Inqilab Logo

বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জীবন যুদ্ধে ফৈর আঘাত

দাম বাড়ল তেল-চিনি-আটার : ভোক্তাদের দেয়ালে পিঠ

স্টাফ রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৮ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০৭ এএম

দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতে করতে ছা-পোষা কেরানি হয়ে ওঠা আনোয়ার হোসেনের (ছদ্মনাম) দু’চোখ ভরা স্বপ্ন আর মন-ভরা ভয়! নিত্যদিনের রকমারি যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে ভীরু থেকে যথার্থই কাপুরুষ হয়ে উঠছেন তিনি। অথচ একসময় রাজনীতি করে মন্ত্রী-এমপি হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। এখন চোখ বুজলেই দেখেন দারিদ্রতার সঙ্গে জীবন যুদ্ধের চিত্র। এখনো আনোয়ার হোসেন স্বপ্ন দেখেন। তবে শুধু বদলে গেছে স্বপ্ন দেখার ধরন। এখন স্বপ্ন দেখেন পরিবার নিয়ে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার। তার মতে, পত্রিকার পাতায় পাতায় বড় বড় হরফে লেখা থাকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সব খবর। কিন্তু দেশের ভেতর জীবন যুদ্ধে যারা প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছে, তারা উপেক্ষীতই থেকে যায়।

নিত্যপণ্যের বাজারের আগুণের লেলিহান শিখায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে আনোয়ার হোসেনদের জীবন। সেই ছাই থেকেই পুণরায় যেখানে নতুন জীবন শুরুর প্রচেষ্টা, ঠিক তখনই আবারো একটি আঘাত। একসঙ্গে বাড়ানো হয়েছে তেল ও চিনির দাম। এর আগে কখনো একত্রে পণ্য দুটির দাম বাড়াতে দেখা যায়নি। এ দফায় বোতলজাত সয়াবিন তেলে লিটারে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১৯০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির কেজিতে ১৩ টাকা বাড়িয়ে ১০৮ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। এ ছাড়া খোলা চিনির কেজি ধরা হয়েছে ১০২ টাকা। সরকারি উদ্যোগে খোলা বাজারে (ওএমএস) বিক্রি করা আটার দামও বাড়ানো হয়েছে। খোলা আটার দাম প্রতি কেজিতে ছয় টাকা বাড়িয়ে ২৪ টাকা ও দুই কেজির প্যাকেট আটার দাম নয় টাকা বাড়িয়ে ৫৫ টাকা করা হয়েছে।

গত বুধবার ভোজ্যতেল ও চিনি ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে দাম বৃদ্ধির বিষয়টি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে জানায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে তেল-চিনির দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেওয়া হয়। নতুন এই দাম গতকাল বৃহস্পতিবার থেকেই কার্যকর হবে বলে জানানো হয়। এছাড়া আগামী রোববার থেকে আটার বর্ধিত দাম কার্যকর হবে।

আলাদা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তেল ও চিনির দাম বাড়ার বিষয়টি জানিয়েছে বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন ও বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন। গত বুধবার ওএমএস কার্যক্রমে বিক্রি করা খোলা ও প্যাকেট আটার মূল্য পুর্নর্নিরধারণ করে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে খাদ্য অধিদফতরের মহাপরিচালকের কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছে। নতুন দাম আগামী রোববার থেকে কার্যকর হবে বলেও চিঠিতে জানানো হয়েছে।

নতুন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, গতকাল থেকেই ১ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেল ১৯০ টাকায় বিক্রি হবে। এত দিন এ দাম ছিল ১৭৮ টাকা। এ ছাড়া ৫ লিটারের বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ৯২৫ টাকায়। এত দিন দাম ছিল ৮৮০ টাকা, তার মানে নতুন করে বাড়ছে ৪৫ টাকা। অন্যদিকে খোলা সয়াবিনের দাম লিটারে ১৪ টাকা বাড়ানো হয়েছে। তাতে প্রতি লিটার খোলা সয়াবিন তেলের নতুন দাম হচ্ছে ১৭২ টাকা। এত দিন প্রতি লিটার বিক্রি হয়েছে ১৫৮ টাকায়। আর প্রতি লিটার খোলা পাম তেল বিক্রি হবে ১২১ টাকায়।

