পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সড়ক দুর্ঘটনাকে এখন আর নিছক দুর্ঘটনা বলা যায় না। এটা মূলত যেসব চালক গাড়ি চালান তাদেরই অদক্ষতা, অযোগ্যতা এবং বেপরোয়া মনোভাবের কারণ। একজন গাড়ি চালকের মধ্যে এই অদক্ষতা, অযোগ্যতা, বেপরোয়া মনোভাব-এই তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকা মানে সে জেনেশুনে ও বুঝে দুর্ঘটনার মাধ্যমে মানুষ হত্যা করছে। কেউ যদি একটু খেয়াল করে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত দুর্ঘটনা কবলিত যানবাহনগুলোর চিত্র দেখে তা থেকেই বুঝতে পারবে চালকরা ইচ্ছা করে এই দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে। চালকের মধ্যে উল্লেখিত তিনটি বৈশিষ্ট্য থাকার কারণেই বাস গিয়ে সরাসরি গাছের সাথে ধাক্কা খাচ্ছে, কিংবা রাস্তা ছেড়ে পাশের খাল ও জলাশয়ে গিয়ে উল্টে পড়ছে। বেশিরভাগ দুর্ঘটনার চিত্র এরকমই। চালকরা যদি দক্ষ, যোগ্য এবং ধীর-স্থির হতেন তবে এ ধরনের চিত্র দেখা যেত না। দুর্ঘটনা ঘটলেও তার চিত্র দেখে বোঝা যেত, এ দুর্ঘটনায় সত্যিকার অর্থেই চালকের কোনো হাত ছিল না কিংবা দুর্ঘটনা থেকে বাঁচতে চালকের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না। এবারের ঈদে যেসব দুর্ঘটনার চিত্র আমরা দেখেছি এবং দেখছি, তাতে এই চিত্রটাই ফুটে উঠেছে যে এসব দুর্ঘটনা যেন ইচ্ছাকৃত এবং তাতে চালকদের বেপরোয়া মনোভাব দায়ী। তা নাহলে গাড়ি কেন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাছের সঙ্গে ধাক্কা বা জলাশয়ে গিয়ে উল্টে পড়বে? চালকরা যে জেনেশুনে, ইচ্ছাকৃত ভুল করছে তাতে এখন আর সন্দেহের অবকাশ নেই এবং তাদের এই মনোভাব পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। যদি তাই হতো তবে, গত বছর নিরাপদ সড়ক চাই-এর দাবীতে শিক্ষার্থীরা যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং সরকার সমস্যা সমাধানে আশ্বাস দিয়েছিল, তার প্রতিক্রিয়া কিছুটা হলেও সড়ক দুর্ঘটনা বৃদ্ধির ওপর পড়ত। কিছুটা হলেও দুর্ঘটনা কমত। একটা পরিসংখ্যান দিলেই বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে। গত বছর ঈদুল আজহার ছুটির পাঁচ দিনে সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ৬৪ জনের। এবার ঈদের ছুটিসহ গত এক সপ্তাহে মৃত্যু হয়েছে ৭৪ জনের। গত নয় দিনে ১২০ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক। এ চিত্র থেকে বোঝা যায়, শিক্ষার্থীদের আন্দোলন পুরোটাই বৃথা গিয়েছে। বরং মনে হচ্ছে, এ আন্দোলনে ক্ষুদ্ধ হয়ে এবং জেদ করেই চালকরা দুর্ঘটনার হার বাড়িয়ে দিয়েছে।
দুই.
