পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পৃথিবীতে যেমন অনেক জাতির উত্থান হয়েছে তেমনি কালের প্রবাহে তা আবার হারিয়েও গেছে। হাজার বছরের রোমান সা¤্রাজ্য ও সূর্য অস্ত না যাওয়া ব্রিটিশ সা¤্রাজ্যের ইতিহাস আজ কোথায়? উত্থান ও পতনের জোয়ার ভাটার এই নশ্বর পৃথিবীতে যারাই অন্যায়ভাবে অন্যের অধিকার হরণ কিংবা দেশ দখলের চেষ্টা করেছে তারাই কালের বির্বতনে হারিয়ে গেছে। প্রথম বিশ^যুদ্ধ থেকে শুরু করে অদ্যাবধি কোনো যুদ্ধই মানবসভ্যতার কল্যাণ বয়ে আনেনি। সম্প্রতি ভারত কাশ্মীরকে দখলে নিয়ে যে কাজটি করেছে, তা যে একদিন তাদের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে, তা ইতিহাসের পাঠ থেকেই বোঝা যায়। ইতোমধ্যে বিশ্বের তাবৎ বিশ্লেষকরা এমনকি ভারতের বিশিষ্টজনরা পর্যন্ত এমন ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। তারা ইতিহাস পাঠ এবং বিশ্লেষণ করেই এই ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন। ভারত নিজেকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে অথচ অগণতান্ত্রিকভাবে কাশ্মীরের জনগণের উপর নিপীড়নের স্টিমরোলার বহু বছর ধরেই চালাচ্ছে। শেষ পর্যন্ত তা দখল করেই নিল। কাশ্মীরকে পৃথিবীর ভূস্বর্গ বলা হয়। এই নয়নাভিরাম নৈসর্গিক ভূস্বর্গকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করতেই ভারতের ক্ষমতাসীন দল জনতা পার্টি (বিজেপি) এমন কান্ড করে বসেছে। যদিও ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরকে ভারতের তৎকালীন সরকার বিশেষ মর্যাদা দিয়েছিল। কিন্তু আজ হিন্দুত্ববাদী মোদি সরকার কাশ্মীরের জনগণের সেই অধিকারটুকু কেড়ে নিল। কাশ্মীরের সমস্যা নতুন নয়। এটি আর্ন্তজাতিক সমস্যা যা ৭০/৮০ বছরেও সমাধান হয়নি। জাতিসংঘের প্রস্তাব যদি ভারত মেনে নিত এমনকি নেহরুর নীতি বজায় রাখত তাহলেও কাশ্মীরিদের এমন দুর্দশায় পড়তে হতো না। তবে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ভারত তার সংবিধানে কাশ্মীরকে যে স্ট্যাটাস দিয়েছিল তা বাতিল করে সংঘাতের পথকে আরও চওড়া করে দিল।
আমরা বুঝতে পারছি না ভারত কেন বার বার উত্তেজনা বাড়ানোর সুযোগ তৈরি করছে। ভারত কি আরেকটি যুদ্ধ চাচ্ছে? যদি তাই হয়, তবে তা যে এই উপমহাদেশে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে তাতে সন্দেহ নেই। কারণ পাকিস্তান এখন পারমাণবিক শক্তির অধিকারী। যদি তার সাথে কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ বেঁধে যায়, তবে এর পরিণতি শুধু ভারতকেই ভোগ করতে হবে না, গোটা উপমহাদেশ এমনকি পুরো বিশ্বকেও অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। কাজেই সময় থাকতে কাশ্মীর সমস্যার সমাধান করার জন্য জাতিসংঘের প্রস্তাব মোতাবেক গণভোট করার জন্য ভারতকে বাধ্য করতে সারাবিশ্বের এগিয়ে আসা উচিত। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ, মুসলমান দেশগুলো এবং ওআইসির বিশেষ ভূমিকা নেয়া দরকার। কারণ পুরো কাশ্মীরই এখন অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, খাঁচায় বন্দি বিড়ালের মতো। খাঁচাবন্দি বিড়ালকে খোঁচালে তা এক সময় বাঘের রূপ ধারণ করে। কাম্মীরি জনগণের অবস্থাও অনেকটা এরকম। ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাশ্মীরিদের খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করছে। এর প্রতিরোধও কিছুটা লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। নরেন্দ মোদি জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণে বলেছেন, কাশ্মীরের জনগণের কল্যাণে নাকি ৩৭০ ধারা বাতিল করা হয়েছে। অথচ সেখানে সেনাবাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী পুলিশ সদস্য মিলিয়ে প্রায় ৭ লক্ষাধিক নিরাপত্তাবাহিনীর সদস্য মোতায়েন রয়েছে। সত্যিই যদি কাশ্মীরের জনগণের কল্যাণে ভারত সরকার তা বাতিল করতো তাহলে সেখানে এত সৈন্য পাঠানোর প্রয়োজন পড়ত না। তার উদ্দেশ্য যে কাশ্মীরকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলা, তা এখন স্পষ্ট। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ৩৭০ ধারার কারণে সংবিধান অনুযায়ী কাশ্মীরের বাইরের লোকেরা জমি কিনতে পারতো না, ভোটারও হতে পারত না। ভারত ইচ্ছে করলেও মুসলমানদের জমি দখলে নিতে পারত না। কিন্তু এখন আর কোনো বাধাই রইল না। একদিকে চলবে নিপীড়ন, আরেকদিকে লুটপাট। এভাবে এক সময় কাশ্মীর ফিলিস্তিনি ও রোঙ্গিাদের মতোই উধাও হয়ে যাবে।
ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ কাশ্মীরের রাজা হরি সিংয়ের হাত ধরে যুক্ত হয়। ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর ভারতে অধিভুক্তির ব্যাপারে তিনি একটি সম্মতিপত্র স্বাক্ষর করেন। সে সময়ই বেশ কিছু শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়। ওই সব শর্তানুসারে ১৯৪৯ সালে ভারতের সংবিধানে ৩৭০ অনুচ্ছেদ যুক্ত হয়। এই অনুচ্ছেদের ফলে জম্মু-কাশ্মীরের জনগণের নাগরিকত্ব, সম্পদের মালিকানা, মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ করা হতো। অন্য রাজ্যের অধিবাসীরা সেখানে জমি কিংবা সম্পদ কিনতে পারত না। এখন জম্মু-কাশ্মীরকে দুই ভাগ করে জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যেরে মর্যাদা কেড়ে নেওয়া হল। এখন থেকে তার পরিচিতি হবে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল হিসেবে। কাশ্মীরের নাগরিকদের জন্য ৩৭০ এবং ৩৫ (ক) অনুচ্ছেদ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ধারাই ছিল তাদের মর্যাদার রক্ষাকবচ। তাদের নিজস্ব আইন ছিল। কেন্দ্রীয় সরকার চাইলেও সহজে সেখানে হস্তক্ষেপ করতে পারত না। এমনকি ভারতের অন্য অঞ্চলের কোনো নাগরিকের ওই এলাকায় গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ ছিল না। ভারত সরকারের এই ঘোষণার ফলে অন্য রাজ্যের জনসাধারণ এখন কাশ্মীরে গিয়ে সম্পদ কিনতে পারবে। এমনকি স্থায়ীভাবে বসবাস ও করতে পারবে। এই কারণেই ভয় পাচ্ছে কাশ্মীরের জনসাধারণ। কারণ তারা আশংকা করছে এই মর্যাদা বাতিলের ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ওই এলাকা এখন হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় পরিণত হবে।
