শেখ ফজলুল করিমের জীবন ও সাহিত্য
বাঙ্গালী মুসলমানদের লুপ্ত গৌরব ও ইতিহাস ঐতিহ্য নিয়ে যে কয়জন খ্যাতনামা মুসলিম সাহিত্যিক স্মরণীয় বরণীয়
‘লেখাপড়া শেষ করেছিস, চাকরিও করছিস একটা। এবার বিয়ে...!’
কয়েকদিন ধরে বাবা ও মা এভাবেই আমার বিয়ের জন্য বলে যাচ্ছে। আমি মুখে কিছু বলিনি। ‘মৌনতাই সম্মতির লক্ষণ’ ভেবে নিয়ে তারা পাত্রীর সন্ধানে নেমে পড়েছে। দশটির মতো মেয়ে দেখেও ফেলেছে। কিন্তু কাউকেই পছন্দ হয় নি। শেষমেশ বিরক্ত হয়ে বাবা আমাকে বলে বসল, ‘এ যুগের ছেলে তুই, একটা প্রেম-ট্রেমও যদি করে রাখতি আমরা হাসিমুখে তাকেই বউ করে ঘরে আনতাম।’
তখন আমার মনে পড়েছিল খাদিজার কথা। সেই যে প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় যার সাথে চড়ুইভাতি খেলতে গিয়ে বউ বউ খেলেছি। সে এখন কাতার প্রবাসী এক পয়সাওয়ালা যুবকের বউ। সুতরাং তার কথা মনে করেও আর লাভ নেই। কলেজে পড়ার সময় নীলার সাথে একবার বন্ধুত্ব হয়েছিল। কিন্তু প্রেমে রূপান্তরিত হয় নি। সেদিন বড়ভাবী এসে জানতে চাইল আমার পছন্দের কোনো মেয়ে আছে কি না। আমার কাছ থেকে না বোধক জবাব পেয়ে পারিবারের লোকজন ঘটকের শরণাপন্ন হল। ঘটকের নাম আউয়াল মিয়া। আমাদের পাশের গ্রামের অদুদ মিয়ার ছেলে। বীমার দালালের চেয়ে বেশি অধ্যাবসায়ী সে। ইতিমধ্যে সাত-আটখানা মেয়ের ছবি দেখিয়ে তাদের সাত-পুরুষের ইতিবৃত্ত শুনিয়ে গেছে। কিন্তু কোনোটাই পছন্দ হয় নি। কিন্তু নাছোর বান্দা আউয়াল মিয়া। ফটোর নতুন চালান নিয়ে, নোট খাতা ভর্তি এক গাদা জীবনবৃত্তান্ত নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে দুই দিন না যেতেই। টিভি, মোটর সাইকেল, থানা সদরে পাঁচকাঠা জমি কিংবা ঘর সাজানোর আসবাব দেওয়ার কথা বলে একটার পর একটা টোপ ফেলেছে। আমি তো হাবাগোবা বেলে মাছ নই যে, কেঁচো মোড়ানো বড়শিটি খপ করে গিলে ফেলব পরখ করে না দেখেই। তাকে বলেছি, ‘ওসব টাকা-পয়সা বাড়ি গাড়িতে আমার লোভ নেই, একজন শিক্ষিতা, সুরুচিপূর্ণ, অঝগড়াটে, অদেমাগি মেয়ে দেখুন আমার জন্য। অপ্সরী-টপ্সরী দরকার নেই, সাধারণের মধ্যে বৈশিষ্ট্য এমন হলেই হবে।’
‘আইচ্ছা, ব্যবস্থা করতেছি।’ বলেই আউয়াল মিয়া চলে গেল। দুই দিন পর এক কাকডাকা ভোলো সে আবার ফিরে এলো। আমি ঘুম থেকে জেগে তখন বারান্দায় বসেছিলাম। সে এসে ডলফিন মাছের তেল তেলে হাসি হেসে বলল, ‘তোমার জন্য একটা পাত্রীর খোঁজ পাওয়া গেছে, একজাক্টলি তুমি যেমনটি চাও ঠিক তেমনই।’
‘দেখতে কেমন?’
‘গায়ের রং উজ্জ্বল গোলাপি।’
‘তার দু’টো গুণের কথা বলুন।’
খাতা খুলে জীবনবৃত্তান্ত দেখে আউয়াল মিয়া বলে, ‘আছে, আছে। অনে গুণ আছে। গুণে গুণে একবারে টইটম্বুর।
‘যে কোনো একটি গুণের কথা বলুন শুনি।’
‘আচ্ছা বলছি, তুমি এটাকে গুণ না বলে সুঅভ্যাসও বলতে পারো।’
‘কী সেটা?’ ‘
‘রান্না।’
‘কী কী রান্না জানে?’
‘পোলাও, কোর্মা, চপ, পুডিং, কেক, নিমকি, পরাটা...!’
