Inqilab Logo

শুক্রবার ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১, ০৫ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাঠ্যপুস্তক থেকে ‘বিবর্তনবাদ’ শিক্ষা বাতিলের দাবি কেন তুলেছি?

মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী | প্রকাশের সময় : ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

বিগত ২০১৩ সাল থেকে জাতীয় শিক্ষার মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, অনার্স ও মাস্টার্স স্তর পর্যন্ত পাঠ্যবইয়ে ‘বিবর্তনবাদ’ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ‘বিবর্তন মতবাদ’ মানুষ ও বানরের পূর্ব পুরুষ একই সাব্যস্ত করে। তাই এই মতবাদ মুসলমানদের ঈমান-আক্বিদা বিরোধী কুফরী মতবাদ। এই মতবাদে বিশ্বাস করলে ঈমান থাকবে না। কারণ, পবিত্র কুরআনের অসংখ্য আয়াতে আল্লাহ তাআলা স্পষ্টভাবে বলেছেন, মানব জাতির উৎপত্তি হযরত আদম (আ.) থেকেই শুরু হয়েছে। বিবর্তন তত্ত¡ মতে শুধু মানুষের আদি পিতা বানর সাব্যস্ত করেই থামে না। বরং এই মহাবিশ্ব, গ্রহ, উপগ্রহ, সমগ্র প্রাণী জগত এবং তরুলতাসহ সকল সৃষ্টি যে অত্যন্ত সুনিপুণ ও সুবিন্যস্তভাবে আল্লাহ তাআলা নিজ কুদরতে সৃষ্টি করেছেন, এই বিশ্বাসটাই আর অক্ষুণ্ন থাকে না।

বিবর্তনবাদ শিক্ষার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- সৃষ্টিকর্তার ধারণা থেকে মানুষকে বের করে দেয়া। কারণ, ডারউইনবাদ বা এভলুশন- এর বক্তব্য- ‘সবকিছু প্রকৃতি থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এই পৃথিবী, গ্রহ, উপগ্রহ, মহাজগত, প্রা-ণীক‚ল, সবকিছুই বিভিন্ন রাসায়নিক বিবর্তনের মাধ্যমেই সৃষ্টি হয়েছে। প্রাণের অস্তিত্বও এই প্রক্রিয়ায় প্রথমে প্রোটোভাইরাস, তারপর ভাইরাস, এরপর ব্যাকটেরিয়া। এভাবে একটি থেকে অপরটি, এমন করে করে লক্ষ-কোটি প্রজাতির সমস্ত প্রাণী ও উদ্ভিদজগত সৃষ্টি হয়েছে। এমনই একটা পর্যায়ে বানর, তারপর মানুষ। এভাবে জগতে নতুন নতুন প্রাণী ও প্রজাতির সৃষ্টি হয়। এর অর্থ দাঁড়ায়- মহান সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব, কিয়ামত, হাশর, বিচার, পুলসিরাত, বেহেস্ত, দোযখসহ ইসলামী আক্বীদা-বিশ্বাসের সব কিছুই কাল্পনিক ও অবাস্তব চিন্তা। (নাউজুবিল্লাহ)।

প্রাণীর সৃষ্টি সম্পর্কে পবিত্র কুরআন-হাদীস তথা ইসলামী আক্বিদা-বিশ্বাসের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ দর্শন ডারউইনের এই বিবর্তন তত্ত¡কে পাঠ্যপুস্তকে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে ছাত্রছাত্রীরা এই মতবাদকে বিজ্ঞানের যুগান্তকারী এক আবিষ্কার ও অকাট্য মতবাদ রূপেই গ্রহণ করে নেয় এবং তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস তথা ঈমান-আক্বিদায় মারাত্মক সংশয় সৃষ্টি হয়ে নাস্তিক্যবাদি ধ্যান-ধারণার প্রতি ধাবিত হয়।

উদাহরণত: নবম-দশম শ্রেণীর জীব বিজ্ঞান বইয়ের ২৭৬ পৃষ্ঠায় পড়ানো হচ্ছে- “বিবর্তনের বিপক্ষে কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। জীবজগৎ সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান যতই সমৃদ্ধ হচ্ছে, বিবর্তনকে অস্বীকার করা ততই অসম্ভব হয়ে পড়ছে”।
নবম-দশম শ্রেণীর বিজ্ঞান বইয়ের ১০২ ও ১১২ পৃষ্ঠায় পড়ানো হচ্ছে- “জীবজগতের যে পরিবর্তন বা বিবর্তন ঘটেছে, তার স্বপক্ষে একাধিক প্রমাণ আছে”। “পৃথিবীর সব বিজ্ঞানীকে নিয়ে একবার একটা জরিপ নেওয়া হয়েছিল, জরিপের বিষয়বস্তু ছিল পৃথিবীর নানা বৈজ্ঞানিক তত্তে¡র মাঝে সর্বশ্রেষ্ঠ কোনটি। বিজ্ঞানীরা রায় দিয়ে বলেছিলেন, বিজ্ঞানের সর্বশ্রেষ্ঠ তত্ত¡ হচ্ছে ডারউইনের বিবর্তন তত্ত¡”।

একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ‘জীববিজ্ঞান’ বইয়ের ২৮৭ পৃষ্ঠা থেকে বিবর্তনবাদের পাঠ শুরুই হয়েছে এভাবে- “জীব জগতে যে বিবর্তন ঘটেছে, এ প্রত্যয় জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে জন্মেছে বহু বছর আগেই”। “মানুষের পূর্বপুরুষের লেজ ক্রমাগত অব্যবহারের ফলে কক্কিক্স এ রূপান্তরিত হয়েছে”। “বিবর্তনের ক্ষেত্রে ডারউইনের মতবাদ নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী ও সাড়া জাগানো অবদান”। “বিবর্তনের স্বপক্ষে প্রাপ্ত প্রমাণগুলো একত্র করলে কারও পক্ষে এর বিরুদ্ধে কোনো যুক্তি তৈরি বা উত্থাপন করা সম্ভব হবে না”।

এভাবে নবম শ্রেণী থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের মনে বিবর্তনবাদ বিষয়ক পাঠের মাধ্যমে এইরূপ বদ্ধমূল ধারণা তৈরি করা হচ্ছে যে, মানব জাতি’সহ সমগ্র প্রাণী জগত ও সমগ্র মহাবিশে^র বর্তমান অবয়ব বিবর্তন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই বর্তমান অবস্থায় এসেছে। সৃষ্টিকর্তা বলে কিছু নেই।
বিবর্তনবাদ শিক্ষা মতে, মহান আল্লাহর ধারণা ভিত্তিহীন। তাই বিবর্তনবাদ আল্লাহকে স্বীকার করে না। পৃথিবীর প্রচলিত কোন ধর্মকেই স্বীকার করে না। বরং ধর্মকে উল্লেখ করেছে ‘নিরক্ষর সমাজের সরল মানুষের চিন্তা- চেতনার ফসল’ হিসেবে। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর সমাজ বিজ্ঞান বইয়ে ২৫১ থেকে ২৫৬ পৃষ্ঠায় ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ধর্মের ধারণা শিক্ষা দিতে সম্পূর্ণ পাঠটাই বিবর্তনবাদি বিজ্ঞানীদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে সাজানো হয়েছে। ধর্মের ধারণা শিক্ষাদানের এই ৬ পৃষ্ঠার পাঠে এক লাইনও ইসলামের আলোকে ধর্মের ব্যাখ্যামূলক কোন কথা রাখা হয়নি।

সৃষ্টি প্রক্রিয়া সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ স্পষ্ট ঘোষণা করছেন, অর্থাৎ- “হে মানব সমাজ! তোমরা তোমাদের পালনকর্তাকে ভয় কর, যিনি তোমাদেরকে এক ব্যক্তি থেকে সৃষ্টি করেছেন এবং যিনি তার থেকে তার সঙ্গীনীকে সৃষ্টি করেছেন; আর বিস্তার করেছেন তাদের দু’জন থেকে অগণিত পুরুষ ও নারী। (সূরা নিসা, আয়াত- ১)। অপর আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেন, “আমি মানুষকে মাটির সারাংশ থেকে সৃষ্টি করেছি। অত:পর আমি তাকে শুক্রবিন্দু রূপে এক সংরক্ষিত আধারে স্থাপন করেছি। এরপর আমি শুক্রবিন্দুকে জমাট রক্তরূপে সৃষ্টি করেছি। অত:পর জমাট রক্তকে মাংসপিন্ড পরিণত করেছি। এরপর সেই মাংসপিÐ থেকে অস্থি সৃষ্টি করেছি। অত:পর অস্থিকে মাংস দ্বারা আবৃত করেছি। অবশেষে তাকে এক নতুন রূপে দাঁড় করিয়েছি”। সূরা মু’মিনূন, আয়াত- ১২-১৩)।

পবিত্র কুরআনে আরো ইরশাদ হচ্ছে- “হে বনী আদম! শয়তান যেন তোমাদেরকে বিভ্রান্ত না করে; যেমন সে তোমাদের পিতামাতা (আদম-হাওয়া)কে জান্নাত থেকে বের করে দিয়েছে...”। (সূরা আল-আ’রাফ- ২৭ আয়াত)। পবিত্র কুরআনের আয়াতে স্পষ্টত:ই প্রমাণ হয় সর্বপ্রথম আল্লাহ তাআলা হযরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করেছেন এবং তাঁর থেকেই মানব জাতির উৎপত্তি ও বিস্তার শুরু হয়েছে। এই মহাবিশ^ এবং এতে বিরাজমান সকল প্রাণী, বৃক্ষরাজি ও তরুলতা অত্যন্ত সুবিন্যস্তভাবে মহান আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন। তাঁর হুকুম ছাড়া প্রকৃতির খেয়ালে একটা ধুলিকণাও সৃষ্টি হয়নি।

