পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হচ্ছে না বললে ভুল হবে। কিন্তু এই উন্নয়নটি একটি সুনির্দিষ্ট খাতে বেশি, যথা ভৌত কাঠামো সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন। বিশেষ করে, সড়কপথের উন্নয়ন, বিমানবন্দরের উন্নয়ন, দু-একটি ভারী শিল্পের উন্নয়ন, সমুদ্রবন্দর সৃষ্টি, নৌবন্দরের সংস্কার, নদীর ওপর সেতু নির্মাণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারখানা নির্মাণ ইত্যাদি। উন্নয়ন প্রসঙ্গে পদ্মা সেতুর নাম না নিলে অন্যায় হবে। কিন্তু ৩৫ বা ৩২ বছর আগে এত নিবিড় প্রচারণার সুযোগ ছিল না। সেই সময় যমুনা নদীর উপরে যমুনা সেতু নির্মিত হয়েছিল কিন্তু এত ঢাকঢোল পেটানো হয়নি। তখন এরশাদ সাহেবের আমল। যমুনার মতো বিশাল নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ও নির্মাণ অভিজ্ঞতার ক্ষেত্রে মাইলফলক ছিল এবং বাংলাদেশের পরিকল্পনাবিদদের জন্য আত্মবিশ্বাস সৃষ্টিতেও মাইলফলক ছিল, যার ওপর ভিত্তি করে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সহজতর হয়েছে। ঈশ্বরদীতে রূপপুর নিউক্লিয়ার প্ল্যান্ট করা হচ্ছে, সুন্দরবন ঘেঁষে রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র করা হচ্ছে; পটুয়াখালীতে পায়রা বন্দর করা হচ্ছে, চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর মোহনায় ভূগর্ভস্থ টানেল সড়ক নির্মিত হচ্ছে। সুতরাং দেশ একদম বসে নেই। এগুলো মেগা প্রকল্প। এরকম আরো মেগা প্রকল্প আছে মানে বিরাট মাত্রার বিনিয়োগ ও বিশাল সময় ধরে কর্মযজ্ঞ; অনেক কেনাকাটা। যেটা বলা হয় না, স্বীকার করা হয় না, সেটা হলো, মেগা প্রকল্পের অন্যতম সহযোগী ‘মেগা দুর্নীতি’।
মেগা দুর্নীতি মানে বড় আকারের দুর্নীতি। কত বড় দুর্নীতি সেটা, মাত্র দুই-তিনটি বাক্য দিয়ে বোঝাতে পারব না। টাকার অঙ্কে সেই দুর্নীতির পরিমাণ কী, সেটি সম্মানিত পাঠকদের হাতের স্মার্ট ফোনের ক্যালকুলেটরে গোনা যাবে না; কারণ, সেই টাকার অঙ্ক ক্যালকুলেটরের সক্ষমতা থেকে অনেক বড়। মেগা প্রকল্পের সাথে দুর্নীতিগুলোতে খুব বড় প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা জড়িত থাকেন; এই দুর্নীতির জন্য খুব সুন্দর সুন্দর ছলনা, বাহানা এবং কৌশলের আশ্রয় নেয়া হয়। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করেন যে, বড় বড় প্রকল্পগুলোতে মূল্যস্ফীতি ঘটানো হয় দুর্নীতির জন্য। দেশের বেশিরভাগ মানুষই বিশ্বাস করেন, যেহেতু বড় বড় ব্যক্তিরা, বড় বড় দায়িত্বশীলরা জেনেশুনে, বুঝেশুনে, চিন্তা-ভাবনা করে, গুছিয়ে-গাছিয়ে, পরিকল্পিতভাবে মেগা দুর্নীতি করে থাকেন, সেহেতু মধ্য বা নিম্নস্তরে মেগা প্রকল্পের সাথে জড়িত ব্যক্তিরা দুর্নীতি করতে উৎসাহিত হন এবং প্রেরণা পান, দুর্নীতির আবহে তারা স্বাচ্ছন্দ্যে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করেন। এ দেশের সব সরকারের আমলেই দুর্নীতি ছিল; শুধু আফসোসের বিষয় হলো, বর্তমান আমলে তথা বিগত দশ বছরে সেই দুর্নীতির প্রবণতা এবং মাত্রা অতীতের সব সীমা ও কল্পণাকে ছাড়িয়ে গেছে।