ভারত সরকার ৩৭০ ধারা এমনি এমনি বাতিল করেনি। এর পেছনে বিরাট ষড়যন্ত্র রয়েছে। এতদিন কাশ্মীরের জনগণ বেশ খানিকটা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার পেত। ভারতের অন্যান্য কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ও অঙ্গরাজ্যের চেয়ে কিছুটা বাড়তি সুবিধা কাশ্মীর পেত। যেমন ঃ নিজস্ব সংবিধান, মুখ্যমন্ত্রীর বদলে প্রধানমন্ত্রী থাকা, কেন্দ্রীয় আইন না মানার সুযোগ ইত্যাদি। ১৯৫৪ সালের ১৪ই মে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি রাজেন্দ্র প্রসাদ এক অধ্যাদেশের মাধ্যমে কাশ্মীরের এই মর্যাদা নির্ধারণ করেছিলেন যা অন্য কোনো ভারতীয় রাজ্যকে দেয়া হয়নি। কাশ্মীরিরা যেন সার্বভৌমত্বের বোধ নিয়ে ভারত ইউনিয়নে থেকে যায় সেই লক্ষ্যে পন্ডিত জওহরলাল নেহরু সরকারের সুপারিশে রাষ্ট্রপতি এই অধ্যাদেশটি জারি করেন। সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৭০ এর আলোকে অধ্যাদেশটি জারি হয়। এতে জম্মু ও কাশ্মীরকে নিজেদের সংবিধান ও একটি আলাদা পতাকার স্বাধীনতা দেয়া হয়। তবে অনেকে বলতে পারেন,জম্মু-কাশ্মীরের এই মর্যাদা হ্রাস ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু জম্ম-কাশ্মীর ইস্যু কখনোই ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল না। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই কাশ্মীর নিয়ে উপহমহাদেশের রাজনীতি, ভূ-রাজনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ব্রিটিশ ভারত বিভক্ত হওয়ার শুরুর দিকেই ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হয়েছিল কাশ্মীর নিয়ে। কাশ্মীরের এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য মোটেও সুখকর নয়। কারণ কাশ্মীরকে কেন্দ্র করে যদি সংঘাতময় পরিস্থিতি দেখা দেয় তাহলে উপমহাদেশে ও নিশ্চিতভাবে অস্থিরতা দেখা দিবে। এমনকি বাংলাদেশ তা থেকে দূরে থাকতে পারবে না। কাশ্মীর ইস্যুতে অস্থিরতা ও নিপীড়ন যদি বাড়ে তাহলে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদও ছড়িয়ে পড়তে পারে। যা ভারতের পক্ষে ঠেকানো সম্ভব হবে না। নরেন্দ মোদির অযৌক্তিক পদক্ষেপ হয়তো তাঁর সমর্থকদের খুশি করবে। কিন্তু তিনি যে এই অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন নিয়ে দীর্ঘকালের চুক্তি লঙ্ঘন করেছেন তার খেসারত হয়তো একদিন দিতে হতে পারে। কেননা সরকারের সমর্থকরা এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানালেও বিরোধীরা সংসদের কক্ষে বসে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম বলেছেন, সরকার যা করেছে তা দেশ ও গণতন্ত্রের পক্ষে চরম বিপজ্জনক। এই সিদ্ধান্ত দেশকে টুকরা টুকরো করে দেওয়ার প্রথম পদক্ষেপ। ইচ্ছে করলেই মোদি সরকার এখন যে কোনো রাজ্যকে তার ইচ্ছেমতো ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে। কাশ্মীরের বিশেষ ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত সঠিক নয় বলেই মনে করেন ভারতের সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল সোলি সোরাবজি। তিনি মনে করেন, কাশ্মীর নিয়ে মোদি সরকারের এই সিদ্ধান্তে প্রাজ্ঞতা নেই, বরং অনেক বেশি রাজনৈতিক। যা আজকের এই ঐতিহাসিক পদক্ষেপ ভবিষ্যতে সাংঘাতিক ভুল বলে প্রমাণিত হতে পারে। এব্যাপারে বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক দলের উচিত ভারতের নিন্দা করা। কারণ যুদ্ধ হলে তার প্রভাব বাংলাদেশের উপরও পড়বে। আমরা আশা করব, ভারত সরকার যুদ্ধের পথে না গিয়ে কাশ্মীরের জনগণের অধিকার ফিরিয়ে দিতে উদ্যোগী ভূমিকা পালন করবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।