চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
সর্বজন স্বীকৃত বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ মহামানব , নবীকুল শিরোমণি রসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন, দারিদ্রতা মানুষকে কুফরীর দিকে ধাবিত করে। অর্থাৎ মানষ আল্লাহবিমুখ হয়ে পড়ে । ধর্ম,কর্ম ছেড়ে দেয় । আর এ জন্যই রাসূলে পাক (সাঃ) জাহাদুলবালা অর্থাৎ দারিদ্রতা থেকে আল্লাহ পাকের আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন (বোখারী শরীফ) ।
কারন আর্থিক অস্বচ্ছলতা থাকলে মানুষের মন-মেজাজ ঠিক থাকে না । আর মন মেজাজের শান্তির উপরই নির্ভর করে পরিপূর্ণ ইবাদতের নিশ্চয়তা। রসূলেপাক (সাঃ) বলেছেন , লা ছালাতা ইল্লা বি হুজুরিল কালব । অর্থাৎ মনের একাগ্রতা ছাড়া সঠিকভাবে নামাজ আদায় হয় না । একাগ্রতা তখনই সম্ভব যখন মানুষ সকল প্রকার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকে । আর্থিক অস্বচ্ছলতা মানুষকে দুম্চিন্তামুক্ত করতে পারে না।
এরপর আসুন সামাজিক শান্তির কথায় । এখানেও লক্ষ্য করবেন যে , সমাজে যত প্রকার অশান্তি আছে , বিশৃঙ্খলা আছে , তার মূলে রয়েছে দারিদ্রতা । চুরি , ডাকাতি , ছিনতাই , রাহাজানি , ঘুষ , দুর্নীতি , আমানতে খেয়ানত , জেনেশুনে পরের সম্পদ আতœসাৎ ইত্যাদির কারণ দারিদ্রতা । চুরি, ডাকাতি ,ছিনতাইকারী, দুনীৃতিবাজরা খুব ভাল করেই জানে যে , তাদের এই অপকর্ম লোক সম্মুখে ফাঁশ হয়ে গেলে অপমানিত হতে হবে, জেলজুলুম খাটতে হবে । এমনকি বেকায়দায় পড়লে জীবনটা পর্যন্ত চলে যেতে পারে । তারপরও ক্ষুধার জ¦ালা সহ্য করতে না পেরে মানুষ এ সমস্ত ঘৃণ্য পথ অবলম্বন করতে বাধ্য হয় । অনেক সময় ক্ষুধার জ¦ালা সহ্য করতে না পেরে আতœহত্যার পথ বেছে নেয় । অবুঝ ছেলেমেয়েদের বিষ মিশ্রিত খাবার খাইয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে, নিজেও এ পথ বেছে নেয় । প্রাণপ্রিয়, ্¯্রীকে ভরণপোষন করতে অপারগ হয়ে তালাকের পথ বেছে নেয় । আবার কোন সময় স্ত্রীর বাপের বাড়ী থেকে যৌতুক এনে দিতে স্ত্রীর উপর নির্যাতন চালায় । সেই নির্যাতনগুলো কখনও এমন লোমর্হষক বীভৎস হয় যা লিখতে গেলে কলম কেঁপে উঠে। যদি সমাজে দারিদ্রতা না থাকত তাহলে কী এমনভাবে মা-বোনদের জীবন দিতে হত ?
নারীদের ভরণপোষনের সমস্ত দায়িত্ব আল্লাহপাক পুরূষদের উপর ন্যস্ত করেছেন । পুরূষরা তাদের সে দায়িত্ব পালন করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণেই মহিলাদের উপার্জনে নামতে হচ্ছে । পুরূষদের পাশাপাশি কাজ করতে হচ্ছে । এর এই এক সাথে কাজ করার কারণেই বেগানা পুরূষদের সাথে মিশতে হচ্ছে এবং পর্দা ঠিক রাখা সব সময় ঠিক হচ্ছে না । আর এই বেপর্দাই মহিলাদের বিপথগামী হতে সাহায্য করছে । যারা কাজ পাচ্ছে না অথবা পুরূষদের নিকট থেকে তালাকপ্রাপ্ত হয়ে সুষ্ঠ জীবনযাপনে ব্যর্থ হচ্ছে তাদের অনেকে সমাজের নিকৃষ্ঠতম পেশা গ্রহন করতে বাধ্য হচ্ছে । এক কথায় আমরা এসব অশান্তি , অনাচার , অত্যাচার , জুলুম , নির্যাতন , খুন-খারাবী , সামাজিক বিশৃঙ্খলার জন্য দারিদ্রতাকে অনেকাংশে দায়ী করতে পারি । ইসলাম এই দারিদ্রতা থেকে আশরাফুল মাখলুকাতকে রক্ষার জন্য স্বচ্ছল ব্যক্তিদের প্রতি কড়া নির্দেশ দিয়েছেন । আল্লাহপাক বলেছেন , আকিমুস সালাতা অয়াতুজ জাকাতা । অর্থাৎ নামাজের পরই আল্লাহপাক জাকাতের নির্দেশ দিয়েছেন । মালদারদের প্রতি তাদের সম্পদের একটি নির্দিষ্ট অংশ অভাবগ্রস্ত লোকদের মধ্যে বিতরন করতে নির্দেশ দিয়েছেন। এটি ইসলামের অবশ্য পালনীয় পঞ্চ স্তম্ভের একটি অন্যতম স্তম্ভ । যাকাত প্রদান করা না হলে কবীরা গুনাহ হবে । অস্বীকার করলে বেঈমান হয়ে যাবে ।
রসূলে পাক (সাঃ) এর ইন্তেকালের পর হযরত আবু বকর (রাঃ) যাকাত প্রদানে অস্বীকারকারীদের বিরূদ্ধে জেহাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন –এতেই বুঝা যায় ইসলামে যাকাতের কত গুরূত্ব।যাকাতের মূল লক্ষ্য হল , সমাজ থেকে দারিদ্র দূর করা । সঠিকভাবে যাকাত প্রদান করা হলে সমাজে দারিদ্র থাকার কোন প্রশ্নই আসে না ্।
এজন্য রসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন , সমাজের বিত্তশালী লোকদের নিকট থেকে হিসেব মোতাবেক যাকাত আদায় কর এবং সমাজের গরীব-দুঃখী মানুষের মধ্যে বিতরন করে দাও ।
হযরত আবুজর গিফারী (রাঃ) বলেন , আমি হুজুরের খেদমতে হাজির হলাম। তিনি তখন কাবা ঘরের ছায়ায় বসেছিলেন । আমাকে দেখে তিনি বললেন, কাবার প্রভুর শপথ। যার নিকট অনেক কিছু রয়েছে সেই ক্ষতিগ্রস্ত । আমি আরজ করলাম এরা কারা ? রসূলে পাক (সাঃ) উত্তরে বললেন, যে সমস্ত লোকদের নিকট অগাধ সম্পদ রয়েছে তারাই ক্ষতিগ্রস্ত । তবে তাদের মধ্যে যারা হাত খুলে আল্লাহর রাস্তায় দান করে, তাদের কোন ভয় নেই । একথা বলার সাথে সাথে আল্লাহর রসূল (সাঃ) স্বীয় হাত দু’খানি ডান-বামে ফেরাতে ছিলেন। অতঃপর তিনি বললেন , এ ধরনের লোকের সংখ্যা খুবই অল্প । যাদের নিকট পর্যাপ্ত গরু , ছাগল ও উট আছে আর তার যাকাত আদায় করে না কিয়মতের দিন ঐ সমস্ত পশুকে অত্যন্ত ভয়াবহ আকৃতি ধারণ করিয়ে তাদের নিকট উপস্থিত করা হবে। পশুগুলো ক্ষিপ্ত হয়ে তাদের মনিবকে শিং দ্বারা আঘাত করতে থাকবে । একটির পর একটি এভাবে শাস্তি প্রদান করতে থাকবে । এভাবেই সমস্ত লোকের হিসেব শেষ হয়ে যাবে (বোখারী মুসলিম)।
সুতরাং প্রতিটি সম্পদশালী মুসলমানকে যাকাত প্রদান করতে হবে । এর এভাবেই অভাবগ্রস্ত লোকদের অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে । প্রতিটি মুসলমানদের ঘরে শান্তি ফিরে আসবে । সামাজিক বিশৃঙ্খলতা দূর হবে। চুরি, ডাকাতি , জুলুম , নির্যাতন , ছিনতাই ,রাহাজানি , খুন , ব্যাভিচার দূরীভুত হয়ে এক অনাবিল শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে ।