বাংলাদেশে এ মুহূর্তে এমন কোনো পেশা নেই যেখানে আর্থিক বা নৈতিক দুর্নীতি হচ্ছে না, কম বা বেশি হোক। ‘আর্থিক দুর্নীতি’ বলতে আমরা বুঝি অবৈধভাবে উপার্জন, গোপনীয়ভাবে সেই অবৈধ টাকার সংরক্ষণ এবং সুযোগ বুঝে তার খরচ। আর্থিক দুর্নীতির অন্যতম জ্বলন্ত উদাহরণ, বর্তমান উদাহরণটি হচ্ছে, শেয়ার কেলেঙ্কারি। ঘটনাক্রমে তথা ইংরেজি পরিভাষায় কো-ইনসিডেনটালি, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই এই শেয়ার কেলেঙ্কারিগুলো হতে দেখা যাচ্ছে। ১৯৯৭-৯৮ সালে হয়েছে; ২০১০-১১ সালে হয়েছে এবং ২০১৯ সালেও হচ্ছে। ‘শেয়ার কেলেঙ্কারি’ মানে হলো লাখ লাখ সাধারণ বিনিয়োগকারীকে পথে বসানো; মানে হলো, প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ব্যবহার করে, অদূরদর্শিতা ও অদক্ষতার বাহানা করে, কূটবুদ্ধি ব্যবহার করে কিছু শেয়ারের দরপতন ঘটাতে থাকা; পতনশীল শেয়ারগুলো সঙ্ঘবদ্ধভাবে কম দামে কেনা এবং পরবর্তী সময়ে এগুলোকে উচ্চমূল্যে বিক্রি করা। সফল শেয়ার কেলেঙ্কারির অন্যতম উপাদান হলো কেলেঙ্কারির নায়কদের ক্ষমতাসীন অথবা ক্ষমতার সাখে সম্পর্কিত হতে হবে এবং অবশ্যই বুদ্ধিমান হতে হবে। এই কেলেঙ্কারির কোনো বিচার বাংলাদেশে হয়নি। শেয়ার কেলেঙ্কারির কারণে শোকাহত বা বিক্ষুব্ধ পরিবারের সংখ্যা এক কোটির উপরে। এই এক কোটি পরিবারের সদস্যরা নীরবে চোখের পানি ফেলেন; কিন্তু সুযোগ পেলেই মনে মনে বা প্রকাশ্যে কেলেঙ্কারির মহানায়কদের নাম ধরে, ক্ষমতাসীনদের নাম ধরে গালি এবং বদদোয়া দিতে থাকেন। সম্প্রতি আবার বাংলাদেশের সব পত্রপত্রিকায় শেয়ার কেলেঙ্কারি প্রসঙ্গ শিরোনাম হয়েছে। শুধু একটি শিরোনাম এখানে উদ্ধৃত করছি। তা হলো: ‘একদিনে পাঁচ হাজার কোটি টাকা হাওয়া।’ এই টাকাগুলোর মালিক ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। সুতরাং যাদের টাকা লুটপাট করে ফেলা হলো, তারা কি স্থিরচিত্তে সমাজে বসবাস করছেন, নাকি অস্থিরচিত্তে দিনযাপন করছেন?
আর্থিক দুর্নীতির উল্লেখযোগ্য চারটি কারণ : এক. লোভ-লালসা। দুই. ধনী হওয়ার জন্য অসুস্থ প্রতিযোগিতা। তিন. লেখাপড়ার বা জ্ঞান অর্জনের প্রতি বা জ্ঞানী লোকদের বা শিক্ষিতদের পেশার প্রতি মানুষের মনে অসম্মানের মনোভাব সৃষ্টি এবং টাকাওয়ালাদের প্রতি, বড় বড় গাড়ি-বাড়িওয়ালাদের মতো হওয়ার জন্য মানুষের মনে আকর্ষণ। চার. সরকারি কর্মকর্তারা তাদের বৈধ আয়ের মধ্যে চলতে চেষ্টা না করে, ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের মতোই বেপরোয়া জীবনযাপনের প্রতি আগ্রহী হওয়া; এরূপ জীবনযাপন করতে হলে অবৈধ আর্থিক উপার্জন ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই। এ ধরনের প্রবণতা একদিনে শুরু হয়নি। এ প্রবণতা পাকিস্তান আমলেও কিছুটা ছিল। দুঃখের বিষয়, এ ধরনের প্রবণতা নতুন করে গতি পায় মুক্তিযুদ্ধের পরে স্বাধীন বাংলাদেশে। তবে সব সরকারের আমলেই এ প্রবণতা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির অন্যতম অনুষঙ্গ হলো, আর্থিক ও নৈতিক দুর্নীতি। আমরা পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে ধারণ করেছি কিন্তু সেটার কোনো প্রতিষেধক চিন্তা করিনি। অর্থাৎ আমরা নৈতিকতাকে বর্জন করেছি। এই কাহিনী, এই প্রবণতা, এই রেওয়াজ প্রধানত ১৯৭২ থেকে শুরু। ছোট চারাগাছ থেকে ক্রমান্বয়ে বড় হতে হতে এখন ২০১৯ সালে এসে এটা প্রবাদপ্রতিম বটগাছে পরিণত হয়েছে।
