Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

হজ পরবর্তী জীবনচিত্র

মো. আমিনুর রহমান | প্রকাশের সময় : ১৮ আগস্ট, ২০১৯, ১২:০২ এএম

হজ্জ ইসলামের মৌলিক স্তম্ভ। শারীরিক ও আর্থিক ইবাদাত। হজ্জের মাধ্যমে ব্যক্তি আল্লাহর কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পন ও আল্লাহর প্রতিনিধি হওয়ার উপযোগী বৈশিষ্ট লাভ করতে পারে। হজ্জের আনুষ্ঠানিকতা ব্যক্তির মধ্যে তীব্র দায়িত্বানুভ‚তির সৃষ্টি করে এবং ঈমানকে বলিষ্ঠ করে। ফলে তিনি হজ্জ পূর্ব অবস্থার চেয়ে মুমিন হিসাবে অনেক বেশী কার্যক্রম চালাতে পারেন। সাধারণভাবে মনে করা হয়, দুনিয়ার ঝামেলা মুক্ত হয়ে হজ্জে যাওয়া দরকার। ফলে অনেকে বৃদ্ধ বয়সে হজ্জে যান। হজ্জ থেকে এসে জগৎ সংসারে সময় দিতে চান না। কেউ কেউ দুনিয়া বিমুখ হন। অনেকে হজ্জ থেকে ফিরে এসে হালাল-হারাম বাছ বিচার না করে পূর্বের মত চলতে থাকেন। হজ্জ প্রস্তুতির পূর্বে হজ্জ পথযাত্রী অবশ্যই রাফাছ-অশ্লীলতা, ফুসুক-পাপাচার, এবং জিদাল-ঝগড়া-বিবাদ হতে পবিত্র থেকে তাকওয়া অর্জনের অনুশীলন করবেন (সূত্র-সুরা আল বাকারাহ, আয়াত নং ১৯৭)। তাকওয়াকে পাথেয় করে রওনা হবেন। হজ্জে মাবরুর (কবুল হজ্জ) এর জন্য যেমন তাকওয়ার প্রস্তুতি দরকার, তেমনি সফল হাজীর হজ্জ পরবর্তী জীবন কার্যক্রম সর্বাত্মকভাবে ইসলামের অনুসারী হতে হবে। হাজী তকমা নিয়ে কোরআন সুন্নাহ বিরোধী কর্মকান্ডে তৎপর হওয়ার কোন সুযোগ নেই (সূত্র: সূরা আল বাকারাহ আয়াত নং ২০৩-২০৬)। আমরা হজ্জব্রত পালনের অন্যতম শ্লোগান লাব্বায়েক ধ্বনি নিয়ে একটু ভেবে নিই। ‘হাজীর হে আল্লাহ, তোমার দুয়ারে হাজির, (এ ঘোষনা দিতে) যে, তোমার কোন শরীক নেই, নিশ্চিতভাবে সর্ব প্রশংসা তোমার, সর্ব নেয়ামত তোমার হতে, সার্বভৌমত্ব একান্তভাবে তোমারই, এবং সর্ব শেরেকি ও অপবিত্রতা হতে তুমি বিমুক্ত।’ এভাবে আবেগ জড়িত কন্ঠে হজ্জ ব্রত পালনকারী শেরেকী, কুফুরী স¤পূর্ণরূপে পরিহার করে একান্তভাবে কুরআন সুন্নাহর জীবনে ফিরে আসে (তওবা করে) এবং আল্লাহর যে কোন ডাকে সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে সদা প্রস্তুত থাকার দৃঢ প্রত্যয় ঘোষণা দেয়।

হজ্জের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, আরাফাতে অবস্থান, তাওয়াফে জিয়ারতসহ বাস্তব নিদর্শন ও রাসুল (সা.) এর স্মৃতি বিজড়িত পূতপবিত্র স্থানসমূহ প্রত্যক্ষ করার ফলে হাজীদের চিন্তা চেতনা, চরিত্র ও কর্ম এবং জীবন বৈশিষ্টে ইতিবাচক পরিবর্তন হতে বাধ্য। শয়তানকে কংকর মারার মাধ্যমে তার মধ্যে তাবৎ শয়তানী শক্তি দূর হয়। মশহুর হাদীসের ভাষায় ‘হজ্জ শেষে মানুষ নি®পাপ শিশু হয়ে ফিরে আসেন’। নিজেকে সিবগাতাল্লাহ-আল্লাহর রঙে রঙিন করে নেন। আল্লাহর পরম স্নেহশীল বান্দায় পরিণত হন, যা মত্যুকাল পর্যন্ত কখনো মুছে যায় না।

