পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ইসলামের পঞ্চ স্তম্ভের মধ্যে অন্যতম হল হজ্জ। ‘হজ্জ’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হল সংকল্প করা, কোনো স্থানে যাওয়ার ইচ্ছে করা, গমণ করা, চক্রাকারে প্রদক্ষিণ করা, প্রতিজ্ঞা করা ইত্যাদি। আর ইসলামী শরিয়তের পরিভাষায় মহান আল্লাহ্ জাল্লা শানুহূর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে কুরআন ও হাদীসের নিয়মানুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট পন্থায় কা’বা শরীফ এবং তার আশেপাশের নির্দিষ্ট স্থানসমূহে অবস্থান, তাওয়াফ ও যিয়ারত করাকে হজ্জ বলা হয়। আবার কোনো কোনো উলামায়ে কিরামের মতে, জিলহজ্জ মাসের ৯ তারিখে ইহ্রাম বেঁধে আরাফাতের ময়দানে অবস্থানসহ কয়েকটি নির্দিষ্ট স্থানে নির্ধারিত কয়েকটি আমল যথাযথভাবে আদায় করে কা’বাগৃহ তাওয়াফ করাকে হজ্জ বলে।
পবিত্র কুরআনুল কারীমে উল্লিখিত হয়েছে যে, পৃথিবীতে আল্লাহ্ তায়ালার ইবাদতের জন্য নির্মিত প্রথম ইমারত (স্থাপনা) হচ্ছে মক্কাস্থ পবিত্র কা’বাগৃহ যা ‘বায়তুল্লাহ্’ বা আল্লাহর ঘর নামে অভিহিত। আল্লাহ্ তায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আ.)কে আদেশ দেন, ‘আমার গৃহকে পবিত্র রেখো তাদের জন্য, যারা তাওয়াফ করে এবং যারা সালাত-এ দাঁড়ায়, রুকু করে ও সিজদা আদায় করে। আর মানুষের নিকট হজ্জের ঘোষণা করে দাও, তারা তোমার নিকট আসবে পদব্রজে ও সর্বপ্রকার দ্রæতগামী উটের পিঠে আরোহণ করে, তারা আসবে দূর-দূরান্তের পথ অতিক্রম করে।’ (আল কুরআন, ২২: ২৬-২৭)। এই আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে হযরত ইব্রাহিম (আ.) সর্বপ্রথম কা’বাকে কেন্দ্র করে হজ্জের প্রবর্তন করেন। তার আহবানে লোকেরা মক্কায় হজ্জ সম্পাদন করার জন্য আসতে থাকে। তিনি ও পুত্র হযরত ইসমাঈল (আ.) কা’বা ঘর পুণনির্মাণ করেন। তখন থেকে প্রতি বছর বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজীগণ কা’বা শরীফে হজ্জ নিমিত্ত সমবেত হতে থাকে।
হজ্জ মূলত: কায়িক ও আর্থিক উভয়ের সমন্বিত একটি ইবাদত। তাই উভয় দিক থেকে সামর্থবান মুসলিমের উপর হজ্জ পালন করা ফরয। অর্থাৎ হজ্জ আদায়ে সক্ষম এমন শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি নিত্যপ্রয়োজনীয় খরচাদি ও আসবাবপত্রের অতিরিক্ত হজ্জে যাওয়া-আসার ব্যয় এবং হজ্জ আদায়কালীন সাংসারিক ব্যয় নির্বাহে সক্ষম এমন সামর্থবান ব্যক্তির উপর হজ্জ আদায় করা ফরয। হজ্জ প্রত্যেক মুসলমানের উপর সারা জীবনে একবারই ফরয হয়। একবার ফরয হজ্জ আদায়ের পর পরবর্তী হজ্জগুলো নফল হিসেবে গণ্য হবে। এ সম্পর্কে হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, একদিন নবী (স.) আমাদের উদ্দেশ্যে কথা বলছিলেন। তিনি বললেন, হে মানবসকল! আল্লাহ্ পাক তোমাদের মধ্যে যারা সামর্থবান তাদের উপর হজ্জ ফরয করেছেন; সুতরাং তোমরা হজ্জ পালন করো। এমতাবস্থায় এক ব্যক্তি আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! আমাদের কি প্রতি বছর হজ্জ পালন করতে হবে? তিনি চুপ রইলেন এবং পরবর্তীতে লোকটি এভাবে তিনবার জিজ্ঞেস করল। অত:পর রাসূল (স.) বললেন, আমি যদি হ্যাঁ বলতাম, তাহলে তো প্রতি বছর হজ্জ করা ফরয হয়ে যেতো, কিন্তু তোমাদের পক্ষে তা করা সম্ভব হতো না। (সহীহ্ মুসলিম:১৩৩৭)
হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রা.) হতে অনুরূপ হাদীসে আরো বলা হয়েছে, হজ্জ (ফরয) হল একবার, এরপরে যে অতিরিক্ত আদায় করবে তা নফল হিসেবে গণ্য হবে। (মুসনাদে আহমদ: ২৩০৪)
হজ্জ যেহেতু একবারই ফরয তাই যার উপর হজ্জ ফরয হয়েছে সে যদি মৃত্যুর আগে যে কোনো বছর হজ্জ আদায় করে, তবে তার ফরয আদায় হয়ে যাবে। কিন্তু হজ্জ বিধানের মৌলিক তাৎপর্য, তার যথার্থ দাবি ও মূল হুকুম হচ্ছে হজ্জ ফরয হওয়ার সাথে সাথে আদায় করা, বিনা ওজরে বিলম্ব না করা। কারণ বিনা ওজরে বিলম্ব করাও গুণাহের কাজ। আল্লাহ্ পাক ও তার রাসূল(স.) ফরয হজ্জ আদায়ের প্রতি এমনভাবে গুরুত্বারোপ করেছেন যে, কেউ যদি এই হজ্জকে অস্বীকার করে বা এ বিষয়ে কোনো ধরণের অবহেলা প্রদর্শন করে তবে সে আল্লাহর জিম্মা থেকে মুক্ত ও হতভাগ্যরূপে বিবেচিত হবে। আল্লাহ্ পাক সূরা আলে ইমরানের ৯৭ নং আয়াতে ইরশাদ করেন, ‘মানুষের মধ্যে যারা সেখানে (বায়তুল্লাহ্) পৌঁছার সামর্থ্য রাখে তাদের এ গৃহের হজ্জ পালন করা ফরয। আর কেউ যদি অস্বীকার করে তাহলে তোমাদের জেনে রাখা উচিত যে, আল্লাহ্ তায়ালা সৃষ্টিজগতের প্রতি মুখাপেক্ষী নন।’
তাছাড়া যে কোনো ধরণের বিপদ-আপদ, অসুখ-বিসুখের সম্মুখীন হওয়া বা মৃত্যুর ডাক এসে যাওয়া তো অস্বাভাবিক কিছু নয়। তাই হজ্জ ফরয হওয়ার পর বিলম্ব করলে পরে সামর্থ্য হারিয়ে ফেললে বা মৃত্যুবরণ করলে আল্লাহ্ তায়ালার নিকট অপরাধী হিসেবেই তাকে হাজির করা হবে। এজন্যই হাদীস শরীফে হজ্জ ফরয হওয়া মাত্র আদায় করার তাগিদ ও হুকুম প্রদান করা হয়েছে।
হযরত ইবনে আব্বাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূল (স.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি হজ্জ করার ইচ্ছে করে, সে যেন তাড়াতাড়ি তা আদায় করে নেয়। কারণ যে কোনো সময় সে অসুস্থ হয়ে যেতে পারে বা বাহনের ব্যবস্থাও না থাকতে পারে অথবা অন্য কোনো সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে। (সুনানে ইবনে মাজাহ্ : ২৮৮৩)। অন্য এক হাদীসে ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, নবী করীম (স.) ইরশাদ করেছেন, ফরয হজ্জ আদায়ের ব্যাপারে তোমরা মোটেও বিলম্ব করো না। কারণ তোমাদের কারো জানা নেই তোমাদের পরবর্তী জীবনে কী ঘটবে। (মুসনাদে আহমদ: ২৮৬৭)
