পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সড়ক দুর্ঘটনাকে এখন আর নিছক দুর্ঘটনা বলা যায় না। এটা হত্যাকান্ড। বছরের পর বছর ধরে সড়ক-মহাসড়কে যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে এবং তার যে ধরণ তা বিশ্লেষণ করেই বিশেষজ্ঞরা সড়ক দুর্ঘটনাকে এখন হত্যাকান্ড হিসেবে চিহ্নিত করছেন। চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, সড়কে চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যথাযথ দায়িত্ব পালন না করা, বিআরটিএ-এর অকার্যকর পদক্ষেপের দরুণ সড়কে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর মিছিল কোনোভাবেই থামছে না। এ মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। এবারের ঈদের ছুটি এবং তার পরবর্তী কয়েক দিনের সড়ক দুর্ঘটনার চিত্র দেখলেই বোঝা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার নামে যেন একশ্রেণীর চালক যাত্রীদের হত্যা করার মিশন নিয়ে নেমেছে। গত শুক্রবার ময়মনসিংহে এক গার্মেন্টস ব্যবসায়ী স্ত্রী, তিন সন্তান ও শ্যালককে নিয়ে দুর্ঘটনায় যেভাবে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে তিনি এক আত্মীয়র বিয়ের অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার রামগোপালপুর এলাকায় তার গাড়িটিকে একটি বাস নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে চাপা দেয়। মুহুর্তেই তার পুরো পরিবার নিঃশেষ হয়ে যায়। গত রবিবার কুমিল্লা-নোয়াখালি মহাসড়কে এক হোটেল ব্যবসায়ী স্ত্রী, তিন ছেলে, এক মেয়েসহ সিএনজিতে করে কুমিল্লায় এক আত্মীয়র বিয়ের দায়াত অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন। ঢাকা থেকে কুমিল্লাগামী একটি বাস একটি মাইক্রোবাসকে ওভারটেকিং করতে গিয়ে সিএনজিটির সঙ্গে মুখোমুখি হয়ে যায়। এতে পুরো পরিবারের ৬ জনই নিহত হয়। এই যে চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একের পর এক গাড়িকে চাপা দেয়া কিংবা পাশের জলাশয়ে গিয়ে উল্টে পড়া, গাছের সঙ্গে ধাক্কা খাওয়াÑএটা কে কি দুর্ঘটনা বলা যায়? বরং দ্ব্যর্থহীনভাবে বলা যায়, এসকল গাড়ি চালকরা স্বেচ্ছায় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মানুষকে হত্যা করছে। এর দায় শুধু গাড়িচালকেরই নয়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় সর্বোপরি সরকারের।
গতকাল প্রায় সবগুলো দৈনিকে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যানের বরাতে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়, এবারের ঈদযাত্রা এবং তৎপরবর্তী ঈদফেরত যাত্রায় সারাদেশে ২০৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২২৪ জন নিহত এবং ৮৬৬ জন আহত হয়েছে। তবে এটা নিশ্চিত, এই পরিসংখ্যান জ্ঞাত দুর্ঘটনার অংশমাত্র। এর বাইরে আরও অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে যা পত্র-পত্রিকা বা অন্য কোনো মাধ্যমে আসে না। বিস্মিত হতে হয় এই ভেবে যে, সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে কত আন্দোলন, মানববন্ধন, সভা-সেমিনার হয়েছে এবং হচ্ছে, তার ছিঁটেফোটাও কোনো কাজে আসছে না। এত আঁকুতি, এত আহাজারী সংশ্লিষ্ট কারো মনেই কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারছে না। কি কারণে, কেন দুর্ঘটনা ঘটছে, এগুলো চিহ্নিত হলেও এর প্রতিকারে পরিবহন মালিক, শ্রমিক সংগঠন তো বটেই সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যেন নির্বিকার হয়ে রয়েছে। তাদের কোনো টনকই নড়ছে না। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনা ঘটবে, মানুষ মারা যাবে, পঙ্গু হবেÑতাতে কি! অথচ যারা যাত্রী এবং যাদের কারণে পরিবহন ক্ষেত্র টিকে আছে তাদের ট্যাক্সের পয়সাই খাতটি চলছে। সড়কে উপযুক্ত যানবাহন চলাচল নিশ্চিত করার বিষয়টি যে বিআরটিএ’র দায়িত্ব, সেই সংস্থাটির ব্যর্থতা এখন অমার্জনীয় হয়ে উঠেছে। গাড়ির ফিটনেস, ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ এ সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করা সংস্থাটির দায়িত্ব। এ বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকাও আয় করছে। বিপরীতে দেখা যাচ্ছে, সড়কে এ সংস্থাটির কাজের কোনো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে না। তাহলে এই হাজার হাজার কোটি টাকা