পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিদায় হজ¦ ছিল রসূলুল্লাহ (সা.) এর মদনী জীবনের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ইসলামের বহু আহকামের ঘোষণা, ইসলামের পরিপূর্ণতা লাভ, শেষ অসিয়ত এবং অন্যান্য অসংখ্য কল্যাণকর বিষয় ইত্যাদি ছাড়াও এ বছর ইসলামের অন্যতম রোকন হজ¦ ফরজ হয়। এটি ছিল তাঁর শেষ হজ¦ এবং হিজরতের পর প্রথম হজ¦। তওহীদে বিশ^াস স্থাপনের পর চারটি প্রধান আরকানের মধ্যে হজ¦ একটি। বাকি তিনটি হচ্ছে নামাজ, রোজা ও যাকাত। হজ¦ জীবনে একবার ফরজ এবং উহার সময় সীমা শাওয়াল, জিলকদ এবং জিলহজে¦র দশ দিন। একে ‘হজে¦র মওসুম’ বলা হয়। কোরআনে যাকে বলা হয়েছে, “আল-হাজ্জু আশকুরুন মা‘লুমাতুন।” অর্থাৎ- “হজ¦ হয় সুবিদিত মাস সমূহে। (সূরা বাকারা: আয়াত- ১৯৭) উমরা পালন করা ‘সুন্নতে মোওয়াক্কাদা’ এবং বছরের যে কোন অংশে তা আদায় করা যায়। ইসলামের পূর্বেও কোরেশ কাফের, এমনকি আরবের কাফেরদের মধ্যেও হজ¦ প্রচলিত ছিল এবং ইসলামের পর রসূলুল্লাহ (সা.) যতদিন মক্কায় ছিলেন হজ¦ করতে নিষেধ করেননি।
আমাদের আলোচনা বিদায় হজ¦কালীন রসূলুল্লাহ (সা.) এর কয়েকটি খোৎবা প্রসঙ্গে। ‘আরাফাত’ ময়দানে দশম হিজরীর ৯ জিলহজ¦ রসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রদত্ত বিখ্যাত ঐতিহাসিক খোৎবা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ, তাৎপর্য মন্ডিত এবং সদূর প্রসারী প্রভাব বিস্তারকারী অদ্বিতীয়। এ খোৎবায় তিনি ইসলামের নীতিমালাকে সুদৃঢ়ভাবে নির্ধারণ করে দিয়েছেন এবং জাহেলী যুগের সকল রীতি প্রথার বিলুপ্তি ঘোষণা করেছেন। এ খোৎবায় তিনি সেই হারামকে হারাম হিসেবে বহাল রাখেন যা সর্ব সম্মতভাবে পূর্বেও হারাম ছিল। তিনি বলেন; “তোমাদের শোনিত, তোমাদের ধন-সম্পদ এবং ইজ্জত-আব্রæ পরস্পরের ওপর হারাম।” এ খোৎবায় তিনি জাহেলিয়াতের সমস্ত কুপ্রথা, কুসংস্কারকে পদদলিত করে দিয়েছেন। অর্থাৎ চিরকালের জন্য বিলুপ্ত ঘোষণা করেছেন। তিনি এ খোৎবায় জাহেলী যুগের সুদ খোরীকে সম্পূর্ণ মুছে দিয়েছেন। এ খোৎবায় তিনি উম্মতকে উপদেশ দিয়েছেন যে, নারীদের সাথে সর্বদা উত্তম আচরণ করবে। অতঃপর ব্যাখ্যা করেছেন, পুরুষদের ওপর নারীদের এবং নারীদের ওপর পুরুষদের ভিন্ন ভিন্ন অধিকার রয়েছে।
রসূলুল্লাহ (সা.) এ খোৎবায় সমগ্র উম্মতকে আরও উপদেশ প্রদান করেন, “কিতাবুল্লাহকে ধারণ করবে” এবং বলেন, “যতক্ষণ না লোক এ কিতাবকে ধারণ করে চলবে, গোমরাহ (পথভ্রষ্ট) হবে না।”