ইসলাম বিজ্ঞান চর্চা এবং প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারের বিরোধী নয়। বরং মানব কল্যাণে জ্ঞানের চর্চা, গবেষণা, প্রযুক্তি উদ্ভাবন ও ব্যবহারকে উৎসাহিত করে। কিন্তু বির্বতনবাদ শিক্ষা বিজ্ঞান চর্চার নামে কেবল অনর্থক সময় অপচয়ই নয়, বরং এটা ইসলামকে উৎখাতের পুঁজিবাদের এক মহাপ্রকল্প। আধুনিক বিজ্ঞান বিবর্তনবাদের কল্পকাহিনীকে ছুঁড়ে ফেলেছে। যে কারণে উন্নত বিশে^র অনেক দেশে বিবর্তন শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আমাদের দেশে ২০১২ সাল পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকে ‘বিবর্তন’ শিক্ষা ছিল না। ২০১৩ সালে একযোগে নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশ, অনার্স ও মাস্টার্স স্তরের পাঠ্যবইয়ে বিবর্তন পাঠ যুক্ত করা হয়। দৃশ্যত:ই বুঝা যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক ইসলামবিদ্বেষী নাস্তিক্যবাদ ও পুঁজিবাদিদের চাপ ও প্ররোচণাতেই এটা করা হয়েছে। সংবিধান মতেও মুসলিম ছাত্র-ছাত্রদীদেরকে ঈমান-আক্বিদা বিরোধী কুফরী বিবর্তন মতবাদ শিক্ষা দেওয়ার সুযোগ নেই।

বিবর্তনবাদের এই শিক্ষা স্পষ্টত:ই কুফরি শিক্ষা। বিবর্তনবাদে বিশ্বাস করলে ঈমান থাকবে না। এই শিক্ষা অব্যাহত থাকলে কয়েক প্রজন্ম পর পুরো জাতির মধ্যে নাস্তিক্যবাদ ছড়িয়ে পড়বে। এটা অত্যন্ত সূ²ভাবে জাতীর চিন্তা-চেতনা ও বিশ্বাস থেকে ঈমান হরণের এক ভয়াবহ উদ্যোগ।

এতে করে সমাজ ও ব্যক্তিজীবন থেকে ধর্মীয় বিধিনিষেধ ওঠে যেতে শুরু করবে। ধর্মীয় বিয়ে মানবে না। বিয়ের বহুবিধ দায়বদ্ধতা ছাড়াই লিভটুগেদারে আগ্রহী হবে। জারজ সন্তানে দেশ ভরে যাবে। মদ, জুুয়ার বিধিনিষেধ মানবে না। সমকামিতার বৈধতা নিয়ে আন্দোলন হবে। মানবতাবোধ হারিয়ে যাবে এবং ভোগবাদে মানুষ ডুবে যবে। আল্লাহ, রাসূল, ইসলাম নিয়ে কট‚ক্তি এবং আলেম-উলামা, ধর্মীয় শিক্ষা ও ধর্মভীরু মানুষকে বাধা ও বিরক্তিকর ভাবতে শুরু করবে। এ পর্যায়ে আমরা সরকারের কাছে তিনটি সুনির্দিষ্ট দাবি তুলেছি। (১) ঈমান-আক্বিদা ও সমাজিক শৃঙ্খলাবিরোধী ডারউনের কুফরী ‘বিবর্তনবাদ’ শিক্ষা পাঠ্যপুস্তক থেকে নিষিদ্ধ করতে হবে। (২) ঈমান-আক্বিদাবিরোধী ‘বিবর্তনবাদ’ শিক্ষা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তির সাথে জড়িতদেরকে চিহ্ণিত করে কঠোর শাস্তি দিতে হবে। (৩) শিক্ষার সকল স্তরে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ইসলামধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক করতে হবে।

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা, জামিয়া মাহমুদিয়া সুবহানিয়া-টঙ্গী এবং মহাসচিব- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।



 

Show all comments
  • Sakawat Hossain ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০১৯, ২:১২ পিএম says : 0
    বস্তুনিষ্ঠ লিখনির জন্য লেখককে সাধুবাদ।
    Total Reply(0) Reply
  • রাজ ২৭ মার্চ, ২০২২, ৫:২৭ এএম says : 0
    উন্নত বিশ্বের কোন কোন দেশে এটা নিষিদ্ধ একটু বলবেন প্লিজ। অনেক দেশে নিষিদ্ধ সেটা আগেও শুনেছি কিন্তু দেশের নাম গুলো জানা নেই। কেউ জানলে বলবেন প্লিজ
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাঠ্যপুস্তক

২০ জানুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন