পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
কাশ্মীর ও আসাম প্রদেশে গণহত্যা হতে পারে বলে সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘জেনোসাইড ওয়াচ’। সংস্থাটি তাদের ওয়েবসাইটে এ নিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে বলছে, ‘কাশ্মীরে গণহত্যাসংক্রান্ত ১০টি লক্ষণ এখন স্পষ্ট’। এক সময়ের পৃথিবীর ভূস্বর্গ খ্যাত কাশ্মীরের পরিস্থিতি নতুন এক ভয়ঙ্কর গন্তব্যের অভিমুখী হচ্ছে বলে মনে হয়। গত ৫ আগস্ট ভারতের প্রেসিডেন্ট এক ডিক্রির মাধ্যমে জম্মু ও কাশ্মীরের ৭০ বছরের পুরনো ‘বিশেষ মর্যাদা’ বাতিল করেছে সংবিধানের ৩৭০ নম্বর অনুচ্ছেদ রদ করার মাধ্যমে। এই ডিক্রির মাধ্যমে দীর্ঘ দিনের বিতর্কিত এই ভূখন্ডের রাজ্যের মর্যাদা পুরোপুরি কেড়ে নেয়া হলো। পাকিস্তান জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনে যোগাযোগের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান চাইলেও ভারত বলছে, জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা বাতিল করা তাদের অভ্যন্তরীণ ইস্যু। তারা চায় না এতে তৃতীয় কোনো পক্ষ যুক্ত হোক। ভারত কোনো রকম আপোষ, সমাধান বা কারো মধ্যস্থতা করার তোয়াক্কা করছে না। ভারত মনে করছে, আমার গভয়ে শক্তি আছে, যা খুশি তাই করতে পারি। কিন্তু ভারতের বুঝতে হবে, জম্মু-কাশ্মীরের পরিবর্তীত প্রেক্ষাপটে, আঞ্চলিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে। বিজেপির উগ্র হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদীদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব, সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী এবং প্রতিবেশীদের সাথে তার যে বৈরিতার সূচনা হচ্ছে, তা পুরো দক্ষিণ এশিয়ায় অশান্তি তৈরিসহ সংঘাত ছড়িয়ে দিতে পারে।
জাতিসত্তা বা ধর্মের ভিত্তিতে কার্যকর একটি স্বশাসিত অঞ্চলকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিবর্তন করার মতো অত্যন্ত সংবেদনশীল বিষয় উগ্র ফ্যাসিবাদী মানসিকতার চরমপন্থী ও কট্টর হিন্দুবাদী সংগঠন বিজেপি এবং আরএসএসের দ্বারাই সম্ভব। কাশ্মীর এমন একটি বিতর্কিত অঞ্চল, যেখানে বিংশ শতাব্দীতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে তিনটি বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। প্রতিবারই পাকিস্তান ভারতের পদক্ষেপেই প্রভাবিত হয়েছে। ভারত সাংবিধানিকভাবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হলেও বিজেপি সরকার হিন্দুত্ববাদ মতাদর্শের উত্থানে একনিষ্ঠভাবে কাজ করে চলেছে। ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের এ বার্তার মধ্য দিয়ে বিজেপি পক্ষান্তরে ভারতের বৃহত্তম সংখ্যালঘু স¤প্রদায় মুসলমানদের সমর্থন কামনা করেনি।
কাশ্মীরের আগের মর্যাদা ছিল মূলত দেশীয় রাজ্যের স্বায়ত্তশাসনের মতো। আর পরিবর্তিত যে ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাতে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ বা রাজ্যের যে মর্যাদা রয়েছে, তা থেকে আরো নিচে নামিয়ে কার্যকরভাবে কাশ্মীরকে একপ্রকার অধিকৃত ভূখন্ডের পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে। ইহুদি বসতি স্থাপনের মাধ্যমে যেভাবে ফিলিস্তিনি ভূখন্ডে খোদ ফিলিস্তিনিদেরই সংখ্যালঘুতে পরিণত করার চেষ্টা চলছে, ঠিক একই কৌশল কাশ্মীরে নিয়েছে ভারত। ইসরাইলে ফিলিস্তিনি আরবদের বসবাস রয়েছে। কিন্তু রাষ্ট্রের ইহুদি নাগরিকরা যে অধিকার ভোগ করে, সেই অধিকার পায় না আরবরা। সেখানে অ-ইহুদিদের কার্যত দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত করা হয়েছে।
কাশ্মীরে আগে থেকে মোতায়েন ভারতের সৈন্য সংখ্যা ৭ লাখের মতো। অর্থাৎ প্রতি ১০ জন নাগরিকের বিপরীতে একজন করে সৈন্য সেখানে মোতায়েন ছিল। এরপর গত কয়েক দিনে সেখানে আরো লক্ষাধিক সেনা পাঠানো হয়েছে বলে কোনো কোনো সূত্র অনুমান করছে। বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয়েছে, ইন্টারনেটসহ সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা, নিষিদ্ধ করা হয়েছে সব ধরনের সভা-সমাবেশ। রাজ্যজুড়ে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে বলে আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর থেকেও জানা যায়। বন্ধ হয়ে গেছে ব্যবসা-বাণিজ্যসহ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। ভারতেরই অন্যান্য রাজ্যে যেখানে বেসামরিক নাগরিক ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যের আনুপাতিক হার প্রতি ৮০০ জনের বিপরীতে একজন সৈন্য, সেখানে কাশ্মীরে প্রতি ৮/১০ জনের জন্য একজন করে সৈন্য থাকার অর্থ হলো, পুরো রাজ্যের প্রতিটি মানুষের ওপর সেনা নজরদারি রাখা। কাশ্মীরের দেড় কোটি মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য পরিস্থিতি কতটা ভয়াবহ, তা এ তথ্য থেকেই বোঝা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘জেনোসাইড ওয়াচ’ মূলত গণহত্যা রোধে কাজ করে থাকে। তারা সামগ্রিক অনুঘটন বিশ্লেষণ করে গণহত্যা হতে পারে কিনা তার অনুমান ও তা রোধ, বন্ধসহ দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে তৎপরতা চালায়। গণহত্যা প্রতিকারবিষয়ক আন্তর্জাতিক ওই সংস্থাটি আশঙ্কা করছে, কাশ্মীর ও আসামে গণহত্যা হতে পারে। সংস্থাটির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত ওই সতর্কবার্তায় গণহত্যার লক্ষণ হিসেবে দশটি বিষয়ের উল্লেখ করা হয়েছে। তারা বলছে, কাশ্মীরের বর্তমান যে পরিস্থিতি তাতে করে নিকট ভবিষ্যতে যে কোনো সময় ওই দুই অঞ্চলে গণহত্যা চলানো হতে পারে। গণহত্যা সংক্রান্ত জেনোসাইড ওয়াচের ১০ লক্ষণ হলো- ১. ‘শ্রেণিকরণ’ বা অপরায়নের রাজনীতি। হিন্দু ও শিখ নিয়ে গঠিত ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘আমরা’ বনাম কাশ্মীরের সাধারণ মুসলিমকে ‘তারা’ বলে চিহ্নিত করা। এই দুইভাগের কারণে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে। ২. ভিন্ন পরিচয় নির্মাণ : গণহত্যার জন্য দ্বিতীয় যে পর্যায়টি সেটি হলো ভিন্ন পরিচয় নির্মাণ। কাশ্মীরের মুসলিমদের নামগুলো মুসলিম (পরিচয়পত্রে), তাদের আলাদা ভাষা এবং পোশাক রয়েছে। ৩. নানা বৈষম্য বিরাজ থাকা। ৪. অমানবিকতা : কাশ্মীরের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে দেশটির সরকার থেকে শুরু করে গণমাধ্যম ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের আরও কিছু পরিচয় হলো বিচ্ছিন্নতাবাদী, অপরাধী এবং সবচেয়ে বড় নেতিবাচক যে পরিচয় তা হলো ‘জঙ্গি’। ৫. সংগঠন (সামরিক) : ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরে ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ দেশটির প্রায় ৭ লাখ সেনাসদস্য সেখানে মোতায়েন রয়েছে। এছাড়া তাদের মধ্যে সশস্ত্র পুলিশ রয়েছে। ৬. মেরুকরণ : ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার দল বিজেপি দেশটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুদের মধ্যে প্রকাশ্যে ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও মিথ্যা তথ্য দিয়ে মুসলিমবিদ্বেষী ঘৃণা তৈরির কাজটি সুকৌশলে করে যাচ্ছে। ৭. প্রস্তুতি : গোটা কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। যেকোনো মূল্যে কাশ্মীরের নিয়ন্ত্রণ নেয়াকে ‘চ‚ড়ান্ত সমাধান’ হিসেবে দেখছে বিজেপি নেতারা। ৮. নিপীড়ন : কাশ্মীরের মুসলিমদের খাঁচাবন্দি তথা অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তাদের কোনো কারণ ছাড়াই মেরে ফেলা হচ্ছে। এছাড়া গ্রেপ্তার, ধর্ষণ এবং নির্যাতন অহরহই ঘটছে। ৯. বিধ্বংস : ১৯৯০ সাল থেকে সেখানে ২৫টি বড় বড় সংঘবদ্ধ হত্যাকান্ড চালিয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী। ১০. অস্বীকার : কাশ্মীরের ‘অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সন্ত্রাসবাদ নির্মূল’ করাই তাদের প্রধান লক্ষ্য বলে দাবি করছে নরেন্দ্র মোদি ও তার কট্টর হিন্দুত্ববাদী দল বিজেপি। তারা কোনো হত্যার কথা স্বীকার করে না। তাদের দাবি, সেনাবাহিনী কিংবা পুলিশ কেউই নির্যাতন, ধর্ষণ অথবা হত্যার চেষ্টাও করেনি। কাশ্মীর ও আসামে গণহত্যা হতে পারে জেনোসাইড ওয়াচের উপরের ১০টি লক্ষণ ও গণহত্যাবিষয়ক বিশ্লেষণ নিয়ে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের এখনই ভাবা জরুরি।
গত ৫ আগস্ট কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদাসংক্রান্ত সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিল করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে ভাগ করে মোদি সরকার। জম্মু-কাশ্মীরের পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদাও কেড়ে নেয়া হলো। কেড়ে নেয়া হলো নিজস্ব পতাকা। এখন থেকে তার পরিচিতি হবে ‘কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল’ হিসেবে। এটা কাশ্মীরকে শাসনতান্ত্রিকভাবে অরক্ষিত ও অধিকৃত ভূখন্ডে রূপান্তর করার কূটকৌশল মাত্র। ৩৭০ অনুচ্ছেদ এবং এর আওতাধীন ৩৫ক ধারার বিধান বলে জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের সংসদের বিশেষ কিছু ক্ষমতা ছিল। অন্য রাজ্যের বিধানসভার মেয়াদ যেখানে পাঁচ বছর, সেখানে কাশ্মীরে বিধানসভার মেয়াদ ছিল ছয় বছর। কাশ্মীরের সরকার প্রধান ‘মুখ্যমন্ত্রী’র পরিবর্তে ‘প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে পরিচিত হতেন। পররাষ্ট্র, অর্থ, যোগাযোগ ও প্রতিরক্ষা ছাড়া বাকি সব বিষয়ে রাজ্যের স্বার্থবিষয়ক কোনো আইন প্রণয়ন করতে হলে কেন্দ্রকে কাশ্মীরের সংসদের অনুমোদন নিতে হতো। কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা না হলে বিশেষত উপত্যকার জমি কেনা অথবা ভোটার হওয়া যেত না। স্থায়ী বাসিন্দা কারা হবেন, সেটি নির্ধারণ করত কাশ্মীর সংসদ। সাধারণত ১০ বছর এখানে বসবাস না করলে স্থায়ী বাসিন্দা হিসেবে গণ্য করা হতো না।
৩৭০ ধারার সুরক্ষা তুলে দেয়ায় এখন ভারতীয় হিন্দুরা কাশ্মীরে জায়গা কিনে বসতি স্থাপন করতে পারবে এবং নির্বিঘেœ সেখানকার ভোটারও হতে পারবে। ‘সঙ্ঘ পরিবার’ ৫০ লাখ হিন্দু পরিবারকে ইতোমধ্যে জম্মু ও কাশ্মীরে পুনর্বাসনের জন্য কার্যক্রম হাতে নিয়েছে বলে ভারতীয় গণমাধ্যমের খবরে জানানো হয়েছে। ভারতের সঙ্ঘ পরিবারের যে মহাপরিকল্পনা, তার একটি অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো কাশ্মীর। এ মহাপরিকল্পনা অনুসারে, ২০২৮ সাল নাগাদ ভারতকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একটি হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করা হবে। ইতোমধ্যে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত বলেছেন, ভারতীয়দের প্রধান পরিচয় হবে ‘হিন্দু’। অন্য ধর্মে বিশ্বাসীদেরকে হিন্দুত্বের ভাবাদর্শ ও পরিচয়কে মেনে নিয়ে এখানে থাকতে হবে।
কংগ্রেস সংসদ সদস্য গোলাম নবি আজাদ বলেছেন, ‘সীমান্তের একটা রাজ্য যা ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক এবং ঐতিহাসিকভাবে ভিন্ন; সেটাকেই বেঁধে রেখেছিল ৩৭০ ধারা। ক্ষমতায় মত্ত হয়ে এবং শুধু ভোট পেতে বিজেপি সরকার সেগুলো ছেঁটে ফেলল। তিনি বলেন, জম্মু-কাশ্মীর ভারতীয় সংবিধানের মস্তক ছিল। বিজেপি সরকার আজ শিরñেদ করল।’
নিরাপত্তা অভিযানের নামে কাশ্মীরি মুসলমানদের ওপর নতুন করে একটি বড় ধরনের গণহত্যা শুরু হলে অবাক হওয়ার কারণ নেই। বরং পরিস্থিতি সেদিকেই যাচ্ছে বলে আশঙ্কা হয়। ‘গুজরাট গণহত্যার নায়ক’ যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী তখন মুসলমানদের নির্বিচারে কচুকাটা করে গোটা দেশে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে তিনি পিছিয়ে থাকবেন, এমন মনে করার কারণ নেই। তবে ভারতকে একটি কথা মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতাকমী কোনো জাতিকে কেউ চিরদিন পদানত করে রাখতে পারে না। বেনিয়া ইংরেজরাও ভারতকে পদানত করে রেখেছিল ১৯০ বছর। এর পরে আর পারেনি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।