এখন সমাজ ও পরিবার এমন একটা সময় অতিক্রম করছে, যে সময়ে সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবোধ চরম অবক্ষয়ের দিকে ধাবিত। একের পর এক অনৈতিক ঘটনা ঘটছে, মানুষ খুন হচ্ছে। আপন মানুষ খুনি হয়ে উঠছে। যারা আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে, তাদের একটা শ্রেণীও অপরাধমূলক কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়ছে। সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় মনুষ্য সৃষ্ট এক ধরনের বিপর্যয়কর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সমাজ ও পরিবার অস্থির হয়ে উঠেছে। যেসব ঘটনা ঘটছে, এগুলো কোনভাবেই দুর্ঘটনা নয়। জেনেবুঝেই করা হচ্ছে। খুনি কিভাবে খুন করেছে, তা যেভাবে নিঃসংকোচে অবলীলায় বর্ণনা করে, তাকে দুর্ঘটনা বলা যায় না। একইভাবে সড়কপথে যেসব দুর্ঘটনা ঘটছে, সেগুলোকেও এখন আর শুধু দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য করা যাচ্ছে না। বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণায় বলা হয়েছে, বিগত দেড় দশকে সারাদেশে ৫০ হাজারের অধিক সড়ক দুর্ঘটনার মধ্যে ৯১ শতাংশই হয়েছে অতিরিক্ত গতি ও চালকের বেপরোয়া মনোভাবের জন্য। এসব দুর্ঘটনায় মারা যায় ৫০ হাজারের অধিক। সংস্থাটির হিসাবে প্রায় অর্ধেকই ঘটেছে জাতীয় মহাসড়কগুলোতে। এর অর্থ মহাসড়কগুলো যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। বেশিরভাগ দুর্ঘটনাই চালকদের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে হয়েছে। তাহলে এসব দুর্ঘটনাকে কি ¯্রফে দুর্ঘটনা বলা যায়? নিরাপদ সড়ক চাই সংগঠনের একাধিক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, অতিরিক্ত গতি ও বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর চারটি বড় কারণ হচ্ছে, চালকের প্রশিক্ষণের অভাব, স্থায়ী নিয়োগের বদলে যাত্রার ওপর বেতন নির্ধারণ, শাস্তির অপ্রতুলতা এবং হাইওয়ে পুলিশের দায়িত্বে অবহেলা। এসব কারণ থেকে না বোঝার কি কোন কারণ আছে যে দুর্ঘটনার পেছনে মানুষের হাত নেই? এসব কারণ কি প্রাকৃতিক, যে তা বলে কয়ে আসে না বা ঠেকানো যায় না? নিশ্চিতভাবেই এসব কারণ দূর করা যায়, ঠেকানো যায়। যদি সংশ্লিষ্টরা সচেতন হন, দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলে দায় না সারেন এবং দুর্ঘটনার কারণগুলো দূর করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। দুর্ভাগ্যের বিষয়, বড় ধরনের কোন ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটলেই আমরা কেবল তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ থেকে শুরু করে কারণ ও প্রতিকার নিয়ে মেতে উঠি। বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন পথও বাতলে দেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ও নড়েচড়ে বসে। কিছুদিন আন্দোলন, মানববন্ধন করার পর ভুলে যাই। যেন আরেকটি ট্র্যাজিক দুর্ঘটনা ঘটা পর্যন্ত অপেক্ষা করি। দুর্ঘটনার জন্য যেসব কারণ উঠে এসেছে এবং এর জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে কি সুপারিশ বা কি শাস্তির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে বা সার্বিক সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে গৃহিত কার্যক্রম কতটা জোরদার হয়েছে, তা অস্পষ্টই থেকে যাচ্ছে। গাড়ি চালকদের বেপরোয়া মনোভাব ও অদক্ষতা নতুন কিছু নয়। তারা নিজেদের অদক্ষতা জেনে বুঝেই গাড়ির স্টিয়ারিং ধরছেন। গাড়ি মালিকরাও তাদের জ্ঞাতসারেই ভুয়া লাইসেন্সধারী ও অদক্ষ চালকদের প্রশ্রয় দিচ্ছেন। আর সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আইনের যথাযথ প্রয়োগে উদাসীনতা ও শৈথিল্য রয়েছে। কাজেই দুর্ঘটনা যে শুধুই দুর্ঘটনা, এতে চালকদের হাত নেই-এটা এখন আর বলা যাচ্ছে না। বলা যায়, জানার মধ্যে থেকেই দুর্ঘটনা ঘটছে, রুঢ়ভাবে বললে ঘটানো হচ্ছে। যাত্রীদের যানবাহনে উঠিয়ে মৃত্যুপথযাত্রী করা হচ্ছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, অর্থনীতির লাইফ লাইন হিসেবে পরিচিত ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের উপর রয়েছে প্রায় ২০০ বাজার, অবাধে চলে ধীর গতির থ্রি হুইলার। এ এক অকল্পনীয় ব্যাপার। বিশ্বের কোনো সভ্য দেশে মহাসড়কে এভাবে বাজার বসা, ধীরগতির যানবাহন চলে কিনা, জানা নেই। শুধু এই মহাসড়কেই নয়, দেশের অন্যান্য মহাসড়কের চিত্রও একই। এর কোনো প্রতিকার হচ্ছে না। এ যে এক ধরনের আত্মঘাতী প্রবণতা তা ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। অর্থাৎ জেনেবুঝেই দুর্ঘটনা ঘটছে, ঘটানো হচ্ছে এবং ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বলা যায়, একশ্রেণীর গাড়ি চালক ঘাতক হয়ে মানুষ হত্যা করছে।
তিন.