‘শুধু ওসবই। মাছ-মাংস, আলুভাজি অথবা ভর্তাটর্তা বানাতে পারে তো?’
‘পারে, পারে আলুভাজি, উচ্ছেভাজি, ভর্তা, কইমাছের ঝোল, বেলে মাছের চচ্চরি...!’
‘ব্যস, ব্যস। ওতেই হবে।’ আমি মনে মনে হিসেব মেলাই। ছোটবেলা থেকেই আমার শখ মাছ ধরা- জাল দিয়ে, বড়শি ফেলে, চাঁই পেতে, পানি সেচে- মাছ ধরার সবগুলো কায়দা আমার রপ্ত। এজন্য আমার মরহুমা দাদি আদর করে ডাকত, ‘নাতি আমার মেছুয়া। বড় হলে একটা কৈবর্তের মেয়ে আনব বউ করে।’
এখন দেখছি দাদির ইচ্ছেই পূরণ হতে চলেছে। আমি বড় বড় মাছ মেরে আনব আর বউ সেটা বিভিন্ন প্রণালিতে রান্না করে ভক্ষণ করাবে। আউয়াল মিয়া পাত্রীর ছবি দেখাল। ছবিটা বেশ। ছিপ ছিপে লম্বাটে গড়ন। উজ্জ্বল ডাগর চোখ! মোনালিসার মতো হাসি। আমার পছন্দ হয়ে গেল। এই খুশিতে আমি আউয়াল মিয়াকে খাওয়ালাম। খালি চা নয়, পুরো ব্রেকফাস্ট। খেতে খেতে সে জানতে চাইল, ‘তাহলে বাবা, পাত্রী তোমার পছন্দ হয়েছে? তোমার সম্মতি পেলে আমরা সামনে এগুতে পারি। বলো, তুমি কি এই মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি?’
আমি সম্মতি জানালাম, নীরবে মৌন সম্মতি নয়, একেবারে মুখ খুলে বললাম, ‘আমি রাজি।’
আমার সম্মতি পেয়ে পরিবারের মুরুব্বিরা পাত্রীর বাড়িতে গেলেন। পাত্রীকে সরাসরি দেখে পাকা কথা বলে বিয়ের দিন ধার্য করতে যাবে, তখনই বাঁধল বিপত্তি। পাত্রীর নাম সুলতানা। সেও নাকি পাত্রকে দেখবে। পাত্রের বাড়ি-ঘর দেখেবে। এ যুগে পাত্রীর এমন ইচ্ছে হয়! মুরব্বিরা রীতিমতো রেগে আগুন হয়ে বাড়ি এসে আমাকে যখন এ কথা জানাল-তখন আমি বরফগলা জলের মতো শীতল গলায় বললাম, ‘পাত্রীর এই চাওয়াতে কোনো অন্যায় নেই। আসতে দিন তাকে।’
আমার কাছ থেকে সম্মতি পেয়ে পাত্রী সুলতানা তার বান্ধবীদের নিয়ে দলবেঁধে এসে হাজির হলো আমার বাড়িতে। তাদের সাত বান্ধবীকে দেখে আমার মায়ের চক্ষু যেন কপালে উঠে গেছে। ড্রয়িংরুমে বসে আমার জীবনবৃত্তান্ত জেনে চলে গেল। যাবার আগে জানিয়ে গেল, ‘শুধু ছেলেরাই কেন মেয়েকে দেখতে যেতে পারবে? মেয়েরা কেন পারবে না? আমরা সেই প্রথা ভাঙতেই এখানে এসেছি। আর আপনাকে দেখার পর আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, আপনাকে আমি এখন বিয়ে করতে সম্মতি প্রকাশ করতে পারছি না...!’
তারপর...? তারপর আর কী? নাটেশাকটি মুড়োল, বিয়ে আমার ফুরোল!