সাফা-মারওয়ায় সাঈ তার মনে দৃঢ় আশা ও মহান আল্লহর রহমত এর শ্বাসত প্রত্যাশা বৃদ্ধি করে সাঈ স্মরন করিয়ে দেয় আল্লাহর সাহায্য পেতে হলে প্রচুর চেষ্টা মেহনতের প্রয়োজন হয়। নিশ্চিন্তে বসে না থেকে ছুটাছুটি করলে আল্লাহর অনুগ্রহ পাওয়া যায়। সূরা আল বাকারাহ ১৫৮ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চই সাফা-মারওয়া আল্লাহর নিদর্শন সমুহের অর্ন্তভূক্ত। অতএব, যে ব্যক্তি এই গৃহে হজ্জ করে কিংবা ওমরাহ করে তার জন্য এতুদোভয়ের প্রদক্ষিণ করা দূষণীয় নয়। আর যে ব্যক্তি স্বেচ্ছায় কোন ভাল কাজ করে আল্লাহ তার উপযুক্ত মূল্য দান করেন এবং তিনি সবকিছু জানেন।’

উক্ত ২:১৫৮ আয়াতের আগে ও পরের আয়াতসমূহে হজ্জ ও ওমরাহর কোন সংশ্লিষ্টতা নেই কিন্তু এ আয়াতসমূহ কেন এখানে সন্নিবেসিত করা হলো? ২:১৫৮ আয়াতের সাথে সংশ্লিষ্টতা খুঁজতে হলে সুরা আল বাকারার ১৫১-১৬৩ আয়াতগুলো বুঝা দরকার। যার মধ্যে সাঈর তাৎপর্য ও মুসলিম উম্মাহর দায়িত্ব ও কর্তব্য বুঝা যায়। উক্ত আয়াত সমুহের সারমর্ম হচ্ছে, রাসুল(সা.) প্রথমত: মানুষের কাছে আল্লাহর আয়াত পড়ে শুনাবেন। দ্বিতীয়ত: তাদের (জীবনকে) পরিশুদ্ধ করে দেবে এবং তৃতীয়ত: তিনি আল্লাহর কিতাব ও (তার অন্তর্নিহিত) জ্ঞান শিক্ষা দেবেন। সর্বোপরি, তিনি এমন সব বিষয় সমূহের জ্ঞান দান করবেন যা মানুষ আগে জানত না (২:১৫১)। রাসুল (সা.) এর অবর্তমানে উপরোক্ত তিনটি কাজ মুসলিম উম্মাহর প্রত্যেক সদস্যের আবশ্যিক কর্তব্য। আর যারা আল্লাহকে স্মরন করবে, আল্লাহ ও তাদের স্মরনে রাখবেন । আর আল্লাহর হুকুম অমান্য করা যাবে না (২:১৫২)। আল্লাহকে এ প্রক্রিয়ায় স্মরণ রাখতে হলে তাঁকে অবশ্যই তাগুতি-ইসলাম বিরোধী শক্তির কঠিন মোকাবেলায় দাঁড়াতে হবে। কারণ কোরআনী কাজে শয়তানী শক্তি নি¯পৃহ থাকবে না। শয়তানের সর্বগ্রাসী আক্রমণের মোকাবেলার জন্য ইমানদারদের (পরম) ধৈর্য্য ও (খালেস) নামাজের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রর্থনা করতে হবে, কারণ আল্লাহ ধৈর্যশীল মানুষের সাথে থাকেন (২:১৫৩)। ইসলামের এ কার্যক্রম করতে গিয়ে বাতিল শক্তির মোকাবেলায় চূড়ান্তভাবে কিছু মুমিনকে জীবন বিসর্জন দিতে হতে পারে (২:১৫৪)। আল্লাহর রাস্তায় কার্যক্রমরত থাকা বাকীদের পরীক্ষ করা হবে ভয়-ভীতি, ক্ষুধা-অনাহার (কখনও) জান-মাল ও ফসলাদির ক্ষতি সাধন করে (২:২৫৫)। আর সত্যিকার মুমিনগন বিপদ-মুসিবতে আপতিত হলেও কোন পরওয়া করে না বরং তারা বলবে, আমরাতো আল্লাহরই জন্য আর নিশ্চিতভাবে আমরা তাঁর দিকে ফিরে যাব (২:১৫৬)। আর এই পরীক্ষায় যারা টিকে থাকবে সেই অটল বিশ্বাসীরা আল্লাহর সমগ্র অনুগ্রহ, রহমত ও হেদায়েত প্রাপ্ত (২:১৫৭)। এভাবে মহান আল্লাহর পক্ষ থেকে তাদের ঈমানী পরীক্ষা পাশের অপূর্ব সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়েছে। অতপর ২:১৫৮ নং আয়াতে সাফা-মারওয়া সাঈ কে জীবন্ত নিদর্শন বলা হয়েছে। হযরত ইব্রাহীম (আ.) এর জন্য কঠিনতম পরীক্ষা, শিশু পুত্র ইসমাঈল আর মা হাজেরার শুষ্ক মরু প্রান্তরে ক্ষুধার জ্বালা, প্রাণনাশের আশংকা নিয়ে কি পরীক্ষাই না দিতে হয়েছে। সাফা-মারওয়ার সাঈ প্রতিটি হাজী ও প্রতিটি ওমরাহকারীকে আজও ২:১৫১-১৫৭ আয়াতে বর্ণিত কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে ও তাগুতি শক্তির মোকাবেলায় অগ্নিপরীক্ষায় টিকে থাকতে নির্দেশ দেয় এবং সাফল্যের সুসংবাদ প্রাপ্তিতে উৎসাহিত করে।