সড়ক দুর্ঘটনায় একটি পরিবারের উপার্জনক্ষম কোন সদস্য মৃত্যু বা পঙ্গুত্বের শিকার হলে সে পরিবারটি কি শোচনীয় ও অশেষ দুর্ভোগের মধ্যে পড়ে, তা তারা ছাড়া আর কারো পক্ষে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। আমরা দূর থেকে দুঃখ ও শোক প্রকাশ করা ছাড়া কিছু করতে পারি না। পুরো পরিবারটিই যে ছারখার হয়ে গেল, তা গভীরভাবে চিন্তা করি না। বিগত দেড় দশক ধরে যে ৫০ হাজারের অধিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে, এসব মানুষের পরিবারগুলো কি অবস্থায় আছে, তা কি আমরা কেউ জানি? দূর অতীতের পরিসংখ্যানে না গিয়ে এ বছর সড়ক দুর্ঘটনায় যেসব মানুষ প্রাণ হারিয়েছে এবং আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছে তাদের পরিবারগুলো কি অবস্থায় রয়েছে, তাও তো আমরা জানি না। পরিবারগুলোর খোঁজও কেউ নিচ্ছে না। অথচ রাষ্ট্রের মানবিক দায়িত্ব এসব পরিবারগুলোর খোঁজ নেয়া এবং তারা যে নির্মম পরিণতি ভোগ করছে, তা উপলব্ধি করে সড়ক দুর্ঘটনা হ্রাসে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। সরকারি হিসাবে সড়ক দুর্ঘটনায় দেশে প্রতিদিন গড়ে ৮ জন মানুষ মারা যায়। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে ৩০ জন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ৪৮ জন। পুলিশের হিসাব অনুযায়ী বছরে ৩ হাজার, যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাবে ৮ হাজার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে ২৫ হাজার এবং অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে ১৮ হাজার মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে। এআরআই-এর হিসেবে দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে ৫৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে যানবাহনের অতিরিক্ত গতির কারণে। ৩৭ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটে চালকের বেপরোয়া মনোভাবের কারণে। অর্থাৎ জেনে বুঝে সড়কে দুর্ঘটনা ঘটানো হচ্ছে এবং মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। এর রাশ টেনে ধরার কোন কার্যকর উদ্যোগ নেই। যদি থাকত, তবে যাত্রী কল্যাণ সমিতির হিসাব অনুযায়ী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ৩৭ শতাংশ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তির মৃত্যুর হারটি কমিয়ে আনা যেত। অনেক পরিবার নিঃস্ব ও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পেত। বলা বাহুল্য, সড়ক দুর্ঘটনায় শুধু একটি পরিবারের একজন উপার্জনক্ষম ব্যক্তিরই মৃত্যু হয় না, পুরো পরিবারটিকেও বিপন্ন অবস্থার মধ্যে ফেলে দেয়। এভাবে অভিভাবকহীন কত পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, তার খবর কখনোই পাওয়া যায় না। এ নিয়ে কোন পরিসংখ্যানও করতে দেখা যায় না। দুর্ঘটনার শিকার পরিবারগুলো সমাজে বা রাষ্ট্রের কি প্রভাব ফেলছে তারও হিসাব করা প্রয়োজন। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে এক গবেষণায় বলা হয়েছে, দুর্ঘটনায় আহত-নিহতদের শতকরা ৭৩ ভাগ উৎপাদনশীল খাতের সাথে জড়িত। সরকারি হিসাবে, সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিবছর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ থেকে ২ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের এক নেতা বলেছিলেন, ‘এর দায় সরকারেরও আছে। মানছি, চালকদের প্রশিক্ষণের অভাব আছে। তাহলে সরকার কেন প্রশিক্ষণ দিচ্ছে না? হাইওয়ে পুলিশের তো যন্ত্র আছে। তারা ব্যবস্থা নেয় না কেন? আসলে চালকরা মুনাফাবাজির শিকার।’ তার কথার সূত্র ধরেই বলা যায়, সড়ক দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে সরকারের নিশ্চয়ই দায় রয়েছে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যদি চালকদের ডাটাবেজ তৈরি করে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত, তাহলে অনেক চালককে ঘুষ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স নিতে হতো না। হাইওয়ে পুলিশ যদি তাদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করত তবে, গাড়ি চালকরাও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালাতে পারত না। অথচ মোটরযান আইনে জাতীয় মহাসড়ক এবং শহর ও লোকালয়ের জন্য আলাদা গতিসীমা রয়েছে। মহাসড়কে বাস, কোচ ও পিকআপের সর্বোচ্চ গতিসীমা নির্ধারণ করা হয়েছে ঘন্টায় ৫৫ কিলোমিটার, ভারী ট্রাক ও লরির গতিবেগ ৫০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও অন্যান্য ভারী যানবাহনের সর্বোচ্চ গতিসীমা ৩০ কিলোমিটার। ব্যক্তিগত গাড়ির সার্বোচ্চ গতি ১১০ কিলোমিটার। অন্যদিকে শহর ও লোকালয়ে বাস, কোচ, পিকআপ, ভারী ট্রাক, লরির সর্বোচ্চ গতিসীমা ৪০ কিলোমিটার। ট্রাক্টর ও ভারী যানবাহন ২০ কিলোমিটার এবং ব্যক্তিগত গাড়ি ৫০ কিলোমিটার। মহাসড়ক ও শহরের যানবাহনের গতির দিকে তাকালে গতিসীমার এ আইন যে কেউ মানছে না বা কর্তব্যরত ট্রাফিক ও হাইওয়ে পুলিশ মানানোর যে কোন উদ্যোগ নিচ্ছে না, তা যে কেউ বুঝতে পারবেন। হাইওয়ে পুলিশ বলেছে, ‘অতিরিক্ত গতি মাপার যন্ত্র হাইওয়ে পুলিশের সব স্থানেই আছে। গতি না মানার দায়ে প্রতিদিনই মামলা দেয়া হয়।’ তাহলে বেপরোয়া গতি কমছে না কেন? সমস্যা কোথায়? বাস-ট্রাকের অনেক চালক বলেছেন, তাদের প্রায় সব চালকই ট্রিপ অনুযায়ী মালিকের কাছ থেকে টাকা পান। তারা মাসিক বেতনভুক্ত নন। এজন্য ট্রিপ বাড়ানোর জন্য পথে গতি বৃদ্ধি করে পাল্লা দিয়ে গাড়ি চালানো হয়। এতেই দুর্ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ ট্রিপ বাড়িয়ে বাড়তি রোজগারের জন্য তারা শুধু নিজের জীবনের ঝুঁকিই নিচ্ছেন না, যাত্রীদের জীবনও ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছেন। কোন সভ্য দেশে এ ধরনের আত্মঘাতি প্রতিযোগিতা চলে কিনা, তা আমাদের জানা নেই। চালকদের এ কথা থেকে বলার সুযোগ নেই দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই, এর পেছনে তাদের হাত নেই।
চার.
