Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

উচ্ছেদ-দখলে কোটি টাকার খেলা

মতিঝিল এজিবি কলোনি বাজার

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০১ এএম

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মালিকানাধীন মতিঝিল এজিবি কলোনি কাঁচাবাজার নগরবাসীর কাছে পরিচিত ‘টাকার খনি’ হিসেবে। রাস্তা দখল করে এখানে অবৈধভাবে দোকান বসিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় কোটি কোটি টাকা। গত কয়েকবছরে একাধিকবার এসব দোকান উচ্ছেদ করা হলেও কয়েকদিন না যেতেই আবার দখল হয়ে যায়। শুরুর দিকে অস্থায়ীভাবে দোকান তৈরি করা হলেও এবছর দালান গেঁথে স্থায়ীভাবে দু’শোর বেশি দোকান তৈরি করা হয়েছে।

কলোনির বাসীন্দা ও স্থানীয়রা বলেন, মতিঝিল কাঁচাবাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমবায় সমিতি লিমিটেড, এজিবি কলোনি, স্থানীয় আওয়ামী লীগ ও বিএনপিসহ অঙ্গসংগঠনের নেতারা এবং অসচ্ছল দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির নামে বেনামে এসব জায়গা দখল করে প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। পরবর্তীতে পাকা দোকান ঘর তৈরি করে ভাড়া দিয়ে হাতিয়ে নেয় কোটি কোটি টাকা। অভিযোগ রয়েছে, টাকা নিলেও সিন্ডিকেটের লোকেরা সিটি করপোরেশনের লোকদের দিয়ে এসব উচ্ছেদ করিয়ে অন্যপক্ষের কাছে ভাড়া দেয়। ইতোপূর্বে এসব জায়গার অবৈধ দখল ও দোকান বরাদ্দ নিয়ে হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছিলেন।

কলোনির বাসিন্দা ও পথচারীদের অভিযোগ, এজিবি কলোনি সড়কটি টাকার খনি। এখানে দোকান বসানোর নামে সিন্ডিকেটের লোকেরা কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। তারা বলেন, সিটি করপোরেশন উচ্ছেদ খেলা খেললেও মূলত এসব সিন্ডিকেটভুক্ত প্রভাবশালীরা বহাল তবিয়তে থাকেন। একবার উচ্ছেদ হলে সিন্ডিকেটের টাকা আয়ের পথ আরো বেশি সহজ হয়। ভুক্তভোগী বাসীন্দারা বলেন, সড়ক ও ফুটপাথ দখল করে অবৈধভাবে এসব দোকান বসায় পথচারীরা চলাচলে মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়েন। এছাড়া এখানে থাকা বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাতায়াত ও লেখাপড়ায় বড় ধরণের ক্ষতি হচ্ছে।

স্থানীয়রা বলেন, এজিবি কলোনি কাঁচাবাজার এলাকাটি ডিএসসিসির ১০ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাভুক্ত। কাঁচাবাজারটি মূলত মুক্তিযোদ্ধা মেসবাহ উদ্দিন আহমেদ সাবু সড়কের দু’পাশ ঘিরে গড়ে উঠেছে।
গত বুধবার সরেজমিনকালে ঘুরে দেখা গেছে, দেয়াল পাকা টিনশেড দোকান। রাস্তার দু’পাশ পাকা টিনশেডের প্রায় দু’শো দোকান। এর বাইরে ফুটপাথে আরও শতাধিক দোকান রয়েছে। মূল রাস্তাও দখল করে অনেকে ডাব, সবজিসহ অন্যান্য পণ্যে বিক্রির ভাসমান দোকান বসিয়েছে। রাস্তার দু’ধারে থাকা এসব দোকানের মধ্যে- ভাতের হোটেল, ফার্নিচারের দোকান, ফার্মেসি, মাছ-মুরগি ও গোশতের দোকান রয়েছে। এছাড়া কয়েকটি ফাস্টফুডের দোকান ও শোরুমও ছাড়াও পুরোনো কাগজ, ভাঙারি এবং মুদি-মনিহারি দোকান রয়েছে।

সরেজমিনকালে দেখা গেছে, নতুন করে তৈরি এসব দোকানের বেশিরভাগই পুরোপুরিভাবে চালু হয়েছে। তবে কয়েকটিতে শাটার লাগানো ছাড়াও ফ্লোর ডালাইয়ের কাজ বাকি রয়েছে। ফুটপাথ দখল করে অবৈধভাবে তৈরি খাবার হোটেলগুলোতে পুরোধমে খাওয়া-দাওয়া করতে দেখা গেছে। হোটেলের ব্যবহৃত ময়লা পানি সরাসরি রাস্তায় ফেলা হচ্ছে। মুরগি ও সবজির দোকানীরা হাক-ডাক দিয়ে ক্রেতাদের ডাকছিলেন।