খোৎবা সমাপ্ত হওয়ার পর তিনি লোকদেরকে বললেন, “যখন তোমাদেরকে জিজ্ঞাসা করা হবে এসব হুকুম তোমাদের কাছে পৌঁছেছে নাকি পৌঁছেনি? তখন তোমরা কি সাক্ষ্য দেবে?” সকলেই বলল; “আমরা সাক্ষ্য দেব যে, আপনি আল্লাহর সকল নির্দেশ পৌঁছে দিয়েছেন এবং আপনি সম্পূর্ণরূপে উপদেশ প্রদান করেছেন।” এরপর তিনি আমাদের দিকে আঙ্গুলি সংকেত করে তিন বার বলেন; “হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক, হে আল্লাহ! তুমি সাক্ষী থাক।” অতঃপর তিনি লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন; “যে সব লোক এখানে উপস্থিত তারা এ সকল আহকাম (নির্দেশনাবলী) সে সকল লোকদের নিকট পৌঁছে দেবে যারা অনুপস্থিত।”
দশম জিলহজ¦ কোরবানির দিন। এ দিন কোরবানি করার পূর্বে মসজিদে খাইফের কাছে মিনায় রসূলুল্লাহ (সা.) অবস্থান করেন এবং এ খোৎবায় তিনি বহু জরুরি আহকাম শিক্ষা দেন। তাতে তিনি কোরবানি দিবসের ফজিলত-মাহাত্ম্য বর্ণনা করেন, মক্কার ‘হুরমত’ এর (মর্যাদার) কথা বলেন এবং এই বিষয়ও ব্যক্ত করেন যে, “এ শহর সমস্ত শহরের চেয়ে মর্যাদায় সর্বোত্তম।” এ খোৎবায় তিনি হুকুম দেন যে, “আল্লাহর কিতাব অনুযায়ী যে ব্যক্তি তাদেরকে পরিচালনা করবে, তোমাদের কর্তব্য হবে তার অনুসরণ করা।” তিনি সকলের প্রতি নির্দেশ দেন যে, “মানাসেকে হজ¦’ এর নিয়মাবলী পালনে আমার অনুসরণ করবে এবং সেগুলো আমার কাছ থেকে শিখে নেবে।”
রসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আলী (রা.)-কে লক্ষ্য করে বলেন; “এবারের পর হয়তো আমাদের আর হজ¦ করা হবে না।” অতঃপর তিনি ‘মানাসেকে হজ¦’ শিক্ষা দেন এবং সবার উদ্দেশ্যে বলেন; “আমার পরে তোমরা যেন কাফের না হয়ে যাও এবং পরস্পর একে অপরের গলা না কাট” এবং নির্দেশ দেন যে, “আল্লাহর আহকাম (নির্দশাবলী) ঐ সব লোকের নিকট পৌঁছে দেবে, যাদের নিকট এখনও পৌঁছেনি।” এ দিনও তিনি খোৎবায় বলেন; “যে ব্যক্তি কোন পাপ কর্ম করে, উহার ক্ষতি তাকেই বহন করতে হবে। অতঃপর একই খোৎবায় তিনি বলেন; “তোমরা সকলে নিজের প্রভুর এবাদত কর, তোমরা পাঁচ ওয়াক্তের নামাজ পড়, তোমাদের মাসের (রমজানের) রোজা রাখ এবং তোমাদের মধ্যে ‘ওলিল আমর’ (ক্ষমতা প্রাপ্তের) আনুগত্য কর, তোমরা সবাই তোমাদের রবের জান্নাতে প্রবেশ করবে।”
এ খোৎবার সময় তিনি সকলের কাছ থেকে বিদায় গ্রহণ করেন। এ জন্য এ হজ¦কে সাহাবায়ে কেরাম ‘বিদায় হজ¦’ নামে আখ্যায়িত করেন। এ খোৎবার পরপরই রসূলুল্লাহ (সা.) কোরবান গাহে গমন করেন এবং কোরবানি করেন।
এ খোৎবার সময় রসূলুল্লাহ (সা.) এর একটি মোজেযা প্রকাশ পায়। আব্দুর রহমান ইবনে মোআজ তামিমির বরাতে আবু দাউদ ও নাসায়ীতে বর্ণিত, তিনি বলেন; “এ খোৎবা মিনা এর দূর নিকটের সকল লোক নিজ নিজ অবস্থান হতে সমভাবে শুনছিলেন, এটি শ্রবণ করার জন্য সকলের কান খুলে দেওয়া হয়েছিল।”
তখন তো আধুনিক কালের মত মাইক বা অন্য কোন শ্রবণ যন্ত্র ছিল না, মিনার দূর নিকট সকল স্থান থেকে সমস্বরে হুজুর (সা.) এর খোৎবা শ্রবণের ঘটনা অবশ্যই মোজেযা ছিল।
