Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

সরকারি হাসপাতালের দুর্নীতি, লুটপাট বন্ধ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ২৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০২ এএম

দেশের বৃহত্তম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, মিটফোর্ড হাপাতাল থেকে শুরু করে রাজধানীসহ জেলা পর্যায়ের সকল সরকারি হাসপাতালে শত শত কোটি টাকার চিকিৎসা যন্ত্রপাতি অকেজো ও অব্যবহৃত থাকার পেছনে রয়েছে একশ্রেণির ডাক্তার-কর্মকর্তার কমিশন বাণিজ্য। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর ধরে এসব হাসপাতালের জন্য কেনা কোটি কোটি টাকার যন্ত্রপাতি অকেজো থাকলেও তা মেরামতের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। আবার কখনো দেখা যায়, কোটি কোটি টাকা খরচ করে যন্ত্রপাতি ক্রয় করার পর টেকনিশিয়ান না থাকার অজুহাতে মাসের পর মাস এমনকি বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রপাতি বাক্সবন্দি পড়ে থাকছে। ইত্যবসরে প্রতিদিন বিভিন্ন বিভাগের শত শত রোগীকে সরকারী হাসপাতাল থেকেই প্রাইভেট হাসপাতাল বা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে পাঠানো হচ্ছে। দরিদ্র রোগীরা সরকারি হাসপাতাল থেকে বিনা খরচে বা নামমাত্র খরচে চিকিৎসা সেবা পাওয়ার কথা থাকলেও ডাক্তার ও কর্মকর্তাদের সিন্ডিকেটেড দুর্নীতি ও কমিশন বাণিজ্যের কারণে তাদেরকে বেসরকারি হাসপাতাল বা ডায়াগনোস্টিক সেন্টারের গলাকাটা মুনাফাবাজির শিকার হতে হচ্ছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের যন্ত্রপাতি ক্রয়ের পেছনে সরকার বছরে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করলেও সাধারণ নিত্য প্রয়োজনীয় মেডিকেল ইক্যুইটমেন্টগুলোও মাসের পর মাস ধরে অকেজো থাকলেও ব্যক্তি উদ্যোগে ক্ষুদ্র পরিসরে প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি হাসপাতাল-ডায়াগনোস্টিক সেন্টারে কখনো যন্ত্রপাতি অকেজো পড়ে থাকতে দেখা যায় না।

সম্প্রতি একটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রোগীদের পর্দা কেনায় অবিশ্বাস্য দুর্নীতি ধরা পড়েছে। একেকটি পর্দার মূল্য ধরা হয়েছে ৩৭ লাখ টাকা! এমন অবিশ্বাস্য শতগুন বেশি মূল্যে কেনা হয়েছে আরো অনেক কিছুই। ক্রয়খাতের এই মহাদুর্নীতি ও লুটপাটের মধ্য দিয়ে যে সব যন্ত্রপাতি হাসপাতালে সরবরাহ করা হচ্ছে তা’ও সাধারণ রোগীদের কোনো কাজে আসছে না। হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও দায়িত্বশীল ডাক্তার ও টেকনিশিয়ানরা যোগসাজশ করে এসব যন্ত্রপাতি অকেজো রেখে বেসরকারি হাসপাতালের ব্যবসায় নিশ্চিত করছেন। বিনিময়ে তারা প্রত্যেক সেবা ও রোগী বাবদ মোটা অংকের কমিশন পাচ্ছেন। মূলত এটাই হচ্ছে সরকারি হাসপাতালের যন্ত্রপাতি নষ্ট থাকা, সিট না থাকা বা ভর্তির ক্ষেত্রে অহেতুক প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির পেছনের কারণ। সম্প্রতি একটি দৈনিকে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, বরিশাল শেরে বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) ডায়ালাইসিস মেশিনটি গত ১১ বছরে একদিও চলেনি। দেশের দক্ষিণের একটি বিভাগীয় শহরের প্রধান হাসপাতালের চিত্র এটি। বেসরকারি হাসপাতালে ডায়ালাইসিস করতে প্রতিবার হাজার হাজার টাকা দিতে হয়। ফলে সে এলাকার দরিদ্র রোগীরা বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে। নেফ্রোলজি বিভাগের ডায়ালাইসিস মেশিন প্রায় একযুগ ধরে অকেজা পড়ে থাকলেও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ নতুন ২০টি মেশিন কেনার চাহিদাপত্র দিয়েছেন বলে জানা যায়। গতকাল একটি ইংরেজি দৈনিকে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত রিপোর্ট থেকে বুঝা যাচ্ছে, রাজধানীর ডিএমসিএইচ, বিএসএমএমইউ থেকে শুরু করে দেশের প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে একই অবস্থা বিরাজ করছে। এক্স-রে, এমআরআই, সিটি স্ক্যান, কালার ডপলার, আইসিইউ ক্যাথেটার, আইসিইউ ভেন্টিলেটরের মত গুরুত্বপূর্ণ ও মূল্যবান যন্ত্রপাতিগুলো নষ্ট করে রেখে রোগীদের প্রাইভেট-হাসপাতাল ও ডায়াগরোস্টিক সেন্টারে যেতে বাধ্য করছে হাসপাতালের কর্মকর্তা ও প্রাইভেট হাসপাতালের দালালরা।

দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা হচ্ছে নাগরিকদের নিরাপত্তার অন্যতম বড় সূচক। আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক মানদন্ডে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবা অত্যন্ত নি¤œমানের। এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, জিডিপি পার ক্যাপিটা হিসাবে বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় ৩২ ডলার ভারতে তা ৬১ ডলার, নেপালে ৩৯ ডলার, ভিয়েতনামে ১১১ ডলার, মালদ্বীপে ৭২০ ডলার এবং শ্রীলঙ্কায় তা প্রায় ১০০০ ডলার। অন্যদিকে বেসরকারিভাবে বাংলাদেশিদের চিকিৎসা খরচ এসব দেশের চেয়ে অনেক বেশি। সরকারি হাসপাতালের দুর্নীতি-অব্যবস্থাপনা এবং অপর্যাপ্ত বাজেটসহ নানাবিধ সংকটের কারণে লাখ লাখ রোগীকে তাদের অর্থনৈতিক সামর্থ্যের বাইরে গিয়ে প্রাইভেট হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণ করতে বাধ্য হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত মুনাফাবাজির উপর ভিত্তি করে দেশে বেশকিছু অভিজাত হাসপাতাল গড়ে উঠলেও এসব হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থার সংকট থাকায় ভালো চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকা সত্তে¡ও অনেক রোগী দেশের বাইরে চলে যায়। এভাবে মেডিকেল ট্যুরিজমের নামে বছরে দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। আবার জীবন বাঁচাতে জরুরি চিকিৎসার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে প্রতি বছর ৪০ লক্ষাধিক মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যাচ্ছে বলে সম্প্রতি এক রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে। গত অর্থ বছরে স্বাস্থ্য খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ২৩ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। এসডিজি গোল অনুসারে এ বাজেট প্রয়োজনের চেয়ে তিনভাগের একভাগ। সেই অপ্রতুল বাজেটেই চলছে বেপরোয়া লুটপাট। শত শত গুন বেশি দামে কেনা মেডিকেল ইক্যুইপমেন্টও মানুষের কোনো কাজে আসছে না। মফম্বলের হাসপাতালে ডাক্তারদের যোগদানে অনাগ্রহ-অনুপস্থিতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কড়া নির্দেশনা থাকলেও অবস্থার তেমন কোনো পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। সরকারি হাসপাতালের কেনাকাটায় লুটপাট দুর্নীতি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে, সেই সাথে হাসপাতালগুলোর সেবার মান, বেসরকারি হাসপাতালের ডায়াগনোসিস ও চিকিৎসা খরচ নির্ধারণে লাগাম টানতে প্রয়োজনীয় নজরদারি ও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে ক্রয় করা চিকিৎসা যন্ত্রপাতি নষ্ট ও অকেজো থাকার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাসপাতাল

৪ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
২১ সেপ্টেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন