Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সর্বোত্তম উম্মতের শান

মাওলানা এম. এ. মান্নান | প্রকাশের সময় : ১ নভেম্বর, ২০১৯, ১:৫২ এএম

এই মাস বরকতময় রবিউল আউয়াল। এই মাসে সৃষ্টি জগতের শ্রেষ্ঠ, সমস্ত নবীগণের সরদার আখেরী নবী, আঁকায়ে নামদার, তাজেদারে মদীনা, হুজুরে পুরনূর মোহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার দিন এই পৃথিবীর সমস্ত লোকের হেদায়েতের দাওয়াত নিয়ে আগমন করেন এবং এই মাসেই তিনি তাঁর দায়িত্ব পুরোপুরিভাবে পালন করে আল্লাহ পাকের আহ্বানে সাড়া দিয়ে রফিকে আ’লা এর দরবারে তাশরিফ নেন। যাবার বেলায় সমস্ত উম্মতে মোহাম্মদীর জন্য রেখে যান দু’টি জিনিস- একটি আল্লাহ পাকের ‘কোরআন’ এবং অপরটি তাঁর ‘হাদীস’। 

অর্থাৎ হাদীস এবং কোরআন হল মুসলমানদের জন্য রক্ষাকবচ। এ দু’টি জিনিস যতদিন উম্মাতে মোহাম্মদী পথ- প্রদর্শক হিসেবে আঁকড়ে ধরে থাকবে, ততদিন কেউ বিপথগামী হবে না।
পবিত্র কোরআন আল্লাহ পাকের কালাম। যা সুদীর্ঘ ২৩ বছরে, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে হজরত জিব্রাঈল (আ:) এর মাধ্যমে হুজুরে পাক (সা:) এর নিকট নাজিল হয়।
হাদীস হল হুজুরে পাক (সা:) এর জীবন চরিত। হুজুরে পাক (সা:) এর প্রতিটি কথা, প্রতিটি কাজ এবং সাহাবায়ে কেরামগণের কথা বা কর্মের প্রতি সম্মতিই হল হাদীস।
হাদীস যেমন হুজুরে পাক (সা:) এর জীবন চরিত, আল্লাহ পাকের কালাম কোরআনও হুজুরে পাক (সা:) এর জীবন দর্পণ।
প্রমাণ হিসেবে বলা যেতে পারে, একবার একজন সাহাবী এসে হজরত মা আয়েশা (রা:) এর নিকট হুজুরে পাক (সা:) সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তখন হজরত মা আয়েশা (রা:) ঐ সাহাবীকে প্রশ্ন করলেন, “তুমি কি কোরআন পড় না? পবিত্র কোরআনই হল হুজুরে পাক (সা:) এর জীবন চরিত।” অর্থাৎ হুজুরে পাক (সা:) এর স্বভাব ছিল কোরআন। কোরআনে যে কথা দ্বারা আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি প্রমাণিত হতো, তারই উপর ছিল হুজুরে পাক (সা:) এর সন্তুষ্টি ও অসন্তুষ্টি। এজন্যই আল্লাহ পাক হুজুরে পাক (সা:) কে উত্তম ও মহান চরিত্রের অধিকারী বলে আখ্যায়িত করেছেন।
হুজুরে পাক (সা:) আমাদের জন্য যে কোরআন রেখে গেছেন, এই কোরআন আল্লাহ পাকের বাণী। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামগণ এই বাণী আল্লাহ পাকের মুখ থেকে শুনেননি। শুনেছেন হুজুরে পাক (সা:) এর মুখ থেকে। হাদীসও হুজুরে পাক (সা:) এর মুখ থেকে শুনা। এ দু’টির মধ্যে কোনটি হাদীস আর কোনটি আল্লাহ পাকের বাণী তা হুজুরে পাক (সা:) বলে দিয়েছেন। আবার আল্লাহ পাক বলে দিয়েছেন যে, “আমার হাবীব কোন কথাই বলেন না, যা আমি নির্দেশ না করি।” অর্থাৎ হুজুরে পাক (সা:) নিজের থেকে কথা তৈরি করে আল্লাহ পাকের দিকে সম্বন্ধযুক্ত করেন না। তিনি যা কিছু বলেন তা সবই আল্লাহ পাকের নিকট থেকে প্রত্যাদেশ প্রাপ্ত।
এখন প্রশ্ন হল, যাঁকে আল্লাহ পাক এত মর্যাদা দিয়েছেন, কোন বংশের তিনি?
হজরত ইব্রাহীম (আ:) কে আল্লাহ পাক নবী বানিয়ে এমন এক সম্প্রদায়ের নিকট প্রেরণ করলেন, যারা ছিল সবাই মূর্তি পূজক।