শুধু তাই নয়, এক সময় বায়তুল্লাহ্ উঠিয়ে নেয়া হলে মানুষ হজ্জ করতে পারবে না এই আশঙ্কার কারণেও আল্লাহর রাসূল উম্মতকে তাড়াতাড়ি হজ্জ আদায় করার হুকুম প্রদান করেছেন। হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূল (স.) বলেছেন, তোমরা হজ্জ ও উমরার মাধ্যমে এই (বায়তুল্লাহ্) গৃহের উপকার গ্রহণ কর। কেননা তা ইতোপূর্বে দু’বার ধ্বংস হয়েছে। তৃতীয়বারের পর উঠিয়ে নেওয়া হবে। (সহীহ্ ইবনে খুযাইমা:২৫০৬)
হজ্জ আদায় করার শক্তি-সামর্থ্য ও অর্থ-বিত্ত থাকার পরও যে ব্যক্তি হজ্জ আদায় করে না তার সম্পর্কে হাদীস শরীফে কঠোর হুমকি প্রদান করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা.) বলেন, যে ব্যক্তি হজ্জ করার সামর্থ্য রাখে, তবুও হজ্জ আদায় করে না সে ইহুদী হয়ে মৃত্যুবরণ করলো কি খৃস্টান হয়ে তার কোনো পরোয়া আল্লাহর নেই। তিনি আরো বলেন, আমার ইচ্ছে হয় কিছু লোককে বিভিন্ন শহরাঞ্চল ও লোকালয়ে পাঠিয়ে দিই, তারা সেখানে দেখবে, কারা সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও হজ্জ পালন করছে না। তারা তাদের উপর কর আরোপ করবে। তারা মুসলমান নয়, তারা মুসলমান নয়।
হজ্জ মুসলমানদের জন্য ফরয ইবাদত যা পূর্বেই বলা হয়েছে। ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী নারী-পুরুষ নির্বিশেষে প্রত্যেক মুসলমানের জন্য জীবনে অন্তত একবার হজ্জ পালন করা অবশ্য কর্তব্য, যদি তার পক্ষে সম্ভব হয়। হজ্জ পালনের শর্ত হলো: প্রাপ্ত বয়স, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, ব্যক্তি স্বাধীনতা, আর্থিক স্বচ্ছলতা, পথের নিরাপত্তা এবং ফিরে আসা পর্যন্ত পরিবারের সদস্যবৃন্দের ভরণ-পোষণের নিশ্চয়তা। মহিলাদের ক্ষেত্রে স্বামী অথবা মুহ্রিম বা অবিবাহযোগ্য কোনো আত্মীয়কে সহযাত্রী করা আবশ্যক।
জীবদ্দশায় হজ্জ করতে পারেনি এমন ব্যক্তি বদলি হজ্জের ওয়াসিয়াত করতে পারে। সে মারা গেলে তার সম্পত্তি থেকে কাফন-দাফনের খরচ ও তার ঋণ থাকলে তা পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে তার এক-তৃতীয়াংশ দ্বারা হজ্জের ব্যয় নির্বাহ সম্ভব হলে ওয়ারিশ্দের ওপর তার পক্ষে হজ্জ পালন করা ওয়াজিব হয়।