বোখারী ও মুসলিমে আবু বুকরা (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, কোরবানি দিবসের খোৎবায় রসূলুল্লাহ (সা.) বলেন; “জামানার পট পরিবর্তন হয়ে সেই অবস্থায় এসেছে যে অবস্থায় আল্লাহ উহা সৃষ্টি করেছিলেন। আল্লাহ তাআলা দ্বাদশ মাস সৃষ্টি করেছেন, সেগুলোর মধ্যে চার মাস ‘হুরমত’ বা মর্যাদার মাস। তিনটি লাগাতার অর্থাৎ- জিলকদ, জিলহজ¦ ও শাবানরে মধ্যবর্তীকায়।” অতঃপর রসূলুল্লাহ (সা.) প্রশ্ন করেন, “এটি কোন মাস?” সবাই বলল “আল্লাহ ও তার রসূল জানেন।” তিনি কিছুক্ষণ নীরব থাকার পর বললেন, “এটা কি জিলহজ¦ মাস নয়?” সকলে বলল; “হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল।” এরপর জিজ্ঞাসা করলেন, “এটি কোন শহর? সবাই বলল, “আল্লাহ ও তার রসূল জানেন।” তিনি কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর বললেন; “এটি কি মক্কা শহর নয়?” সবাই বলল; “হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল।” অতঃপর জিজ্ঞাসা করলেন, “এটি কোন দিন?” সবাই বলল, “আল্লাহ ও তার রসূল জানেন।” কিছুক্ষণ থেমে থাকার পর বললেন; “এটি কি কোরবানির দিবস নয়?” সবাই বলল; “হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল।” তিনি বললেন; “তোমাদের শোনিত, তোমাদের সকল ধন সম্পদ এবং তোমাদের আব্রæ-ইজ্জত একে অপরের ওপর হারাম, যেমন হারাম এ দিনের, এ শহরে এবং এ মাসে।” আর বললেন, “অচিরেই এমন সময় আসবে, যখন তোমাদের আমলনামা সম্পর্কে তিনি জিজ্ঞাসা করবেন। খবরদার, সাবধান! আমার পরে গোমরাহ (পথ ভ্রষ্ট) হয়ে যাবে না।” অপর বর্ণানায় আছে, “কাফের হয়ে যাবে না এবং পরস্পর একে অপরের গলা কাটবে না।”
বিদায় হজে¦র সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করার পর রসূলুল্লাহ (সা.) মক্কা হতে মদীনার দিকে যাত্রা করেন এবং ‘গাদীরে খুম’ নামক স্থানে পৌঁছেন। এটি ছিল মক্কা হতে তিন মাইল দূরে ‘জোহফা’ নামক স্থান, যা মক্কা ও মদীনার মধ্যবর্তী স্থানে অবস্থিত। ‘গাদীর’ অর্থ পুকুর। এখানে পৌঁছার পর রসূলুল্লাহ (সা.) একটি খোৎবা প্রদান করেন। এটিকে বলা হয় ‘গাদীরে খুম’ এর খুৎবা।
প্রথমে খোৎবা সম্পর্কে বলে রাখতে হয় যে, রসূলুল্লাহ (সা.) এর পক্ষ হতে হজরত আলী (রা.) বিশেষ উদ্দেশ্যে ইয়েমেনে প্রেরিত হয়েছিলেন। ‘গাদীরে খুম’ এ যখন খোৎবা প্রদান করেন তখন হজরত আলী (রা.)ও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ইয়েমেনে তাকে কেন প্রেরণ করা হয়েছিল এবং সেখানে তিনি কতদিন অবস্থান করেছিলেন ও কী ঘটনা ঘটেছিল সে ব্যাপারে কিছু জানা না গেলেও বিদায় হজ¦কালে রসূলুল্লাহ (সা.) এর সঙ্গে ছিলেন তা স্পষ্ট। কেননা রসূলুল্লাহ (সা.) তাঁর নিজের পক্ষ হতে কোরবানিগুলো জবাই করার পর যেগুলো অবশিষ্ট ছিল সেগুলো রসূলুল্লাহ (সা.) এর নির্দেশে হজরত আলী (রা.) জবাই করেন। এ স্থানে রসূলুল্লাহ (সা) যে খোৎবা দেন তা বিভিন্ন হাদীসে বিভিন্ন ধরনে বর্ণিত হয়েছে এবং কোন কোন বর্ণনায় হজরত আলী (রা.) এর নাম উল্লেখিত হয়েছে।