এবারে যাকাত প্রদানের কতগুলো অনিয়মের কথা তুলে ধরছি । আমাদের দেশে যে পদ্ধতিতে যাকাত প্রদান করা হয় তাতে যাকাত প্রদানের উদ্দেশ্য মোটেও পূরণ হয় না । কারণ ১০/২০ টাকা অথবা একটা শাড়ি, লুঙ্গি দিলে কারো অভাব দূর হয় না । যাকাত দিতে হবে একটা পরিকল্পনার মাধ্যমে, যেমন আপনার পরিবারে ২ জন গরীর লোক আছে । আপনি যাকাত দিবেন ১০,০০০ টাকা । তাদের ডেকে আনুন । বলুন যে আমি আপনাদের দুজনকে ৫ হাজার করে টাকা দিচ্ছি । এই টাকা দিয়ে তুমি ব্যবসা কর অথবা নৌকা কিনে চালাও । এভাবে তুমি প্রতিষ্ঠিত হও। ভবিষ্যতে তোমাকে আর কোন সাহায্য করা হবে না । তখন দেখবেন সে পরিশ্রম করে দাড়িয়ে গেছে । এভাবে যদি প্রতিটি স্বচ্ছল লোক যাকাত প্রদান করে তাহলে দেখা যাবে কোন পরিবারে আর দারিদ্র থাকবে না ।
এখন যেভাবে যাকাত দেয়া হচ্ছে তাতে লোক সমাগম হয়, প্রচুর নাম হয়,অমুক ব্যক্তির নিকট থেকে যাকাতের শাড়ি আনতে গিয়ে পদস্পৃষ্ট হয়ে ৫ জন মহিলা নিহত হয়েছে । এভাবে প্রতি বছরই যাকাত প্রদর্শনীর মাধ্যমে দেয়া হয়ে আসছে । মানুষ মারা যাচ্ছে কিন্তু যাকাতের আসল উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না ।
তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে । আর সেটি হল যাকাত কিন্তু প্রকাশ্যেই দেয়া উচিত । তার কারণ হল মানুষ যাতে বুঝতে পারে যে,তিনি যাকাত দিচ্ছেন । গোপনে দিলে মানুষের মধ্যে এই ধারণা হতে পারে যে , তিনি যাকাত দেন না। আরো একটি উপকার আছে যে, এই ব্যক্তির যাকাত প্রদান দেখে অন্যরাও উদ্বুগ্ধ হবে যাকাত প্রদান করতে । তবে যাকাত গোপনেও দেয়া যেতে পারে ।
যাকাত ছাড়া অন্য দানের বেলায় কিন্তু প্রকােেশ্য দিলে রিয়া হয়ে যাবে । রসূলে পাক (সাঃ) বলেছেন , দান-সদকা এমনভাবে আদায় করবে যে ডান হাতে দিলে বাম হাতও যেন টের না পায় । অর্থাৎ অত্যন্ত গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে । যত বেশী গোপনীয়তা রক্ষা করা হবে তত বেশী নেকী আমল নামায় লিপিবদ্ধ করা হবে। তবে কোন কোন সময় অন্যকে উদ্বুগ্ধ করার জন্য প্রকাশে দান করা যেতে পারে । প্রতিটি দানের উদ্দেশ্য হল দারিদ্র দূর করা ।
আল্লাহপাক কোরআনের বহু আয়াতে দানের কথা উল্লেখ বলেছেন। বলেছেন, আমি তোমাদের যে নেয়ামত দান করেছি, তা থেকে গরীব- দুঃখীকে সাহায্য করা আআনফিকু ফি সাবিলিল্লাহ আআনফিকু মিম্মা রাজাকনাকুম অথবা আআনফিকু মিনাত তায়্যিবাতি ইত্যাদি । এবং একাজটি তোমার মৃত্যু আসার পূর্বেই করবে। রাসূলে পাক (সাঃ) এবং তার সাহাবাগণ নিজের প্রয়োজনের জন্য সামান্য রেখে দান করে দিতেন।
আল্লাহপাকও সূরা বাকারার ২১৯ নং আয়াতে বলেছেন, তোমাদের নিজেদের প্রয়োজনাতিরিক্ত সবই দান করে দাও অন্যদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য । এই হুকুমটি হল নফল সদকার বেলায় । যাকাতের বেলায় এই হুকুম নয়। যাকাত হল গরীবের হক। সুতরাং আজ যদি বিত্তশালী লোকেরা দারিদ্র দূর করার উদ্দেশ্য নিয়ে যাকাত এবং দান খয়রাত করত তাহলে দেশে কোন গরীব লোক থাকত না । যেমন ওমর ইবনে আঃ আজীজ এর শাসন আমলে যাকাতের মাল গ্রহন করার লোক খুঁজে পাওয়া যেত না। আসুন আমরা সবাই আল্লাহপাকের নির্দেশ মত এবং যে উদ্দেশ্যে যাকাত ফরজ করা হয়েছে সেই উদ্দেশ্য সফল করার মানসে যাকাত প্রদান করি । দান-খযরাত করি। আল্লাহপাক আমাদের সকলকে তওফিক দান করূন। আমীন।
(আলহাজ¦ মাওলানা এম.এ.মান্নান (রহঃ) এর রচনাবলী হতে সংগৃহীত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।