Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দারিদ্র্য বিমোচনের অর্থে ধনী দুই কর্মকর্তা!

৩৮৬ কোটি টাকার প্রকল্পে নয়-ছয়

সাঈদ আহমেদ | প্রকাশের সময় : ১৮ জুন, ২০২১, ১২:০৬ এএম

অর্থ বরাদ্দ ছিল পল্লী দারিদ্র্য বিমোচনে। সেই অর্থে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত দুই কর্মকর্তা। পৌনে ৪শ’ কোটি টাকার তিনটি প্রকল্পের অর্থ নয়-ছয় করে তারা এই অর্থের মালিক হন। প্রকল্পের সরকারি অর্থ লেনদেনে ইচ্ছামতো ব্যবহার করেন ব্যক্তিগত ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। ব্যবহার করা হয় পরিবারের সদস্য এবং স্বজনদের অ্যাকাউন্টও। নিজেরই বেনামি প্রতিষ্ঠান থেকে করা হয়েছে প্রকল্পের কেনাকাটা। কেনাকাটার বাইরেও অর্থ লোপাট হয়েছে নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি, পদোন্নতি দিয়ে। এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অনুসন্ধান, বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ), প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক অডিট এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের তদন্তে। তবে অকাট্য দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্তে¡ও রহস্যজনক কারণে মাসের পর মাস ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে দুদকের অনুসন্ধান। ‘তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ’র নামে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে মামলা। যদিও দুদক সচিব ড. মু. আনোয়ার হোসেন হাওলাদার জানিয়েছেন, সরকারি অর্থ আত্মসাত এবং লন্ডারিংয়ের অভিযোগ দু’টি পৃথকভাবে অনুসন্ধান চলছে। অপরাধ প্রতীয়মান হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

দুদক সূত্র জানায়, স্থানীয় সরকারের পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের অধীনস্থ প্রতিষ্ঠান ‘পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন’ (পিডিবিএফ)। সারাদেশে বিভিন্ন নামে এ প্রতিষ্ঠানের রয়েছে বেশ কিছু প্রকল্প। এর মধ্যে আলোচিত তিনটি প্রকল্প হচ্ছে, সম্প্রসারণ, আইসিটি ও রংপুরের গঙ্গাচড়া এবং হাতিবান্ধার সোলার প্রকল্প। তিন প্রকল্পে সরকারি বরাদ্দ ছিল ৩৮৬ কোটি টাকা। এ অর্থ ব্যয়ের পুরোটা জুড়েই রয়েছে পিডিবিএফ’র পরিচালক মো. আমিনুল ইসলাম এবং যুগ্ম পরিচালক (সংযুক্ত) মনারুল ইসলামের দুর্নীতি আর স্বেচ্ছাচারিতার অভিযোগ। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, নিয়োগ বাণিজ্য, বদলি, পদোন্নতি এবং কেনাকাটায় রয়েছে ব্যাপক নয়-ছয় করার। এর মধ্যে প্রশিক্ষণের পেছনে ব্যয় দেখানো হয় ২০ কোটি টাকা। এছাড়া ফার্নিচার কেনা, ৬শ’টি বাইসাইকেল, ১শ’ মোটরসাইকেল, ৭শ’ ট্যাব, জেলা কার্যালয়ের জন্য ল্যাপটপ, ১১টি ল্যাবের জন্য ল্যাপটপ, ২৫টি এসি, ৬শ’ কম্পিউটার প্রিন্টার, মাল্টিমিডিয়া, ৩৬০টি মাইক্রোফিন সফটওয়্যার কেনা হয়। গঙ্গাচরা সোলার প্রকল্পের আওতায় ১২ হাজার ৬শ’টি সোলার হোম সিস্টেম কেনা হয় অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়।

চলতি বছর ১৫ ফেব্রæয়ারি বিএফআইইউ এ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দেয়। পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে পাঠানো ওই প্রতিবেদনে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ারও সুপারিশ করা হয়। এ প্রেক্ষিতে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য মন্ত্রণালয় প্রতিবেদনটি দুর্নীতি দমন কমিশনে পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু মাসের পর মাস অতিবাহিত হলেও দায়ের করেনি কোনো মামলা।