এই মুশরেকদের মাঝে আল্লাহ পাকের ওয়াহদানিয়াতের দাওয়াত প্রদান করতে নির্দেশ দিলেন হজরত ইব্রাহীম (আ:)কে। সংগী নেই, সাথী নেই সম্পূর্ণ একা- এ যে কত বড় পরীক্ষা, শুধু কি তাই, তাঁকে আরো অনেকগুলো পরীক্ষা দিতে হয়েছে।
প্রশ্ন হতে পারে, আল্লাহ পাক কেন তাঁকে পরীক্ষা করতে গেলেন? আল্লাহ পাক কি তাঁর গুণ বৈশিষ্ট্য সমূহ সম্পর্কে অজ্ঞ?
না, আল্লাহ পাক সর্বজ্ঞ। তিনি সবই জানেন। তারপরও কেন পরীক্ষা করতে গেলেন? কারণ, এই পরীক্ষার অর্থ হল, স্বীয় বন্ধুকে পূর্ণত্বের শেষ স্তরে পৌঁছানো।
প্রথম পরীক্ষা হল: এমন একটি জাতির নিকট তাঁকে নবী বানিয়ে পাঠালেন, যারা সবাই ছিল মূর্তি পূজক। তাদের সমস্ত রীতিনীতি ও বিশ^াসের বিপরীতে কাজ করার দায়িত্ব আল্লাহ পাক তাঁকে দিলেন। তিনি সাহসিকতার সাথে কাজ আরম্ভ করে দিলেন। তিনি মূর্তি পূজার অসারতা সম্পর্কে বলতে লাগলেন এবং কঠোর ভাষায় এ কাজের নিন্দা জানাতে লাগলেন।
ফলে সমগ্র জাতি গেল তাঁর বিরুদ্ধে। বাদশাহ নমরূদ তাকে অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার সিদ্ধান্ত নিল। হজরত ইব্রাহীম (আ:) আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য হাসিমুখে নিজেকে আগুনে নিক্ষেপের জন্য পেশ করলেন। আল্লাহ পাক স্বীয় বন্ধুর ঈমানী শক্তি দেখে মুগ্ধ হয়ে আগুনকে নির্দেশ দিলেন; “হে অগ্নি, হজরত ইব্রাহীম (আ:) এর উপর আরামদায়ক শীতল ও নিরাপত্তার কারণ হয়ে যাও।” এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার সাথে সাথে দ্বিতীয় পরীক্ষার হুকুম আসে। আর তা হল: নিজ জন্মভূমি ত্যাগ করে সিরিয়ায় চলে যেতে হবে। এবারও আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে হাসিমুখে মাতৃভূমি ত্যাগ করে পরিবার-পরিজনসহ সিরিয়ায় হিজরত করলেন।
ওখানে অবস্থানের সময় আল্লাহ পাক এই বৃদ্ধ বয়সে বিবি হাজেরা (রা:) কে একটি পুত্র সন্তান দান করলেন। তার নাম রাখলেন হজরত ইসমাইল (আ:)।
এবার নির্দেশ আসলো এখান থেকেও চলে যেতে হবে। কোথায় যাবেন জানা নেই। আল্লাহ পাকের নির্দেশে হজরত জিব্রাইল (আ:) আগমন করে তাদের সাথে নিয়ে রওয়ানা হলেন। পথিমধ্যে কোন শ্যামল বনানী দেখলে হজরত ইব্রাহীম (আ:) বলতেন, “এখানেই অবস্থান করানো হোক।” জিব্রাইল (আ:) বলতেন, “এখানে অবস্থানের নির্দেশ নেই।” এভাবে চলতে চলতে উপস্থিত হলেন এক শুষ্ক পাহাড় ও উত্তপ্ত বালুকাময় স্থানে। এখানেই থামিয়ে দেয়া হল। কারণ এখানেই নির্মিত হবে কাবা ঘর।
তিনি আল্লাহ পাকের মহব্বতে এই জনশূণ্য মরু প্রান্তরেই শিশু পুত্র ও বিবি হাজেরা (আ:) কে রেখে সিরিয়া চলে যেতে চাইলেন।
তিনি রওয়ানা হয়ে পড়লেন, বিবি হাজেরা (আ:) জিজ্ঞেস করলেন, “কোথায় যাচ্ছেন?”কোন উত্তর নেই। পরে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি কি আল্লাহ পাকের হুকুমে চলে যাচ্ছেন?” এবার হজরত ইব্রাহীম (আ:) বললেন, “হ্যাঁ।”
এবারে বিবি হাজেরা (আ:) সম্পূর্ণ আল্লাহ পাকের উপর ভরসা করে বসবাস করতে লাগলেন। কিন্তু সাথে পানি যা ছিল, গেল শেষ হয়ে। পানির খোঁজে বিবি হাজেরা দৌঁড়াদৌঁড়ি করছেন ছাফা ও মারওয়া নামক দুই পাহাড়ের মাঝে।