চালকদের বেপরোয়া মনোভাব, অদক্ষতা, প্রশিক্ষণের অভাব, মাদকাসক্তি, মোবাইলে কথা বলা, জাল ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, সড়কের ত্রুটি ও যথাযথ সংস্কারের অভাব, আইনের কার্যকর প্রয়োগ না হওয়া-এসব কারণেই বেশিরভাগ দুর্ঘটনা ঘটছে। এসব কারণ দূর করতে পারলেই কেবল দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা বলা যেতে পারে। কাজেই শনাক্তকৃত কারণ দূর করতে এবং পরিবহন খাতে নিয়ম-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিকল্প নেই। মূল জায়গায় হাত দেয়া দরকার। যেসব কারণে ফিটনেসবিহীন গাড়ি রাস্তায় নামছে এবং চালকরা বেপরোয়া হয়ে যায়, সেগুলো কীভাবে বন্ধ করা যায়, এ ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া দরকার। সড়ক-মহাসড়কে চালকদের গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে পরিবহন মালিক, সংগঠন এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় যদি নিয়মিত মনিটরিংয়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করে, তবে তাদের মানসিকতার পরিবর্তন আসতে বাধ্য। যাত্রী নিয়ে গাড়ির যাত্রার প্রাক্কালে চালকের মানসিক সুস্থ্যতা পরীক্ষার মাধ্যমে সে সুস্থ্য বা উপযুক্ত কিনা, তা নিশ্চিত করতে পারলে দুর্ঘটনা হ্রাস করা সম্ভব। গাড়ি চালককেও তার বিবেক-বুদ্ধি সক্রিয় রেখে গাড়ি চালাতে হবে। ফাঁকা সড়ক পেলেই গতি বাড়িয়ে দিতে হবে, কিংবা উল্লাসে গাড়ি চালাতে হবে-এ বিষয়টি তাদের মন থেকে মুছে ফেলতে হবে। তাকে এই মনোভাব ধারণ করতে হবে, ধীর-স্থিরভাবে এবং সুষম গতিতে গাড়ি চালিয়েও গন্তব্যে পৌঁছা যায়। এরজন্য অতিরিক্ত গতি বা উদ্বেলিত হওয়ার কিছু নেই। সড়ক-মহাসড়কে দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও বুঝতে হবে তার কিছু আর্থিক সুবিধা বা গাফিলতির জন্য অনেক মানুষ ও তাদের পরিবার দুর্ঘটনায় নিহত হয়ে নিঃস্ব হয়ে যেতে পারে। সারা দেশের চালকদের সমন্বিত ডাটাবেজ তৈরি করে, তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা কললে তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতি দূর এবং দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। পাশাপাশি সড়কের নিয়ম কানুন মেনে চলার জন্য চালক ও যাত্রীদের বাধ্য করতে হবে। বাংলাদেশে শতকরা ৭০ ভাগ যাত্রী সড়ক পরিবহনে যাতায়াত করে। সড়ক পরিবহনে এত যাত্রী খুব কম দেশেই দেখা যায়। দুর্ঘটনা কমিয়ে আনতে সড়ক পরিবহনের উপর থেকে চাপ কমাতে হবে। এজন্য রেল ও নৌপথকে আধুনিক ও গতিশীল করার উদ্যোগ নিতে হবে। রেলকে যাত্রীদের কাছে নিরাপদ, আরামদায়ক ও জনপ্রিয় করে তুলতে হবে। নৌপথেও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত লঞ্চ ও জাহাজের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং আইনের কার্যকর প্রয়োগ সবসময়ের জন্য নিশ্চিত করতে হবে। রেল ও নৌ এই দুই যাত্রী পরিবহণ উন্নত করলে সড়ক পথে মর্মান্তিক দুর্ঘটনাও অনেকাংশে হ্রাস পাবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।