পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ক্যাসিনো জুয়া এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদের মালিক হওয়া যুবলীগ নেতাদের কান্ডকারখানা ও শান শওকত রূপকথাকেও যেন হার মানায়। সাতজন বডিগার্ড আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে সর্বক্ষণ ঘিরে থাকা কিংবা ডলারের বস্তা নিয়ে সিঙ্গাপুরে জুয়া খেলতে যাওয়া ব্যক্তিরা এক দশক আগেও মধ্যবিত্ত পরিবারের অতি সাধারণ মানুষদের একজন হিসেবেই ছিলেন। ক্যাসিনো কান্ডে গ্রেফতার হওয়া সবর্শেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম ইসমাঈল হোসেন স¤্রাট। তবে আবরার হত্যার পর ভোলায় পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনার তোড়ে ক্যাসিনো ও দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে যেন অনেকটাই ভাটা পড়ে গেছে। তাহলে কি সেই দুর্মুখদের কথাই সত্য হবে, যারা বলেছিল, এসব আইওয়াশ। দু’দিন পর সবই আবার আগের মতই চলবে! শেষ পর্যন্ত অভিযান যেখানেই যাক, ঘটনা যে আগের মত আর ঘটবে না তা অনেকটা নিশ্চিত। ক্যাসিনো জুয়ার প্রশ্নে যুবলীগ চেয়ারম্যান নিজেকে ধোয়া তুলসি পাতা সাজানোর চেষ্টা করেছিলেন। সেই যুবলীগ চেয়ারম্যানও অবশেষে বরখাস্ত হয়েছেন। তার ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে, বিদেশ যাত্রায়ও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতায় নামোল্লেখ না করে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-এমপিদের অনেকেই র্যাবের অভিযানের সম্মুখীন হতে পারেন বলে জল্পনা করা হচ্ছে। গোয়েন্দা রির্পোটের ভিত্তিতে তদন্ত ও নজরদারিতে থাকা অবৈধ সম্পদের মালিক সম্পদ ক্রোক করার পাশাপাশি তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন করা হলে সেটা হবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক দৃর্বৃত্তায়নের সংস্কৃতির উপর অনেক বড় আঘাৎ। প্রথম তালিকায় এ পর্যন্ত ধরা পড়াদের ছাড়া আরো অন্তত ৫০ জনের নাম রয়েছে বলে জানা যায়। দ্বিতীয় তালিকায় বেশ কয়েকজন এমপিসহ উঁচুতলার প্রভাবশালী ২১জনের নামসহ শতাধিক নামের তালিকা গোয়েন্দাদের হাতে আছে। গত ১০ বছরে বিভিন্ন সময়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নানা রকম অভিযান পরিচালিত হতে দেখা গেছে। নদী দখল, রেলের জমি দখল, ফুটপাথ দখলের মত সার্বজনীন উদ্যোগগুলোতেও ইঁদুর বিড়াল খেলা দেখা গেছে। এ কারণেই প্রভাবশালী যুবলীগ নেতাদের পরিনতি দেখার পরও গডফাদার মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ না হওয়া পর্যন্ত চলমান অভিযান জনণের পুরোপুরি আস্থা অর্জন করতে পারছে না। তবে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ণ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেণীর সদস্যের অনৈতিক প্রভাব ও বেপরোয়া মনোভাব ১০-২০ জন প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাকে ধরলেই বন্ধ হয়ে যাবে না। প্রতিবিধানের জন্য এর উৎসমূলে হাত দিতে হবে। এ সপ্তাহে নুসরাত হত্যার বিচারের রায়ে ১৬ জনের ফাঁসির আদেশ প্রকাশিত হয়েছে। এদের ফাঁসির বিনিময়ে নুসরাত ফিরে আসবে না। তবে এ ধরণের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রয়োজন। সেই সাথে আজ আমাদেরকে ভাবতে হবে, কেন নিজের পিতৃতুল্য শিক্ষকের লালসার শিকার হয়ে নির্মম মৃত্যুর শিকার হল নুসরাত জাহান। কেন ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনিতে নির্মম মৃত্যুর সম্মুখীন হলেন আরেক শিশু সন্তানের ¯েœহমীয় মা। সহপাঠি বড়ভাইতুল্য সিনিয়রদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হল বুয়েটের মেধাবী শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ। এর কোনোটিই বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এ সব আমাদের দুবৃত্তায়িত রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং মানহীন- অনৈতিক শিক্ষাব্যবস্থার প্রতিফলন। জাতীয় রাজনৈতিক সংস্কৃতি, জনগণের ক্ষমতায়ণ, বৈষম্যমুক্ত সামাজব্যবস্থা, আইনের শাসন ও শিক্ষা ব্যবস্থা ও প্রশাসনের সাংবিধানিক কমিটমেন্ট রক্ষার স্থায়ী ও কার্যকর উদ্যোগ ছাড়া শুধু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে এ অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের পর ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে নানাবিধ অপকর্মের অভিযোগ উঠছে। ইতিমধ্যে দুই সিটি কপোর্রেশনের মেয়রগণ অভিযুক্ত কাউন্সিলরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এসব মেয়র-কাউন্সিলররা স্বচ্ছ ভোটের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত না হওয়ার কারণেই তাদেরকে এমন সব কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া সম্ভব। জনগণের ভোটে নির্বাচিত না হলে জগগণের কাছে দায়বদ্ধতা থাকে না। এটাই বাস্তব।
রাজনীতির উপরি কাঠামোতে পঁচন ধরলে নিচের কাঠামো ধসে পড়তে বাধ্য। এটি যেমন প্রতিটি রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে পারিবারিক ও সামাজিক নেতৃত্বের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য, ঠিক একইভাবে আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতেও সমানভাবে প্রযোজ্য। বিশ্ব এখন একটি একক বা ইউনিপোলার পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ব্যবস্থার অধীন। উপরের দেশগুলোর দ্বারা নিচের দেশগুলোর প্রভাব এড়ানো খুবই কঠিন। বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থা দিল্লী বা ওয়াশিংটনের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নীতির দ্বারা প্রভাবিত হবে তা নির্ভর করে এ দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের উপর। মাদরাসা শিক্ষা ও জঙ্গিবাদ নিয়ে একশ্রেণীর মতলববাজ মানুষের ধূ¤্রজাল সৃষ্টি, ফেনি নদীর পানি প্রত্যাহারের চুক্তি, আবরার হত্যা, রাসূল(স:) কে নিয়ে কটুক্তি ব্যঙ্গ, ফেইজবুক আইডি হ্যাকিং বা ভোলায় পুলিশ-জনতার সংর্ঘষে প্রাণহানির মত ঘটনাগুলোর সাথে হয়তো কোনো না কোনো ভাবে মাল্টিন্যাশনাল ও মাল্টিকালচারের স্বার্থের সংঘাতের যোগসুত্র খুঁজে পাওয়া যাবে। এমনকি আমেরিকার জাতীয় নির্বাচনে রাশিয়ান গোয়েন্দাগিরি ও প্রযুক্তিগত হস্তক্ষেপের অভিযোগে তোলপাড় চলছে। একইভাবে হোয়াইট হাউজের উপর ইসরাইলের গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগও এখন সামনে আসতে শুরু করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট, হোয়াইট হাউজের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মার্কিন সিটিজেনদের উপর ইজরাইলী গোয়েন্দা নজরদারির তথ্য উঠে আসছে। এর মানে হচ্ছে, বিশ্বের প্রতিটা প্রান্তের মানুষই কোনো না কোনোভাবে আরেক পক্ষের নজরদারি অথবা প্রভাবে চালিত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে নাগরিক হিসেবে , এমনকি রাষ্ট্রের শাসকদেরও পসন্দ অপসন্দের কোনো সুযোগ নেই। নিয়তি অথবা সময়ের বাস্তবতার দ্বারা যেন সবাই নিয়ন্ত্রিত হলেও শুধুমাত্র রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীণ ব্যবস্থাপনায় গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের চর্চা, আইনের শাসন এবং সামাজিক-রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজের কমিটমেন্টই সিঙ্গাপুর -শৃলঙ্কা বা বেলজিয়াম-বাংলাদেশের মধ্যে ব্যাপক ব্যাবধান সৃষ্টি করে দেয়। সেই ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় ভোটাধিকার প্রয়োগে বাঁধাপ্রাপ্ত হওয়ার কারনে দেশের মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বেড়ে চলেছে। ভোটারবিহিন জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে দেশের কোনো একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচনও জনগণের ভোটাধিকারের