এরআগে চলতি মাসের প্রথমেই দাম বৃদ্ধির আবেদন করা হলে ট্যারিফ কমিশনকে সার্বিক বিষয় পর্যালোচনার জন্য নির্দেশনা দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সে অনুযায়ী দাম প্রস্তাব হলে মন্ত্রণালয় থেকে নতুন করে কোনো দাম নির্দিষ্ট করা হয়নি। ফলে দাম কার্যকর না করায় তেলের সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
খুচরা কিংবা পাইকারি সব পর্যায়ে তীব্র হয়েছে তেলের ঘাটতি। ক্রেতারা ঘুরছেন এ দোকান থেকে ও দোকান, কিন্তু দ্রæত পাচ্ছেন না তেলের দেখা। দোকানিরা বলছেন, কোম্পানি ডিও বা চাহিদাপত্র নেয়া বন্ধ করে দিয়েছে।
এর আগে বেশ কয়েকবার তেলের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের পরই সরবরাহে সঙ্কট তৈরি করে তেল উৎপাদক একাধিক প্রতিষ্ঠান। তৈরি হয়, বাজারে অস্থিরতা। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। বছরে দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা ২০ লাখ টন।

তেলের দাম বাড়ার বিষয়ে ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, ভোজ্যতেলের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে সমন্বয় করা হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১ নভেম্বর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে মূল্য সমন্বয়ের আবেদন করা হয়। পরে দুই দফায় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড কমিশনের সঙ্গে মূল্য সমন্বয়ের বিষয়ে আলোচনা হয়। দাম সমন্বয়ে সম্মত হয় কমিশন।

অন্যদিকে প্রতি কেজি প্যাকেটজাত চিনি ১০৮ টাকায় বিক্রি হবে। আগে দাম ছিল ৯৫ টাকা। তবে বেশ কিছুদিন আগেই বাজারে চিনির দাম শতক ছাড়িয়ে গেছে। বাজারে চিনির সঙ্কটও দেখা দেয়। নতুন দর অনুযায়ী ৫০ কেজির চিনির বস্তার দাম হবে ৫ হাজার ১০০ টাকা। এ ক্ষেত্রে প্রতি কেজি চিনির দাম পড়বে ১০২ টাকা।
চিনির দাম বাড়ার বিষয়ে সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, গত ৩ নভেম্বর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে মূল্য সমন্বয়ের আবেদন করা হয়। পরে দুই দফায় ট্রেড অ্যান্ড কমিশনের সঙ্গে মূল্য সমন্বয় নিয়ে আলোচনা হয়। এ বিষয়ে সম্মত হয় কমিশন।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, লম্বা সময় ধরেই চিনি নিয়ে সঙ্কটে পড়েছে ক্রেতা। বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় এ পণ্যের দেখা মিলছে না। যাও দুই-এক দোকানে পাওয়া যাচ্ছে, তার কেজি ১২৫ থেকে ১৩০ টাকা। চিনি সঙ্কটে ব্যাহত হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসা পরিচালনা। বাসাবাড়িতেও স্পষ্ট চিনির শূন্যতা, কিন্তু সরবরাহ নিশ্চিতে নেয়া হচ্ছে না কোনো পদক্ষেপ।