সাঈর নির্দেশ সংক্রান্ত ২:১৫৮ আয়াত এর পরবর্তী ২:১৫৯-১৬৩ আয়াতগুলোর সারসংক্ষেপ হচ্ছে, যারা আল্লাহর সু¯পষ্ট পথ নির্দেশ গোপন করবে তাদের উপর আল্লাহর অভিস¤পাত, ফেরেশতাদের অভিস¤পাত এবং মানুষের অভিস¤পাত ! তারা চিরন্তনভাবে অভিশপ্ত জীবনে থাকবে, যার শাস্তি কখনো কম করা হবে না। কিন্তু যারা তওবা করে ২:১৫১-১৫২ আয়াতে বর্ণিত কার্যক্রমে ফিরে আসবে ও নিজেকে সংশোধন করে সত্যকে সুস্পষ্টভাবে অন্যের নিকট তুলে ধরবে তাদের তওবা কবুল করা হবে। আর আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ বিধান দাতা নেই। যারা তার হুকুম মেনে চলে মহান আল্লাহ তাদের জন্য রাহমানুর রাহীম। সম্মানিত হাজীগন উক্ত আয়াত সমূহ থেকে হজ্জ পরবর্তী জীবন চিত্র কি হবে তা অবশ্যই নির্ধারন করতে সক্ষম হবেন ইনশাআল্লাহ।

হজ্জ হচ্ছে মুসলিম উম্মাহর সর্ব বৃহৎ প্রতিনিধি সম্মেলন। যে কোন সম্মেলন থেকে সংশ্লিষ্ট সংস্থার কর্মীরা উৎসাহিত হয়, তাদের করণীয় সাথে করে নিয়ে আসে এবং সে অনুযায়ী কার্যক্রম চালায়। ফলে হজ্জ থেকে ফিরে দুনিয়া বিমুখ হওয়া, পাপ কাজ করা, হজ্জের শিক্ষার পরিপন্থী। হজ্জ পরবর্তী জীবনে মৌলিক ইবাদত-বন্দেগী আরো মজবুতীর সাথে পালন করা দরকার। হজ্জের জন্য হালাল সম্পদ বাঞ্চনীয়। অন্যথায় হজ্জ কবুল হয় না। রাসুল (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ পূতঃপবিত্র। তিনি পবিত্র সম্পদ ব্যতিত অন্য কিছু কবুল করেননা। অতএব হজ্জ পরবর্তীতে হারাম উপার্জন থেকে পবিত্র থেকে হালাল উপার্জন জরুরী। হজ্জের পর মুসলিম সমাজে পর¯পরের মধ্যে ঐক্য তৈরী ও ভ্রাতৃত্বের স¤পর্ক তৈরীতে কাজ করা আবশ্যক। মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ, বিভ্রান্তি অনৈক্যের কারণগুলো হজ্জের নিদর্শনের পরিপন্থী।

লেখক: এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট, আইবিবিএল



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হজ

২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

আরও
আরও পড়ুন