প্রকাশ থাকে যে, পবিত্র কা’বাগৃহে সর্বপ্রথম হজ্জ আদায় করেন ইসলামের প্রথম নবী প্রথম মানব হযরত আদম (আ.); তারপর হযরত নূহ(আ.)সহ ইসলামের অন্যান্য নবী-রাসূল এ দায়িত্ব পালন করেন। হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর সময় থেকে হজ্জ ফরয বা আবশ্যকীয় ইবাদত হিসেবে নির্ধারিত করা হয়। হজ্জের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান হযরত ইব্রাহিম (আ.) এর জীবনের সাথে সম্পর্কিত। যেমন: হযরত ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহ্ পাকের নির্দেশে তার স্ত্রী বিবি হাজেরাকে নির্জন মরুভূমিতে রেখে এসেছিলেন। সেখানে, কা’বা শরীফের অদূরে বিবি হাজেরা নবজাত শিশু ইসমাইল (আ.)কে নিয়ে পানির অভাবে পড়েছিলেন। সাহায্যের জন্য কাউকে না পেয়ে তিনি পানির খোঁজে সাফা-র্মাওয়া পাহাড়ের মধ্যে দৌড়াদৌড়ি করেছিলেন। এই ঘটনাকে স্মরণ করেই হজ্জের সময় মুসলিমদের জন্য সাফা-র্মাওয়া পাহাড়ের মধ্যে সায়ী বা হাটঁ-চলার বিধান রয়েছে। এছাড়াও আল্লাহ্ তায়ালা যখন বেহেশ্ত থেকে হযরত আদম (আ.) ও হাওয়া (আ.)কে পৃথিবীতে পাঠিয়ে দেন, এতে তারা পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে উভয়ে আরাফাত ময়দানে এসে মিলিত হন। এই ঘটনার কৃতজ্ঞতাস্বরূপ হজ্জের একটি অংশ হিসেবে মুসলিমরা আরাফাতের ময়দানে এসে উপস্থিত হয়ে মহান আল্লাহ্ পাকের কাছে কান্নাকাটি করে ইবাদতে মনোনিবেশ করেন।
অনুমান করা হয় যে, বাংলাদেশ তথা এই ভারতীয় উপমহাদেশে ১২০৪ সালে মুসলিম বিজয় ও ইসলাম প্রচারের পর থেকেই ধর্মপ্রাণ মু’মীন-মুসুল্লিগণ হজ্জ পালন করে আসছেন। পঞ্চদশ শতকে বিশিষ্ট ওলীয়ে কামেল নূর কুতুবুল আলম বেশ কয়েকবার হজ্জব্রত পালন করেছিলেন। বাগেরহাটের পীর খান জাহান আলীও (রহ.) পবিত্র হজ্জব্রত পালনার্থে মক্কা গমণ করেন। শাহ্ সুজা বার্মার আরাকান হয়ে হজ্জের সময় মক্কা নগরীতে গমণ করবেন এরূপ ইচ্ছে বুকে ধারণ করে সপরিবারে ঢাকা ত্যাগ করেন। হাজী মুহম্মদ মুহসীন ও হাজী শরিয়তুল্লাহ্ মক্কায় হজ্জ পালন করেন। বৃটিশ ও পাকিস্তান আমলে বাংলাদেশের মুসলিমগণ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দিয়ে ভারতের বোম্বে (মুম্বাই) হয়ে জাহাজযোগে হজ্জ পালন করতে মক্কায় যেতেন। বর্তমানে অবশ্য বিমানযোগেই বাংলাদেশের সকল হাজীগণ হজ্জব্রত পালন করছেন।
হজ্জ সম্পর্কে নবী করীম (স.) এর একটি হাদীস বর্ণনা করেই আলোচনার ইতি টানবো। হযরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে হাদীসটি বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূল (স.) কে বলতে শুনেছি, যে ব্যক্তি আল্লাহ্কে সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হজ্জ পালন করল এবং সকল প্রকার অশ্লীল কথাবার্তা ও গুণাহের কাজ থেকে বিরত থাকল, সে ঐ দিনের মতো নিষ্পাপ হয়ে হজ্জ থেকে ফিরে আসবে যেদিন মায়ের গর্ভ থেকে নিষ্পাপ অবস্থায় ভূমিষ্ট হয়েছিল। (সহীহ্ বুখারী: ১৫২১)
লেখক: কবি, গবেষক, ইসলামী চিন্তাবিদ ও বিসিএস(সা. শি) ক্যাডার কর্মকর্তা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।