হঠাৎ করে কেন রসূলুল্লাহ (সা.) আলী (রা.) সম্পর্কে বললেন, “মান কুনতু মাওলাহু‘ ফা আলীয়্যুন মাওলাহু”। অর্থাৎ- “আমি যার মাওলা আলীও তার মাওলা।” রসূলুল্লাহ (সা.) এর এ উক্তি থেকে শুরু হয়েছে এক নতুন বিষয়, নতুন মাছআলা, যাকে বলা যায় আলোড়ন সৃষ্টিকারী মতবাদ তথা ফেতনা। ইসলামী খেলাফতের মূলে কুঠারাঘাতকারী এ ভ্রান্ত মতবাদ সূচনা থেকে প্রতিষ্ঠিত হয়ে আসলেও ইতিহাসে তার গুঞ্জন বিদ্যমান এবং একটি সম্প্রদায়ের মূলমন্ত্র হিসেবে মুসলিম উম্মা বিশেষভাবে ‘আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’ এর বাইরে অবস্থানকারী একটি কথিত মুসলিম সম্প্রদায় নামে পরিচিত। বিষয়টি খোলাসা করে বলতে হলে প্রথমে ‘গাদীরে খুম’ এ প্রদত্ত রসূলুল্লাহ (সা.) এর খোৎবাটি উল্লেখ করতে হয়।
হজরত বারা ইবনে আজেব (রা.) এবং হজরত জাইদ ইবনে আরকাম (রা.) হতে ইমাম আহমদ (রহ.) বর্ণনা করেন, যখন রসূলুল্লাহ (সা.) ‘গাদীরে খুম’ এ পৌঁছেন, তখন হজরত আলী (রা.) এর হাত ধরে বলেন; “তোমরা কি জান না যে, আমি মোমেনদের জন্য তাদের নিজেদের সত্তা হতে উত্তম।” তারা সবাই বলল; “হ্যাঁ”। তিনি বললেন; “তোমাদের কি জানা নেই যে, আমি প্রত্যেক মোমেনদের জন্য তাদের নিজের চেয়ে উত্তম।” সবাই বলল; “হ্যাঁ।” তখন তিনি বললেন; “হে আল্লাহ! আমি যার মাওলা, আলীও তার মাওলা। হে আল্লাহ! যে আলী (রা.)-কে বন্ধু মনে করে, তুমিও তাকে বন্ধু মনে কর। আর যে আলী (রা.) এর সাথে দুশমনি করে, তুমিও তার সাথে দুশমনি কর।” অতঃপর হজরত উমর (রা.) হজরত আলী (রা.) এর সাথে সাক্ষাত করে তাকে ধন্যবাদ জানান।
এ খোৎবাটি তিরমিজিসহ আরও বিভিন্ন হাদীস গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। মওলানা হাকিম আবুল বারাকাত আব্দুর রউফ দানাপুরী সাহেব তার বিখ্যাত ‘আস সিয়ার’ গ্রন্থে এতদসংক্রান্ত হাদীসগুলোর কথা উল্লেখ করে নানা দিক বিশদভাবে আলোচনা পর্যালোচনা করেছেন। এ খোৎবায় রসূলুল্লাহ (সা.) হজরত আলী (রা.) এর ফজিলতের কথা কেন উল্লেখ করেছেন সে প্রসঙ্গে দানাপুরী সাহেব ইবনে হাজার মক্কী এর ‘ছাওয়ায়েকে মোহাররেকা’ এর বরাতে বলেছেন যে, হাফেজ শামসুদ্দীন জাহাবী কর্তৃক ইবনে ইসহাক হতে বর্ণিত; “যে সব লোক হজরত আলী (রা.) এর সঙ্গে ইয়েমেনে গিয়েছিলেন তাদের মধ্যে কেউ কেউ আলী (রা.) এর প্রতি নারাজ ছিলেন এবং সহি বোখারী হতে জানা যায় যে, হজরত বোরায়দা (রা.) এর মনে হজরত আলী (রা.) এর কোন কাজে তাঁর প্রতি হিংসা জন্মে ছিল, যা রসূলুল্লাহ (সা.) প্রত্যাখ্যান করেন। হাফেজ জাহাবী উহার ‘তাছহীহ’ (সংশোধন) করেন যে, হজরত রসূলুল্লাহ (সা.) এর সামনে অভিযোগ করলে তার চেহারা মোবারক বিষণœতা দেখা দেয়। হজরত বোরায়দা (রা.) খোদ বলেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “হে বোরায়দা (রা.) আমি কি মোমেনদের জন্য তাদের নিজের চেয়ে উত্তম নই?” আমি বলল্লাম, “হ্যাঁ, হে আল্লাহর রসূল।” তিনি বললেন, “যার মাওলা আমি, আলী (রা.)ও তার মাওলা।”
