌধুরী হয়ে কে.এম ওবায়েদ, তোফায়েল, রাজ্জাক, খোকা পর্যন্ত এসে তার গতি যেন মন্থর হয়ে গেছে। দেশে মন্ত্রী আছে, এমপি আছে, রাজনীতিবিদ নেই। বাংলাদেশ আছে, মুজিব নেই। রাজপথ আছে, ভাসানী নেই। দেশ ও জাতির তাগিদে মেধা ও সংকল্পে মরিয়া হয়ে ওঠারও কোনো লক্ষণ নেই। এগুলো দেখবারও কি কেউ নেই?
রাজনীতি আজ রাজনীতির স্থানে নেই। সমাজের অস্থিরতার সাথে যুগের ধনলিপ্সা যুক্ত হয়ে রাজনীতি আজ বেসাতীতে পরিণত হয়েছে। তোফায়েল অহমদের ভাষায়, রাজনীতি আজ রাজনীতিবিদদের হাতে নেই। রাজনীতির এই বেদনার্ত পরিবেশে রাজনীতিবিদদের মধ্যে সৌহার্দ ও সম্প্রীতির একটি বন্ধন সৃষ্টির প্রয়াশ আমৃত্যু খোকার মধ্যে অব্যাহত ছিল। খোকার জীবন দর্শন ও তার রাজনৈতিক জীবন সম্পর্কে আমাদের একটা সু-স্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন।
২০০২ বা ২০০৩ সালে রিহ্যাবের মেলায় প্রধান অতিথি সাদেক হোসেন খোকা। তখন গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী মির্জা আব্বাস। খোকা ভাই বললেন, মির্জা আব্বাস সাহেব তাকে মেলা উদ্বোধন করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এতে আমরা খুশি হলাম। আজ আব্বাস ভাইয়ের ভাষায়ই বলতে হয়, কিছু লোক ছিল যারা আমাদের ভিতর সুসম্পর্ক থাকুক এটা তারা চাইত না। এখানে অত্যন্ত সুস্পষ্ট ভাষায় বলতে চাই, আজ থেকে ৩২ বছর আগে প্রসঙ্গক্রমে বেগম জিয়ার সাথে, পরবর্তীতে সালাম তালুকদার সাহেবের সাথে এবং আরো পরে মির্জা আলমগীর সাহেবের সাথে আলাপ কালে বলতে হয়েছে, এরা দুজনে কেউই খারাপ মনের মানুষ নয়। মানুষের উপকার করতে চায়, ক্ষতি করতে চায় না। এই দুই ব্যক্তির দ্বারা ঢাকা মহানগর বিএনপি বা কেন্দ্রীয় বিএনপি ককনো কোনো কালে সামান্যতম ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। তাদের ভিতর বিরাট রকমের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হবার কোনো কারণ নেই। খোকা ভাই আজ নেই, মির্জা আব্বাস সাহেবও শারীরিকভাবে অতটা সুস্থ নন। তাদের অবর্তমানে দুষ্টচক্রের রাজনীতি ঢাকা মহানগরীসহ সারাদেশে শতগুণে বৃদ্ধি পাবে। খোকা ভাই মনে করতেন, তিনি জনগণের মানুষ। জনগণের ভিতর যেমন হরেক রকমের মানুষ থাকে, জনগণের নেতাকে তেমনি হরেক গুণের অধিকারী হতে হয়। বৈচিত্র্যময় চরিত্রই তাদেরকে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলে। এ জন্য জনগণের নেতাদের মধ্যে দোষ ও গুণের মিলন দেখা যায়। কিন্তু সকলের প্রতি ভালবাসা এই গুণটি যেন খোকার ভিতরে অসাধারণ পরিমাণে ছিল তাতে সন্দেহ নেই। সকল দোষ ত্রুটি জেনে শুনেই এ ধরনের নেতাদের প্রতি জনগণ বিতৃষ্ণার বদলে এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করে। এ প্রসঙ্গে কথা বলতে যেয়ে মরহুম আমমেদ ছফা শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক ও খাজা নাজিমউদ্দিনের তুলনা করেছেন। ফজলুল হক সাহেবের অনেক পরিচয়ের মধ্যে তার একটা পরিচয় ছিল তিনি বাংলার প্রিয়তম মিথ্যাবাদী। অন্যদিকে খাজা নাজিমউদ্দিন মিথ্যা বলেছেন এমন কথা শোনা যেত না। বাংলার মানুষ প্রিয়তম মিথ্যাবাদী ফজলুল হকের স্মৃতির প্রতি যে ভালবাসা বা অনুরাগ পোষণ করে থাকে সত্যবাদী নাজিমউদ্দিনের প্রতি সে রকম ভালবাসা প্রদর্শন করে না। তার যথার্থ কারণ কী? কারণ একটাই জনগণ চূড়ান্ত বিচারে মানুষ চিনতে ভুল করে না। যে মানুষের মনে জনগণের জন্য ভালবাসা সঞ্চিত আছে তার দোষ ত্রুটি থাকলেও জনগণ তাকে মনের গভীরে স্থান দিতে কার্পণ্য করে না।
পরিশেষে বলতে হয়, কোনো মহৎ কাজের উদাহরণ আমাদের সামনে আজ প্রেরণার উৎস হিসেবে কাজ করছে না। অল্পজ্ঞানী, অদূরদর্শী, রুচিহীন, শিষ্টাচার বহির্ভূত, শিক্ষার মর্মবাণী ও মানববিদ্যা বিবর্জিত একদল জাকজমকপূর্ণ লোক রাজনীতি থেকে অর্থনীতি, শিক্ষাঙ্গন থেকে সংবাদপত্র সবখানেই আজ জেঁকে বসেছে। যেখানে দেবার কথা ছিল সেখানে যত পার নিয়ে নাও এমন ব্যক্তিদের হাতে রুদ্ধ হয়ে আছে এদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ। ঢাকার মেয়র অনেকেই ছিলেন। কিন্তু সাদেক হোসেন খোকার মতন জনমনে সাড়া জাগানোর গুণাবলী সম্বলিত নেতা আর একজন খুঁজে পাওয়া যাবে না। জিয়ার মতো তিনিও তার স্বজনদের রাজনীতি ও সামাজিক কর্মকা- থেকে দূরে রেখেছেন। গত ৪ নভেম্বর আমাদের মাঝ খান থেকে হারিয়ে গেছে সেই অনন্য প্রভা। জুরাইনের পুরাতন কবর স্থানে সবুজ ঘাষের তলে, বেলে মাটির নিচে চির নিদ্রায় শায়িত এখন সাদেক হোসেন খোকা।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও রাজনীতিক
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।