রাজধানীর সেগুনবাগিচা এলাকায় চা বিক্রি করেন বিল্লাল মিয়া। প্রতিদিন প্রয়োজন হয় তিন কেজি চিনি, কিন্তু এতটুকু চিনি জোগাড় করতেই যেন ঝক্কির শেষ নেই। তিনি বলেন, চিনি জোগাড় করতে অনেক কষ্ট করতে হয়। দোকান বন্ধ করে রাতে চিনির জন্য বের হতে হয়।
মিরপুরে শরবত বিক্রি করেন মোশাররফ হোসেন। দিনে এই ব্যবসায়ীর দরকার হয় অন্তত ছয় থেকে সাত কেজি চিনি, কিন্তু একে তো দাম বেশি, অন্যদিকে পাওয়া যায় না। তাই চিনির বদলে এখন গুড়ই ভরসা। তিনি বলেন, চিনি পেলেও দাম বেশি। গুড়েই পড়তা হয়।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বছরে চিনির চাহিদা ১৮ থেকে ২০ লাখ টন। এর মধ্যে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত মিলগুলোতে ৩০ হাজার টন চিনি উৎপন্ন হয়। বাকি চিনি বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।
অন্যদিকে খোলা আটার দাম প্রতি কেজিতে ছয় টাকা বাড়িয়ে ২৪ টাকা ও দুই কেজির প্যাকেট আটার দাম নয় টাকা বাড়িয়ে ৫৫ টাকা করা হয়েছে। পুনর্নিধারিত দাম অনুযায়ী, খোলা আটার ক্ষেত্রে কেজিতে মিলারের কাছে গমের এক্স গুদাম মূল্য ১৯ টাকা, পেষাইসহ মিলারের কমিশন দুই টাকা পাঁচ পয়সা, ডিলারের কাছে আটা বিক্রি ২১ টাকা ৫০ পয়সা, ডিলারের কমিশন ও পরিচালন ব্যয় দুই টাকা ৫০ পয়সা। সে হিসাবে প্রতি কেজি খোলা আটার দাম পড়বে ২৪ টাকা। দুই কেজির প্যাকেটের আটার ক্ষেত্রে মিলারের কাছে গমের এক্স গুদাম মূল্য ৩৮ টাকা, পেষাই ও প্যাকেট করাসহ মিলারের কমিশন ১৩ টাকা, ডিলারের কাছে আটা বিক্রি ৫১ টাকা এবং ডিলারের কমিশন ও পরিচালন ব্যয় চার টাকা। সে হিসেবে দুই কেজির প্যাকেট আটার দাম পড়বে ৫৫ টাকা। নি¤œ আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে সরকার ওএমএস কার্যক্রমের আওতায় চাল ও আটা বিক্রি করে থাকে। এক ব্যক্তি একসঙ্গে পাঁচ কেজি ওএমএসের খোলা আটা কিনতে পারেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, গত কয়েকদিন ধরেই চিনি পাওয়া যাচ্ছিলো না। এটা একটা সঙ্কট। ভোক্তারা হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়ছে। যদি আমদানি মূল্য বেশি হয়, অথবা উৎপাদন মূল্য বেশি হয়; তখন মূল্যবৃদ্ধির কোন বিকল্প থাকে না। এতে ভোক্তাদের বাড়বে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু কোন ব্যবসায়ীতো লোকসান দিয়ে সরবরাহ করবে না। তাই মূল্য যে বৃদ্ধি করা হয়েছে তা যদি আমদানি মূল্য এবং উৎপাদন ব্যয়-দুইটার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হয়; তাহলে এটা মেনে নেয়ার কোন বিকল্প আছে বলে আমার মনে হয় না। সরকারকে দেখতে হবে কেউ যেন অতিমুনাফা না করে, অথবা কৃত্তিম সঙ্কট করে বাজারে হাহাকার সৃষ্টি করতে না পারে। আর ভোক্তাদেরতো আয় যেহেতু বাড়েনি, এ মুহুর্তে যেকোন ধরনের মূল্যবৃদ্ধি ভোক্তাদের কাছে কাঙ্খিত নয়।

 



 

Show all comments
  • M A Halim ১৮ নভেম্বর, ২০২২, ৮:৫৪ এএম says : 0
    সারে লক্ষ টন গম আমদানি করার পরে-ও দাম বৃদ্ধি করতে হবে, আহা হা হা গো,,,
    Total Reply(0) Reply
  • Abdur Rashid ১৮ নভেম্বর, ২০২২, ৮:৫৪ এএম says : 0
    বেঁচে থাকার তাগিদ, ক্ষুধা মানুষকে সঠিক পথ দেখাবে
    Total Reply(0) Reply
  • Sharif Gaji ১৮ নভেম্বর, ২০২২, ৮:৫৪ এএম says : 0
    মানুষ কি খেয়ে বাঁচবে
    Total Reply(0) Reply
  • নিঃসঙ্গ পথিক ১৮ নভেম্বর, ২০২২, ৮:৫৫ এএম says : 0
    না খেয়ে মরা লাগবে আমাদের
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দারিদ্র্য

১৮ নভেম্বর, ২০২২
২৪ জানুয়ারি, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