দুদকের হস্তগত রেকর্ডে দেখা যায়. ‘পল্লী দারিদ্র্য বিমোচন ফাউন্ডেশন’-এর ফরিদপুর অঞ্চলের উপ-পরিচালক কার্যালয়ের হিসাব সহকারী সঞ্জয় বসাকের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে (সোনালী ব্যাংক লি:, টেপাখোলা শাখা, সঞ্চয়ী হিসাব নং-২০৩২১০১০০৯২১১) ৬৯ লাখ ৫৮ হাজার টাকা জমা এবং ৬৯ লাখ ৫৬ হাজার টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। বরিশাল এবং খুলনা বিভাগের ২৪টি উপজেলা থেকে এই টাকা জমা হয়। সঞ্জয় বসাকের বেতন-ভাতার বাইরে ব্যক্তিগত এই অর্থ লেনদেন হয়। পিডিবিএফ’র নাটোর অঞ্চলের সহকারী প্রোগ্রামার মো. আসাদুজ্জামানের ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে (সোনালী ব্যাংক, স্টেশন রোড, নাটোর শাখায় সঞ্চয়ী হিসাব নং-৩৪০৭৫৪৫৪) লেনদেন হয়েছে ৫৫ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। অধিকাংশ লেনদেন নগদ ও ট্রান্সফারের মাধ্যমে পিডিবিএফ’র ঠিকানা ব্যবহার করে সংশ্লিষ্ট হিসাবে অর্থ পাঠানো হয়েছে। মনারুল ইসলাম নিজেও এই অ্যাকাউন্টে লেনদেন করেছেন। বেতন-ভাতা ছাড়াও এ অ্যাকাউন্টে ৪৫ লাখ টাকা গ্রহণ করা হয়েছে। মো. আসাদুজ্জামান মনারুল ইসলামের ভাগ্নে বলে জানা গেছে। মনারুল ইসলামের খালাতো ভাই মুদি দোকানদার এ কে এম আসাদুজ্জামানের ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেডের নাটোর শাখায় (সঞ্চয়ী হিসাব নম্বর : ৪৫০১১০২৪২০৬১৭০০০১) ১ কোটি ৯ লাখ টাকা লেনদেন করেছেন। ৩টি প্রকল্প এলাকায় বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে পিডিবিএফ’র ঠিকানা ব্যবহার করে এই অ্যাকাউন্টে টাকা লেনদেন হয়েছে। মনারুল ইসলাম নিজেও এই অ্যাকাউন্টে ১৩ দফায় ৬ লাখ ৬০ হাজার টাকা জমা করেন। প্রধান কার্যালয়ের সহকারী প্রোগ্রামার হিসেবে কর্মরত মনারুল ইসলামের ভাতিজা মুনতাসির মামুনের ২টি অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে অর্থ লেনদেন করেন। এগুলো হচ্ছে- ব্র্যাক ব্যাংক লি:-এর মিরপুর-১১ নম্বর শাখায় (চলতি হিসাব নং-১৫১১২০০৪৭৮৯৯৮০০১) ২৭ লাখ ৯২ হাজার টাকা, ডাচ-বাংলা ব্যাংকের মিরপুর পল্লবী শাখায় পিডিএফবিএফ’র বিভিন্ন জেলা থেকে (সঞ্চয়ী হিসাব নং:২১১১৫১০০৫৪৮৩৮) ৬৪ লাখ ৪৭ হাজার টাকা জমা এবং উত্তোলন হয়েছে।

সূত্র মতে, তিনটি প্রকল্পে দুর্নীতি অনিয়মের মাধ্যমে মনারুল নামে-বেনামে বিপুল বিত্ত-বৈভবের মালিক হয়েছেন। তার রয়েছে নাটোর শহরে ৫তলা বাড়ি। একই এলাকায় ৩০ শতক জমি। নাটোরের সিংড়া উপজেলায় স্ত্রী এবং নিজের যৌথ নামে ২০ একর জমি। ঢাকার সাভার মজিদপুর মৌজায় ১৫ শতক জমি। একটি ৯তলা ভবন। বিভিন্ন নামে কোটি কোটি টাকা এফডিআর। দুদকের উপ-পরিচালক মোশাররফ হোসাইন মৃধা মনারুলের বিষয়টি অনুসন্ধান করছেন। অনুসন্ধানের বিষয়ে তারা কোনো তথ্য প্রদানে রাজি হননি।