তখন এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে সম্পূর্ণ বেকার জীবন নিয়ে ঘোরাঘুরি করি। স্কুল জীবনের মতোই আমরা চার বান্ধবী সকালবেলায় একসাথে বাসা থেকে বের হই। সারাবেলা টই-টই করে ঘুরে সন্ধ্যার পরে বাসায় ঢুকি। এ রকম টই-টই এর একদিন আমাদের কোচিংয়ের এক স্যার আমাদের চারজনকে ডেকে রামধমক দিলেন। আমাদের চারজনের মধ্যে আমি আর রিকি সায়েন্সের স্টুডেন্ট। মোটামুটি মেধাবী। আর বাকি দুইটা, কলি আর জেরিন, আর্টসে পড়ত। এরা এমন মেধাবী যে, এসএসসি পাস করবে কি-না, এটা নিয়ে তাদের মনেই যথেষ্ট সন্দেহ ছিল।
স্যার আমাদের ডেকে বললেন, তোরা যে চারটা সারাদিন হুদাই ঘুরিস, এ সময়টা কোনো একটা কাজে লাগালে ভবিষ্যতে কাজে লাগত। তুই আর রিকি না হয় স্টুডেন্ট ভালো, পাস করে যাবি। ওই গাধা দুইটাকে কিছু একটা শেখা। এরা তো টেনেটুনে এসএসসি পাস করলেও কলেজে কোনোদিন পাস করবে না। ওদেরকে তোরা ইংরেজি শেখা। না হয় কলেজেও ভর্তি হইতে পারবে না কিন্তু বলে দিলাম।
স্যার আমাদেরকে একটা রুমের ব্যবস্থা করে দিলেন। ওই রুমের দরজা বন্ধ করে আমি আর রিকি মিলে প্রতিদিন বিকেলে এক ঘণ্টা সময় ধরে কলি আর জেরিনকে ইংরেজি গ্রামার পড়ানো শুরু করলাম। পড়াশোনা শুরু হইল প্রেজেন্ট টেন্স দিয়ে। এক সপ্তাহ পড়ানোর পরে আমার মনে সন্দেহ হইল আদৌ কি এরা কিছু শিখছে কি-না।
তাই সপ্তাহ শেষে একটা টেস্ট নেওয়ার ঘোষণা দিলাম আমি। প্রেজেন্ট টেন্সের ওপর পরীক্ষা। পরীক্ষার দিন আমাদের দুই স্টুডেন্ট বেশ সাজগোজ করে হাজির।
আমি বোর্ডে লিখলাম-ও ধস ধ ংঃঁফবহঃ.
রিকি আমাদের সুন্দরী শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞাসা করল, এইটা কোন টেন্স?
গাধার গাধা জেরিন, হড়বড় করে বলল, যেহেতু অ্যাম আছে তাহলে এইটা অবশ্যই প্রেজেন্ট কন্টিনিউয়াস টেন্স। আর আমরা তো কন্টিনিউ স্টুডেন্টই থাকি।
রাগে আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। গাল লাল হয়ে গেল। রিকি ঠাণ্ডা মানুষ। রাগ-টাগ করে না।
ও মুচকি মুচকি হেসে বলল, তাই নাকি, জেরিন? এইবার কলি বল এইটা কোন টেন্স।
আমাদের আরেক স্টুডেন্ট কলি জেরিনের চেয়ে চালাক। জেরিনের উত্তর যে ভুল সেইটা সে আমাদের চেহারা দেখেই বুঝে গেল। তারপর অনেক জ্ঞানের ভাব করে বলল, এইটা প্রেজেন্ট পারফেক্ট টেন্স।
আমি রক্তচক্ষু করে বললাম, কী কারণে এইটা পারফেক্ট টেন্স?
কলি বলল, কারণ আমরা স্টুডেন্ট হইছি আগে। স্কুলে ভর্তি হইছি আগেই। কিন্তু সেইটার ফল এখনও বর্তমান আছে। এই জন্য এইটা পারফেক্ট টেন্স হবে।
আমি আর রিকি সেইদিনই এই শিক্ষকতা থেকে রিজাইন দিয়ে দিলাম। বন্ধু আছি বন্ধু থাকি, এদেরকে ইংরেজি শিখাইতে গিয়ে বন্ধুত্ব নষ্ট করার কোনো মানে হয় না।
সপ্তাহ না পেরোতেই আবার স্যারের ডাক, কীরে তোদের শিক্ষকতা জীবনের এখানেই সমাপ্তি?
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে মুখ গম্ভীর করে রাখলাম। স্যার প্রস্তাব দিল ওই কোচিংয়েই ক্লাস সেভেন আর এইটে ইংরেজি পড়াতে হবে, সপ্তাহে চার দিন।
আমি সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। ক্লাস সেভেনের ইংরেজি পড়ানো আর এমন কি কাজ! আমি সবসময়ই আমার ক্লাসের চেয়ে সিনিয়র ক্লাসের স্টুডেন্টদের ইংরেজি পড়াইছি। এসএসসি পরীক্ষার পরে এদের পড়াইতে আমার কোনো অসুবিধাই হবে না।
অনেক আগ্রহ নিয়ে ক্লাস সেভেনের ক্লাস নিতে শুরু করলাম। আমাদের এই কোচিং চট্টগ্রামের সেরা কোচিং সেন্টারগুলোর একটা। সব ভালো ভালো স্কুলের স্টুডেন্টরা এখানে আসে পড়তে। ভালো স্টুডেন্ট মানেই দুষ্টের শিরোমণিও এরা। এই বিষয়ে আমিও কম যাই না, সুতরাং বেশ ভালো ক্লাস হয়। কিন্তু প্রতি ক্লাসে আমার বারোটা বাজায় রক্তিম। (অসমাপ্ত)
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।