স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়নি। বিনা ভোটে, বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় অথবা রাতের আধারে ব্যালটে সিল মেরে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে উপজেলা, জেলা বা সিটি কর্পোরেশন পর্যন্ত প্রতিটা স্থানীয় সরকার নির্বাচনে নিজেদের অনুগতদের মধ্য থেকে পসন্দমত প্রার্থী বাছাই করে নির্বাচনের অনুমোদন দিচ্ছেন। এরপরের নির্বাচনী প্রক্রিয়াটুকু যেন নির্বাচন কমিশনের আইওয়াশ মাত্র। ক্যাসিনো বিরোধী অভিযান থেকে শুরু হওয়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চলমান অভিযানকে এখন অনেকেই শুদ্ধি অভিযান বলে অভিহিত করছেন। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, শিক্ষা দেওয়ার কাজটা নিজের ঘর থেকেই শুরু করেছি। এ অভিযান অব্যাহত রাখারও ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি অভিযান অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন এবং নিজ ঘর থেকে শুরুর প্রসঙ্গটিকে সামনে নিয়ে এসেছেন। তবে বিষয়টি এখনো শুধুই রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। ইতিমধ্যে যারা গ্রেফতার হয়েছেন, যারা দল থেকে বরখাস্ত, বহিষ্কার, অব্যাহতি পেয়েছেন। কিন্তু তাদের দ্বারা সংঘটিত এসব অপকর্ম একদিনে বা হঠাৎ ঘটেনি। বছরের পর বছর ধরে চলা ক্যাসিনো জুয়ার কোটি কোটি টাকার ভাগাভাগিতে অনেক রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একশ্রেণীর কর্মকর্তার যোগসাজশের অভিযোগও উঠে এসেছে। অব্যাহতি প্রাপ্ত যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী পুলিশের সে সব কর্মকর্তাদেরও গ্রেফতারের দাবী তুলেছিলেন। সরকার এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত রাখতে চায় এবং অভিযানকে সত্যিকার অর্থেই শুদ্ধি অভিযান হিসেবে সফল করতে চায় তাহলে সরকারী দলের দুর্নীতিবাজ, দখলবাজ, অবৈধ সম্পদের মালিক ও আইনের প্রতি বেপরোয়া নেতাদের পাশাপাশি তাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদেরও গ্রেফতার ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
দুর্নীতি বিরোধী অভিযান দুর্নীতি দমন কমিশনের একটি সাধারণ কার্যক্রমের অংশ হলেও চলমান শুদ্ধি অভিযানে মূখ্য ভ’মিকা পালন করছে এলিট ফোর্স র্যাব। স্মরণ করা যেতে পারে, মূলত সামরিক বাহিনীর দক্ষ সদস্যদের নিয়ে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে এলিট ফোর্স র্যাব(র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন) গঠিত হওয়ার আগে সরকারীদলের একশ্রেণীর নেতাকর্মীর সন্ত্রাস ও বেপরোয়া আচরণ সীমা ছাড়িয়ে গেলে গোয়েন্দা রিপোর্টের ভিত্তিতে রাজনৈতিক দলের অভিযুক্ত নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে যৌথ বাহিনী। অপারেশন ক্লিনহার্ট নামে পরিচিত সেই অভিযানে ক্ষমতাসীন বিএনপি’র নেতাকর্মীরাই বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের শিকার হন। তবে এবারের শুদ্ধি অভিযান এমন এক বাস্তবতায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে, যখন দেখা যাচ্ছে, যখন সরকারি দলের একশ্রেণীর নেতাকর্মীর অপরাধ প্রবণতা আগের যে কোনো সময়েররেকর্ড বা সীমা অতিক্রম করেছে। তবে অপরাধ যত বড়ই হোক, বিচার বর্হিভুত হত্যাকান্ড সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আমাদের বিচারিক প্রক্রিয়ার ত্রুটি, দুর্বলতা এবং আইনগত ফাঁক-ফাকড় গলিয়ে অনেক দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসীম কিলার, দখলবাজরা পার পেয়ে যেতে পারে। এহেন বাস্তবতাকে সামনে রেখেই দাগী আসামিরা ক্রসফায়ারে নিহত হলে দেশের বেশিরভাগ সাধারণ মানুষ তা সমর্থন করেন। তবে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের এই সংস্কৃতি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণীর অসৎ-অপরাধ প্রবণ কর্মকর্তা কোটি কোটি টাকা কামানোর হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। এ প্রসঙ্গে নারায়ণগঞ্জের সাতখুনের ঘটনা ছাড়াও আরো বেশ কিছু উদাহরণ দেয়া যায়। চলমান শুদ্ধি অভিযানের সময় কোটি কোটি নগদ টাকা, মদের বোতল ও আগ্নেয়াস্ত্রের মজুদ জব্দ হয়েছে। প্রভাবশালী নেতাদের কর্মী ও ক্যাডাররা নেতার মুক্তির দাবীতে বিক্ষোভও করেছে। তবে তাদের নিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক বা ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেনি। সেই সাথে অভিযানের ৪০ দিনের মধ্যেই খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া ও জিকে শামীমের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছে র্যাব। ক্রসফায়ার বা বিনাবিচারে হয়রানির শিকার না করা এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে অভিযোগপত্র বিচার প্রক্রিয়া শুরুর আইনগত বাঁধা না থাকা এবারের অভিযানের একটা ইতিবাচক দিক হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। তবে সবেচেয়ে বড় ইতিবাচক দিক হচ্ছে, অপারেশন সরকারীদলের নেতাকর্মীদের দিয়ে শুরু করা এবং তা অব্যাহত রাখার ঘোষণা। সেই সাথে এটাও সত্য যে, একযুগ ধরে ক্ষমতা ও মাঠের রাজনীতি থেকে নির্বাসিত বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব থেকে শুরু করে লাখ লাখ নেতাকর্মী হাজার হাজার মামলার জালে জড়িয়ে জেলে ও আদালতের এজলাসে ঘুরপাক খাচ্ছেন। একতরফা রাজনৈতিক ব্যবস্থা সরকারী দলের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া করে তুলেছে। সত্যিকার অর্থে শুদ্ধি অভিযান অব্যাহত থাকলে আওয়ামীলীগের লাখ লাখ নেতাকর্মীকে নানা ধরনের অভিযোগে বিচারের আওতায় আনতে হবে। বিরোধি দলের লাখ লাখ নেতাকর্মী যেভাবে রাজনৈতিক মামলার জালে বন্দি আছে। একইভাবে সরকারী দলের ভেতর শুদ্ধি অভিযান পরিচালিত হলে তাদের অনেকেই অবৈধ সম্পদসহ গুরুতর অপরাধের অভিযোগে ফেঁসে যেতে পারেন। দেশ ও জাতির প্রয়োজনে সিদ্ধান্তে অটল থেকে প্রধানমন্ত্রী এমন দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে পারেন কিনা তা দেখার অপেক্ষায় দেশের সাধারণ মানুষ।
দুর্নীতি অপকর্ম করে রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা কখনো ইনডেমনিটি পায়নি। ক্ষমতার হাতবদল হলে রাজনৈতিক কারণেই তাদের অতীতের অপকর্মের জন্য শাস্তির সম্মুখীন হতে হয়। কিন্তু যে আইনের শাসনের অভাবে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যে কর্মকর্তাদের কারণে সাধারণ রাজনৈতিক কর্মীরা দানবীয় শক্তিতে পরিনত হয় তাদেরকে সব সময়ই দায়মুক্তি দেয়া হয়। অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার সমাজকে নিরাপত্তাহীন, অস্থিতশীল করে তোলে। কিন্তু যে সমাজে রাষ্ট্রীয় আইন ও বাহিনীর ইউনিফর্ম ও জনগনের ট্যাক্সের টাকায় কেনা অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহারের কোনো জবাবদিহিতা থাকে না সে সমাজকে শুধু নিরাপত্তাহীন বললে কম বলা হয়ম সে সমাজ পাশবিক নৈরাজ্যে পরিনত হয়। পুলিশের একশ্রেণীর কর্মকর্তার অপরাধ প্রবণতা ও দুর্নীতি পরায়ণতা দেশে এমন প্রশ্নের উদয় হচ্ছে, এখন কি আমাদের দেশ তেমন অবস্থার দিকে ধাবিত হচ্ছে? কয়েক বছর আগে রাজধানীতে দায়িত্বপালন কালে পুলিশের কতিপয় সদস্য ঢাকা দক্ষিন সিটি কর্পোরেশনের এক কর্মকর্তাকে পিটিয়ে আহত করার সময় নাকি বলেছিল, ‘মাছের রাজা ইলিশ, দেশের রাজা পুলিশ’। একাধিক দৈনিক পত্রিকা এই নিয়ে সংবাদ শিরোনাম করেছিল। এরপরও পুলিশের একশ্রেণীর সদস্যের অপরাধ প্রবণতা, দখলবাজি, ঘুষ-দুর্নীতি বেপরোয়া অপকর্মের অনেক উদাহরণ দেখা গেছে। কাউকেই এখনো দৃষ্টান্তমূলক বিচারের সম্মুখীন হতে হয়নি। রাজনৈতিক নেতা খালেদ মাহমুদ, ইসমাইল স¤্রাট, জিকে শামীমদের গ্রেফতার রিমান্ডসহ বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও জিকে শামীমের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে যারা অবৈধ-অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় তাকে সরকারি কাজ পাইয়ে দিলে রাষ্ট্রের হাজার হাজার কোটি টাকা ক্ষতি করেছেন তাদের বিচার না হলে এই অভিযান জাতির জন্য কাঙ্খিত পরিবর্তন আনবে না। দুর্নীতি দমন কমিশন, আদালতের দুর্নীতিবাজ বিচারক-কর্মকর্তা এবং দুর্নীতিবাজ পুলিশ সদস্যদের অসারণের মধ্য দিয়ে শুদ্ধি অভিযান শুরু করতে হবে। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহাকে নি¤œ আদালতের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলতে শোনা গেছে। অনাকাঙ্খিতভাবে দেশত্যাগের পর সেই প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধেও দুর্নীতির অভিযোগের খবর প্রকাশিত হয়েছিল। সম্প্রতি টিআইবির এক রিপোর্টে আদালতের দুর্নীতির মাত্রাকে উদ্বেগজনক বলে অভিহিত করা হয়েছে। গত মাসে প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা যায়, দুর্নীতির অভিযোগ উঠার পর প্রাথমিক তদন্তশেষে ৩ বিচারপতিকে অব্যাহতি দিয়েছে সুপ্রীম কোর্ট। উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সুপ্রীম কোর্টের এমন ভূমিকারও একটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি হিসেবে একটি সুপ্রীম জুডিসিয়াল কাউন্সিল থাকার কথা থাকলেও বর্তমানে তার কোনো অস্তিত্ব নেই। বর্তমানে দেশের আদালতগুলোতে ৩০ লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন আছে। প্রতিদিনই এ সংখ্যা বাড়ছে। মামলার তদন্তে একশ্রেণীর পুলিশ সদস্যের গাফিলতি, দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতার পাশাপাশি বিচার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও উকিল-পেশকারদের দুর্নীতি, অনিয়মের কারণে নি¤œ আদালতের বিচার প্রক্রিয়া নি¤œবিত্ত সাধারণ মানুষের জন্য এক প্রকার প্রহসনে পরিনত হয়। এ অবস্থার পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সব মানুষের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার নামই আইনের শাসন। আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের দাবীকে অগ্রাহ্য করা দেশে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কোনো উন্নয়নই সত্যিকার অর্থে উন্নয়ন বলে গ্রাহ্য হতে পারে না। কয়েকদিন আগে রাজধানীতে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে ডিএমপি’র একজন কমিশনার বলেছেন, এক শ্রেণীর পুলিশ কর্মকর্তা নিজেদেরকে রাজা-বাদশা মনে করেন, সাধারণ মানুষকে মনে করেন প্রজা। তিনি এও স্মরণ করিয়ে দেন যে, সাধারণ মানুষের ট্যাক্সের টাকায় পুলিশের বেতন, পোশাক, অস্ত্রসহ সব সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়। সাধারণ মানুষকে প্রজা মনে করে বাদশাহী ভাব নিয়ে পুলিশে চাকরি করা যাবে না বলেও তিনি মন্তব্য করেন। একজন পুলিশ কর্মকর্তার এমন উপলব্ধি এবং তার বহি:প্রকাশকে পরিবর্তনের শুভ সূচনা হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে, যদি সরকারের শীর্ষ মহল এ বিষয়ে কোনো কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। দুর্নীতিবাজ রাজনৈতিক নেতাকর্মী, পুলিশ, বিচারক এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারাও যখন দুর্নীতির অভিযোগে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হচ্ছেন, তখন প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ আমলা যারা বালিশকান্ড, পর্দাকান্ড, ক্যাসিনোকান্ডের হোতাদের মদতদাতা তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করতে এখনো দেখা যাচ্ছে না। তবে শত বছরের ধারাবাহিকতায় জমে উঠা দুর্নীতি-দুর্বৃত্তায়নের জঞ্জাল দূর করে আলোকোজ্জ্বল ভবিষ্যতের নির্মান শুরু করতে হবে দেশের শিক্ষাঙ্গণ, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলের নৈতিক অবক্ষয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।