এদিকে অন্তত ৮ কোটি টাকা আত্মসাত করেছেন মর্মে অভিযোগ উঠেছে পিডিবিএফ’র পরিচালক মো. আমিনুল ইসলামের বিরুদ্ধে। এক সময় তিনি ১ বছর ৪ মাস প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বেও ছিলেন। তার দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়কে চলতি বছর ২ ফেব্রæয়ারি চিঠি দেন সংস্থাটির সহকারী পরিচালক সুমিত্রা সেন। এ প্রেক্ষিতে পিডিবিএফ’র রেকর্ডপত্র সরবরাহ করে। প্রাপ্ত রেকর্ডে দেখা যায়, আমিনুল ইসলাম অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজামজা প্রকল্প ও সৌরশক্তি উন্নয়ন কর্মসূচির অন্তত ৮ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। ‘সৌরশক্তি উন্নয়ন কর্মসূচি প্রকল্প’ শেষ হওয়ার পরও প্রকল্পের অব্যয়িত অর্থ ফেরত দেননি তিনি। ২০১৬ সালে প্রকল্পটি শেষ হয়। এ প্রকল্পের জনতা ব্যাংক মিরপুর, রূপনগর শাখার অ্যাকাউন্টে (নং-০১০০০১৮৮১৯০৬১) এখন স্থিতি রয়েছে মাত্র ২৫ লাখ টাকা। এখান থেকে তিনি অবৈধ পন্থায় কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে চেক প্রদান করেন। প্রতিষ্ঠানগুলো তারই বেনামী প্রতিষ্ঠান বলে জানা গেছে। এভাবে তিনি ভুয়া কোম্পানির অনুকূলে চেক ইস্যু করে ৭ কোটি ৭০ লাখ টাকা সরিয়েছেন। প্রকল্প শেষে সমুদয় অর্থ ও সম্পদ ‘পিডিবিএফ’এ হস্তান্তরের বিধান রয়েছে। সেটি অগ্রাহ্য করে এ অর্থ তিনি সরিয়ে নেন আত্মীয়-স্বজনদের অ্যাকাউন্টে। এর আগে ১৬ মাস ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে ৫টি অ্যাকাউন্টে আমিনুল ইসলাম অন্তত ২৫ কোটি টাকা সরিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে সোনালী ব্যাংক মিরপুর শিল্পাঞ্চল শাখা (হিসাব নং-৪৪৪৩৮০২০০০৫২৯) ১৮ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক দিনাজপুর শাখা (হিসাব নং-০১৭১২৪৩০০০০১৮৩৬) ৫২ লাখ টাকা। ব্যাংকটির একই শাখায় (হিসাব নং-০১৭১১২২০০০০৩৪৮০) ২ কোটি ৫৩ লাখ ৯৭ হাজার টাকা জমা হয়। একই ব্যাংকের (হিসাব নং-০১৭১৩৬১০০০০০২৪০) দিনাজপুর শাখায় ১ কোটি ২২ লাখ ৯১ হাজার ৯৮০ টাকা জমা হয়। সোনালী ব্যাংক মিরপুর শাখায় (হিসাব নং-৪৪৪৩৮০৩০০০০৪৩) জমা হয় ১ কোটি ৪ লাখ ৫৭ হাজার ৮১০ টাকা। এভাবে ২৩ কোটি ৮৭ লাখ ৭৪ হাজার ৮৩৭ টাকা জমা হয় বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে। উত্তোলন করা হয় ২১ কোটি ৮৩ লাখ ৩৬ হাজার ৭০৬ টাকা। স্থিতি ছিল ২ কোটি ৪ লাখ ৩৮ হাজার ১৩১ টাকা। বার্ষিক অডিট রিপোর্টে আমিনুল ইসলাম অন্তত ৮টি ক্ষেত্রে অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেনÑ মর্মে প্রতীয়মান হয়।
বহুমাত্রিক দুর্নীতির দালিলিক প্রমাণ থাকা সত্তে¡ও এ দুই সরকারি কর্মকর্তা এবং তাদের সহযোগীদের বিষয়ে কার্যকর কোনো ব্যবস্থাই এ পর্যন্ত নেয়া হয়নি। অবসরে যাওয়া প্রভাবশালী দুই আমলার আশীর্বাদপুুষ্ট হওয়ায় কোনো সংস্থাই তাদের এখন পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি। এই দুই আমলার নির্দেশনায় হাইকোর্টের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে চাকরিচ্যুত করা হয় পিডিবিএফ’র তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মদন মোহন সাহাকে। পরিচালক সহিদ হোসেন সেলিমকে সংযুক্ত করে আমিনুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত এমডি হিসেবে বসানো হয়। আমিনুল ইসলাম ও মনারুল ইসলামকে এখন আগলে রাখছেন পিডিবিএফ পরিচালনা পর্ষদের কয়েকজন সদস্য। প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্যের নির্দেশনা সত্তে¡ও তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের ফাইলটি আটকে রাখা হয়েছে। অবসরে যাওয়া প্রভাবশালী দুই আমলার ইশারায়ই দুদকের অনুসন্ধানও থমকে আছে।

আমিনুল ইসলাম এবং মনারুলের বিরুদ্ধে ওঠা দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। একাধিকবার রিং হলেও তারা ফোন ধরেননি।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: দারিদ্র্য

১৮ নভেম্বর, ২০২২
২৪ জানুয়ারি, ২০২১

আরও
আরও পড়ুন
এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
গত​ ৭ দিনের সর্বাধিক পঠিত সংবাদ