পাঁচ-সাত বছর বা আট-দশ বছর আগে বা তারও আগে টেলিভিশন টকশোতে বা পত্রিকার কলামে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদী সামরিক বাহিনীবিদ্বেষী ব্যক্তিরা প্রায়ই একটি বাক্য বা কথা বা তার মর্ম ব্যবহার করতেন; তাহলো- সামরিক সরকারগুলো বাংলাদেশ শাসন করেছে; তারা বাংলাদেশের সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করেছে এবং তারা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করে দেশটাকে অধঃপতনে নিয়ে গেছে। সম্মানিত পাঠক, আপনাদের গণনার সুবিধার্থে বাংলাদেশের মেয়াদগুলো লিখে দিচ্ছি। অতঃপর আপনারা গুনে নেবেন কোন শাসক বা কোন রাজনৈতিক দল কোন কোন মেয়াদে শাসন করেছেন। এসব শাসনকারী ব্যক্তি বা দল যেমন উন্নয়নের কৃতিত্ব নেবেন তেমনই অধঃপতনগুলোর দায়িত্বও নিতে হবে। (ক) ১৯৭২ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯৭৩ সালের মার্চ : আওয়ামী লীগ : বঙ্গবন্ধুর আমল : প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। (খ) ১৯৭৩ সালের মার্চ থেকে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারি : আওয়ামী লীগ : বঙ্গবন্ধুর আমল : প্রধানমন্ত্রী পদ্ধতির সরকার। (গ) ১৯৭৫ এর জানুয়ারি থেকে ১৯৭৫-এর আগস্ট : বাকশাল : বঙ্গবন্ধুর আমল : প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। (ঘ) ১৯৭৫ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর : আওয়ামী লীগ : মোশতাক আমল : প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। (ঙ) ১৯৭৫-এর নভেম্বর থেকে ১৯৭৭ : দলবিহীন সামরিক আইন শাসন : প্রথমে রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, পরে রাষ্ট্রপতি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান : প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। (চ) ১৯৭৮ সাল থেকে ১৯৮১ সালের মে মাস : বিএনপি : জিয়াউর রহমানের আমল : প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। (ছ) জুন ১৯৮১ থেকে মার্চ ১৯৮২ : বিএনপি : বিচারপতি আবদুস সাত্তারের আমল : প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। (জ) এপ্রিল ১৯৮২ থেকে মধ্য ১৯৮৬ : সামরিক আইন শাসন : এরশাদ আমল : প্রথমে প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আহসান উদ্দিন আহমদ ও পরবর্তীতে জেনারেল এরশাদ : প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। (ঝ) মধ্য ১৯৮৬ থেকে ডিসেম্বর ১৯৯০ জাতীয় পার্টি : এরশাদ আমল : প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির সরকার। (ঞ) ৭ ডিসেম্বর ১৯৯০ থেকে মার্চ ১৯৯১ তত্ত¡াবধায়ক সরকার : বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ: প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি। (ট) মার্চ ১৯৯১ থেকে সেপ্টেম্বর ১৯৯১ বিএনপি আমল : নামকাওয়াস্তে প্রেসিডেন্ট ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন : প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া : প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি : (ঠ) সেপ্টেম্বর ১৯৯১ থেকে মার্চ ১৯৯৬ : বিএনপি আমল : খালেদা জিয়া : প্রধানমন্ত্রী পদ্ধতির সরকার (ড) মার্চ ১৯৯৬ থেকে জুন ১৯৯৬ তত্ত¡াবধায়ক সরকার। (ঢ) জুলাই ১৯৯৬ থেকে জুলাই ২০০১ আওয়ামী লীগ : শেখ হাসিনা : প্রধানমন্ত্রী পদ্ধতির সরকার। (ণ) জুলাই ২০০১ থেকে অক্টোবর ২০০১ তত্ত¡াবধায়ক সরকার। (ত) অক্টোবর ২০০১ থেকে অক্টোবর ২০০৬ বিএনপি : খালেদা জিয়া : প্রধানমন্ত্রী পদ্ধতির সরকার : (থ) ২৭ অক্টোবর ২০০৬ থেকে ১১ জানুয়ারি ২০০৭ তত্ত¡াবধায়ক সরকার। (দ) ১১ জানুয়ারি ২০০৭ থেকে ডিসেম্বর ২০০৮ ওয়ান ইলেভেন তত্ত¡াবধায়ক সরকার : মইনুদ্দিন-ফখরুদ্দীন সরকার। (ণ) জানুয়ারি ২০০৯ থেকে জুলাই ২০১৯ সমান দশ বছর সাত মাস : আওয়ামী লীগ : শেখ হাসিনা : প্রধানমন্ত্রী পদ্ধতির সরকার।
কিছুদিন ধরে কয়েকটি খবর প্রাধান্য পাচ্ছে। এক. দেশে বন্যা পরিস্থিতি অবনতিশীল। দুই. পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে বলে গুজব এবং এর কারণে খুন-খারাবি। তিন. ছেলেধরা গুজব এবং এর কারণে খুন-খারাবি। চার. মহামারী আকারে ডেঙ্গু জ্বর। পাঁচ. প্রিয়া সাহা নামক জনৈক ভদ্রমহিলা কর্তৃক যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র, বাংলাদেশী জাতি এবং বাংলাদেশ সরকারকে হেয় করে উসকানিমূলক ও অসত্য অভিযোগ। ছয়. শেয়ার কেলেঙ্কারিতে হিমালয় পর্বতসমান আর্থিক দুর্নীতি। সাত. লন্ডনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চক্ষু চিকিৎসা।
এখন আমি কয়েক লাইন উপরে উল্লিখিত দু’টি সুনির্দিষ্ট গুজব ও তার প্রসঙ্গে দুটি কথা লিখছি। প্রধান প্রধান পত্রিকাগুলোতে লাল ও কালো কালিতে বড় বড় শিরোনাম হয়েছে। ছয় বছর আগে সাভারের রানা প্লাজা নামক বিল্ডিং বিধ্বস্ত হয়েছিল; তখন বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেছিলেন যে, জামায়াত-শিবিরের লোকেরা রানা প্লাজার গেট এবং খাম্বাগুলো ধরে ঝাঁকুনি দেয়াতে বিল্ডিংটা চূড়ান্তভাবে পড়ে গেছে। অতি স¤প্রতি বাংলাদেশ সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রী বলছেন, সমাজে অস্থিরতা সৃষ্টির জন্য এসব গুজব ও হত্যাকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে এবং বিএনপি-জামায়াত এতে জড়িত। আমি মাঝেমধ্যে হাসি। দেশ চালানোর দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের চিন্তাভাবনা এত ঠুনকো কীভাবে হয়? পদ্মা সেতুতে মানুষের মাথা লাগবে- এই গুজবের সৃষ্টিকর্তা কে বা এই গুজবের উৎপত্তিস্থল কোথায়, কোন দিন, কোন সময়? সেটি আমার পক্ষে নির্ণয় করা সম্ভব নয়; তা সরকারি গোয়েন্দারা করবেন। কিন্তু গুজব যে সৃষ্টি হয়েছিল সেটি বাস্তব। আরো বাস্তব হলো, সরকারের প্রতিক্রিয়া অনেক ধীরগতিতে হয়েছে এবং অনেক কাকতালীয় ঘটনা গুজবের প্রতি সমর্থনের সৃষ্টি হয়েছে। পদ্মা সেতুতে মাথা লাগবে- এই গুজবের সাথে গণপিটুনি দিয়ে মানুষ মেরে ফেলার সম্পর্ক আছে। কতজন কোন জায়গায় কোন সময় মারা গেছে, সেই তথ্যগুলো গুরুত্বপূর্ণ হলেও, তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, কেন এই গণপিটুনির বা খুন-খারাবির পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো?