মাওলানা দানাপুরী এতদসংক্রান্ত বিষয়গুলো উল্লেখ করে তার বিস্তারিত আলোচনার পর বর্ণনাগুলোকে সহি আখ্যায়িত করে বলেন; “নিঃসন্দেহে এর দ্বারা হজরত আলী (রা.) এর মহা মর্যাদা প্রমাণিত হয়।” তিনি অতঃপর বলেন; “কিন্তু শিয়ারা এ বর্ণনাকে হজরত আলী (রা.) এর খেলাফতের ওপর সর্ববৃহত যুক্তি হিসেবে মনে করেন এবং শায়খাইন (হজরত আবু বকর রা. ও হজরত উমর রা.) এর বিরুদ্ধে যে যুক্তি প্রদর্শন করে থাকেন তা ভিত্তিহীন।” তিনি এ ভিত্তিহীনতার বহু যুক্তি প্রমাণ উপস্থাপন করেন এবং এ ক্ষেত্রে ‘ইমামত’ এর ধারণা সঠিক নয় বলে মন্তব্য করেন এবং বলেন, “মাওলা অর্থ সাহায্যকারী, মাহবুব ইত্যাদি, আমীর বা সুলতান নয়।”
‘গাদীরে খুম’ এর খোৎবা সম্পর্কে হাদীসের আলোকে তাত্তি¡ক আলোচনায় প্রমাণিত হয় যে, রসূলুল্লাহ (সা.) এর ওফাতের পর হজরত আলী (রা.) এর পরিবর্তে হজরত আবু বকর (রা.) এবং হজরত উমর (রা.) কে খলিফা হিসেবে মনোনীত করা ভুল ছিল। মওলনা আব্দুর রউফ দানাপুরী (রহ.) এই ভ্রান্ত মতবাদকে বলিষ্ঠ যুক্তি প্রমাণ দ্বারা খÐন করেছেন।
উল্লেখ্য, রাষ্ট্রীয়ভাবে এ ভ্রান্ত মতবাদকে প্রতিষ্ঠা করার অপচেষ্টা চালিয়ে ছিলেন, আব্বাসীয় খেলাফত আমলে বনি বুওয়াইয়া (বনি বুয়া) সরকারের মোয়েজুদ্দৌলা দায়লমী। পারস্যের শাসনকর্তা মোয়েজুদ্দৌলা বাগদাদের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন এবং সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে খলিফাকে করেন ক্ষমতাহীন এবং ওজিফা ভোগী। ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর খলিফা মতীলিল্লাহ এর আমলে (৩৩৪-৩৬৩ হি.) তিনি শিয়া মতবাদের প্রচার প্রচলন শুরু করে দেন। ৩৫১ সালে তিনি ‘ঈদ’ এ ‘গাদীরে খুম’ উদযাপনের সরকারি ফরমান জারি করেন এবং জোরেশোরে, ধুমধামের সাথে ঢোল বাজিয়ে আনন্দ উল্লাশের নির্দেশ দেন। ৩৫২ হিজরী সালের শুরুতে মোয়েজুদ্দৌলা নির্দেশ জারি করেন যে, ১০ মোহাররম হজরত ইমাম হোসেন (রা.) এর শোক মাতমে সকল দোকান পাঠ বন্ধ রাখতে হবে, বেচাকেনা বন্ধ থাকবে, শহর ও গ্রাম অঞ্চলের সকল মুসলমানকে মাতমী পোশাক পরিহিত অবস্থায় ‘নূহা’ (আহজারী) করতে হবে এবং নারীরা উলঙ্গ মাথায় মুখে কালি মেখে এবং কাপড় ছিড়ে সড়ক ও বাজারে মর্শিয়া পাঠ করবে এবং বুক থাবড়ে বের হবে। ‘গাদীরে খুম’ খোৎবার বিকৃত অর্থ করে যে ভ্রান্ত মতবাদের সৃষ্টি করা হয় তারই কিছু নমুনা উপরে তুলে ধরা হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।