দিয়ে সংস্থাটি কি করছে? এই অর্থের বিনিময়ে সে কি পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা এবং নিরাপদ পরিবহন নিশ্চিত করতে পারছে? অন্যদিকে সড়কের শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা কাজে নিয়োজিত ট্র্যাফিক পুলিশ কি তার দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে? সড়ক দুর্ঘটনা যেভাবে মহামারি আকার ধারণ করছে, তাতে এটাই প্রতীয়মাণ হচ্ছে, সড়ক পরিবহন ও শৃঙ্খলার সাথে জড়িত সকল সংস্থা ও মন্ত্রণালয় পুরোপুরিভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। তা নাহলে, সড়ক-মহাসড়ক কেন মৃত্যুর পথে পরিণত হবে? অথচ যেসব প্রধান প্রধান কারণে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটছে তার সবই বহু আগে চিহ্নিত হয়েছে। এসব কারণের অর্ধেকও যদি সমাধান করা যেত, তাহলে সড়কে এমন মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হতো না। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে প্রায়ই লোকবলের সংকটের কথা বলা হয়। এ সংকট দূর করা কি খুব কঠিন কাজ? এ খাত থেকে যে হাজার হাজার কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা হচ্ছে, তা দিয়ে কি লোকবল বাড়িয়ে সড়কে এবং পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো যায় না? মূল কথা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো এ ব্যাপারে কোনোরূপ আন্তরিকতা দেখাচ্ছে না। তাদের কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। এ কথা তো সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন, দিন যত যাবে, ততই মানুষের চাপ বাড়বে, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি পাবে এবং এর সাথে তাল মিলিয়েই লোকবল বৃদ্ধি ও সড়ক শৃঙ্খলা সাজাতে হয়। সারাবিশ্বেই এ কাজটি পরিকল্পিতভাবে করা হয়ে থাকে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক উন্নতির কথা জোরেসোরে বলা হচ্ছে, অথচ সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে এবং তা যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার ক্ষেত্রে কোনো উদ্যোগই নিতে দেখা যাচ্ছে না। আদালত নির্দেশ দিলেও তা প্রতিপালিত হচ্ছে না। সড়ক-মহাসড়কে যেমন নির্বাধে ধীরগতির ত্রিচক্র যান চলছে, তেমনি চালকরাও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাচ্ছে। এসব প্রাণঘাতি আচরণ পরিবর্তনে কোনো উদ্যোগই পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এই উদাসীনতা, শৈথিল্য সড়কে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এই মৃত্যুকে হত্যাকাÐ ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
সড়কে প্রতিদিন এত মানুষের প্রাণ যাচ্ছে, এ চিত্র দেখে কি পরিবহন সংশ্লিষ্ট মালিক-শ্রমিক সংগঠনগুলোর নেতা, বিআরটিএ এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তিদের কি একটুও প্রাণ কাঁদে না? নিমেষে যে পৃথিবী থেকে একের পর এক পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে, অসংখ্য পরিবার অভিভাবকহারা হচ্ছে, পঙ্গুতবরণ করে অসহনীয় জীবনযাপন করছে, সর্বোপরি রাষ্ট্রের যে প্রভূত ক্ষতি সাধিত হচ্ছেÑএর কি কোনো প্রতিকার হবে না? সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের স্বজনদের আহাজারি আর কতকাল দেখতে হবে? তারা এর প্রতিকার কার কাছে চাইবে, কে এ প্রতিকার করবে? এর কোনো উত্তর নেই। যে বেপরোয়া চালকের কারণে এত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, সে কি এর দায়িত্ব নেবে কিংবা যাদের কারণে সে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে, তারা এর দায়িত্ব নেবে? সরকার কি দায়িত্ব নিচ্ছে? নিচ্ছে না। একটি পরিবারের সদস্যের মৃত্যুর বেদনা তারা ছাড়া আর কেউ জানে না। এই যে সড়কে দুর্ঘটনার নামে মানুষ হত্যার মিশন চলছে, আমরা মনে করি, এর দায়িত্ব নিতে হবে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ, সড়ক শৃঙ্খলার সাথে জড়িত ট্র্যাফিক পুলিশ সবোর্পরি সরকারকে। সরকার যদি সড়ক শৃঙ্খলা ফেরাতে সচেষ্ট হয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে এ ধরনের দুর্ঘটনা হত্যাকাÐ না হয়ে দুর্ঘটনা হিসেবেই বিবেচিত হবে। সড়ক দুর্ঘটনার নামে হত্যাকাÐ বন্ধে সরকারকেই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।