এদিকে, সড়কটির মাঝখানে পয়োনিষ্কাশনের ৬ ফুট দৈর্ঘের সিমেন্টের পাইপ বসানোর জন্য খোঁড়া হলেও কাজ শেষ পুরোপুরি করা হয়নি। সরেজমিনকালে দেখা গেছে, পুরো রাস্তার মাঝখান কাটা। পাইপ বসানো হলেও ফের ডালাই করা হয়নি। সামান্য বৃষ্টিতে পুরোপুরি কর্দমাক্ত হয়ে পরে। পায়ে হেটে চলাও দুস্কর হয়ে পড়ে। এছাড়া রাস্তাটির বেশিরভাগ জায়গায় অবৈধভাবে তৈরি দোকানগুলোর নির্মাণকাজের ইট-বালু-পাথর রাখা হয়েছে। বৃষ্টির সময় রিকশা বা কোন অন্যকোন যানবাহন গেলে হেটে চলা মানুষদের একপাশে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। একইভাবে ফুটপাথ সংস্কারের জন্য টাইসসহ অন্যান্য সামগ্রী রাখা হলেও দীর্ঘদিনেও সেগুলো রাস্তায় লাগানো হয়নি। ধীরগতিতে কাজ চলার কারণে কলোনির বাসীন্দারা মারাত্মক ভোগান্তিতে পড়লেও মুখ বুঝে সহ্য করতে বাধ্য হচ্ছেন।

আগে দোকান থাকলেও বর্তমানে দোকান বরাদ্দ পাননি এমন কয়েকজন ভুক্তভোগী অভিযোগে বলেন, বাজারটিতে দীর্ঘদিন ধরে তাদের দোকান থাকলেও এবার তাদেরকে কোন দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এসব ব্যবসায়ীরা বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা জাহিদুল ইসলাম টিপু, ১০ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুনসুর আহমেদ মারুফ এবং যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ প্রভাবশালীরা এখানে আধিপত্য বিস্তার করে আছে। তারাই নিজেদের ইচ্ছেমতো সিটি করপোরেশনের লোকদের দিয়ে উচ্ছেদ করিয়ে নিজেরাই আবার দখল করেন। এক একবার উচ্ছেদ ও গড়ার খেলার মধ্য দিয়ে মূলত এসব ক্ষমতাসীন আর প্রভাবশালীরা কোটিপতি হন।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ২০১৬ সালে উচ্ছেদের পর ‘অসচ্ছল দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতি’র নামে কাঁচাবাজারে দোকান তৈরির কাজ শুরু হয়। যদিও এই সমিতির সবাই প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা নয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি সমিতির সব সদস্যের নামেও দোকান বরাদ্দ নেই। এর আগে এলাকাবাসীর পক্ষে এই কাঁচাবাজারের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে একটি রিট করা হয়। সেই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৬ সালের ১৩ এপ্রিল দোকানঘর নির্মাণের ওপর হাইকোর্ট নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন।

সমিতির কয়েকজন সদস্য বলেন, ২০১৫ সালে মার্চ মাসে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের বাজার বরাদ্দ কমিটি থেকে তারা ১৩৪টি দোকান বরাদ্দ পান। এর কিছুদিন পর সিটি করপোরেশন সেসব দোকান উচ্ছেদ করে। এভাবে বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকবার উচ্ছেদের ঘটনা ঘটেছে। তবে এবার দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অনুমতি নিয়ে নতুন করে দোকান তৈরি করা হয়েছে বলে তারা জানান।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন দোকানী বলেন, অনেকটা বাধ্য হয়ে দোকান করতে হচ্ছে। তাদের ভাষ্য, জমি-জমা বিক্রি করে এক এক দোকানী ৩ থেকে ১০ লাখ টাকা করে দিয়েছেন। স্থানীয় কাউন্সিলর, ক্ষমতাসীন দল ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী ও প্রভাবশালীদের একটি সিন্ডিকেট এসব টাকা নিয়েছেন।

কয়েকজন ব্যবসায়ী বলেন, অনেকে ২৫-৩০ বছর ধরে দোকান করছেন। বিভিন্ন সময়ে উচ্ছেদের কারণে তারা ব্যপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। সিন্ডিকেটের লোকেরাই উচ্ছেদ করে আবার তারাই টাকা নিয়ে নতুন করে দোকান বরাদ্দ দেয়। যার কারণে কেউ তাদের দাবিকৃত টাকা দিতে অস্বীকার করলে আম-ছালা সবই হারাতে হয়।
এ বিষয়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর মুনসুর আহমেদ মারুফ বলেন, কাঁচাবাজারের দোকান বরাদ্দ বা টাকা লেনদেনের সাথে তার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই। যারা অভিযোগ করেছেন তারা মিথ্যা বলেছেন। তিনি বলেন, আমি জেনেছি, অসচ্ছল দুস্থ মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ সমিতির মুক্তিযোদ্ধাদের সিটি করপোরেশন থেকে বৈধভাবে এসব দোকান বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

ডিএসসিসির সংশ্লিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, এজিবি কলোনির সড়কের উভয় পাশে গড়ে ওঠা দোকানগুলো একাধিকবার অভিযান চালিয়ে উচ্ছেদ করা হয়েছে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই আবার দখল হয়ে যায়। স্থানীয় ক্ষমতাসীন ও প্রাভাবশালীদের সাথে ডিএসসিসির কিছু কর্মকর্তার যোগসাজসের কারণে বারবার উচ্ছেদ করা হলেও কার্যত সফলতা পাওয়া যাচ্ছে না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: উচ্ছেদ

১৮ অক্টোবর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