শিশু পুত্র হজরত ইসমাইল (আ:) পানি পিপাসায় কান্না আরম্ভ করে দিলেন এবং পা দিয়ে মাটিতে আঘাত করতে লাগলেন। হজরত ইসমাইল (আ:) এর পায়ের আঘাতের স্থানে আল্লাহ পাক পানির একটি ঝরনাধারা বইয়ে দিলেন। যার নাম ‘যমযম’।
হুজুরে পাক (সা:) বলেছেন, “এই যমযম এর সাথে বেহেশতের নদীর সাথে সংযোগ আছে। যার ফলে এই পানি শেষ হয় না, হজে¦র সময় লক্ষ লক্ষ মানুষ এই পানি পান করছেন, সাথে করে নিয়ে যাচ্ছেন, তারপরও কূপের পানির স্তর একটুও নিচে নামে না।
হজরত ইসমাইল (আ:) যখন কিছুটা বড় হলেন, কাজ-কর্ম কিছু করতে পারেন এমন সময় আসলো তৃতীয় নির্দেশ। আল্লাহ পাক হজরত ইব্রাহীম (আ:) কে বললেন, এই ছেলেকে নিজ হাতে জবাই করে দিতে। নির্দেশ পেয়ে হজরত ইব্রাহীম (আ:) পুত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, “আমি স্বপ্নে তোমাকে জবাই করতে দেখেছি। এখন বল, তোমার মতামত কি?” হজরত ইসমাইল (আ:) বললেন, “পিতা, আপনি যে আদেশ পেয়েছেন, তা পালন করুন। আপনি আমাকে এ ব্যাপারে ইনশাআল্লাহ ধৈর্যশীল পাবেন।”
এবারও হজরত ইব্রাহীম (আ:) পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন।
এছাড়াও আরো অনেক পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। সবগুলোতেই তিনি উত্তীর্ণ হলেন।
অত:পর আল্লাহ পাক বলেন, “যখন ইব্রাহীমকে তাঁর পালনকর্তা কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা করলেন, অত:পর তিনি তা পূর্ণ করে দিলেন, তখন পালনকর্তা বললেন, আমি তোমাকে মানব জাতির নেতা করবো। তিনি বললেন, আমার বংশধর থেকে? তিনি বললেন, আমার অঙ্গীকার অত্যাচারীদের পর্যন্ত পৌঁছাবে না।” (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১২৪)
অর্থাৎ, উপরোক্ত পরীক্ষাগুলোতে তিনি পরিপূর্ণ সফলতা লাভ করায় আল্লাহ পাক তাঁকে জাতির নেতা হিসেবে মনোনীত করে দিলেন। এই সুসংবাদ পেয়ে তিনি আল্লাহ পাকের নিকট দোয়া করলেন যে, “হে আল্লাহ! আমার বংশধর থেকেও নেতা নির্বাচন করুন এবং আমার বংশে যেন কোন নাফরমান জন্ম না নেয়। আল্লাহ পাক তাই কবুল করলেন। হুজুরে পাক (সা:) হজরত ইব্রাহীম (আ:) এরই বংশের।
হুজুর (সা:) গৌরব করে বললেন যে, “আমার পিতা হজরত ইব্রাহীম (আ:)। আজ যারা হজরত ইব্রাহীম (আ:) এর বংশোদ্ভূত বলে দাবী করে, তারা কেয়ামতের দিন হজরত ইব্রাহীম (আ:) এর উম্মত বলেও দাবী করতে পারবে না। সুতরাং, তারা হুজুরে পাক (সা:) এর উম্মত বলেও দাবী করতে পারবে না। তারাই হবে জাহান্নামী।
এখন হুজুরে পাক (সা:) এর উম্মতের মর্যাদা সম্পর্কে কয়েকটি হাদীস।
১। হুজুর (সা:) বলেন, “আমার উম্মতের একদল লোক সর্বদা আল্লাহ পাকের হুকুমের উপর কায়েম থাকবে। যারা তাদের লাঞ্চিত করতে চাইবে এবং যারা তাদের বিরোধিতা করবে, তারা তাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না। এমনকি কিয়ামত পর্যন্ত এ অবস্থায়ই বিদ্যমান থাকবে।” (বোখারী-মুসলিম)

(আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহঃ) এর রচনাবলী হতে সংগৃহীত)।

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

আরও পড়ুন
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