সম্মানিত পাঠক, আসুন, আমরা সবাই মিলে বিবেচনা করি বা মূল্যায়ন করতে চেষ্টা করি, কোনটির কারণে কোনটি হলো। প্রশ্নটির একটি : সমাজে অস্থিরতা বিরাজ করছে বিধায়, সমাজের সদস্যরা, তরুণ ও কিশোরেরা মাদকাসক্ত হচ্ছে, অসামাজিক কাজে ও খুন-খারাবিতে জড়াচ্ছে। প্রশ্নটির ভিন্নরূপ : তরুণ ও কিশোরেরা মাদকাসক্ত হচ্ছে বিধায় অসামাজিক কাজ করছে বিধায় খুন-খারাবিতে জড়াচ্ছে বিধায় সমাজে অস্থিরতা বাড়ছে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর কথাটি লক্ষ করি : আগে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তিনি বলেছেন, বিভিন্ন কারণে মানুষের মধ্যে এক ধরনের ক্ষোভ ও ক্রোধ জন্মেছে; কিন্তু মানুষ তা প্রকাশের কোনো সুযোগ পাচ্ছে না; এমন অবস্থায় তারা আক্রমণ করার মতো কাউকে সামনে পেলেই ঝাঁপিয়ে পড়ছে; এর মধ্য দিয়ে তাদের ক্ষোভ ও ক্রোধ প্রকাশিত হচ্ছে। প্রফেসর চৌধুরী ব্যবহার করেছেন দু’টি শব্দ : ‘বিভিন্ন কারণে’। বিভিন্ন কারণগুলো উল্লেখ করছি। রাজনৈতিক অসততা, দুর্নীতিবাজদের মনোনয়ন দেয়া, লাখ লাখ মিথ্যা মামলা, পুলিশ কর্তৃক রাজনৈতিক কারণে মানুষের হয়রানি, প্রশাসনের সর্ব অঙ্গের নগ্ন দলীয়করণ, অর্থনীতিতে বেপরোয়া লুটপাট, সরকারি সিনিয়র ব্যক্তিদের অনৈতিকতা ও অশালীনতা, দেশের ‘আবহাওয়া’ থেকে রাজনীতিকে উঠিয়ে নেয়া তথা বি-রাজনীতিকরণ, ছাত্ররাজনীতি টিকিয়ে রাখার নামে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় লুটপাটের ও খুন-খারাবির সুযোগ দেয়া এবং সবশেষে, সাধারণ মানুষের ভোট দিতে না পারা তথা গণতান্ত্রিক অধিকার প্রায় সম্পূর্ণ হরণ করা। সাধারণ মানুষের একটি বিরাট অংশ রাজনীতির প্রতি বিতৃষ্ণ এবং তার মধ্যেও ক্ষমতাসীন রাজনীতির প্রতি চরমভাবে বিক্ষুব্ধ। কিন্তু সেই বিতৃষ্ণা ও বিক্ষুব্ধতা প্রকাশের জায়গা মানুষ পাচ্ছে না।
খুব কম রাজনৈতিক কর্মী, পত্রিকার কলাম লেখক। অর্থাৎ কলাম লেখার মানে হচ্ছে তাত্তি¡ক ব্যাপার, চিন্তা প্রকাশের ব্যাপার, অন্যকে চিন্তা করতে উৎসাহিত করার ব্যাপার। অপরপক্ষে রাজনৈতিক কর্মীর কাজ মানুষের সাথে নিবিড়ভাবে মেলামেশা করা, মানুষের সমস্যাগুলো অনুধাবন করা, মানুষকে সাথে নিয়ে ঘরোয়াভাবে অথবা রাজপথে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করা। এই দুইয়ের মধ্যে যোগসূত্র আছে; একটি অপরটির পরিপূরক। কলাম লেখকের পরিচয় ও কর্ম এবং রাজনৈতিক কর্মীর পরিচয় ও কর্ম পরস্পরকে উৎসাহ ও প্রেরণা জোগায়। তাই সারা সপ্তাহ ধরে শুভাকাক্সক্ষীদের কাছ থেকে আবেদন আবদার পেতেই থাকি, যেন তাদের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো নিয়ে কলাম লিখি। যেমন প্রিয়া সাহাকে নিয়ে তথা সংখ্যালঘুদের দেশান্তর নিয়ে লেখার জন্য অনেক অনুরোধ পেয়েছি, কিন্তু তা সম্ভব হলো না। কারণ, সমাজের অস্থিরতা অথবা অস্থির সমাজ, এ ব্যাপারে লিখতেই হবে। ২০১৬ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আমার লেখা একটি কলামের শিরোনাম ছিল ‘তরুণদের অনুভূতি নিয়ে আলোচনা’। সেখানে সমাজের মধ্যে মানুষে মানুষে সহনশীলতা, শ্রদ্ধাবোধ ও শান্তি নিয়ে আলোচনা করেছিলাম। ঢাকা মহানগরের গুলশানে হলি আর্টিজান নামক রেস্টুরেন্টে হামলা এবং মানুষ খুনের ঘটনা ঘটার কয়েক সপ্তাহ পর ওই কলাম লিখেছিলাম। সে সময় ‘জঙ্গিবাদ’ শব্দটি সবদিকে উচ্চারিত হচ্ছিল। এখন উচ্চারিত হচ্ছে সামাজিক অস্থিরতা, খুন-খারাবি, লুটপাট। এরূপ পরিস্থিতিতে সরকারি দল সমস্যাগুলোর জন্য বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করা উট পাখির ন্যায় আচরণের সাথে তুলনীয়।
লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।